রানা নাগ — এই নামটি বাংলার সারস্বত কিংবা কাব্যসুধীবৃন্দের কাছে খুব পরিচিত নয়। চর্চা ও সাধনার নিজস্ব পরিধিতে কবিজীবনটাকে তিনি সাজিয়ে রেখেছেন একান্ত আড়ালে। বরং গদ্যলেখক হিসেবে বাংলার বুধমণ্ডলীর নিকট তিনি সমধিক পরিচিত। মহাজাগতিক রহস্য, মানবজীবনের বিচিত্রতা, শরীর ও ঔষধশিল্প বিষয়ক রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্যে তিনি এক নতুন চিন্তাসূত্র স্থাপন করছেন। জগতের আড়ালিত ঘটনা এবং মানবমনের বিচিত্রতাই তাঁর লেখার বিষয়। এইসব চিন্তনচর্চার বাইরে সযত্নে এবং নিভৃতে চর্চা করে যাচ্ছেন কবিতার এক নতুন নন্দন ও আঙ্গিক। ‘ক্ষুদিতা’ নামের এই কাব্যগ্রন্থে বাংলা কবিতার পরম্পরায় তিনি এক নতুন কবিতার ইঙ্গিত ও অভিজ্ঞতা পরিবেশন করেছেন, যে-কবিতার কাঠামো ও নন্দন ঠিক বাংলা কবিতার ধারাবাহী নয়, কিন্তু প্রসঙ্গ ও যাপিত জীবনের মাধুর্যে রূপায়িত হয়েছে বাংলা কবিতার উত্তরাধিকার।
কবিতা কখনোই একদেশদর্শী নয়; ভাবনা ও কাঠামো বিন্যাসে একটা কবিতায় সমাজ ও ভূগোলের পরিসর থাকলেও কবিতায় বাহিত আত্মাটা সব মানুষের, সেই আত্মাটার জন্যই একটা কবিতা চিরমানবের, চিরকালীন আশ্রমে রূপান্তরিত হয়। সনেট কবিতার বীজভূমি কোথায়? কিংবা জাপানিদের হাইকু লেখার কারণ জানার চেয়ে জরুরি হচ্ছে কবিতাটা প্রাণে টোকা দিচ্ছে কি না। নেপথ্যের কারণ জানার চেয়ে কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হচ্ছে, প্রকৃত কবিতায় আত্মা জেগে ওঠে। কবির ভাষার ভেতরে প্রবেশ করতে করতে নিজের বোধটাই জেগে ওঠে, কল্পনা ও কাব্যজাদুর ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে নিজের অভিজ্ঞতাও কথা বলে। শিল্পপাঠে আমরা নিজের আত্মাকেই জাগাতে চাই। ‘ক্ষুদিতা’ নামের কাঠামোবদ্ধ কাব্যগ্রন্থে সংগত ভাষায়, প্রার্থনার সহজ নিঃশ্বাসে রানা নাগ জগতের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ বিষয়গুলোকেই তুলে ধরেছেন।
অনুভবজাত স্বাভাবিক ভাষা ও ছন্দময়তায় কবিতা হচ্ছে একজন কবির জীবন দেখার ‘শত জলঝরনার ধ্বনি’। কবি জগতকে কোনো প্রশ্ন করেন না; কিন্তু সময় ও মানুষকে প্রশ্নের অধিক প্রশ্নময়তায় রেখে যান। ছোট ছোট চিত্রকল্পে পরমের অধিক পরমকে দেখা যায় কবিতায়। ‘ক্ষুদিতা’ নামের কাব্যগ্রন্থে পরদেশি কবিতার পরিসরে এবং সম্পূর্ণ নতুন গাণিতিক কাঠামোবদ্ধ নন্দনের ভেতর দিয়ে বাংলা কবিতায় কবি রানা নাগ এক নতুন কাব্য-অভিজ্ঞান, কাব্যকাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাব্যগ্রন্থের প্রথমে গ্রন্থিত হয়েছে কবির উদ্ভাবিত ‘ফিবোনাক্কি রাশিমালা’ (শব্দটির উচ্চারণ ফিবোনাচ্চিও হয়) নামের সম্পূর্ণ নতুন গাণিতিক কাঠামোবদ্ধ কবিতা। দ্বিতীয় পর্বে সংযুক্ত হয়েছে সেনরু এবং হাইকুর আদলে ৫/৭/৫ অক্ষরের প্রকৃতি ও মানবজীবন বিষয়ক দার্শনিক কবিতা। কবিতার প্রতিটি প্রসঙ্গই খুব ছোট আর খুব সহজ। কিন্তু সেই ছোট আর সহজ জগতের নীরবতায় প্রবেশ করতে পারলে প্রাণ কেঁদে ওঠে। সমাজ-সংসারের চাতুর্যের চোখে নয়; সহজ চোখে দাঁড়ালে যে-কোনো পাঠক এই কবিতার প্রকৃতি ও অর্থময়তায় সহমর্মী হতে পারবেন। কবিতাগুলোতে শব্দমধ্যে নিঃশব্দে কবি আত্মজীবনকেই পরিবহন করেছেন। সময় ও পারিপার্শ্বের ধুলোমাটি ছাড়া কোনো জীবনই পরিপূর্ণ নয়। কবিতার সেই বাণী ও সুর তাই সবার জীবনকেই ঘিরে ধরে। তাই পরদেশি কবিতার নন্দন কিংবা গাণিতিক কাঠামোর চেয়ে বাঙালির যাপিতজীবনের গীতিময়তাই এই কাব্যগ্রন্থের শক্তি ও পরিচয়।
.
দুই
পৃথিবীর সর্বত্রই গণিত আছে। সেই গণিত দিয়েই বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করেন। সেই গাণিতিক কাঠামোর সাথে মিলিয়ে এই কাব্যগ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে একেবারেই নতুন রীতি-কাঠামোর কবিতা। বাংলা কবিতায় এই ধরনের কাঠামোবদ্ধ রূপ একেবারেই নতুন। সংখ্যানুপাতের ধারানুপাতে এই কবিতাগুলোকে কবি ‘ক্ষুদ্র কবিতা’ এই অর্থে ‘ক্ষুদিতা’ বলছেন। চিন্তায়, কল্পনায় ও নান্দনিকতায় রানা নাগই ‘ফিবোনাক্কি কবিতা’ নামের এই কাঠামোবদ্ধ ‘ক্ষুদ্র কবিতা’-র জনক।
জীবদেহ, মহাকাশ কিংবা প্রকৃতির সর্বত্রই আছে গাণিতিক অনুপাত। এই গাণিতিক অনুপাতের মান ১.৬১৮০৩৩৯৮৮। এটাই ‘গোল্ডেন রেশিও বা সোনালি অনুপাত’। ল্যাটিন ভাষায় এর রূপ হচ্ছে — Φ (PHI/ ফাই)। সাধারণভাবে যে-কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন — এই সংখ্যার এত মাহাত্ম্য কিসের? গণিতের এই অনুপাত এবং সংখ্যাতেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টিজগতের রহস্য ও প্রকৃতি। সৃষ্টির গভীরে গাণিতিক দৃষ্টিতে তাকালেই আমরা এর কার্যকারণ খুঁজে পাবো। আমাদের দেহকাঠামোর বিন্যাসে, গোটা জীবজগতে, পদার্থবিজ্ঞানে কিংবা রসায়নে মিলে যাবে এই গাণিতিক অনুপাত। আমাদের সৌরজগতে, গ্যালাক্সিতে, উল্কা, ছায়াপথেও খুঁজে পাবো এই অনুপাত। এই সংখ্যাতত্ত্বের ভেতরেই লুকিয়ে আছে পিরামিড, তাজমহল বা আইফেল টাওয়ারের স্থাপনাসৌন্দর্য। এই সোনালি অনুপাতের কারণেই শত শত ছবির ভিড়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা এত আকর্ষণ করে!
গণিতের একটা সূত্রের সাথে অন্য সূত্রেরও সম্পর্ক থাকে। সোনালি অনুপাতের এই ধারণাকে স্পষ্ট করার জন্য কবি রানা নাগ নিজেই প্রবন্ধ লিখেছেন। কবির লেখা ‘গোল্ডেন রেশিও এবং এর রহস্যময়তা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, —
“এই গোল্ডেন রেশিওর সাথে ফিবোনাক্কি সিরিজের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফিবোনাক্কি সিরিজ হলো এমন একটা সিরিজ যার প্রতিটি সংখ্যা আগের দুই সংখ্যার যোগফল। যেমন : ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪…
“কেন বললাম ফিবোনাক্কি সিরিজের সাথে সোনালি অনুপাতের সম্পর্কের কথা, সেটা এখন বলছি। আমরা যদি ফিবোনাক্কি সিরিজের যেকোনো সংখ্যাকে তার আগের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করি তাহলে সেই সংখ্যাটাই হবে সোনালি অনুপাত। প্রথম দিকের সংখ্যাগুলোর জন্য হিসাব কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলেও যতই ফিবোনাক্কি রাশিমালা ধরে সামনে যাব, তত ক্রমিক সংখ্যাদ্বয়ের অনুপাত সোনালি অনুপাতের দিকে এগিয়ে যাবে।
“লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এই গাণিতিকি পরিসরেই ছবি এঁকেছিলেন এবং ‘The Divine Proportion’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। বাংলায় একে ‘স্বর্গীয় অনুপাত’-ও বলা যায়। ভিঞ্চিই প্রথম মানবদেহে স্বর্গীয় অনুপাতের উপস্থিতি লক্ষ করেন। তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন যে সব বয়সের মানুষেরই দেহের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য : নাভির নিচ থেকে বাকি অংশের দৈর্ঘ্য = ১.৬১৮০… (PHI); আবার কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং হাঁটু থেকে পায়ের আঙুলের মাথা পর্যন্ত দূরত্বের অনুপাতও ১.৬১৮০… (PHI); মানুষের বাহুর (বাইসেপ্স) সাথে সম্পূর্ণ হাতের অনুপাতের মান হলো ১.৬১৮০… (PHI); মানুষের আঙুলের অগ্রভাগ থেকে কনুইয়ের দৈর্ঘ্য এবং কবজি থেকে কনুইয়ের দৈর্ঘ্যের অনুপাত ১.৬১৮০… (PHI); মানুষের মুখমণ্ডলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১.৬১৮০… (PHI); ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ও নাকের প্রন্থের অনুপাত, চোখের ২ প্রান্তের দূরত্ব ও চুল থেকে চোখের মণির দূরত্বও ১.৬১৮০… (PHI)। মুখমণ্ডলের সবকিছুতে, শরীরের গিঁটে গিঁটে, মেরুদণ্ডে, অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবখানেই এই সোনালি অনুপাত খুঁজে পাওয়া যাবে।”
প্রাজ্ঞ অনুসন্ধানীরা গোটা মানবদেহে প্রায় তিন শতাধিক সোনালি অনুপাত খুঁজে পেয়েছেন। মানুষের মুখমণ্ডলেও আছে ত্রিশটির বেশি সোনালি অনুপাত। ভিঞ্চি মানবদেহে বিস্তারিত এই সোনালি অনুপাত আবিষ্কার করে বসে ছিলেন না। গণিতসূত্রের এই কাঠামোকে তিনি প্রয়োগ করছেন বিভিন্ন শিল্পকর্মে। তাঁর বেশিরভাগ শিল্পকর্মেই এই গণিতসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘The last Supper’, ‘Merry Magdalin’, ‘Monalisa’-তে রয়েছে সোনালি অনুপাতের উপস্থিতি। শুধু মানবদেহই নয়, জীবদেহ ও উদ্ভিদকুলেও এই অনুপাত বিদ্যমান। সামুদ্রিক টর্নেডো, হারিকেন, ঘূর্ণিঝড়, ধোঁয়ার কুণ্ডলী সবসময়ই Golden Spiral অনুসরণ করে বৃদ্ধি পায়। এমনকি গ্যালাক্সিগুলোও Golden Spiral অনুসরণ করে বিস্তৃত হয়। প্রকৃতিতে বিরাজিত এই গাণিতিকি ধারণাকেই কবি রানা নাগ বাংলা কবিতায় স্থাপন করেছেন। কাঠামোগত এই বিন্যাস নতুন এবং অভিনব। কবিতার শিরোনামগুলো বর্ণে বর্ণে বিন্যাস্ত। আমার কাছে মনে হয় কবিতাগুলোর কোনো শিরোনামই নেই। একেকটি বর্ণ শীর্ষভাগে রেখে কবি সময় ও জীবনের একেকটি বিষয়কে হাজির করেছেন। সেই হিসেবে প্রতিটি কবিতাই আট পঙক্তিতে (১,১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১) বিন্যাস্ত। প্রতিটি কবিতার চেহারাই Spiral কিংবা কুণ্ডলীপাকানো রূপ ধারণ করেছে। একে আমরা ‘সোনালি ঘূর্ণি’ বলতে পারি। এতে কি আমরা ভারতীয় তান্ত্রিকতার ‘কুলকুণ্ডলিনী’ বা চক্রের আভাস পাচ্ছি না? সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে ফিগারেটিভ কিংবা লেখচিত্রের ভঙ্গিতে কবিতার এই রূপ ও প্রকৃতি বাংলা কবিতায় কেউ উপস্থাপন করেননি। এইদিক থেকে রানা নাগ অনন্য এবং নতুন নন্দনের অভিযাত্রী।
গ
তে
গলা।
গানও
হয় আবার
গলাবাজি গালমন্দ
এসব সবই হয় — এক গলায়।
গলায় গলায় ভাব, সেও সেই গলার কথাতেই হয়।
*
ড
তে
ডাক।
ডাকে না
ডাকপিয়ন,
যেমন ডুমুরডালে
বসে ডাকে না ডাহুক এখানে আর।
ড্যাবডেবে চোখে দেখি ডাকসাইটে সভ্যতা ও তার ডর।
এইসব কবিতার কাঠামোর ভেতর সময় ও পৃথিবীর চিরসত্য রূপটাই উঠে এসেছে। তুচ্ছ, সাধারণ একেকটি শব্দ যেন বাণীর মতো, ধ্যানের মতো শোনায়। প্রথম কবিতাটিতে ‘গ’ বর্ণ দিয়ে শুরু করে কবি বলছেন, ‘গলা’, ‘গান’, ‘গলাবজি’ এবং ‘গালমন্দ’ হয় এক গলায়। শেষে দার্শনিক উচ্চারণের মতো কবিতাটি শেষ হয়েছে, ‘গলায় গলায় ভাব, সেও সেই গলার কথাতেই হয়’। দ্বিতীয় কবিতাটিতে ডাক, ডাকপিয়ন, ডুমুর, ডাহুক, ড্যাবডেবে চোখ, ডাকসাইটে সভ্যতা, ডর — এই শব্দগুলো একটা বীণায়, একটা দার্শনিক সুরে বেজে উঠেছে। শুধু শব্দের চাতুর্য নয়; কবিতার ভেতরের রূপ ও রসকে সম্ভোগ করতে পারলে এর দার্শনিকতাকেও স্পর্শ করা যায়। ছোট পরিসরে একেকটি কবিতায় উঠে এসেছে সময় ও চারপাশের দৃষ্টিপাত; শান্তির সমুদ্রস্বর ও ভাবনার গভীরতা।
চ
তে
চক্র।
চতুর
ভগবানের
চকচকে চোখে চলে
এই চক্রের চল। পৃথ্বী, সূর্য, চাঁদ
সর্বত্রই চাকার চুম্বক, চলবে চরাচরে অবিরাম।
.
*
আ
তে
আমি,
আনন্দ।
আমিত্বে থাকে
যেই সুখানন্দ, সেই
ঈশ্বর মতো। ‘আনাল হক’ টাইপ।
নিজ নিজ আনন্দই স্বর্গ আসলে, অপ্সরারা হলোগ্রাম।
.
*
ক
তে
কাম।
কয়লা
আবার কলা।
কয়লা থেকেই হীরা
পরিবর্তন আসলে এমনই কিছু
যা এক ফিনিক্স। এর সূত্রে স্থবিরতা মানে উল্টো ভ্রমণ।
চ
তে
চক্র। আরম্ভের এই শব্দগুলোই যেন কবিতাটায় একটা আঘাত তৈরি করে; প্রশ্ন ও বিহ্বলতা তৈরি করে। শব্দে শব্দে চেনা যায় প্রতিদিনের লেগে-থাকা সময় ও সমাজ। এ কবিতা আসলে জীবনের বন্দনা, গতির বন্দনা; বেঁচে থাকায় আত্মসমর্পণ। জীবনটা একটা ‘চক্রের চল’। জীবন একটা চাকার চুম্বক। এই চাকার চুম্বক চরাচরে চলবে অবিরাম। জীবনসত্যের এই ধরনের কবিতা স্নায়ু ও আত্মাকে পরিপূর্ণ করে।
শব্দগুলো কখনোই আকস্মিক নয়। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি শব্দই অনিবার্য ও যৌক্তিক। একেকটি কবিতায় রানা নাগ মূলত শব্দানুপ্রাসের খেলা খেলেছেন। শব্দের জীবন্ত পরশে জগতটাও চিত্রকল্প ও ভাবসত্যে উন্মোচিত হয়েছে। ‘আমি’, ‘আনন্দ’ এবং ‘আমিত্ব’ এই শব্দগুলো দিয়ে কবি আমাদেরকে ভেতরের জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। বসন্ত ও যৌবনের চিরসুন্দর আমিত্বকেই তুলে ধরেছেন। ‘কাম’, ‘কয়লা’, ‘কলা’ এই শব্দগুলোর সাথে পরিবর্তনের সম্পর্ক কী! কিন্তু কবিতার শেষান্তে শব্দগুলো আর নিছক একটা শব্দ থাকে না। শব্দগুলো কল্পনার একটা দূর দিগন্ত উন্মোচন করে। কবির অনুভবজাত সহজ শব্দগুলো একটা সত্যকেই হাজির করে। ‘কয়লা থেকেই হীরা / পরিবর্তন আসলে এমনই কিছু যা এক ফিনিক্স। এর সূত্রে স্থবিরতা মানে উল্টো ভ্রমণ।’
নতুন দিনের বাংলা কবিতায় এই রূপ এবং ব্যক্তিত্বের অভিযাত্রায় কেউ আগ্রহ প্রকাশ না-ও করতে পারেন। কিন্তু নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় এমন মানুষকেই আমরা মনে রাখি কিংবা সান্নিধ্যলাভের প্রতীক্ষায় থাকি, যার ব্যক্তিত্ব নির্জন এবং চমক-লাগানো। চিন্তায় ও বিচিত্রতায় যিনি দূরকে নৈকট্যে দেখান। বলার ভঙ্গিতেই এই কবিতাগুলোতে হাজির হয়েছে চিন্তার নতুনত্ব; শুধু এইটুকু নয়, বলার পরিবেশ ও পরিবেশনেও তিনি একটা দিকের উন্মোচন করেছেন। গাণিতিক কাঠামো ধারণ করে এই ধরনের কবিতায় উঠে এসেছে বাংলা কবিতার ভূগোল ও আচারিক সভ্যতা। চিন্তার বহুরৈখিক টানে আমাদের অভিজ্ঞতা ও জীবনযাপন ভিন্ন হলেও বাংলা কবিতার গীতলতার স্বর ও প্রকৃতি নিয়েই রানা নাগ লিখেছেন স্বর্ণালি সংখ্যার ফিগারেটিভ কবিতা।
.
তিন
যে-কোনো মহৎ কাব্যগ্রন্থ আসলে মানবিক ইবাদতখানা। জগতের অন্তর্গত আর্তনাদ, আর্তস্বর এবং আত্মস্বর এত প্রবল যে সবার আত্মাই ভিজে যায়। প্রাণের কান্নার গভীরতা টের পাওয়া যায় শব্দমধ্যে নিঃসত্ত্ব অবাচ্যতায়। প্রকৃতি ও জীবন অভিন্ন হলেও আমাদের স্বার্থের তর্জনীতে পৃথক হয়েছে জীবন-ভাবনার পরিসর। জীবনধর্মের বাইরে যে সমাজ ও সামাজিকধর্ম — এই সামাজিক বোধ ও আচারকেই প্রশ্ন করে রানা নাগের কবিতা। ঠিক প্রশ্ন নয়; বাংলা কবিতার গীতলধর্মে আত্মা ও চৈতন্যকেই স্পর্শ করে।
প্রাণের কান্না
মনে যদি না-ধরে
তুমি মানুষ?
(ক্ষুদিতা-১৩৭)
*
মনের পশু বলি হবে কীভাবে রক্তের স্রোতে?
(ক্ষুদিতা-১৩৮)
*
পাঠার কান্না নিতে পারি না আর, পূজা করি না।
(ক্ষুদিতা-১৩৯)
৫/৭/৫ অক্ষরের তিন পঙক্তির এই কবিতাগুলোতে কী-একটা সত্য ও বিষাদ যে কবি নিংড়ে দিয়েছেন — বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে এই সত্যকে যে-কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন। পাঁঠা বলির যে-দৃশ্য ও আচারিক পরিসর কবি তৈরি করেছেন — এই সত্যে দাঁড়াতে পারাও খুব সহজ নয়। কবি হয়তো পাঁঠার কান্না নিতে পারেন না, কিন্তু পশু বলির এই আয়োজন বন্ধ করবে কে? মনের পশুকে বলি করতে পারলেই পশু বলি বন্ধ হতে পারে! প্রাণের কান্না যদি প্রাণকে স্পর্শ না করে তবে কি নিজেকে মানুষ ভাবা যাবে! তিন পঙক্তির এই কবিতাগুলো আসলে সময় ও মানুষের জিজ্ঞাসা। প্রকৃতি ও মানবজীবনের ছোট ছোট জিজ্ঞাসার একেকটি অনুভবই দার্শনিক প্রত্যয়ে উঠে এসেছে ক্ষুদিতায়।
.
চার
জাপানি কবিতার কাঠামোগত শিষ্টাচার এবং বর্ণময়তাকে ধারণ করেই বিশ্বসাহিত্যে হাইকু কবিতার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক অনুভবের বিচিত্রতায় হাইকু এক ধরনের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা। তিনটি পঙক্তিতে যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ৫ জাপানি অক্ষর (জাপানিরা এই মাত্রাবিন্যাস কিংবা অক্ষর গণনাকে মোরাস বলে) মিলে মোট ১৭ মোরাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রকৃতির একেকটি মুহূর্তকেই ধারণ করা হয়। সময় ও প্রকৃতির মাঝে বিরাজিত একটি ছবি এবং মুহূর্তের অবগাহনকে তুলে ধরার জন্য হাইকু লিখিত হয়। মোরাস ও মাত্রা এক নয়। জাপানি বর্ণমালা পিক্টোগ্রাফিধর্মী। একটা মোরাস কিংবা বর্ণমালায় যে-কোনো দৃশ্য ও ভাবগভীরতা প্রকাশিত হয়। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় ৫/৭/৫ বর্ণমালায় তিনলাইনে হাইকু লেখার সূত্রপাত হয়। ইউরোপীয়রাই ১৭ মোরাসকে ১৭ দল মনে করে হাইকু লেখার সূত্রপাত করেন। তাদের দেখাদেখি বাংলা ভাষায় ১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয়। মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস অনুসারী। ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ সিলেবলের পরিবর্তে আরো বেশি সিলেবলে হাইকু লেখা শুরু হয়েছে। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিগণ স্বীকার করেছেন যে মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। তারা ১৭ দল ও তিন বাক্য বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লিখেছেন।
হাইকু এবং সেনরু ৫/৭/৫ বর্ণমালাতেই লিখিত হয়। প্রকৃতি ও প্রকৃতির অ্যাবস্ট্রাকশনই হাইকুর প্রসঙ্গ ও বিষয়। নির্ধারিত শব্দ প্রয়োগে ভাবের বহুলতায় একেকটি হাইকু হচ্ছে জীবন্ত প্রকৃতি। প্রকৃতির নিরন্তর ফুরিয়ে যাওয়া কিংবা অঙ্কুরিত হওয়ার নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে হাইকুতে। কিন্তু সেনরুতে প্রকাশিত হয় মানবমনের মহিমা। দেশকালব্যাপী বিস্তৃত একেকটা মানুষের মন এবং মনোজগতের রূপময়তাই উচ্চারিত হয় সেনরুতে। কবিতার একটা গঠনকাঠামোয় জাপানিরা প্রকৃতি ও মানুষকে বিভাজিত করে হাইকু এবং সেনরু নামের দুটো ধারা তৈরি করেছেন।
বাংলা ভাষার ভাবসম্পদকে অন্তরে ধারণ করেই বাঙালি কবিরা জাপানি হাইকুতে আত্মীয়তা স্থাপন করেছেন। পারঙ্গমতায় এবং অন্তরঙ্গতায় রানা নাগও বাংলা কবিতার উত্তরাধিকার বহন করছেন। দীনহীন জীবনের যে পরশ, ব্যথা আর হাহাকারের সৎ ও পবিত্র উচ্চারণ নিয়েই হাজির হয়েছেন কবিতায়। কোথাও কোনো জড়তা নেই। কবিতার মুগ্ধ বুননে, যাপিত জীবনের উচ্চারণে উঠে এসেছে ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’।
ত্রি-পঙক্তির বিচিত্রতায় রানা নাগের কবিতায় বাহিত হয়েছে সময় ও সমাজের চিত্রপট অনুসরণ করে, যা স্মৃতি-মননকে স্পর্শ করতে করতে উপলব্ধির পথ খুলে দেয়। প্রতিটি কবিতার গড়ন একই ধাঁচের, কিন্তু বিষয় ও প্রসঙ্গে চিরপরিচিত বাংলা ও বাঙালির যাপিত জীবনটাই স্পষ্ট হয়েছে। প্রকৃতি দেখাতে দেখাতে উঠে এসেছে জীবনের রূপ; জীবনের বহুরৈখিক বিচিত্রতা। এখানেও কবি রানা নাগ একটা নিরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি মনে করেন জীবন ও প্রকৃতি এক এবং অভিন্ন। প্রকৃতির ভেতরেই জীবন; আবার জীবনের ভেতরেই প্রকৃতি। রঙ-ছবি-শব্দ ও অনুভবের প্রাসঙ্গিকতায় জাপানি সেনরু এবং হাইকুকে সুরের একটা ঐকতানে মিলিয়ে ৫/৭/৫ অক্ষরের তিন পঙক্তির ‘ক্ষুদিতা’ লিখেছেন কবি।
পাঁচ
নদীর পথে
বাঁধ দিয়ে শাসন?
ফলটা দেখো।
(ক্ষুদিতা-৭৮)
*
নদীর বাঁকে
কালো জলের পাক
মীনেরা মৃত।
(ক্ষুদিতা-১০)
*
কাকের ঘরে
কোকিলের জন্মটা,
অনন্য কথা।
(ক্ষুদিতা-৮৮)
*
সকল প্রাণ
মালার মতো ঠিক,
এক সুতোতে।
(ক্ষুদিতা-৮৯)
*
বাবুইপাখি
আমার প্রকৃতির
সত্যপ্রোগ্রাম।
(ক্ষুদিতা-৮৭)
এই যে বাবুইপাখি ঠোঁটের আগায় একটা একটা করে খড়-লতা-পাতা দিয়ে তৈরি করে শিল্পসম্ভার — কবি একেই তুলনা করছেন মানবমস্তিষ্ক কিংবা কম্পিউটার প্রোগামের সঙ্গে। এই যে নদীতীরে মানবসভ্যতা, সেই নদীকেই আমরা দূষিত করছি, বাঁধ দিচ্ছি! নদীর এই মৃত্যুতে মীন ও মানুষ কী বাঁচবে! পৃথিবীর জন্মের পর থেকে কত যে দৃশ্য আর ঘটনা — জীবনের এই অনুভবকেই কবি প্রশ্নে, প্রতিপ্রশ্নে খুঁজে এনেছেন তিনপঙক্তির ক্ষুদিতায়। জাপানি কবিতার ফর্মে, কল্পনার চমৎকারিত্বে কবিতাগুলো পুরোপুরি একটা ডিসকোর্স। তিন পঙক্তির কাব্যজগতের প্রাজ্ঞতায় ডুবুরি হতে ভালো লাগে। মনে হয় পঙক্তির ছায়াতলে নিজের জীবনটাকেই দেখা যাচ্ছে।
রানা নাগ স্মরণ ও মূল্যায়ন রচনারাশি
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
- মালজোড়া গানের সনতারা বেগম || সরোজ মোস্তফা - April 13, 2025
- কবিতা নাই, ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রধান গদ্য আছে - March 31, 2025
- ঈদসংখ্যার জিয়নমরণ || সরোজ মোস্তফা - March 30, 2025
COMMENTS