তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪

তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪

আঠারো জুলাই যে-লেখাগুলা (ড্যাশবোর্ডে তেমন অন্তত তিনটা সাজানোগোছানো আছে, সেখান থেকে এইটা একটা) আমরা গানপারে আপ্লোডের জন্যে রেডি করে রেখেছিলাম, হননোন্মত্ত হাসিনাতাণ্ডবে সেসব আর ছাপানো সম্ভব হয় নাই। কেন হয় নাই, তার বিবরণব্যাখ্যা আর দরকার হবে না। আদতে সতেরো জুলাই থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশ গোটা দুনিয়া থেকে। ইন্টার্নেট, যত ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া, মানুষে-মানুষে এক্সপ্রেশন লেনদেনের ফোনসংযোগব্যবস্থা শাটডাউন করে দিয়ে হাসিনা শুরু করেন হত্যা আর হত্যা আর হত্যা। মিথ্যা আর মিথ্যা আর মিথ্যা। কারফিউ। কারফিউয়ের পর কারফিউ। গভমেন্ট হলিডে একের পর এক। হত্যা হাজার ছাড়ায় রাতারাতি। ইন্টার্নেট পুরাপুরি ফিরে পেতে পাঁচ অগাস্ট বিকাল গড়ায়, হাসিনা দেশের জাতীয় মর্যাদাবাহী বিল্ডিং-ভবনগুলি বিশেষত সংসদ ও গণভবন অরক্ষিত রেখে সেনাপাহারায় পালিয়ে যান। দিগ্বিদিক পালাতে থাকে ষোলো বছরের আইন-ও-বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের হোতা হাসিনার পোষা আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা। রাজনৈতিকভাবে অবদমিত জনতা ফাঁকা প্রবেশতোরণ পেয়ে ঢুকে যায় গণভবনে, সংসদে, ব্যাপক লুটের শিকার হয় ন্যাশনাল আইকনিক স্থাপনাসমূহ। গভীর সংকটে নিপতিত দেশ ও মানুষ। ষোলো বছর ধরে তৈরি হওয়া বিচারহীনতার সংস্কৃতি গেঁড়ে বসা সর্বত্র। অরক্ষিত অরাজক গোটা বাংলাদেশ আজ। দরকার রাষ্ট্রের খোলনলচের সংস্কার।

যা-হোক। অতি সংক্ষিপ্তভাবে বলা হলেও উপরোক্ত কথাগুলি ইতিহাসের নিরিখে পাঠের ও প্রতিক্রিয়ার বিশদ পরিসর সামনের দিনগুলায় আমরা করে নিতে পারব নিশ্চয়। আপাতত পুরানা লেখাগুলা আপ্লোড করে রাখি। নিচের লেখাটা আমরা পাচ্ছি কথাসাহিত্যিক আহমদ মিনহাজের বয়ানে। যে-লেখা আঠারো জুলাই রিলিজ হবার কথা ছিল তা আজকে এক নতুন গুমট আবহাওয়ায় পাঠ করতে কে আগ্রহী হবে তা জানি না, আমরা চাই বিগত সময়ের যা-কিছু গরিমার তা ছাড়াও ন্যাক্কারজনক প্রতিটি অধ্যায় যেন পুনর্পাঠ করে যেতে পারি এবং পারি লার্নিং ডিসেমিনেইট করতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জুলাই সতেরো পর্যন্ত কোটা-(সংস্কার/বিরোধী) আন্দোলন কেন্দ্র করে শাসক আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের নিপীড়ন মাথায় রেখে এই লেখার কালো পটভূমিকায় বানানো ব্যানার বাতিল করে লাল ব্যানার করতে হলো। মূলত ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে গোটা বাংলাদেশ রক্তাক্ত হচ্ছিল রোজ শিক্ষার্থীদের খুন করার ধারাবাহিক ঘৃণ্য প্রক্রিয়ায়। হাসিনা তার গণহত্যাকারী চেহারাটা আর লুকিয়ে রাখতে পারেন নাই, অগত্যা, উপায়ান্তরহীন, জনতার সগর্জন ধাওয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্রকাশ্য দিবালোকে সেনাপাহারায়।

এই অভ্যুত্থানকালে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আমরা জাতিগতভাবে যেন অটুট রাখতে পারি। — গানপার / ০৮ অগাস্ট ২০২৪


তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ || আহমদ মিনহাজ


মাথা কাজ করতেসে না। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর নিপীড়নের মাত্রা দেখে ফের স্তম্ভিত হচ্ছি। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কোটার মতো একটি ইস্যু, যেটি কিনা দুই পক্ষের আলোচনায় অনায়াস সমাধান করা যায়, তাকে জটিল পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে দেখে আজব লাগছে! প্রথম দফায় এটি যখন শুরু হলো ও আমাদের মাননীয়া (উনার ভাষায় রাগের মাথায়) কোটা বাতিল করলেন, তখনও আজব মনে হয়েছিল! একজন সরকারপ্রধান রাগের মাথায় এটা-ওটা বাতিল করছেন, মন চাইলে ফিরিয়ে আনছেন…! হাস্যকর! সত্যি হাস্যকর! নাকি এটি উনার চাল? মওকা বুঝে ব্যবহার করবেন বলে গেমটি খেললেন তখন? হতেও পারে।

উনার কাজের ধারা এরকমই দেখে আসতেছি এতটা বছর! দেখতে-দেখতে চোখ পচে গেছে। মগজও বিলক্ষণ। তাই হয়তো কোটা আবার ফিরল দেখে আশ্চর্য হইনি। গা করিনি একরতি। ঘটনা এখন যেদিকে মোড় নিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে মাননীয়া বয়সদোষে তালজ্ঞান হারাচ্ছেন। হাজার হোক, জো বাইডেন থেকে তিনি কি আর এমন জুনিয়র! কোটাকে যে-কারণফেরে উনি জীবিত করেন-না-কেন, পরিস্থিতি এখন উনার নিয়ন্ত্রণে নেই শতভাগ। ভুলচুক ঘটে গেছে। হাওয়া বুঝে কথা রয়েসয়ে বলতে হয়। মুখে লাগাম টানতে না পারলে ঝুঁকি বাড়ে। সেটি ঘটেছে। না উনি, না উনার সিপাহসালার … দুজনেই দেখি মুখের লাগাম টানতে নাচার! এবার ঠেলা সামলাও। নিজের কথা যদি বলি, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে আমি কনফিউজড। এতরকম ন্যারেটিভ! কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কোনটার কী উদ্দেশ্য, কে কোন অ্যাজেন্ডা নিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলার মাথা খাচ্ছেন … বুঝে আসতেছে না!

আন্দোলনে যারা আছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি ও শতভাগ সমর্থন থাকছে, এবং জুলুমবাজের বিপক্ষে ঘৃণা। তো এই অবস্থায় এমন কিছু বলা উচিত হবে না যেটি আন্দোলনের নৈতিকশক্তিকে খাটো করে দেখছে বা তার বিপক্ষে চলে যাচ্ছে মনে হবে। যে-স্পিরিট এখন দেখছি সেটিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তবু না-বলে পারছি না,—কোটা আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে মনের সন্দেহ দূর হচ্ছে না। বিগত সময়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আর কোটাকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি কি এক? প্রশ্নটি ভাবাচ্ছে। ওইসময় আন্দোলনগুলো সাফল্য পেয়েছে। কেন পেয়েছে সেটি একবার ভাবেন, উত্তর পেয়ে যাবেন। চব্বিশে এসে প্রসেসটা কাজ করবে কি? ওয়ার্ক করার জন্য যা দরকার তার সবটা আওয়ামী সরকার পরিকল্পনামাফিক বিনষ্ট করেছে। আন্দোলন সফল করতে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। দেশের মানুষ সর্বজনীন ক্ষোভে ফুঁসছেন তাতে সন্দেহ নাই কিন্তু সম্পৃক্ত হচ্ছেন কি?

আপামর সাধারণকে রাস্তায় নামাতে হলে যেসব এলিমেন্টস আপনার দরকার পড়ছে তার কোনোটাই দৃশ্যমান দেখছি না। নামানোর কিছু অবশিষ্ট রাখে নাই এ-সরকার! দুইহাজার আটে গদিতে বসার পর থেকে পয়লা চালে বিরোধী রাজনীতির কোমর ভেঙে দিতে যা করা দরকার ছিল তার সবটা একে-একে করেছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে ও গণবান্ধব হওয়ার দায় বহনে বাধ্য করে নিজেকে, সেগুলোকে ইতোমধ্যে ধ্বংস করা হয়েছে। রাজনীতিবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে আপনি প্রেশার গ্রুপ বলতেন, তারাও মৃত। মুক্তিযুদ্ধ সহ যা-কিছু দেশের সাংবিধানিক অস্তিত্বকে ভাষা দেবে ও তাকে জনবান্ধব থাকতে বাধ্য করবে, এবং এর জন্য আওয়ামী লীগ গদিতে বসে যে-ন্যারেটিভ তৈরি করল, এখন এর ভুল অথবা অসৎ উদ্দেশ্য ধরিয়ে দিতে কাউন্টার ন্যারেটিভে গমনের রাস্তা সে খোলা রাখেনি। সচেতনভাবে খিল এঁটে দিয়েছে। কাউন্টার ন্যারেটিভের নামে আমি-আপনি এতদিন ধরে যেসব বস্তু তৈরি করেছি সেগুলো সন্দেহ ও বিতর্কমুক্ত নয়। এর সিংহভাগ, খেয়াল করলে দেখবেন, আওয়ামী ন্যারেটিভকে খারিজ করতে যেয়ে এমন সব ভাষা সেখানে যোগ করেছে যা কিনা দেশটার পয়দা হওয়ার ইতিহাসকে প্রকারান্তরে ডিনাই করে বসে। মুক্তিযুদ্ধসহ চেতনা নামক আজব আওয়ামী ন্যারেটিভে নিহিত শয়তানিকে খারিজ করতে যেযে নিজের অসৎ উদ্দেশ্য তারা চরিতার্থ করতে আকুল। চলমান আন্দোলনেকে এ-কারণে ভুগতে দেখছি।

আন্দোলনটিকে শুরুতে স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলেও এখন তা নয়। সরকার জানত ওটা স্বতঃস্ফূর্ত থাকবে না। থাকতে যেন না পারে সেই ছকে একে আদালত থেকে পুনরায় জিন্দা করেছে। পুরো ইস্যুটি যে-কারণে স্ক্রিপ্টেড। নিজের লুজ মোশন আটকানোর উপায় হিসেবে এটিকে এখন ব্যবহার করছে। এমতাবস্থায় গণআর্তনাদ আমাকে-আপনাকে বিপন্ন করবে, আবেগে আমরা ফুঁসে উঠব কিন্তু দিন শেষে রাস্তায় নামব না। সমাজমাধ্যমে পড়ে থাকব। সেখানে বসে বিপ্লবী বাণী আওরাবো দেদারসে। নামানোর কাজটি ওইসব বাচ্চা ছেলেমেয়ের নয়। সেটি তাদের কাজও নয়। আন্দোলন এই জায়গা থেকে ভেবে দেখলে নেতৃত্বহীন। কেউ নেই যে এর ভিতরে ঘটতে থাকা পাল্টাপাল্টি ন্যারেটিভের সত্য-মিথ্যা ক্লিয়ার করবে। রাস্তায় নামতে যেয়ে আপনি কি কোটায় সোচ্চার ছেলেমেয়ের হয়ে নামছেন? নাকি বিএনপি, জামাত বা এরকম কারো অ্যাজেন্ডা সফল করবেন বলে নামছেন? আচ্ছা, ওসবে পরোয়া না করে নামলেন। প্রশ্ন হলো, তারা কি আপনার জন্য সঠিক বিকল্প? এতটা অসহায় ক্রোধ আর নিস্ফল পরাজয়ের অনুভূতি কবে দেখেছেন সেটি ভাবতে পারেন।

সাজানো ইলেকশন করে এই সরকার আবার ক্ষমতায় এসেছে। এর নৈতিক চাপ প্রচণ্ড। মাননীয়া মুখে যতই লম্বা বাণী ঝাড়ুন, নাইটমেয়ার ওনার হয় বৈকি। আমি ভুয়া…ভুয়া;—বাক্যটি রাতে উনার ঘাড়ে সওয়ার হয়। তার ওপর আছে চলমান মুদ্রাস্ফীতি। বাজারের অবিশ্বাস্য লাগামছাড়া পাগলা গতি। আছে দেশকে দুর্নীতি দিয়ে সয়লাব করার দুর্নাম। টাকা পাচারের ভাগাড় করে তোলার দায়। আছে রিজার্ভে ঘাটতি। বাহারি উন্নয়নের মাশুল গোনার চাপ। ব্যারিস্টার সুমন স্তুতিছলে সত্যি কথাটি ভালোই বলেছে সংসদে : আমি এক লক্ষ টাকা লোন করে রাতে ঘুমাইতে পারি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আড়াই লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়া ক্যামনে ঘুমান! তার ওপর আছে আইএমএফ-এর গণবিরোধী শর্ত মেনে ধার উধারের মজবুরি। ফ্যাক্টগুলোকে টকশোর চাপাবাজদের বিষয় মনে করে ইগনোর করলেও মাননীয়ার রাতের ঘুম হারাম করতে তারা যথেষ্ট। সব কিন্তু চাপা পড়ে যাচ্ছে কোটা ইস্যুর তোড়ে! এমন এক ইস্যু যার প্রেক্ষাপট ভেবে দেখলে আমরা না পারব সরকারকে শতভাগ দুষতে, না পারব ওইসব ছেলেমেয়েকে, যাদের সামনে আমাদের মাননীয়া সরকারি চাকরির মূলা ছাড়া কোনো বিকল্প রাখেননি! ওইটা বাগানো গেলে মতিউর-বেনজির হতে আর ক’দিন! প্রাইভেট সেক্টর গেল এক দশকে কতখানি বিকশিত হয়েছে এই দেশে? শতাংশের হিসেবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তার অবদান কত ভাগ? সব চাপা পড়ে যাচ্ছে! বুঝেশুনে চাপা দিচ্ছেন মাননীয়া!

এরশাদশাহির পতনের ডঙ্কা বাজার দিনক্ষণে বিকল্প ছিল আমাদের কাছে। হয়তো বাজে বিকল্প, তবু বিকল্প ছিল। ওই আওয়ামী লীগ বা বিনএপিকে আমি-আপনি বিকল্প ভেবেছি। এখন বিকল্প কে? বিকল্প কারা? কার হাতে আপনি নিজেকে জিম্মা করবেন?


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
লাল, চিরকাল

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you