হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ

হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ

 

মিনহাজভাই, (হাসিনাপতন) পড়লাম, অসাধারণ বিশ্লেষণ। সময়কে পাঠ করার জন্য অত্যন্ত জরুরিও বটে। কী কারণে হাসিনা সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠল তার একটা পরিষ্কার চিত্র যেন চিত্রায়িত হলো এই লেখনীর মাধমে। আমিও একমত, সামনাসামনি আলাপে হয়তো আরও বিস্তারিত করার সুযোগ পাবো।

১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্রদের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূত্রপাত তারা একটা মানসিক প্রস্তুতির মধ্যে ছিল। কোটা পুনর্বহালের হাইকোর্টের রায় ঘোষণামাত্র তারা লাইব্রেরির সামনে জমায়েত হয়, মিছিল করে, ভীতিজনক পরিবেশকে উপেক্ষা করে কর্মসূচির ডাক দেয়। যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আমি নিজেও এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম মঈনউদ্দিন ফখরুদ্দিন শাসনামলে। খেলার মাঠে ঘটা একটা ঘটনার জের ধরে তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্ররা জমায়েত হয় লাইব্রেরির সামনে, মিছিল সহকারে মাঠের দিকে যায়, তাড়া খেয়ে ফিরে আসে, আবার সংঘটিত হয়, রাতব্যাপী সংর্ঘষ চলে। পুরো ঘটনার আমিও একজন অংশীদার ছিলাম। পরবর্তী দুইদিন এই আন্দোলনকে সারাদেশব্যাপী ছড়িয়ে যেতে দেখলাম। ছাত্রশক্তি একটা বারুদের মতো, কেবল দরকার আগুনের খানিক স্পর্শ। ২০২৪-এ এটাই ঘটল।

২. আপাত অরাজনৈতিক কিন্তু রাজনীতিসচেতন আওয়ামীপ্রতিপক্ষ কিশোর-তরুণ, যারা জেনজি  প্রজন্ম নামে পরিচিত (১৯৯৭-২০১২), তাদের মধ্যে আওয়ামীবিরোধিতার মানসিক ক্ষেত্র কীভাবে তৈরি হলো? কিংবা আদৌ তারা রাজনীতি-সচেতন কি না? কিংবা তাদের আদর্শের জায়গায় কী বিরাজ করে? আপনার লেখার মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত এসেছে, তারপরও আমি বিষয়টি পুনঃপাঠ করার চেষ্টা করছি। প্রথমত ষাট, সত্তর, আশি কিংবা নব্বই দশক পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের আদর্শ এবং তার প্রভাব কিংবা মানবতার যেসকল আদর্শ সমাজে বিচরণ করত পরবর্তী সময়ে তা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদিতে অভ্যস্ত প্রজন্ম আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ধর্মীয় ভাবাদর্শের কাছে উৎসর্গিত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার সাংবাদিক, ইউটিউবার, লেখকদের প্রভাব তাদের মনোজগতের গঠনে নিয়ামক হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষকদের কথা আপনার লেখায় উঠে এসেছে তারাও হয়ে ওঠেন তরুণদের আদর্শ। এই যে বুদ্ধিজীবিতা, এখানে দলমত নির্বিশেষে একটা দলই সক্রিয় ছিল আর তারা সবাই আওয়ামী এবং ভারত বিরোধী। আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কেউ তরুণদের আদর্শ হয়ে উঠতে পারেননি। একটা সময় পর্যন্ত (মুহম্মদ) জাফর ইকবালের একটা প্রভাব ছিল কিন্তু আওয়ামী স্বৈরাচার তার প্রয়োজনে অথবা অনবরত জামাত প্রচেষ্টায় তিনিও তার ইমেজ হারিয়ে ঠুনকো এক সাবেক শিক্ষকে পরিণত হন। তাই জেনজি রাজনৈতিক সচেতনতা আওয়ামী হটানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

৩. তরুণ প্রজন্মের মাঝে ভারতবিরোধিতার আরও একটা বড় কারণ ক্রিকেট খেলাকেন্দ্রিক। ভারতের মোড়লিপনায় ক্ষুব্ধ এদেশের তরুণদের একটা বড়ো অংশ। দুই দেশের খেলাকে কেন্দ্র করে অনলাইন যুদ্ধ এখন নিয়মিত ঘটনা।

৪. ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল, সুযোগ বুঝে জামাত বিএনপির অংশগ্রহণ এবং তার সফল সমাপ্তি পূর্বপরিকল্পনার তত্ত্বকে একেবারে খারিজ করে না। পরপর একাধিক সফল ছাত্র-আন্দোলনকে লক্ষ করে এইক্ষেত্রে আরো বেশি মনোনিবেশ করা একেবারে অবাস্তব নয়। আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধা নেওয়া সেনাবাহিনীর আমূল বদলে যাওয়া, জামাতকে সামনে আনা, হাসিনা-পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপে জামাতের মতকে বিজয়ী হতে দেখা…একেবারে কাকতালীয় এরকম নাও হতে পারে। আমাদের পার্শ্ববর্তী জামাত-নিয়ন্ত্রিত হসপিটালের ভূমিকা, ফান্ড প্রদান এবং মাঠে উপস্থিত থাকার নির্দেশনা এই সফল বাস্তবায়নের নিশ্চয়তাকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল।

৫. ফরহাদ মজহার সম্পর্কে এখন পর্যন্ত আমার যে-ধারণা সেটি ভুল হতে পারে, তারপরও বলছি, তাঁর মূল লক্ষ্য আওয়ামীলীগহীন বাংলাদেশ। যার ভিত্তি হবে ধর্মগোত্র মিলিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ইসলাম স্বভাবতই প্রাধান্য পাবে। আর বিপ্লব শব্দটাকে তিনি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন, যার মাধ্যমে আপাতত আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার মধ্যেই তাঁর মনোযোগ।

৩ টা বিষয়ের উপর একটু আলোকপাত করছি :

১. এইমাত্র চোখে পড়ল নিউজটা, পুর্বঘোষণামতো রোকেয়া প্রাচী গিয়েছিলেন (ধানমণ্ডি) ৩২-এ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে, এই অবস্থায় একদল লোক লাঠি নিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। সমচেতনার কয়েকজন গিয়েছিলেন, তারাই পরে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

২. সালমান এফ রহমান স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী আর লুটেরাদের একজন। স্বৈরাচার সরকারের অন্যতম কুশীলব। কিছুদিন আগে হজ করতে গিয়েছিলেন। গতকাল তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে দাড়িকাটা অবস্থায়। এই দাড়ি কেটে জনগণের সামনে হাজির করাটা খুব কৌশলী একটা কাজ।

৩. ফরহাদ মজহার ততক্ষণ পর্যন্ত সহিষ্ণু যতক্ষণ-না ইসলাম ভাবাদর্শের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিরাপদ থাকে। কিন্তু গত দুইদিন মুজিব, ১৫ আগস্ট প্রশ্নে উনি আর সহনশীলতা ধরে রাখতে পারেননি, ফ্যাসিস্টদের মতো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন।


হাসিনাপতন :: আহমদ মিনহাজ
জুলাই জেনোসাইড : গানপার সংকলন

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you