রামকানাইয়ের রাধারমণ

রামকানাইয়ের রাধারমণ

দুইহাজারের চার বা পাঁচ হবে, সেই সময়টায় একটা অ্যালবাম বাজারে এসেছে এন্তার অ্যালবামের ভিড়ে। এবং তখনও ঘরে ঘরে ক্যাসেট কেনা চালু রয়েছে, প্লেয়ার ছিল ঘরে ঘরে ক্যাসেটের, কম্প্যাক্ট ডিস্কের যুগ শুরু হলেও বর্তমানের বিস্তৃতি তখনও দূরবর্তী। ইউটিউব আর সাউন্ডক্লাউড ইত্যাদি ড্রিমেও উঁকি দেয় নাই। ফিতার ক্যাসেটেই মিউজিকের উড়াউড়ি। ঠিক সেই সময়ের গল্প এইটা। অ্যালবামটা প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়েছিল, যেমন তখন অডিয়োরেকর্ডকোম্প্যানি নিঃশব্দেই রিলিজ দিত সংগীতসংকলন আর আমরা সশব্দে যেয়ে খরিদ করিয়া আনতাম স্বীয় ঘরে ঘরে, বর্তমানে বেরোয় সশব্দে কিন্তু কয়জনে কেনে তা সমীক্ষাসাপেক্ষ।

গোটা-বারো গান ছিল প্রোক্ত সংকলনে, যেইটার কাহিনি নিয়া আজকে এই গল্প, সেসবের কোনোটাই লিসেনিং-পীড়াকর ছিল না। তাতে একটা গান ছিল অভাবিত উড়ালের। কণ্ঠসম্পদ আছে অনেকেরই, কিন্তু কণ্ঠশিল্পীদের শুধু কণ্ঠ থাকলেই হয় না, রেন্ডিশনে একটা ফ্লাইট না এলে সেই গান খুব বেশিদিন মনে রাখা যায় না। অ্যালবামের সব-কয়টা গান ছিল উন্নত গায়নমানসম্পন্ন, উল্লেখোদ্যত গানটা এক-কথায় ছিল উড়ালসম্পন্ন। ‘সুরধুনির কিনারায়’ ছিল সম্ভবত সেই অ্যালবামের নাম। শিল্পী রামকানাই দাশ। যে-গানটা গল্পে আসছে অচিরে, একটু পরের প্যারায়, সেইটা অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও রামকানাইকণ্ঠে-অবিচ্ছেদ্য গান। ‘জলে গিয়াছিলাম সই’ সেই গানের শীর্ষ ও সূচনালাইন। স্যংরাইটার এবং অরিজিন্যাল কম্পোজার রাধারমণ দত্ত।

সিলেটে রাধারমণের গান দুই-চাইরটা জানে সকলেই। বিয়াশাদিতে, পারিবারিক সম্মিলনী ফুর্তিফার্তায়, রাধারমণের দুই-চাইরখানা ধামাইল না-হইলেই নয়। ডিস্কো-জকিদিগের দৌরাত্ম্য শুরুর আগে ধামাইলের মার্কেটভ্যালু অত্যন্ত হাই ছিল অনুষ্ঠানাদিতে, বিশেষত শাদিশুদায়, এখন ধামাইল বিটের সঙ্গে হিপহপের হাই কম্পিটিশন। কে কোণঠাসা? ধামাইলই কি? মোস্টলি। তাতে করে হিপহপারদের হাইক্লাস নিশ্চিত হয় না। তাছাড়া আরোপ-করা গানাবাজানার সঙ্গে রক্তদ্রাবী মিউজিকের তো তুলনা করাটাই বাতুলতা। রাধারমণের গান এতদঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ধমনী-শিরায় ইঞ্জেক্টেড, রক্তগ্রন্থির পরতে পরতে প্রবাহিত সুরপুঞ্জ, লোকমানসের আদি ও অকৃত্রিম অনুষঙ্গ ধরে এগোয় এই মহাজনের পদাবলি ও সুরমালা।

গানটার কথা আলাদা করে বলতে চাইছিলাম, ‘জলে গিয়াছিলাম সই’ শীর্ষক গানটা, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি স্মৃতির আবেগসঞ্জাত তাড়নায়। সেই সময়টায়, রামকানাইয়ের অ্যালবামরিলিজের সেই সময়টায়, এই নিবন্ধকারের এক নিকটজনের পত্নীবিয়োগের অমোঘ দুঃখকাণ্ড ঘটে। এবং তখন সেই মাঝবয়সী বিপত্নীক গম্ভীর-মন্দ্র পুরুষ ব্যক্তিটিকে দেখেছি কীভাবে রেওয়াইন্ড করে রিপিটেডলি পুনঃপুনঃ শুনছিলেন রামকানাইয়ের গাওয়া রাধারমণের সেই গান! বিশেষ এই লাইন-দুইটা : “পালিতে পালিসলাম পাখি দুধ-কলা দিয়া / যাইবার কালে বেঈমান পাখি না চাইল ফিরিয়া” … তারপরে সেই নিঃশ্বাসনুয়ানো পঙক্তিনিচয়, শেষের ক্লাইমেক্স লাইনদ্বয়, যেখানে পাওয়া যায় পদকর্তার ভনিতা : “ভাইবে রাধারমণ বলে পাখি রইল কই / আইনা দে মোর প্রাণপাখি পিঞ্জরাতে থুই” … ইত্যাদি।

কিন্তু, বলতে পারেন হয়তো যে, এইটা তো রাধারমণের গান, সকল প্রশংসা কাজেই রাধারমণজির প্রাপ্য, রামকানাইজি এইখানে ক্রেডিট ক্লেইম করতে পারেন না। আদৌ গ্রাহ্য হবার মতো নয় এহেন বক্তব্য। কারণ, গীতবিতানের আড়াই-তিনহাজার গানের জন্য গুরুদেব সম্বোধনে খ্যাত রবীন্দ্রনাথের প্রেইজ্ করলেই কি আর না করলেই কি। কিচ্ছু যায় আসে না তাতে ট্যাগোরের। বরঞ্চ একেকটা ট্যাগোরস্যং একেক কণ্ঠশিল্পীর গলায় যেমতি প্রাণপ্রতিষ্ঠা পায়, প্রেইজ্ প্রাপ্য ওই নির্দিষ্ট কণ্ঠশিল্পীর। এক্ষেত্রেও হয়েছে সেইটাই। রামকানাইয়ের গলায় রাধারমণের এই গান এতটা পার্ফেক্টলি সেট হয়েছে যে এরপর থেকে রামকানাইয়ের আইডি/সিগ্নেচার হয়ে গেছে এইটা। “রামকানাই দাশ? ও আচ্ছা, চিনছি, ওই-যে জলে গিয়াছিলাম সইয়ের শিল্পী না?”

ram kanai

রামকানাইয়ের সম্ভবত ‘সুরধুনির কিনারায়’ ডেব্যু-অ্যালবাম, স্টুডিয়োরেকর্ড হিশেবে, পরে বেশ খানতিনেক বেরিয়েছে আরও। বেতার-টিভি ইত্যাদিতে কিংবা পাব্লিক ফাংশানে গাওয়াটা আমরা আপাতত গুনছি না। অ্যালবাম ছাড়া আমাদের মতো সংস্কৃতিস্পর্শবঞ্চিত শহরকীটেদের জন্য সংগীত শ্রবণের বিকল্প উপায় তেমন অবারিত ছিল না। সাংস্কৃতিক ছিলাম না তত, যতটা সাংস্কৃতিক থাকলে পরে সান্নিধ্য-সাহচর্য পাওয়া যায় শিল্পীর বা স্রষ্টার। যা-হোক, গানটা আরেকবার শুনি বরঞ্চ :

জলে গিয়াছিলাম সই
কালা কাজলের পাখি দেইখা আইলাম কই।।

সোনারও পিঞ্জরা সই গো রুপারও টানগুনি
আবের চান্দুয়া দিয়া পিঞ্জরা ঢাকুনি।।

পালিতে পালিসলাম পাখি দুধ কলা দিয়া
এগো যাইবার কালে বেঈমান পাখি না চাইল ফিরিয়া।।

ভাইবে রাধারমণ বলে পাখি রইল কই
এগো আইনা দে মোর প্রাণপাখি পিঞ্জরাতে থুই।।

 

কিন্তু যদি বলা হয় তিনি ‘বিরাট’ কণ্ঠশিল্পী, নির্ঘাৎ অতিশয়োক্তি করা হয়। কিংবা রামকানাইয়ের কণ্ঠজাদু হয়তো-বা তার নিত্য-সান্নিধ্য-পাওয়া গানানুরাগীরা হাতেনাতে পেয়েছেন হামেশা, অ্যালবামে সে-রকম কোনো ম্যাজিক আমরা পাই নাই। মাটির ঘ্রাণ, জলের টান ইত্যাদি কিছু মুখস্থ তোতাপাখিশংসাবাক্য যদি ধর্তব্যে না রাখি তবে রামকানাইয়ের অবদান তার গানগাওয়ায় নয়। কিংবা তিনি যে নিজে বেশকিছু অনবদ্য কম্পোজিশন করেছেন, কয়েকটা গান লিখেছেন যা আমরা শুনেছি তিন-চারটে, এসবের কিছুতেই একজন সংগীতমজ্জমান সমুজদার রামকানাইয়ের প্রতিভার মূল আখরটা পাওয়া যাবে না। রামকানাইয়ের সংগীতপ্রতিভার প্রকাশ, আমাদের বিবেচনায়, ঘটেছে অন্যত্র। বলছি ক্রমশ।

রামকানাই শিক্ষকতা করেছেন আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে সানন্দ চৈতন্যে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ-নিঃশ্বাসদিন অব্দি তিনি শিক্ষার্থীদের তালিম দিয়েছেন গানের। শিখিয়েছেন বাসগৃহে, শিখিয়েছেন প্রতিষ্ঠানে। যদিও তার কাছে গান্ডা বাঁধি নাই, কিন্তু অগণিত সংগীতশিক্ষার্থীর মধ্যে সংলগ্নজন কতিপয়ের কাছে রামকানাই দাশের তালিমকৌশল নিয়া সশ্রদ্ধ তারিফ শুনেছি। শিক্ষকতায়, শেখানোয়, রামকানাইপ্রতিভা সবচেয়ে বেশি ইম্প্যাক্ট রেখেছে বলিয়া আমাদের বিবেচনা বলছে। ইন ফ্যাক্ট, শিক্ষকতা পেশাটাই এমন, বিশেষত সংগীত-নৃত্য ইত্যাদি ললিতকলার শিক্ষকতা, এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবিশেষের সর্বস্ব নিংড়ে নিতে চায় পেশাজৈবনিক প্রেশার। শিক্ষকতা এমনই এক নেশা যে এর থেকে মুক্তি মেলে না সহসা।

রামকানাইয়ের ডিসাইপ্যল্ বেড়েছে বছর বছর, তার কাছে তালিম নিয়া ছাত্রশিষ্যরা তাদিগের শিল্পীজীবন অভীষ্টের দিকে নিয়ে গিয়েছে ক্রমশ, পরিতাপ এখানেই যে লোকগানের বিত্তসম্পন্ন ভাণ্ডারী রামকানাই দাশ নিজের সংগীতশিল্পী সত্তাটাকে সেভাবে কাজে লাগান নাই। কিংবা লাগিয়েছেন যখন, লোকসমক্ষে যখন গান নিয়া হাজির হয়েছেন, ততদিনে গলায় লেগেছে বয়সের ভাটা। আমরা তার ভাটাকালীন স্বরশৌর্য শুনেছি। কিন্তু বয়সজনিত পরিপক্বতার সৌন্দর্যও সেই ভাটাকণ্ঠে লেপ্টে থেকেছে বৈকি।

শিক্ষকতা ছাড়া রামকানাই দাশ ছোট-বড় বহুবিধ সংগীতাসর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি পরিকল্পনা ও প্রায়োগিক নেতৃত্বের সঙ্গে সবসময় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন দেখেছি। সিলেটে একটা সময় পর্যন্ত অবস্থান করেছি নিয়মিত এবং দেখেছি রামকানাই দাশ উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত, পুরাতনী গান ছাড়াও লোকসংগীতের আসর ইত্যাদি আয়োজনের নেপথ্যে এবং সম্মুখে নেতৃত্ব দিতেছেন।

খুব বেশিদিন হয়নি সিলেট মফস্বলগন্ধী শহর থেকে বিভাগীয় শহর হয়েছে; এর আগে জেলাশাহরিক সংগীতায়োজনের পরিমণ্ডলে মেন্টরের ভূমিকা পালন করেছেন রামকানাই। জীবনের শেষের প্রায় একদশক মোটামুটি স্থিতিশীল একটা সময় কাটিয়েছেন, বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগটাও পেয়েছেন, যথেষ্ট খ্যাতি-প্রতিপত্তিও জুটেছে, রাজধানীতে শিফট করেছেন, নিজের কাজের পরিধি বিস্তৃত করেছেন, এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে বা ছায়ানটে নিজের সংগীতপ্রতিভা কাজে লাগিয়ে দেশের সংগীতে মেধাবী শিক্ষার্থী-শিল্পীদের মেন্টরিং করেছেন।

হ্যাঁ, সেইটাই, মেন্টরিং। লোকায়তিক সংগীতজ্ঞানের সন্দীপিত প্রতিভা রামকানাই জীবনভর যে-কাজটা করে গেছেন, সচ্চিদানন্দ মগ্নচৈতন্যে যে-কাজে মেধা বিনিয়োগ করেছেন নিজের, একশব্দে মেন্টরিং বলিয়া ব্যাপারটারে ম্যে বি ডিফাইন করা যায়।

শ্রদ্ধার্ঘপ্রণেতা : সুবিনয় ইসলাম 

… …

সুবিনয় ইসলাম
Latest posts by সুবিনয় ইসলাম (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you