এখন রাজা কুমারীর প্রসঙ্গে আসি। তাঁর র্যাপ নিয়া খানিকটা আলাপ করতে চাইব। জগৎ জুড়ে সচল পপ–হিপহপ বা র্যাপার (rapper) কিং আর কুইনগো মাঝে ভারতীয় ললনাকে দলছুট বলে প্রত্যয় জাগছে। পপ ঘরানার ফিউশনে জেনিফার লোপেজ থেকে বিয়োন্সে, কেটি পেরি, নিকি মিনাজ বা শাকিরা সকলে দেখি নিজের দেহ এক্সপোজ করতে ব্যস্ত থাকেন! যদিও ঘটনা এখানে মাইকেল জ্যাকসনের ধারে ঘেঁষার মতো অতুল কিছু নয়। জ্যাকসনের প্রতিটা মুভমেন্ট মিনিং পয়দার কামে ওস্তাদ ছিল, যা তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখছে। সে হইল জাগ্রত টেক্সট! দেরিদীয় বা রোলাঁ বার্থের পন্থায় থিসিসে পরিণত হওয়ার যোগ্য। সেই তুলনায় পপসুন্দরীগণ হস্তমৈথুনের সুখ বহানোর জন্য কামের বোধ হইলেও বুবস আর বাটোকস-এর নিদারুণ ঝাঁকি তোলা গীত-আয়োজনে কানের জন্য কী থাকল সে-কথা ভেবে মন পেরেশান হয়।
পপকুইন ম্যাডোনা সেদিন অবধি শ্রোতা-দর্শকের চোখ-কানকে বশে রাখতে পারছিল। শাকিরা বা লেডি গাগার শুরুয়াতটা দারুণ ছিল! শাকিরা ততদিন সুইট থাকতে পারছে যতদিন আরব ও লাতিন রক্তে দ্রবীভূত কন্যা প্রেমমাখানো যৌন-উসকানির মিষ্টি-মিষ্টি বুলি দিয়া চপলতায় সহজাত ছিল। লেডি গাগা ততদিন পিওর ছিল যখন এলোমেলো জীবনকে পালিশ করতে কেউ তারে বাধ্য বা প্ররোচিত করে নাই। নিউইয়র্কের অলিগলিতে বিচরণমত্ত বখে-যাওয়া গাগায় খাঁটি জিনিস ছিল। বার্বিডল হইতে এইটা তারে ভীষণ বাধা দিয়াছিল। সুরলয়ে ব্যাঘাত ছাড়াই গানগুলায় ভাল্গার অ্যাপ্রোচ তখন ফেটে বের হইতে পারছে। তার এই অ্যাপ্রোচটা সমাজকে প্রত্যাখ্যান করতে চাইছে এমন নয়, তবে উন্মাদতুল্য বিশেষণের স্মারক করে তুলতে ওস্তাদ ছিল। গাগা এখন বার্বিডল হইতে শিখছেন এবং গানগুলা সে-কারণে মাস্টার্বেশনের অধিক আবেদন জাগাইতে বিফল হয়।
অনেকদিন পর শুনতে গিয়া র্যাপারদের (rapper) অবস্থা করুণ মনে হইল! ফিফটি সেন্টস থেকে শুরু করে কমবেশি সকলের দেখি মাইয়াদের বুবস আর পাছার দিকে নজর। মাইয়াগো পাছায় থাবড় দিয়া খালি বুলি আর গালি ঝাড়ে! সেদিক থেকে রাজা কুমারী ভিন্ন স্বাদ বহাইতে পারছেন। সদ্য গ্র্যামি মনোনয়ন পাইলেও কমেন্ট সেকশনে দেখলাম ‘মোস্ট আন্ডাররেটেড আর্টিস্ট’ হিসেবে তাকে মার্ক করা হইতেছে। আত্মপরিচয়ের চিরচেনা সংকটে নিহিত গীতকে নতুন অঙ্গে হাজির করার বাসনায় তাঁকে কমিটেড মনে হইছে। ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বে সচল চিহ্ন একদেহে ধারণের ছলে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ডমিনেটিং ফোর্স রূপে স্বীকৃতি দানের বার্তা কুমারী তাঁর গানে ফেরত আনছেন। র্যাপ (rap) গানে আফ্রিকার একচ্ছত্র রাজত্বে ভারতীয় কালচারের সুরলয়তালকে জোড়ার চেষ্টা তাই শ্রবণের দাবি রাখে।
র্যাপার (rapper) ধাঁচের অঙ্গবিক্ষেপের সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য জুড়তে পারঙ্গম ললনার গানের কলির তল খুঁজতে গিয়া মনে হইল এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যবিদ্যায় মর্মরিত ‘আমরা’ ও ‘বাদবাকি’-র দ্বন্দ্ব হইতে যে-সংলাপ জন্ম নিতে থাকে সেইটা তাঁকে পীড়া দিয়া যায়। পশ্চিমা লোকজন সামগ্রিকভাবে ভারত সম্পর্কে যে-ধারণা রাখেন অথবা জন্ম দিয়া থাকেন এর প্রতিউত্তর দানের উচ্ছল চেষ্টা কুমারীর গানে ভীষণ প্রখর! ভারতীয় রমণীর জগৎ সম্পর্কে উনারা অহরহ যে-বয়ান রচনা করেন সেখানে তাঁর আপত্তিটা ডিরেক্ট। নারীত্বের শক্তিকে সাঈদ চিহ্নিত পশ্চিমে হাজির করার ক্ষণে কুমারী বৈদিক সংস্কৃতি ও তার শক্তিসাধনার যুগে ফেরত গেছেন। এই সাধনার ইতিহাসে শিবত্বের মৌল অঙ্গে মা কালী অজেয় প্রভায় একত্রে বিরাজেন। অগত্যা ডমিনেটিং স্পিচ কুমারীর সুরেলা কণ্ঠ ও দেহ থেকে অনায়াসে ছলকায় :— ‘We rockin’ sarees in Ferraris, / Mixing that Shiva with that Marley / Don’t ask Kumari where your man-go / We don’t need no guns, guns, guns.’
ভারতের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি নিজ গুণে স্বকীয় হইলেও হালফিল বিশ্ব থেকে উৎসারিত সাংস্কৃতিক উৎসারণের চিহ্নকে নিজ অঙ্গে ধারণ করতে তার বাধে না; — এক্সপোজারটা র্যাপার (rapper) কুমারীর গানের কলিতে সদা উপচায়। মূল বার্তা একটাই, — ‘Don’ disrespect me’। অথবা ‘We grew for you / So stand in the line, stand in the line / Supernatural flow / Feelin’ like I’m Kaali / Mixing Benjamins with them Gandhis / International Kumari / Indian Barbie / But the gang is Gulabi’। এহেন ঘোষণার মধ্যে সেই আর্তি প্রখর যেইটা আবার তাঁর সংগীতপ্রয়াসকে আলোচনার সঙ্গে সন্দেহযোগ্য করে তোলে।
সন্দেহের কারণ, রাজা কুমারীর র্যাপ (rap) নাচাগানা হইতে যে-বার্তা ছলকায় তাকে শিবসেনাদের পক্ষে এ্যানক্যাশ করা ব্যাপার না। পশ্চিমা বয়ানের জগতে নিজের অংশগ্রহণ ও স্বীকৃতি আদায়ে উদগ্রীব র্যাপারকে পার্শিয়াল ভাবার সুযোগ তাই থাকে। হিন্দুত্বের বীজাধার পুরুষ-প্রকৃতির রহসঘন উপস্থাপনার সঙ্গে ভারতীয় শক্তিসাধনায় সংগুপ্ত নারীত্বের বয়ানে চমৎকারা হইলেও সামগ্রিক ভারত-সংস্কৃতির উৎসারণ তাঁর র্যাপ-আয়োজনে এখনো অনুপস্থিত। কন্যা প্রধানত বৈদিক যোগধ্যানে আটাকায় আছেন মনে হয়, যেখানে আবার বেদ-উপনিষদ বা ভারতীয় ধারা থেকে উচ্ছ্রিত সংস্কৃতি ও সংস্কারের অঢেল খনির অল্পই এখন অবধি উঠাইতে পারছেন। বিচিত্র প্রাদেশিক সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলমানরা যথারীতি তাঁর র্যাপবুলির তূণে অচিহ্নিত ও অনুপস্থিত। তাঁকে নিয়া লেখা ফাঁদার ইচ্ছে থাকল, যদি সময় পাই। তো যা-ই হোক, আপনি হয়তো শুনে ফেলছেন, তবু ‘উনকো চুপ করানা থা’ কিংবা ‘Run and tell your mummy / The streets go ra pa pum pum’-এর ধামাকা নিয়া হাজির র্যাপকুইনকে ফিরা শোনার রিকোয়েস্ট থাকল।
আপাতত কথা শেষ। শান্তিমন্ত্র জপ করতে-করতে এইবার বিদায় বলি :— সর্বে ভবন্তু সুখীনাং। সর্বে ভবন্তু নিরাময়া। ওম শান্তি … শান্তি শান্তি শান্তি।
আহমদ মিনহাজ তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS