প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে একটি গোলাপ গোপনীয়
প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে মনে-মনে মাথায় হাত-বুলানো
প্রতিদিন ঘুমঢুলুঢুলু দয়িতাহাতের স্নেহে বিলি-কাটা চুলে
প্রতিদিন ঘুমঢুলুঢুলু দক্ষিণখোলা জানালায় চিবুকস্নিগ্ধ চাঁদ
প্রতিদিন ঘুমাবার আগে মেঘের বালিশে মাথা রাখা
প্রতিদিন ঘুমাবার আগে শুভরাত্রি-লেখা এক মেঘচির্কুট
প্রতিদিন ঘুমডাকার প্রাক্কালে কার্নিশে কাক-চিল ডেকে আনা
প্রতিদিন ঘুমেরই তো প্রয়োজনে দু-জনের গাঢ় ঝগড়াঝাটি
২.
বহুদিন হয়ে গেল, ঘুমের ভেতর কোনো স্বপ্ন দেখা হয় না রাত্তিরে। দেরি করে ঘুমালেও, খুব বনেদি নিদ্রারোগী হলেও, ঘুম আমার একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর নিখাদ নিঃস্বপ্ন। মাঝে মাঝে মনে হয়, এইটা কি কোনো অসুখ তবে? এই-যে একদম স্বপ্ন না-দেখা? যাকে বলে খোয়াব, যার জন্য খাবনামা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, তা আর দেখা হবে না বুঝি এ-জীবনে! ছেলেবেলায় তো খুব দেখতাম, খাব্, খোয়াব। সকালবেলা আম্মা খাবনামা খুলে সেসবের অর্থ তৈয়ার করে দিতেন। অমঙ্গলসূচক স্বপ্ন হলে কিছু সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ থাকত অবধারিত। খুব জটিল স্বপ্ন হলে, যেহেতু সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে আমার আম্মার আলাপ-পরিচয় ছিল না, রেফার করে দেয়া হতো ভোরবেলা আরবি-পড়াতে-আসা হুজুরের কাছে। খারাপ কোনো আলামত পেলে হুজুর মিয়াসাব শয়তানের অসোয়াসা থেকে তফাতে থাকার দোয়াকালাম পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতেন। বালামুসিবত থেকে দূরে রহিবার অফুরন্ত দোয়া আর অজস্র ফুঁয়ে ভরে আছে শরীর-গতর, তবু দুর্গতি পিছু ছাড়ল কই? কিন্তু খোয়াব আর দেখা হয় না আজকাল। কেন যে, কে জানে। অবশ্য, জেগে জেগে ব্যাপারটা এত দেখি, এত অনুশীলনচর্চা করি যে, ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন না-দেখার হতেও পারে এটা একটা কারণ। কিন্তু আগে-যে এত ভয়ের স্বপ্ন দেখতাম, দুঃস্বপ্ন দেখে নীল হয়ে যেতাম ঘুমের ভেতর, অন্তত তেমন কিছুও তো দেখা যেত! কই গেল ওই অশেষ টানেলের দুঃস্বপ্ন? কোথায় সেই নিঃসীম গ্রহান্তরে অ্যালিয়েনের দৃশ্যগুলো? ছোটবেলায় এইরকমই তিন-চারটে কমন দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁপে জেগে উঠতাম। স্যুয়িট ড্রিম তো দেখিই না, নাইটমেয়ারও উধাও হয়ে গেছে।
৩.
এই নিয়া কথা বলছিলাম আমার সহকর্মী শিল্পী সত্যজিৎ রাজনের সঙ্গে। সত্যজিৎ পেশায় একজন পেইন্টার, আঁকিয়ে, সৃজনোদ্যমী এবং চিন্তাভাবনায়-চলিষ্ণু তরুণ। সত্যজিৎব্যক্ত কথাগুলো অনুধাবনীয়, প্রণিধানযোগ্য। সত্যজিৎ রাজনের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘুমের ভেতর স্বপ্ন না-দেখাটা আলবৎ অস্বাভাবিকতা, একেবারেই নিঃস্বপ্ন ঘুম অসুখ তো অবশ্যই। জিগ্যেশ করি, ক্ষতিটা তাতে কী এমন? ক্ষতি কিছুই না হয়তো, তবে এইরকম স্বপ্নশূন্য নিদ্রাযাপনকারীদের হাতে তেমন বড় কোনো শিল্পসৃষ্টি সম্ভব হয়ে ওঠে না। জগতের সমস্ত মহান শিল্পস্রষ্টারা তাদের মহত্তর বড় কাজের বীজ পেয়েছেন খোয়াবে, বলেন সত্যজিৎ। শুনে আমিও কনভিন্সড। অসুবিধা নাই, শিল্পসৃজনে তেমনটা লালায়িত আমি নই, কিন্তু স্বপ্নে-পাওয়া ভারী কোনো গুপ্তধনের হদিস পেলে মন্দ হতো না নিশ্চয়ই। কিছু বছর আগে, মনে পড়ে গেল, একটা অটোবায়োগ্র্যাফি পড়ছিলাম এপিজে আব্দুল কালামের। ভারতের মশহুর বোমাকারিগর ও পরবর্তীকালে দেশটির রাষ্ট্রপতি চিরকুমার এপিজে আব্দুল কালাম। বইটির নাম সম্ভবত উইংস অফ ফায়ার । সেখানে একজায়গায় এপিজে আব্দুল কালাম বলছেন : তুমি রোজ রাত্তিরে ঘুমের ভেতর যা দেখো তা স্বপ্ন নয়, যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না তা-ই স্বপ্ন। সত্যজিৎ, না আব্দুল কালাম — কার কথা আমলে নেব আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
৪.
কিটস্ তার প্রেমিকা ফ্যানিকে চমৎকার সব নরম স্পর্শশীলা চিঠি লিখতেন। ততদিনে যক্ষা ধরা পড়েছে তার শরীরে, দেখে ফেলেছেন কাশির সঙ্গে উঠে-আসা লাল রক্ত থকথকে, পেয়ে গিয়েছেন তার নিজের ভাষায় মৃত্যুর পাসপোর্ট । কতকিছু পড়েছি একসময় কিটসজীবনের, কী মৃদু ও স্পর্শকাতর মানুষ এক! কবিতাগুলোও তো তেমনিই, এত নরম ও নাজুক! অর্নামেন্টেশন ও ক্রাফ্টসম্যানশিপের খানিকটা আধিক্য সত্ত্বেও নরম নাইটিঙ্গেলের মৃদুসুরেলা স্বর। ব্রাইট স্টার সিনেমায় কিটস্ এত প্রোজ্জ্বল! এত মৃদু ও মোমের মতো নরম ট্র্যান্সপারেন্ট এক কবির জীবন সিনেমায় তুলে আনা প্রায় অসম্ভব মনে করেছিলাম, সফলভাবেই সেইটা সম্ভব হয়েছে মনে হলো। প্রসঙ্গ আপাতত এ-ই যে, কিটস্ তার প্রেমিকা ফ্যানিকে একটি চির্কুট লিখেছিলেন : send me the words ‘good night’ to put under my pillow. আহা রে! শুভরাত্রিচির্কুট!
৫.
মনে পড়ছে একটা বই পড়েছিলাম ডিলান টমাসের জীবনভিত্তিক। সম্ভবত ফখরুজ্জামান চৌধুরী অনূদিত, অথবা সরাসরি অনুবাদ না-হয়ে নানা সূত্রের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সুবিন্যাস্ত কম্পাইলেশনও হতে পারে। ছোট্ট কলেবরের বই, ভালো লেগেছিল। মূলত কবি ও তার স্ত্রীর দাম্পত্যদিনযাপন ঘিরে আবর্তিত বইটি। কী বিভীষণ কলহসংঘাতী এক দম্পতিযুগল! বাপ রে বাপ! কাইটলিন টমাসের সঙ্গে ডিলান টমাসের জীবন যেন দুই মত্ত হস্তীর জঙ্গল-লণ্ডভণ্ড জীবন। ঘরভরতি ইয়ারদোস্তের সামনে স্বামী-স্ত্রীর তাণ্ডব, তুচ্ছ কথা এমনকি কোনো কথা ছাড়াই বিবাদ তুঙ্গস্পর্শা — পাড়াপড়শী মিডনাইটে জাগিয়ে, এর জ্যান্ত ও জান্তব বিবরণ রয়েছে বইটিতে। সেসব মামুলি দাম্পত্য কলহ-ঝগড়াফ্যাসাদ নয় মোটেও, অকথ্য খিস্তি-গালিগালাজ, অমানুষিক এককথায়। একটুও পুতুপুতু ঝগড়া নয় সেসব, খুনোখুনি-রক্তারক্তি নিত্যিদিন, মদমত্ত দুই শুঁড়-বাগানো হস্তী যেন। মদেও চুর থাকতেন দুজনে দিনরাত, মদে মানে সুরায় মত্ত, স্বামী-স্ত্রী সমানে সমান! কিন্তু এতসবের পরেও, হতবাক অথবা বিপন্ন বিস্ময় এই যে, একজন আরেকজনকে ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারতেন না! বহুবার তাদের ভেঙে-যায়-যায় সংসার বন্ধুদের স্তম্ভিত করে ফের মারামারি-রক্তারক্তিমত্ত রগরগে রঙ্গমঞ্চে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে। এইসবের বিবরণ রয়েছে বইটিতে। আর রয়েছে একের প্রতি অন্যের প্রেমে ও জিঘাংসায় ভরা বিস্ময়কর সমস্ত চিঠি। কী অদ্ভুত জীবন, কী বিচিত্র, কত অমীমাংসিত মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক! বইটির নাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না। দশকেরও বেশিকাল আগে পড়া বই। কিন্তু ডিলান টমাস সম্পর্কে গ্যুগল করে একটা মামুলি উইকি-ওভার্ভিয়্যু থেকেও ঘটনার সত্যতা আঁচ করা যাবে। এই কবির জীবনভিত্তিক সিনেমাটাও দেখেছি, কিন্তু খুবই যাচ্ছেতাই মেলোড্রামা হয়েছে সেইটা কবুল করতে দ্বিধা নাই। সিনেমার নাম ‘দি এজ অফ ল্যভ’। কিনারা অর্থে যেই এজ, প্রেমের বা ভালোবাসার কিনারা, কার্নিশপ্রান্ত। প্রভৃতি। কিরা নাইটলি অভিনয় করেছেন, আরও কে কে যেন। অতিনাটকীয়তার জাহাজ হয়েছে একখানা।
৬.
‘ব্রাইট স্টার’ দেখতে যেয়ে খেয়ালে এল যে এই কিটসের সঙ্গে এক বাংলা কবির খুব মিল। একই রকম নিয়তিবিড়ম্বিত দুইজনেই। লিখেছেন দুইজনেই নরম কলিজার কবিতা। হায়াতে যেটুকু ফেভ্যর করেছে দুইজনেরে, সেইখানেও অবাক-করা মিল। দুইজনেরই প্রেমিকাভাগ্য প্রসন্ন হলেও প্রণয় চরিতার্থ করবার স্কোপ মৌলা তাদেরে দেন নাই। কিটস্ যক্ষ্মায় গেলেন চলে তিরিশ হবার আগেই, ইন-ফ্যাক্ট পঁচিশে, এবং আশ্চর্য, প্রায় শতাব্দীর দূরত্বে এসে সেই বাংলা কবিটি তিরিশ হবার আগেই নিয়েছেন বিদায়। বাংলা কবিটির নাম আবুল হাসান, পৃথক পালঙ্কের কবি, ‘যে তুমি হরণ করো’ কবিতাবইয়ের কবি। লিভার স্ফীত হয়ে এই বিপুল দুনিয়া ছেড়ে গেলেন প্রাকতিরিশেই। স্টিল ফোটোগ্র্যাফগুলো যারা দেখেছেন আবুল হাসানের, তারা আরও জানেন যে কিটসের চেহারার সঙ্গেও বঙ্গীয় কবিটির ছিল অত্যাশ্চর্য মিল। স্বভাবেও। জন্মজন্মান্তর?
৭.
এত নরম করে মেইকিং হয়েছে ‘ব্রাইট স্টার’ সিনেমাটার যে একবার দুইবার তিনবার দেখতে ইচ্ছা যায় একেকটি সিক্যুয়েন্স। কবির জীবনে যখনই কিরণ দেখছি রোদের, পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াতেছে পাশে মেঘের ছায়া। কালো কুয়াশা। তারপরও কবি বাঁচতে চাইছেন। সূর্যালোকে ঘাসের ডগায় নাচতে চাইছেন। ফড়িঙের মতো হাসতে চাইছেন লাফায়ে লাফায়ে। এমনই পোজিটিভ অ্যাপ্রোচ তার জীবনের প্রতি। ঠিক এই কারণেই কান্ট্রিসাইডে যাওয়া। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জোর তোড়জোড়। মূল সিনেমা ওইখানেই। ইংল্যান্ডের অবারিত মগ্নলীন প্রকৃতির ব্যাপ্ত বর্ণচ্ছটা চারকোণা স্ক্রিন ছাপিয়ে উপচে পড়ে আমাদের চোখেমুখে। বেঁকেচুরে ভেঙে থেঁৎলে যাওয়া আমাদের জীবন সফল হয় ন্যাচারের নরম উদ্ভাস দেখতে দেখতে। ন্যাচারের তো স্বদেশ-বিদেশ নাই।
৮.
বিশ্বাসও করতাম না যদি কারো মুখে এই সিনেমার গল্প শুনতাম যে এইখানে কিটসের একেকটা বিশ্বজনপ্রিয় কবিতা কীভাবে লেখা হয়েছিল সেসব পর্যন্ত উপভোগ্য কায়দায় ক্যাপ্চার করা হয়েছে। এইটা সত্য। ঔড টু নাইটিঙ্গেল, ঔড টু মেলাঙ্কলি, ঔড অন অ্যা গ্রেশ্যান আর্ন। কবিতাগুলোর প্রায় প্রত্যেকটা পঙক্তি, প্রত্যেকটা স্তবক, লেখার সময়কার কসরত দুর্দান্তভাবে দেখানো হয়েছে। কিটসের কবিতালাইনগুলিই মনে হয় সিনেমায় ছিটিয়ে দেয়া।
৯.
কাইটলিনের দজ্জাল আর খন্ডার্নি অ্যাপিয়্যারেন্সটা আসে নাই ‘দি এজ অফ ল্যভ’ সিনেমায়। যেই পোসেসিভনেসের জন্য দম্পতিটা রাইতদিন কাউয়াতাড়ানো ঝগড়া-মাইরধইর করে যেত, এইসব খুবই অনুল্লেখের মতো ম্যুভিটায় পাওয়া যায়। ডিলান টমাসরেও পুরা বাংলা ছায়াছবির রোম্যান্টিক নায়ক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে বিবাহবহির্ভূত প্রণয়, ক্যাবারে ড্যান্স আর নাইটক্লাব, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের অভিঘাত ইত্যাদি কিছুই স্বাভাবিক সুতায় গাঁথতে পারেন নাই সিনেমাকার। কবিতা যারা পড়েন নাই জিন্দেগিতে, ডিলান টমাসের একটাও পঙক্তির লগে চেনাজানা নাই যাদের, ম্যে-বি তারাই সিনেমাটা অ্যাপ্রিশিয়েইট করতে পারবেন ক্রিটিক্যালি। কিন্তু তারা নিশ্চিতভাবে টেরই পাবেন না যে এইখানে এক কবির ক্রাইসিস নিয়া মামলা চালানো হচ্ছে।
১০.
ফ্যানি ব্রনরে পেয়েছি ঠিক ফ্যানি ব্রনেরই মতো। বইয়ের পাতায় এই স্নিগ্ধ প্রণয়িনীর চেহারা-হাবভাব যেভাবে দেখে এসেছি আমাদের যৌবনের দিনগুলায়, সেই ফ্যানিই সিনেমাবাহিত হয়ে এসেছেন আমাদের কাছে। সেই মায়া। সেই সকরুণ আশার উপর ভরসা। আবুল হাসানের জয়শ্রী জীবনের মুখখানি সিনেমায় না-দেখতে পেলেও জন কিটসের জীবনভেষজ প্রণয়িনীর সঙ্গে দেখা হলো আমাদের। আর দেখা হলো অপেক্ষার সঙ্গে, এক অপার অপেক্ষা। আবার আসব ফিরে, এই কথাটার চিত্রায়ন দেখা হলো। পরজন্মে এসে যেন তোমাকেই পাই। প্রিয় সুরাইয়া, লাবণ্যপাথরের শুশ্রূষাদায়িনী, পালঙ্কের শিয়রে দ্যাখো করুণ রোদনের পরে ব্যথাশান্ত প্রশমিত সেই প্রেমিকের মুখ!
জাহেদ আহমদ (২০১৩)
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS