গানপার, অজস্র প্রত্যাশার… || আহমদ মিনহাজ

গানপার, অজস্র প্রত্যাশার… || আহমদ মিনহাজ

কন্টেন্টের বৈচিত্র্যই  গানপার-র সম্পদ। ওইসব প্রায় তাৎক্ষণিক, অসম্পূর্ণ টেক্সটকে হয়তো-বা দেশের সাহিত্যবোদ্ধা পাঠকরা গোনায় নিতে চাইবেন না, কিন্তু এই যে গানপার  কেবল সংগীত বা সাহিত্যের কাগজ না হয়ে চারপাশে ছড়ানো ঘটনাকে ধরে রাখার সচল চলন্তিকা হয়ে উঠতে চাইছে,…এই চাওয়াটা (আমার কাছে) তার বড়ো কামিয়াবি বলে মানি। সুগভীর বীক্ষণ ও ভাবরসে জারিত অথবা হাড়ভাঙা মেহনতে রচিত যেসব টেক্সট প্রায় নিখুঁত ও সম্পূর্ণ হয়ে উঠার সাধনা করে সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা তা-বলে অস্বীকার করছি না। ছোটকাগজ ও ছাপানো বহি এই ধাঁচের লেখাপত্র ধারণের দারুণ মাধ্যম হতে পারত, কপালদোষে এই কর্মে আমাদের সফলতা আজো ধারাবাহিক নয়।

মাজাঘষা করে তৈরি যেসব লেখা বহি বা ছোটকাগজে গেলে ভালো হয় সেগুলোর জন্য গানপার  সুবিধাজনক প্লাটফর্ম নয়। অনস্ক্রিনে গুরুতর প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ নিয়ে বিরচিত লেখা পাঠে আমাদের পাঠকরা বিশেষ অভ্যস্ত নন বলেই ধারণা করি। তিন/চার/পাঁচ বছরের যাত্রায় গানপার  হয়তো সমস্যটা ধরতে পেরেছে, যারপরনাই আপাত লঘু কিন্তু বীক্ষণের জায়গা থেকে ভাবলে গরিয়ান বিষয় নিয়ে প্রচুর লেখা নেটে তুলছে নিয়মিত। নিখুঁত-হয়ে-ওঠা লেখ্য বস্তুর চেয়ে এই লেখাগুলোর মূল্য তাই বলে একটুও কম নয়। তুল্যমূল্যের এই জায়গাটা পাঠক এখনো সেভাবে নজর না করলেও আগামীতে করবেন বলে বিশ্বাস রাখি, যদি সাইটটাকে ততদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়।

চারপাশের অজস্র তৎপরতাকে গানপার  নিজ অঙ্গে ধারণ করতে উতলা হলেও এখনো বহু পথে বোধ করি হাঁটা বাকি রয়ে গিয়েছে। যেমন, বিচিত্র মেজাজের আড্ডা বা মজলিশি বিষয় নিয়ে লেখা সাইটে কালেভদ্রে ওঠে। মজলিশি ঢংয়ে লেখকরা একসময় জমিয়ে লিখতেন। সৈয়দ মুজতবা আলী তো ওস্তাদ ছিলেন এই কাজে। অন্নদাশঙ্কর রায়, তপন রায়চৌধুরী থেকে শুরু করে দুই বাংলার আরো অনেক লেখক বৈঠকী মেজাজে নিজের সময় ও অভিজ্ঞানের সরস স্মৃতিচারণ করে গিয়েছেন। ধ্রুপদি গানবাজনার সঙ্গে ক্রিকেট খেলাকে জুড়ি বেঁধে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ধ্রুপদ মেজাজের আলাপ আজো মনে অক্ষয় হয়ে আছে। কুদরত রঙ্গি-বিরঙ্গি  একসময় ফিরে-ফিরে পড়েছি। ধ্রুপদি গানবাজনার বিন্দুবিসর্গ কিছু না বুঝলেও লেখকের সরস আলোচনা ও বীক্ষণের সুবাদে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত শোনার আগ্রহ মনে জন্ম নিয়েছিল। বড়ো-বড়ো ওস্তাদদের গানবাজনা শ্রবণ আর তাঁদেরকে ঘিরে চাউর বিচিত্র গল্পগাছা তরতর করে বলে যাচ্ছেন বটে কিন্তু তার মধ্যেই জরুরি সব রেফারেন্স আর নিজের সংগীতভাবনা পাঠককে ধরিয়ে দিতে ভুলছেন না। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের তাহজীব-ই-মৌসিকি কিংবা সুরেশ চক্রবর্তীর সংগীত বিষয়ক কিতাবের পাত্তা কুমারপ্রসাদের মাহফিল  পড়তে গিয়ে পেয়েছিলাম মনে পড়ছে।

শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে সমকালীন বাংলাদেশের বিবিধ ব্যাপার নিয়ে আব্দুশ শাকুরের রম্য ধাঁচের লেখাগুলো (এক সময় বিচিত্রা  সাপ্তাহিকে নিয়মিত পড়েছি মনে পড়ে।) বেশ উপভোগ্য ছিল। এই তো কিছুদিন আগে মাহফিল  আর খেয়াল  নিয়ে কুমারপ্রসাদের বৈঠকী মেজাজের আলাপটা ফের পাঠ করলাম। ফিরে পড়তে গিয়ে একালের গানবাজনার ব্যাপারে অতুল এই সংগীতরসিকের মনোভাব/মন্তব্যের সঙ্গে নিজের মতবিরোধ টের পাচ্ছিলাম ভিতরে! তাঁর মতো গভীর সংগীতজ্ঞান থাকলে তর্কে নামার স্পর্ধা প্রকাশে দ্বিধা করতাম না। ক্ষমতাটি না থাকায় মনোবিরোধকে মনেই চাপা দিতে হলো! যে-রকম, বাংলা আধুনিক গানের বিবর্তন নিয়ে কবীর সুমনের আলাপ আমার মতো সাধারণ শ্রোতার জন্য ষোলআনা উপকারী হলেও মাঝেমধ্যে তর্কের রোখ চাপে মনে। বাংলা গানের প্রবাদপুরুষদের নিয়ে উনার আলাপ শ্রোতাকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলে সন্দেহ নেই, নতুন ভাবনার বীজও সুমন বুনেন সেখানে, সমস্যা হলো সিংহভাগ আলাপে এমন কিছু জায়গা উনি রেখে যান যেখান থেকে একালের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বা জেনারেশন গ্যাপটা হাট করে চোখের সামনে নগ্ন হয়ে পড়ে। নগ্নতার কথাটা তোলার বড়ো বাধা হচ্ছে বিপুল সাংগীতিক অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন, যার ভিতর দিয়ে কবীর সুমন বা কুমারপ্রসাদের মতো গানবাজনা গুলে খাওয়া বোদ্ধারা নিজেকে তৈরি করেছেন। সংগীতের ব্যাপারে আমার মতো অজ্ঞ, আনাড়ি শ্রোতার আপত্তি বা অস্বস্তি সেখানে পানি পাওয়ার নয়। অস্বস্তি তবু মনকে কুঁরে-কুঁরে খায় আর সেটা চেপে গিয়ে উনাদের সরস, বুদ্ধিদীপ্ত মজলিশি বয়ানের স্বাদ চাখি দিনমান।

কবীর সুমনের মতো সংগীতকোষের চোখের আড়ালে বসে নিজের অতি সাধারণ (বোকাটে হয়তো-বা) অনুভব ও আপত্তিটা উগড়ানোর স্পেসটা যদি গানপার-র মতো সাইটগুলো করে দিতে পারে তাহলে আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতার ভাব প্রকাশের একটা হিল্লে হয়।গানবাজনার কতটা কী শ্রোতা বোঝে তার চেয়ে জরুরি হচ্ছে অনুভবের জগতে গানের রসকে কিছু একটায় আকার নিতে সে দেখছে কি-না। শ্রোতার এই দেখতে পাওয়ার কথাগুলো অনায়াস বলার পরিসর দেশে থাকাই উচিত। গানপার  জায়গাটা দখলে নিতে পারলে বিজ্ঞ সংগীতকারদের বাইরে সাধারণ শ্রোতার অনুভূতি, মতামত ও আপত্তি জানানোর একটা উপায় বোধ করি হয়।

ভাবছি, নিখুঁত হয়ে উঠেনি এ-রকম লেখাপত্রই তো দেখছি বুড়ো বয়সে এসে অধিক স্মরণীয় ঠেকছে মনে। কত ভারী কিতাবের ভারী বিষয় বেমালুম ভুল মেরে গেছি কিন্তু লঘু চালের বিষয়গুলো মনে আজো টাটকা লাগে! এ-যেন বিনয় মজুমদারের পাগলা নিদান! উত্তম কবিতার সংজ্ঞা দিতে বসে বিনয়ের মনে হয়েছিল, যে-কবিতা লোকে পাঠের পরে মনে রাখে ও আওড়ে যেতে পারে তাকে উৎকৃষ্ট কবিতা গণ্য করা উচিত। যুবা বয়সে সুনীল-সমরেশ বুদ্ধদেব গুহ কিংবা হাসনাত আবদুল হাইয়ের ভ্রামণিক অভিজ্ঞতা পাঠের সময় মন অতটা নেচে উঠেনি, খানিক কৌতূহল মিটেছিল মাত্র! ওইসব বৃত্তান্তের নানান অনুষঙ্গ মনে টাটকা দেখে অবাক যাই মাঝেমধ্যে। গানপার-এ মঈনুস সুলতানের লেখায় এই গুণ থাকলেও মজলিশি ঢংয়ে জমিয়ে লেখার চল (সময়ের অবিশ্বাস্য জটিল চাপে হয়তো…) উঠে যাচ্ছে ধারণা করি। গানপার  এই দিকটায় নজর দিলে বড়ো ভালো হয়।

সৈয়দ আলী আহসান শুনেছি রান্নাটা ভালো পারতেন। এ-নিয়ে দু-ছত্র লিখেছিলেন বোধ করি। রন্ধনশিল্প (বিশেষভাবে স্ট্রিট ফুড) বিষয়ক কড়চার পুরোটাই এখন ভিডিও ব্লগারদের দখলে চলে গিয়েছে। সাহিত্যের রসে চুবিয়ে লিখছেন তেমনটা আজকাল চোখে পড়ে না। গানপার-এ এ-রকম লেখাপত্র যদি তোলা যায় তবে বেশ হয়। বিল্লি ওরফে বিলাই ওরফে মার্জার মহাশয় নিয়ে আপনার লেখাটি যেমন রসবশে মনকে নাড়া দিয়েছিল সম্প্রতি। যদিও এমন একখান লেখায় ডিজনি কার্টুনের টম-জেরি আর টি. এস এলিয়ট মহাশয়ের বিলাইবীক্ষণটা স্থান করে নিলে আরো জমত বোধহয়। স্মৃতি হাতরে এরকম আরো কিছু নজির তুলে ধরলে রসহানি ঘটত বলে মনে হয় না।

অথবা ধরুন, রশীদ করীমের উপন্যাসে ক্রিকেট খানিক জায়গা করে নিলেও বাংলাদেশের লেখকদের গল্প-নাটক-আখ্যানে খেলার ঘনঘটা একপ্রকার অনুপস্থিত বলা যায়। সমুদয় ব্যাপারে আমরা এতই সিরিয়াস  যে শেষ অবধি সিরিয়াস  মামা স্বয়ং নিজের জাতকুল হারিয়ে শুষ্কং-কাষ্ঠং জবরজং রূপ ধারণ করেন। চারপাশের অজস্র খুঁটিনাটিকে দেখতে পারার মধ্যে যেসব বীজ জন্ম নেয় তারাই মহীরুহ হওয়ার রসদ হয় পরে। চকিত বীক্ষণ থেকে যেসব রচনা গানপার  হরহামেশা ছাপে সেগুলোর অসম্পূর্ণতাকে আমি এই জায়গায় দাঁড়িয়ে পাঠ করতে ভালোবাসি। এগুলো থেকে নতুন লেখার রস ও রসদ (অন্তত আমি) পাই বৈকি। আজ আর কথা না বাড়াই।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you