খুব মনে পড়ে এবং আহমেদ মুজিব
আহমেদ মুজিব ছিলেন। এত নীরবেও যে থাকা যায়, তারই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার জন্য যেন! দুটি কাব্যগ্রন্থ, একটি মৃত্যুর আগে প্রকাশিত, অন্যটি পরে। পাঠক তো পরের কথা, খুব কম কবিই হয়তো আজকে তার নাম বলতে পারবেন। অথচ বাংলা কবিতায় আশির দশক যাদের হাতে জন্মেছে, ইনি তাদের অগ্রভাগে। কতরকম ফালতু মিথ দিয়ে আমরা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস সাজাচ্ছি, বা সাজতে দিচ্ছি, আহমেদ মুজিবের কবিতা পড়লে এ-কথা অনেকেরই মনে হবে।
খুব মনে পড়ে
সিগারেট আর চা খাওয়ার জন্যই মনে হয় আমার জন্ম।
মান্নাকে খুব মনে পড়ে, পাপলুকে খুব মনে পড়ে,
মাসুদকেও খুব মনে পড়ে।
সিগারেট আর চা খাওয়ার জন্য আমাকেও আমার খুব মনে পড়ে।
দেয়ালে বাড়ন্ত ঝুল আর আমার বুকে কালো পশমের মতো
পৃথিবীর কোণে সবুজ চাপাতার চাষবাস।
অনেকদিন ডামি সিগারেট খেলাম নিজের মতো করে,
অনেকদিন দামি সিগারেট খেলাম অন্যের টাকায়।
শুধু সিগারেট খাওয়ার জন্যেই ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম।
কয়েকদিন পর, জানি না, ওদের মতো এদেরকে খুব মনে পড়বে কিনা আমার।
শুধু সিগারেট খাবো বলে সরোয়ার্দি উদ্যানে ঘুরলাম
শুধু চা খাবো বলে সংসদ ভবনে গেলাম।
আরো অনেক সিগারেট খাবো বলে বন্ধুপত্নীকে সিগারেটে উদ্বুদ্ধ করলাম,
কিন্তু আরো অনেক সিগারেট খাবো বলে নিজপত্নীকে সিগারেটে উদ্বুদ্ধ করলাম না আমি।
শোয়েব শাদাব এবং মহিলা
এই মেডিয়েটেড বিস্মরণের যুগে শোয়েব শাদাবকে কে মনে রাখবে? আশির দশকের কবি, লিখতেন গাণ্ডীব আর অনিন্দ্য নামক লিটলম্যাগে, সিজনাল পাগলামি ছিল, পরে সম্ভবত পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যান। এখনো বেঁচে আছেন কি না জানি না। কবিতার একটা কাজ যদি হয় অর্থ বিপর্যয় ঘটানো (অনেকে বলেন), তাইলে, সিরিয়াস কবিতায় (প্যারোডি বা স্যাটায়ার বাদে) শোয়েব শাদাবের লেখা ‘মহিলা’ ছাড়া এর কোনো ভালো দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়ে না। এখানে বৈপ্লবিক ঘটনা আছে। কবিতায় এমনটা লাখে একটা ঘটে। কাব্যালঙ্কার-অবতারগণ তার স্বাদ নাও পেতে পারেন। শোয়েব শাদাব, আপনাকে সেলাম! এই কবিতারও কোনো বিকল্প পৃথিবীতে নাই।
মহিলা
মা যে এক দূর মহিলা
আমি তাকে দেখেও চিনি না
মনে করো মায়ের ভেতর থেকে
ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে
কিশোরী মায়ের মন
আমি তাকে প্রেমিকা ভাবি
ভাবি, প্রকৃতি
কিংবা মায়ের মনে
তারার রেণুর মতো ঝরে যে নীহার
শ্রাবণের বৃষ্টির রাতে,
আমি তাকে মরণ ভাবি
ভাবি, বিচ্ছেদ।
তা ছাড়া আঁচল পেতে
যখনই সে বসে ভাবে মায়ের কথা
আমি তাকে ভুলেও ভাবি না
মনে করি দূর মহিলা।
ব্রাত্য রাইসু ও হালুমহুলুমভালুমবাসা
তত্ত্বপ্রধান কবিতার একটা বড় সমস্যা হইল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পোয়েট্রি থিওরির কাছে মাইনর হৈয়া থাকে। এমনকি কোনো-একটি কাব্যিক ন্যারেশনে তত্ত্ব ও কাব্য যদি সমান সমানও হয়, একটা মহা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ব্রাত্য রাইসুর এই কবিতাটি আমাকে বহুবছর ধরে ভাবাচ্ছে। আমি আমার জানা কোনো তত্ত্বের কাছে এই কবিতাটিকে ম্লান করতে পারি নাই। অবশ্য আমার তত্ত্বজ্ঞান সীমিত। হয়তো আছে কোনো সুগভীর তত্ত্বচিন্তা কোথাও, যার মারফত এই কবিতাটির উৎস ও গন্তব্য নিয়ে একটি অভিভাবকসুলভ গদ্য লেখা সম্ভব হয়ে উঠবে। কিন্তু আমার সীমিত জ্ঞানে আজো তার দেখা পাই নাই।
হালুমহুলুমভালুমবাসা : লাভ ইন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট
বাঘের সঙ্গে হলো ভালোবাসা শুরু
লাজে মরি ডোরাকাটা, বক্ষ দুরু দুরু!
কে জানে বাঘের মর্জি
আমাকে কি ভালো লাগবে তার?
রাজি কি গরগররাজি
করিলে সংহার —
যদি আমি মরে যাই
বেঁচেবর্তে তরে যাই
এ ভবসংসার —
বাঘের দেখা কি আর পাবো, এ জীবনে?
পাবো না তো!
বাঘেরই সঙ্গে তবু ভাব হবে
এ ঘোর মণ্ডলে
আমি একা একাকিনী
বাঘের বাঘিনী
হবো, আর বসে রবো বাঘেরই কারণে
দূরে দূরে
বাঘ কি তা বুঝতে পারবে?
নাকি ভুল বুঝবে আমাকে? বাঘ
বুঝবে আমাকে?
মাসুদ খান ও সিমেন্ট-আরসিসি
অপরাপর শিল্পমাধ্যম যেখানে স্বীকৃতি, ঋণস্বীকার, আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কারকে অন্যতম নান্দনিক-সামাজিক শর্ত হিসেবে চর্চা করে, বাংলাদেশের সাহিত্যে এর উল্টো এক অরাজক অবস্থা। উপকথার বাংলাদেশের দোযখের মতো, যার কোনো পাহারাদার লাগে না। পরশুরাম আর সজনীকান্ত যেন মহামারি আকারে জন্মাচ্ছে বঙ্গসাহিত্যে। কাউকে কোনোভাবে ম্লান করে দিতে পারাটাই যেন নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়ার একমাত্র শর্ত। ফলে, মাসুদ খানের মতো কবিকেও স্বীকৃতিশূন্য থাকতে হয়। অথচ তিনি বাংলাদেশের একমাত্র জীবিত পোয়েট লরিয়েট! দীর্ঘ এবং সক্রিয় কাব্যজীবন পাওয়ার প্রিভিলেজ আছে তার, নয়তো আরো কেউ কেউ এই পদের কন্টেন্ডার হতে পারতেন। কবিতা জিনিসটা তার ছেলের হাতের মোয়ার মতো, এমন কি বাঙ্গিজাম্পে দাঁড় করিয়ে দিয়েও যদি তার হাতে কাগজকলম ধরিয়ে দেয়া যায়, একখানা অনুপম পয়ার লিখে ফেলবেন (অবশ্য জাম্পখানি কতখানি নিখুঁত হবে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছি না)! কাগজকলমে লেখেন কি না এই ডিজিটাল যুগে তাও জানি না। অপরের সাহিত্যবিচারে অসম্ভব দয়ালু তিনি! কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ নানা কারণে সরব ও নীরব থাকে। প্রথম যেদিন পড়েছিলাম, সেদিন থেকে আজও আমার একই ধারণা, মাসুদ খান ন হন্যতে! মাসুদ খানের বহুবিধ কবিতা পাঠকের প্রিয়। কিন্তু এই কবিতাটি আমি খুঁজছিলাম, কারণ যে কয়টি কবিতা আমার টিন এজে কবিতার ধারণায় গুরুতর ভূমিকম্প ঘটিয়েছিল, এটি তার একটি। আজো সে অগ্নুৎপাত ঘটাতে সমানভাবে সক্ষম বলেই মনে হয়।
সিমেন্ট-আরসিসি
ক্যালসিয়াম, সুনন্দ রাজার পুত্র তুমি, গোবর্ধনগিরিতে ঘর।
ওটা ক্রৌঞ্চ-চ্যানেল — ওই চ্যানেলে বাতাস ও বাসনাবাহিত হয়ে
পাখি আসে। তুমি আসো স্বরচিত লালা বেয়ে,
গড়িয়ে গড়িয়ে, খড় ও ক্যাকটাস পার হয়ে।
কোটিকাল ধরে কত অন্বেষণ! আকর্ষণবশে।
অবশেষে রশ্মিতোয়া নদীর ধারে ভাঙা ঘাটে
দেখা কার্বনার সাথে। পড়শি অম্লজান, পড়শি মৃত্তিকা,
সঙ্গে অগ্নিতাপাঙ্ক আহরণ।
তাহাদের প্রণয়ের রাঙা বটফল ওই ধূসর সিমেন্ট।
লৌহিনী ঘোরে ফেরে সূর্যরেখা ধ’রে
এক ফাঁকে সূর্যাস্ত গঠন করে নেয় গণ্ডদেশে
অতঃপর দেখা হলো সিমেন্ট সিলিকা জল পাথরের সাথে।
সিমেন্ট সিলিকা জল পাথর লৌহিনী
জন্ম-জন্ম ধরে বহুভুজ প্রণয়কল্প প্রভু
গূঢ় বন্ধন, পরস্পরে লীন হয়ে গিয়ে
পুনশ্চ রাঙা বটফল ওই বাকাবিল্লা সিমেন্ট-কংক্রিট।
চিম্বুক পাহাড়ের শানুতলে শতযুগ এইসব নীরব কোলাহল।
কাজল শাহনেওয়াজ ও পশুপালনের দিন
কাজল শাহনেওয়াজের এই কবিতা তুলনারহিত। গোটা আশির দশক খুঁড়েও এ-রকম দশটা কবিতা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। শুধু বাংলাদেশে না, শুধু বাংলাভাষায়ও না, আরো ব্রডার ক্যানভাসেও ভেবে দেখেছি আমি গত এক যুগ।
পশুপালনের দিন
আমার তো ছিলো না পাহাড়ে চড়ার বিদ্যা
তখন আমি নৌকা বাইতে পারতাম
নিজের জন্য একটি খাল খনন করতে করতে
দিন যেত
আমি বৈঠা তুলে মাঝে মাঝে গান গাইতাম
কয়লা দিয়ে ভুতের ছবি এঁকে বশীকরণ চর্চা করতাম
রাতের বেলা পথে নামতাম পরির পাখা কুড়াতে।
একদিন আমি উটের পিঠে চড়তে শিখবো বলে ঠিক করি।
উটের জন্য চাই মরুভূমি যেমন গরুর গাড়ির জন্য হারিকেন।
পড়শির বাড়িতে নাই বাবলার গাছ।
হরিণ পালতে দেখি কেওড়া গাছের প্রয়োজন।
কুমিরের জন্য দরকার চোখের পানি।
তিলে ঘুঘুর জন্য একবিঘা জঙ্গল।
সাপের জন্য তীব্র যৌনফুল।
ঘুঙুরে রোচে না মন তবু বুকভরা ছোট্ট একটা পা খুঁজি
কিছুতেই দেবে না জানি তবু তার আঙ্গুল কখানি খুলে নিতে
রহস্য থেকে নামি, পকেটে রেঞ্চ, হাতে সৌখিন আঙ্গুলদানি।
প্রান্তরের ডাকবাংলায় খুঁজি শিশিরের নিশীথ
হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ি বরফের ডাক, চিলের চিৎকার
কিন্তু কোথায় প্রকৃতির মুখ চেপে ধরার ক্লোরোফর্ম ভেজানো কাপড়
যাতে শে না চেঁচায়?
শক্ত পাকস্থলি কই যাতে পাথরের গিঁট আর ফুলের তীক্ষ্ণ কামড় হজম করতে পারে?
ক্ষুধার চেয়ে গোল, ক্রোধের চেয়েও আন্তরিক
আনন্দের চেয়েও স্বচ্ছ, ভিখারিনীর চেয়েও কপালহারা
কি সে কল্পনা ঘোর গাঢ় জ্যামিতি?
জীবনের কালো উচ্চারণ নিহিত কোন প্রতিতূলনায়?
পাহাড় থেকে যা সহজ উঁচু পাহাড় থেকে তা সহজেই দেখা যায়।
আমি আজো পাহাড়ে চড়িনি
নৌকা বেয়ে বেয়ে
চলে যাই — যেখানে নৌকা নাই সেখানে।
যেখানে আমি নাই সেখানে গিয়ে ঘুরে আসি।
… …
- শেখশাহি, সাংবাদিকতা ও স্বাধীন বাংলা || সুমন রহমান - August 23, 2024
- দেশান্তরী গরিবের কম্যুনিটি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট || সুমন রহমান - July 11, 2024
- পর্বতারোহণ ও জাতীয়তাবাদ || সুমন রহমান - July 7, 2024
COMMENTS