আতিকের সিনেমা || কাজী ইব্রাহিম পিয়াস

আতিকের সিনেমা || কাজী ইব্রাহিম পিয়াস

মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। লাখো শহিদের জীবনের দামে কেনা এই বাংলাদেশ আমাদের। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জীবনে রাজনীতি-শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মিশে থাকবে ওতপ্রোতভাবে। সকল শিল্পমাধ্যমে তাই অবধারিতভাবেই মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে নানান আঙ্গিকে। চলচ্চিত্র নির্মাণ যেহেতু সামষ্টিক ও তুলনামূলক ব্যয়বহুল শিল্পমাধ্যম, তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়ে ওঠেনি; — আর যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে, মানের দিক থেকে বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই উতরে উঠতে পারেনি।

অযথা গোলাগুলি, আগুন, ধর্ষণ, দাড়ি-পাঞ্জাবি পরিহিত রাজাকারের চরিত্রায়ন ইত্যাদি একই ফর্মুলায় মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা তৈরিতেও বাণিজ্যিক প্রেমকাহিনির মতো ঘুরপাক খাচ্ছিলেন আমাদের নির্মাতারা।

মানের দিক থেকে উল্লেখ করার মতো কিছু কাহিনিচিত্র, যেমন — ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘মাটির ময়না’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘গেরিলা’, ‘মুক্তির গান’, ‘জয়যাত্রা’, ‘মেঘমল্লার’ ইত্যাদি। সুখের খবর এই তালিকায় আরো একটি সিনেমা যুক্ত হলো — স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’।

চলচ্চিত্রটির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য যেটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো এক সিনেমায় সবকিছু বলতে না চাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন বিশাল ক্যানভাসকে একটি সিনেমায় তুলে ধরাটা নিতান্তই বালখিল্যতা। তাছাড়া সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধ বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছে। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমায় সৈয়দপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে আনা হয়েছে নানা মেটাফোরের আশ্রয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি এমন চমৎকার চিত্রনাট্যে, দারুণ ক্যামেরার কাজে, সুঅভিনয়ে, সাদাকালো রঙে, স্মুদ সম্পাদনায় সর্বোপরি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ একটি পরিচ্ছন্ন ও সুনির্মাণ।

এ ছবিতে তথাকথিত কোনো নায়ক-নায়িকা নেই। নায়ক বা নায়িকা হলো এই ছবির গল্প আর নির্মাতার দর্শন। নূরুল আলম আতিক (NA Atique) আমার প্রিয় নির্মাতাদের একজন। তার চিন্তা, দর্শন, সিনেমার প্রতি সততা তাঁকে অনন্য করে রাখবে সবসময়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে চলচ্চিত্র সংসদ করার খাতিরে দুইদিনব্যাপী স্ক্রিপ রাইটিং ওয়ার্কশপ করার ছলে এই মানুষটার কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির কাজ ও কথা শুনে তখন থেকেই মনে হয়েছিল তিনি জ্ঞানী ও সিনেমানির্মাণটা বোঝেন।

আমাদের তরুণ মনে তখনই মনে হচ্ছিল নিজেরা ক্রাউড ফান্ডিং শুরু করে অন্তত এই মানুষটাকে সিনেমা বানাবার দায়িত্ব দিই। যা-ই হোক, ‘ডুবসাঁতার’ নির্মাণের প্রায় ১০ বছর পর আতিকভাই সিনেমা নিয়ে ফিরলেন। আনন্দের সংবাদ হলো, তাঁর ‘পেয়ারার সুবাস’ ও ‘মানুষের বাগান’ সহ আরো দুইটি সিনেমা প্রায় শেষ হয়েছে। শুধু ঢাকাবাসী নয়, সকলের দেখার সুযোগ ঘটুক সবকয়টি সিনেমা।

যত মেধাবীই হোক, দিনশেষে একজন নির্মাতা বেঁচে থাকবেন তাঁর নির্মাণে। নিশ্চয়ই ঋত্বিক ঘটক আরো ১০ টা সিনেমা বানালে সেগুলিও ভালো সিনেমাই হতো! তাই আতিকভাইয়ের কাছেও আমরা আরো অনেক অনেক সুনির্মাণ চাই, ভালো সিনেমা চাই।

অনেকগুলো বাংলা সিনেমা চলছে হলে। ভালো করার একটা ট্রানজিশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলা সিনেমা। নতুন নির্মাতা ও ভালো মানের সিনেমা তৈরি হবে যদি আমরা সিনেমা দেখি। ভালো-মন্দ সবই আমরা আলোচনা করব অবশ্যই সে-সিনেমাটা দেখার পর।

জয় হোক বাংলা সিনেমার। জয় বাংলা!


কাজী ইব্রাহিম পিয়াস রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you