লেখাপড়া ও মুক্তক্রীড়া || আহমদ মিনহাজ

লেখাপড়া ও মুক্তক্রীড়া || আহমদ মিনহাজ

অনেকদিন-ধরে-ফেলে-রাখা ফার্নান্দো পেসোয়া-র The Book of Disquiet  নামের ঢাউস বইখানার পিডিএফ ভার্শন অবশেষে গেল ক’দিন ধরে পড়া শুরু করেছি। পাঠকে স্রোতের মতো টেনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে বইটি। যদিও আমি অতি ধীরে পড়ছি। কবে শেষ হবে সেটি এখনও নিশ্চিত নই। হয়তো সময় লাগবে অথবা চটজলদি শেষ হয়েও যেতে পারে। এ-মুহূর্তে বলা কঠিন। সেটি এজন্য যে পেসোয়া আক্ষরিক অর্থে মানুষের পৃথিবীতে Lifeless life কাটিয়ে গেছেন এবং তার কারণটি উপলব্ধি করতে না-পারলে এই বই পাঠে কোনও ফায়দা নেই। দ্রুতপঠনে সেটা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা। এ তো একজন মানুষের কনফেশন মাত্র নয়। পেসোয়ার ভাষায় এটি হচ্ছে তাঁর জীবনের ঘটনাবিহীন আত্মজীবনী (Factless Autobiography)। শব্দের টটোলজিটা একবার ভাবুন! একটি লোক দণ্ডেমুণ্ডে মানুষের জীবন কাটাচ্ছে। আমার-আপনার মতো করে খাচ্ছে এবং আরও যা-যা করা উচিত তার সবকিছু কমবেশি করছে। তবু তার কাছে মনে হচ্ছে সে একটি Factless, Lifeless জীবন কাটিয়ে চলেছে। মনুষ্যজীবন হচ্ছে সেই কয়েদখানা যেখানে জীবন বইছে জীবনের নিয়মে, যদিও সেই জীবনের ওপর জীবনধারী মানুষের নিয়ন্ত্রণ সীমিত অথবা অধিক নিয়ন্ত্রণের দোষে সেটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে নিয়ন্ত্রিত ইত্যাদি।

পাতার-পর-পাতায় যে-বিবরণ পেসোয়া এখন অবধি দিয়ে চলেছেন, লিসবন শহরের চৌহদ্দি ও তাকে ঘিরে যেসব ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ইন্টার‌্যাকশন চলছে, যেখানে পেসোয়া তাদের হয়ে অথবা তারা পেসোয়ার হয়ে পরস্পরকে দেগে দিচ্ছে, এবং আত্মবিবৃতির এই অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়ার ফলে বোঝা মুশকিল হয়ে উঠেছে কে কার হয়ে কাকে মানুষ হিসেবে মানুষের ছক থেকে বের করে দিচ্ছে; এসবের পেছনে পেসোয়ার সেই বিবৃতিটি বইয়ের প্রারম্ভে এবং যতখানি এগিয়েছি তার মধ্যে পুনরাবৃত্তির মতো ফিরে-ফিরে আসছে, যেখানে তিনি বলছেন :

In these random impressions, and with no desire to be other than random, I indifferently narrate my factless autobiography, my lifeless history. These are my Confessions, and if in them I say nothing, it’s because I have nothing to say.

এ-রকম একজন মানুষের বয়ান পড়তে গিয়ে প্রথমে তাঁকে রিড করতে হচ্ছে, তারপর নিজেকে তাঁর টটোলজির গহ্বর থেকে উদ্ধার করে নিতে হচ্ছে, সেখান থেকে সিন্থেসিস কী দাঁড়াবে সেটা নিশ্চিত না-হওয়া অবধি বলা যাবে না এই বইয়ের পাঠ শেষ হয়েছে বা এটি নিয়ে এখন কথা বলা যায়। সুতরাং আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে করি বই পাঠের পর তার থেকে বেরিয়ে আসাটাও জরুরি। যেন নিজেকে ফিরে পাওয়া যায়। অন্যথায় বইবিদ্যা কাজে দেয় না।


বড় কথা হলো যাকে পড়ছি তার সেই রচনাগুলো চিনে ওঠা যে-রচনা অপঠিত থেকে গেলে তার ধরতাই বোঝা একপ্রকার অসম্ভব। কেন জানি পাঠের সূচনা থেকে এই বিশ্বাসটি মনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে, একজন লেখক (তা তিনি যে মার্গের অথবা বিষয় নিয়ে লিখুন-না-কেন) তাকে আবিষ্কার এবং নিজের মাপে নির্মাণের জন্য তার সেই রচনার দিকে তাকানো উচিত যেটি তার মনের বনেদ গড়ে দিয়েছে, পরে নানাবিধ ভাঙচুর সত্ত্বেও সেই বনেদের ছিরিছাদ তার অন্য রচনায় ঘুরেফিরে প্রতিসরিত হয়েই চলেছে। যেমন ধরুন, হাইডেগারের কথা উঠলে লোকে তাঁর বিয়িং অ্যান্ড টাইম-কে অবধারিতভাবে নিয়ে আসে। আমার পাঠ-অভিজ্ঞতায় তাঁর এই ম্যাগনাম ওপাস ছিল বিপর্যয়ের নামান্তর। কারণ আমি আগাতে পারছিলাম না। হাইডেগার যে-পদ্ধতির আশ্রয়ে নিটশে ও শোপেনহওয়ারে জন্য জায়গা রেখে প্লেটো থেকে আগে-পিছে সমগ্র পশ্চিমা দর্শনের কাঠোমোকে বাতিল ও পুনর্নির্মাণ করছিলেন, কবুল করছি, তার এই দার্শনিক সন্দর্ভ আমার ধরতে বেগ পোহাতে হচ্ছিল।

এভাবে বিয়িং অ্যান্ড টাইম  বলতে পারেন আমার একপ্রকার পড়েও না-পড়ার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছিল। সেই হাইডেগারকে আমি বাকি জীবনে একবর্ণও পড়ে উঠতে পারতাম না যদি ‘ব্ল্যাক নোটবুক’ আর কন্সার্নিং টেক্নোলোজির খবর আমায় কেউ না দিত। বলতে পারেন হাইডেগারের খবর করার চাবি বলতে ওই দুটি রচনাকে আমি সর্বাগ্রে রাখি। এটা স্বীকার করি যে, তিনি সারাজীবন অজস্র লিখেছেন এবং সেখানে বিয়িং অ্যান্ড টাইম  আলাদা করে উজ্জ্বল। যদিও এ-সম্পর্কে তাঁর নিজের মতটি ছিল দুর্দান্ত : — লোকে আমার কাছে বিয়িং অ্যান্ড টাইম-এর পরের পর্ব সম্পর্কে জানতে চায়। আর আমি অপেক্ষায় আছি ওটা কখন বাতিল করে নতুন পর্ব লিখব তার জন্য। তো এরপর থেকে হাইডেগার আমার কাছে সেই রিডিং মেটেরিয়্যাল যার কোনও-একটি রচনা বা ইন্টারপ্রিটেশন যদি পাই এবং পড়ার আগ্রহ জাগে মনে, এই আত্মবিশ্বাসটি সেখানে সহায় হয়, — আমি বোধহয় তাঁকে ধরতে এবং তারপর নিজের মতো করে গড়তে পারব

কথাটি বলার একটাই উদ্দেশ্য : — আজকের এবং সবকালের পাঠকের জন্য এই কঠিন কাজটি করাই সবচেয়ে কঠিন; সেটি হলো, তিনি কীভাবে পড়ছেন বা পড়ার মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় রচনাটিকে বের করে নিতে পারছেন কি না। অন্যথায় পড়তে গিয়ে অধিক পড়ে ফেলা এবং শেষমেশ কিছুই না-পড়ার ফাঁদে জিম্মি হওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা। বাংলাদেশের অনেকে হয়তো সেই আত্মপ্রতারণার শিকার।


এখন এই এক সুবিধা হয়েছে (অন্তত আমার জন্য), ইন্টার্নেটকে আমি ভীষণ সহায়ক মনে করি। আমার কাছে ‘গ্যুগল’, ‘ইউটিউব’ এমনকি ফেসবুকগ্রুপগুলো শুধু তথ্য বা খবরের ঘাঁটি নয়, আকারান্তরে রিডিং মেটেরিয়্যাল। পড়া মানে তো খালি ছাপার বই নয়। ডিজিটাল ফর্ম্যাটে রচিত পডকাস্ট, অডিও ও ভিডিও সূত্রে পাওয়া বক্তিমা, সাক্ষাৎকার, সেলুলয়েডে চিত্রায়িত জীবনী বা তথ্যচিত্রকে জরুরি পঠনসামগ্রী মনে হয়। আজ এক দশকের বেশি হয়ে গেল আমার পঠনপাঠনের সংগ্রহশালা বলতে ই-বুক, পিডিএফ, পডকাস্ট এবং এ-রকম সোর্সগুলোর আধিক্য বেশি। মুদ্রিত বই একপ্রকার কেনাই হয়ে ওঠে না, একমাত্র যদি তার সুলুক গ্যুগল না দিতে পারে অথবা দিলেও বিনে পয়সায় দিতে আপত্তি করে, তবেই কিনি। একো-ও আমি সেভাবেই তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্য থেকে বেছে পড়েছি কিছুদিন। এখন মনে হচ্ছে একো-র ক্ষেত্রে আমার এই পদ্ধতিতে কিছু সংশোধনী দরকার ছিল। তাঁকে অদূর ভবিষ্যতে যদি ফিরে পড়ার আগ্রহ হয় (এবং সেটা হবে নিশ্চিত) তাহলে পাঠের পরিধি আরও বাড়ানো দরকার হয়ে উঠবে। সেইসঙ্গে স্তানিস্লভ লেম ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন সেখানে। তারকোভস্কি ও পিটার স্প্যারো তাঁকে সেলুলয়েডে অমরতা দিয়েছেন। লেম যদিও আগে থেকেই সাইফির অন্যতম দার্শনিক পথিকৃৎ। বাংলায়্ও চর্চিত বলে জানি।

একো সেই ব্যতিক্রম যিনি ফুকো-র জ্ঞানকে নতুন করে প্রশ্ন করছেন এবং সেটা কভার করতে গিয়ে বিজ্ঞান-দর্শন সহ আমাদের ভাষাপ্রক্রিয়া ও চিহ্নায়নকে বড় ফ্রেমে ধরেছেন। অকপটে বলি, দেরিদা নিয়ে বাংলায় খুব চর্চা হতে দেখি। এটা ভালো। বহুরকম ইন্টারপ্রিটেশন যত হবে দেরিদাকে নানা মাত্রায় গণের বোধগম্য করতে কাজে দিতেও পারে। আমি ইন্টারপ্রিটেশনকে খারাপ মনে করি না। সেটা বাংলা বা ইংরেজি যে-ভাষায় হোক, এটি একদিক থেকে যিনি লিখছেন তাকে সেই ব্যক্তি বা বিষয়ের চর্চায় শান দিতে সাহায্য করছে। বিজ্ঞানে, দর্শনে বা সাহিত্য ছাড়া রকমারি সকল মাধ্যমেই ইন্টারপ্রিটেশন খুব চলে এবং সাহায্যকারীও বটে। অনেকসময় মূল রচনা ও রচয়িতার একটি ইন্টারপ্রিটেশন থেকে সম্পূর্ণ নতুন রচনা বেরিয়ে আসে। এসব হলো ইন্টারপ্রিটেশনের লাভের দিক।

সবই তো দিনশেষে Abstraction-এর খেল! ভাবনার নানা মাত্রায় গমনাগমনের উপায়। তো সেদিক থেকে একটি রচনাকে ঘিরে যত ব্যাখ্যা এবং ব্যাখ্যারও ব্যাখ্যা গড়ে উঠবে, তার থেকে নিজের ভাবনার সুলুক জাগার সম্ভাবনা থাকে। সেই অর্থে একো কিংবা যে-কোনও রচয়িতার মূল অর্থের সাথে সম্পর্করহিত ব্যাখ্যাকেও আমি সানন্দে নিতে রাজি, যদি সেটা ভাবার মতো ভাষায় কথা কইতে পারে। তবে রচয়িতার এক্ষেত্রে সৎসাহস থাকা উচিত এ-বিবৃতিটি দেওয়ার যে, তিনি মূল রচনা পড়েননি এবং ইন্টারপ্রিটেশন থেকে লিখছেন; অথবা পড়ে থাকলেও তিনি মূল বক্তব্যের বাইরে গিয়ে কথা বলতে চাইছেন। এসবই নির্ভর করছে, মুক্তক্রীড়াকে আমরা কীভাবে অনুমোদন করছি বা নিচ্ছি তার ওপর। আবারও বলছি, যদি লেখায় জাঁক প্রকাশের কিংবা বাহাদুরি নেওয়ার সুর ফুটে বের হয় সেক্ষেত্রে স্যাটায়ার দরকারি এবং সেটা বারবার হওয়া উচিত।


এবার দেরিদা প্রসঙ্গে খানিক ফিরি। বাংলায় (গায়ত্রী যেহেতু নিজে সেভাবে কাজটি করেননি, দু-একখানা বাংলা লিখে দায় সেরেছেন), এই কাজটিকে একটি পরিষ্কার বনেদের ওপর দাঁড় করাতে পেরেছেন এমন কারও সন্ধান কি আপনার জানা আছে? পশ্চিমে যেমন আমরা ড্রাইফুসকে পাই, যার হাইডেগার বাখানি সোজাকথায় নতুন করে দর্শনের পটভূমি চিনতে সাহায্য করে, সে-রকম কাজ কি হয়েছে? কথাটি এজন্য বলা যে, দেরিদার গায়ত্রীঅনূদিত মহাগ্রন্থটি আমি পড়ার তালিকায় এখনও রেখে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে ক্লিকবাজি করি বটে কিন্তু কেন যেন  প্রবেশগম্য হয়ে ওঠে না। ফলে দেরিদা সম্পর্কে আমি কিছু বলতে গেলে (তরুণ বয়সে অর্বাচীনের মতো দু’এক ছত্র যদিও বলেছি কতিপয় বিচ্ছিন্ন পাঠের সুবাদে) এবং এখন ভাবলে নিজের মূর্খতায় লজ্জা পাই বা তাঁর প্রসঙ্গ এলে দ্বিধায় ভুগি। তারচেয়ে ভূত সম্পর্কে দেরিদার অঢেল আগ্রহ মনে আরাম জাগায়। এটি নিয়ে একটি সিনেমাও দেখেছিলাম মনে পড়ে। দেরিদা সেখানে দু’ছত্র বলেছিলেন এ-সম্পর্কে। উপভোগ করেছি সেটা।

গায়ত্রী সংজ্ঞায়িত বি-নির্মাণের এতরকম বাহার বঙ্গে দেখি তাতে মনে হয় যারা লিখছেন তারা অনেক বেশি সক্ষম। অথচ কেন মনে হয় জানি না, দেরিদার ব্যবচ্ছেদ ভিটগেনস্টাইন এবং ভর্তৃহরী, তৎসূত্রে আমাদের ভারতীয় ব্যাকরণশাস্ত্র ও তর্কপদ্ধতির পাঠ ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নহে। গায়ত্রী কি তাঁর নিজের লেখায় ভারতীয় বিনির্মাণের ধরন নিয়ে ভেবেছেন? সে-রকম কোনও রেফ্রেন্স জানা থাকলে বলবেন। আমার কেন জানি মনে হয় ফরহাদ মজহার পূর্ব ও পশ্চিমের দার্শনিকতার মিলনের জায়গাটি একসময় ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের নিবিড়পাঠের দিকে পরে আর অগ্রসর হননি। তাঁর একাধিক লেখায় এটি নিয়ে একধরনের দ্বিধা ও অস্পষ্টতা লক্ষ করেছি বলে কথাটি বলা। বিমলকৃষ্ণ মতিলালের ভারতীয় দর্শনের ভাষা ও তর্কের পদ্ধতি নিয়ে বিরচিত বইগুলো এক্ষেত্রে ভীষণ সহায়ক মনে করি। তাঁর The Character of Logic in India এবং আরও একাধিক গ্রন্থ এ-সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য করলেও মতিলাল বাংলায় লিখেছেন নাম মাত্র।

সে যাকগে, ইন্টার্নেট এখন সুযোগ করে দিয়েছে। ভারতীয় দর্শনের মূল স্তম্ভ (শংকারাচার্য, রামানুজ, মাধবাচার্য সহ অনেকের) টেক্সট সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে সুলভ হয়েছে। যদিও অনুবাদে, তবু এর পঠন জরুরি। আমি সেই পাঠের মধ্যে এখনও আছি বলতে পারেন। পরিকল্পনা আছে, মনের খিদে এ-রকম থাকলে আগামী তিনবছর দুই জগৎকে এক করে ধারাবাহিক পড়ব কিছুদিন। চেষ্টা থাকবে নোটবুক বা স্ক্রেপবুকের আদলে সেই পাঠ-অভিজ্ঞতা টুকে রাখার। যেন পড়ে রিকল করতে পারি।


  • লেখকের সঙ্গে গানপারসঞ্চালকের ইমেইল কনভার্সেশনের একাংশ এই তাৎক্ষণিকা। — গানপার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you