অমর পিয়াল || সুমন রহমান

অমর পিয়াল || সুমন রহমান

অমর পালের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮৭ সালে। জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে। উদ্দাম গলায় গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাচ্ছে। পরে, পরিচয় যখন ঘন হলো, জানলাম তার নাম ‘পিয়াল’। অমর পাল নয়, মাহবুব পিয়াল। অমর পালের গান গাইত বলে তারে আমরা ডাকতাম ‘অমর প্যাল’।

রেনডিশনে অদ্ভূত মিল ছিল দুজনের। দুজনেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে আসা। একজন সাভারে, অন্যজন কলকাতায়। গায়কীর খুঁটিনাটি খুব বুঝতাম না, কিন্ত সমান দরদী ছিল তারা, — এটা বুঝতাম। ছেড়ে-আসা শহরের নস্টালজিয়াই হয়তো এই অর্ন্তগত দরদের উৎস।

অদ্ভূত ব্যাপার, অমর পালের অনেকগুলো গান হয়তো অমর পালের গলায় শোনাই হয়নি। পিয়ালের গলা দিয়েই শুনে শুনে ভেবেছি, অমর পাল শুনে ফেলেছি!

মাঝখানে বেশ কয়েক বছর আগে পিয়াল ভারতে গিয়ে অমর পালের সাথে দেখাও করে এল। একটা ইন্টার্ভিয়্যু করেছিল বোধহয়।

অমর পালকে মিস করব। যেমন মিস করি খালি গলায় পিয়ালের গাওয়া জাহাঙ্গীরনগরের মায়াময় সকালগুলোকে। সেই দরদটুকুকে। সকালের সূর্য-চিকচিক নদীর বুকে পালখোলা গলা। উদাত্ত। গভীর। গান শেষ হলে কেবল নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।

২.
স্বকীয় এসে বলল, বাবা, বাথরুমে ব্রাশ করছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, পিয়ালকাকা এসে ডাকবে, এই যে স্বকীয়!

বলে সে পিয়ালের হাত নাড়ানোর একটা বিশেষ ভঙ্গি করে দেখাল। ও করতেই আমার চোখে ভেসে উঠল, পিয়াল এ-রকমই করত। বাসায় এলে ওদের একটা বিশেষ আদবের টোনে ডাকত। যেন সমান সমান কারো সাথে কথা বলছে।

স্বকীয় এবার একটু কাছাকাছি এসে গলা নামিয়ে বলল, তোমারও কি এমন মনে হয় বাবা? পিয়ালকাকা এসে তোমাকে কিছু বলবে? এমন কিছু?

আমি বললাম, হুমম, মনে হয়। কিন্তু সে তো আর আসবে না বাবা। কোনোদিনই আসবে না।

স্বকীয় ঘুমাতে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর মনে হলো, এটা আমার ছেলের স্বভাববিরূদ্ধ। ওর এত দ্রুত আলাপটি শেষ করবার কথা না। আরো কিছু প্রশ্ন করবার কথা।

কিন্তু করল না। সেটা হয়তো এজন্য না যে, মৃত্যু নিয়ে আলাপে সে কোনো ট্যাবু বোধ করে। করে না, বরং অনেক আগ্রহ আছে দেখেছি গত কয়দিনে।

হয়তো আমার সিনিসিজম আর কনক্লুসিভ টোন ওর ভালো লাগেনি।

শিশুদের জগৎ নানাবিধ ম্যাজিকে ভরা। পিয়ালের পক্ষে সেখানে চিরতরে মৃত হয়ে থাকবার কোনো সুযোগ নাই। হয়তো ওর নানাবিধ প্রপ্সগুলোর মধ্যে, অসংখ্য সুপারহিরোর ছোট ছোট মিনিয়েচার মূর্তিগুলোর মধ্যে কোথাও ওর পিয়ালকাকাকে রেখে দেবে সে।

মৃত্যু নামক এই সামান্য ঘটনাটাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কোনোটাই করবার দরকার পড়বে না তার।

৩.
প্রায়ই বলত, এত সুন্দর অবিচুয়ারি লিখিস, আমি যদি মরে যাই, খুব সুন্দর করে একটা অবিচুয়ারি কিন্তু লিখতে হবে!

হাসতাম। বলতাম, অবশ্যই। খালি মরেই দেখ!

এই অবিচুয়ারি আমি কীভাবে লিখব, পিয়াল! এটা খুব খারাপ ধরনের মশকরা করলি তুই!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you