রিপোর্টার্স ডায়েরি ১ / হাওরের ধানখলা || শামস শামীম

রিপোর্টার্স ডায়েরি ১ / হাওরের ধানখলা || শামস শামীম

বোরো ধান আহরণের এই মওসুমে এক অভিন্ন চিত্র হাওরজুড়ে। প্রতিটি ধানখলার অনন্য দৃশ্যে মন জুড়ায়, ধুলোপড়া চোখে আরাম দেয়। কী দারুণ কষ্টে হাওরের ছায়াহীন বিরান কান্দা-প্রান্তরে সারি সারি খলায় (ধান শুকানোর জন্য তৈরি মাঠ হাওরাঞ্চলে ‘খলা’ নামে পরিচিত) দিন গুজরান করছেন লাখো কৃষক। সেখানে খড়ের অস্থায়ী খলাঘর তৈরি করে রাতে থাকার সাময়িক ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিনে টানা পরিশ্রম করে যখন হাঁপিয়ে ওঠেন কৃষক তখন সেই অস্থায়ী খলাঘরে সাময়িক আশ্রয় নেন। আনন্দের সঙ্গে আতঙ্ক, ভীতি ও হাহাকার জুড়ে থাকে ধানখলাকে ঘিরে।

ধানখলার দৃশ্য হাওরবাসীর চেনা। শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় জীবন টেনে নিচ্ছেন তারা। কিন্তু বাইরের লোকসকল যারা, প্রথমে ধানখলা দেখে চোখ ফেরাতে পারেন না সহজে। তাদের চোখ আটকে যায় অলৌকিক মায়াজালে। স্থির চাহনিতে নিজেরা অজান্তেই ডুব দিয়ে থাকেন। খলায় শুকানো ধানের স্তূপ ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে। কুলায় ধান ওড়িয়ে চিটা ছাড়াচ্ছে কমবেশি সকলেই। শুকানোর জন্য দেওয়া ধান নেড়ে দিচ্ছে কোমল পা। এই মরসুমে হাওরের চেয়ে ধানখলাগুলোই মুখরিত থাকে বেশি। আর মুখর করে যারা রাখেন তাদের প্রায় সবাই নারী, — হাওরের অর্থনীতিতে যাদের শ্রমের মূল্যায়ন প্রায় অনুপস্থিত। এ যেন অমর্ত্য সেনের লুকায়িত অর্থনীতির এক প্রোজ্জ্বল দিক, যা যুগযুগ ধরে হাওর-অর্থনীতির মূল্যায়নের বাইরেই রয়ে গেছে।

হাওরের মানুষ আমি। জলা-জাঙ্গাল আর কান্দার সঙ্গে শৈশব থেকেই মিতালি। ধানখলায় ছোটবেলা থেকেই ধান পাহারা দেওয়া আর তদারকি দায়িত্বের হাতেখড়ি শুরু হয়েছিল। বৈশাখি ধানের বিনিময়ে বুটমটর (ভাজা ছোলা), গরম জিলাপি, কাটাগজা, নিমকি, রসগোল্লা আর নানা পদের মণ্ডামিঠাই খেয়েছি কুছিকুছি (ধান-চাল মাপার ছোট টুকরি) ধান দিয়ে। ফেরিঅলার হরেক মুধর ডাক আর মণ্ডামিঠাই আমাদের প্রলুব্ধ করত। আমরা বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে মণ্ডামিঠাই বিক্রেতার বস্তায় ভরে দিতাম কুছিকুছি ধান।

হাওরের সেই ধানখলাগুলো এখন মুখর। কাজের সুবাদে বেরোতে হয়। চিরচেনা এমন মুখর রূপ দেখে নিজেও চোখ ফেরাতে পারি না। একেকটি খলা দেখি, মুগ্ধতায় সিক্ত হই। মনে হয় কোনো ধ্যানী শিল্পীর শিল্পিত ছোঁয়ায় অনন্য রূপ নিয়েছে ধানখলা। একেকটি দৃশ্যমুহূর্ত ধরার জন্য শিল্পী যেন অনন্তকাল নির্ঘুম কাটাচ্ছেন। ডুব দিয়ে আছেন অথৈ সুন্দরের মাঝে। তার ধ্যানও যেন ভেঙে যাচ্ছে খলার উস্কে দেওয়া সৌন্দর্যে।

এখন করোনাকাল। বিশ্বজন স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি। কিন্তু স্বেচ্ছাবন্দিকালেও উল্টো চিত্র দেশের খাদ্য যোগানদাতা হাওরে। সবাই এখন ঘরে ছেড়ে হাওরে। কষ্টের ফসল গোলায় না উঠলে জীবন তাদের থমকে যায়, আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। এইবার বিশ্ব শ্রমসংস্থা সহ অর্থনীতিবিদরা আগাম খাদ্যসংকটের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও আগাম খাদ্যসংকটের আভাস বুঝতে পেরে বারবার যে-কোনো মূল্যে হাওরের ধান কেটে তোলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। এই অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের অন্নের জোগানদাতা হাওরবাসীর কি ফসল ঘরে রেখে বসে থাকলে চলে? করোনার চেয়ে তাদের যত ভয় কালবৈশাখী, বজ্রবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলকে। উজানের ঢল মুহূর্তেই এসে ভাসিয়ে নেয় ভাটির ধানচোখের স্বপন। দেখতে দেখতে তলিয়ে যায় একেকটি ফসলী হাওর। তখন এক শব্দহীন কান্না ছাড়া উপায় থাকে না হাওরবাসীর। আসুন, এই রিপোর্টে, দুইজন কৃষকের বোরো আহরণে নামার কথা শুনি তাদের জবানিতে।

হাওরে শ্রমিকদের সঙ্গে ধান কাটছিলেন গৌরারং ইউনিয়নের কান্দিগাও গ্রামের কৃষক আনিসুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আল্লা যুদি আশা ফুরায়, আমরা ধান কাইট্যা তুলমুই তুলমু। করুনাউরুনা আমাদের আটকাইত পারত না, আগে আল্লা বাদে।’ এখান থেকে সরে গিয়ে দেখি, আরেকটি খলায় পরিবারের লোকজন নিয়ে ধান শুকাচ্ছিলেন গৌরারং গ্রামের কিষাণী প্রমিলা দাস। তিনি বলেন, ‘আমরা এত কষ্ট কইরা ক্ষেতকিষ্টি করছি। এখন যুদি ধান না তুলি বাইচ্চাকাইচ্চা কি কইরা লালনফালন করমু। করোনা আইছে তো আমরা কি করমু। খাইতে অইব, বাঁচতে অইব। ইতার লাগি বাইচ্চাকাইচ্চা লইয়া সবাই লামি গেছি খলাত।’ দেশের অন্নযোগানদাতাদের কী করোনাভয় মানায়?

খরচা, জোয়ালভাঙ্গা, দেখার হাওর ও শনির হাওর ঘুরে দেখেছি এবার। প্রতিটি ধানখলাতেই এখন নারীদের প্রোজ্জ্বল উপস্থিতি। যারা সাধারণত ঘর থেকে বের হন না, গুরুজনের সামনে আসেন না, পর্দা করেন — তারাও ছুটে আসেন ধানের মায়ায়, ঘরের বউ-ঝি সন্তানসন্ততি নিয়ে। কিছু পুরুষও থাকেন। তবে বিভিন্ন বয়সের নারীদের সংখ্যাই বেশি। গ্রীষ্মের রগচটা সূর্যের খরতাপে ঘেমে নেয়ে বাহু ডুবিয়ে খড় শুকাতে দেন তারা। খলায় শুকাতে-দেওয়া ধানে নগ্ন পা ডুবিয়ে নাড়ছেন ধান। দু-পা ডুবিয়ে ধান নাড়া আর বাহু ডুবিয়ে খড় নাড়ার দৃশ্যগুলো অতিপ্রাকৃত অনন্য সুন্দর। কোমল পা ডুবিয়ে ধান নাড়ার দৃশ্যটি নুপুরের নিক্কণ বাজায় অনবরত। এই দৃশ্য দেখে যে-কোনো মুনিঋষির ধ্যান উবে যাবে মুহূর্তেই। ছায়াহীন খলাপ্রান্তরে সকালসন্ধ্যা এমন অনন্য দৃশ্য দেখা ধান আহরণের এই মওসুমে। শুধু গৃহস্থ গিন্নীরাই নয়, যে-শ্রমিককসকল ধান কাটেন তাদের ধানের ভাগ নিতে খলায় আসেন তাদের বউ-ঝিরাও। তারাও খলার কোণে চেয়েচিন্তে ধান শুকান। গফসপ করেন সংসারের খুটখাট বিষয়ে।

মহামারি করোনা তার দাপট দেখাচ্ছে বিশ্বকে। ভয়ে জড়সড় মানুষ বলতে গেলে এখন প্রায় বন্দি জীবনযাপন করছেন স্বেচ্ছায়। এই দৃশ্য দেশের প্রধান খাদ্যভাণ্ডার হাওরে বলতে গেলে প্রায় অনুপস্থিত। জীবনধারণের নিয়ামক কৃষক করোনাকে পাত্তা না দিয়েই বছরের আহার সংস্থানে নেমেছেন। বজ্রবৃষ্টি আর কালবৈশাখির চোখরাঙানিকেই তার যত ভয়। তাই দ্রুত ধান কেটে, মাড়াই শেষে শুকিয়ে গোলায় তুলতে রাতদিন পরিশ্রম করছেন তারা।

হাওরের ধানী জমির চেয়েও এখন সবচেয়ে ব্যস্ত ধানখলা। খলাগুলি কৃষকের প্রধান প্লাটফর্মে রূপ নিয়েছে। এখানে মওসুম শুরুর আগেই খলামাঠ পরিষ্কার করে গোবরমাটিতে লেপেমুছে ঝকঝকে তকতকে করেন ঘরনীরা। ধান আহরণ পর্যন্ত প্রায় মাসখানেক সময় প্রতিদিন সকালেই নিয়ম করে গোবরপানিতে শলার ঝাড়ু দিয়ে খলা লেপতে থাকেন। ধানখলার পাশেই একসময় সনাতন পদ্ধতিতে হালের গরু দিয়ে দীর্ঘসময়ব্যাপী মাড়াই করা হতো। সেই দৃশ্য আজ অনুপস্থিত। এখন এসেছে মাড়াইকল। ধানখলার পাশেই মাড়াই শেষে খলায় ধান শুকাতে দেওয়া হয়। অস্থায়ী খলাঘর তৈরি করে ধান তোলা শেষ হওয়া তক এখানেই থাকেন কৃষক। ধানখলাকে কেন্দ্র করে এ-সময় এক ভিন্নরকম জীবনযাপন করে কৃষক। বৃষ্টি, শিলা ও কালবৈশাখীর সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম করেন ধানখলার মানুষেরা এবং খলাঘরেই সময় কাটে তাদের। এ-সময় গৃহিণীদের কাজ বেড়ে যায়। বাড়ির কাজ সামলে বাইরের খলায় এসেও সময় দিতে হয়। শুকানো, নাড়া এবং মাথায় বহনের মতো ভারী কাজও করেন তারা। ঋণগ্রস্থ কৃষক এ-সময় থাকেন দুশ্চিন্তায়। কারণ মওসুমের শুরুতে সুদে ঋণ (লগ্নি) নিয়ে চাষাবাদ করেছিলেন। দাদনদারের পাকা কথা, খলা থেকেই ধান দিতে হবে। তাই দাদনের লোভী লোকজন লাল চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের চোখ হাঁটে খলায় খলায়। সেই লোভী চোখের চাহনি বিদ্ধ করে অসহায় কৃষকের বুক। তাদের সামন থেকেই অর্ধেক মূল্যে বস্তা বস্তা ধান নিয়ে যায় দাদনের লোকেরা।

হাওরে এই মওসুমে করোনাকে তোয়াক্কা না করেই দেশের অন্নসংস্থানের নিশ্চয়তার সংগ্রাম করছেন লাখো কৃষক। দেশবাসী দেখেছে ২০১৭ সনে হাওরডুবিতে কীভাবে দেশে হুহু করে চালের দাম বেড়েছিল। জাতীয় জীবনে এ-সময় সাংঘাতিক প্রভাব পড়েছিল। সরকার হাওরের দেড়লাখ চাষী পরিবারকে পাক্কা একবছর প্রণোদনা দিয়েছিল। ধান লাগানোর সময় বিনামূল্যে সার-বীজ দিয়েছিল। বহুদিন পরে সরকারও বুঝতে পেরেছিল হাওরের গুরুত্ব। তাই এবারও হাওরের জন্য ধানকাটার চারশতাধিক মেশিন দিয়েছে। ফসল রক্ষার জন্য ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। দুইদশক ধরে বাইরের শ্রমিক আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকসংকটে হাবুডুবু-খাওয়া কৃষক বিপাকে পড়েছিল। সরকার বিশেষ ব্যবস্থায় লকডাউনের মধ্যে বাইরের জেলা থেকে আরো সাড়ে-দশহাজার শ্রমিক নিয়ে এসেছে। তাই শেষ পর্যায়ে আছে এবারের ধানকাটা। কৃষি বিভাগের মতে ৩০ এপ্রিল জেলায় ৬১ ভাগ বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে।

হাওরজেলা সুনামগঞ্জে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পরিবার বোরোধান চাষের সঙ্গে জড়িত। এ-বছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হবে এই ধান থেকে, যা স্থানীয় চাহিদা ৫ লাখ মেট্রিক টন মিটিয়ে আরো উদ্ধৃত্ত থাকবে সাড়ে-আটলাখ মেট্রিক টন। সরকার কিছু কৃষকের কাছ থেকে ১ হাজার ৪০ টাকা মণ দরে মাত্র ২৫ হাজার ৮৬৬ মেট্রিক টন ধান কিনবে লটারির মাধ্যমে। এই লটারি ও কৃষক নির্বাচন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। প্রতি বছর ফড়িয়ারা সুবিধা নেয় কৃষকের নাম ভাঙিয়ে। স্থানীয়ভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধানসংগ্রহের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু সেই দাবি এখনো নিম্নকণ্ঠের পর্যায়েই রয়ে গেছে। নির্বাচিত কৃষককে অনেক দূর থেকে এনে শহরের গুদামে ধান দিতে হয়। এতে পদে পদে হয়রানির কারণে সুযোগ নেয় ফড়িয়া। স্থানীয় পর্যায়ে খলা থেকেই বিশেষ ব্যবস্থায় ধান সংগ্রহ করা হলে কৃষক ঠকত না, ফড়িয়ারাও পেত না সুযোগ। এবারও ধানচাল সংগ্রহে কৃষক ও মিলারদের বরাদ্দে বৈষম্য রয়েছে। মিলারদের কাছ থেকে ২৯ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। কৃষকরা বলছেন, খলা থেকেই ধান সংগ্রহ করা হলে প্রকৃত কৃষকরা উপকৃত হতেন। ফড়িয়ারাও সুযোগ পেত না। সংকটভীতি কাটিয়ে ওঠা সংগ্রামী কৃষকের নিম্নকণ্ঠের ডাক কে শুনবে?


হাওরের ধানখলা
আলোকচিত্রমালা


এই বিপর্যয়কালীন দুনিয়াজোড়া লকডাউনের সময় বৃহত্তর সুনামগঞ্জের হাওর-প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেশকিছু ধানখলার কর্মমুখরতার চিত্র তোলা গিয়েছিল। বর্তমান প্রতিবেদনের সঙ্গে সেই চিত্রগুলোর নির্বাচিত অংশের একটি গুচ্ছ সংযুক্ত রইল।  — শামস শামীম  ৩০.০৪.২০২০

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you