ক্ষমতার সঙ্গ, সখ্য, লাভলোকসান ও শিল্পী সায়ান

ক্ষমতার সঙ্গ, সখ্য, লাভলোকসান ও শিল্পী সায়ান

প্রথম আলোসায়ানের সাক্ষাৎকারটা প্রচণ্ড সময়ানুগ। ক্ষমতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের জায়গা থেকে যে-কথাগুলো আসলে বলা উচিত, বলতে পারাটা পরম স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, সেগুলোই সায়ান বলেছেন এখানে। পরিস্থিতি এমন যে, স্বাভাবিক কথাগুলো আমরা এখন আর বলতে পারছি না। বলতে গিয়ে আটকাচ্ছে। গলার ভিতরে দলা-দলা কাশির বেগ টের পাচ্ছি। যদি-বা বলছি তার মধ্যে কথার কেরদানি থাকলেও সারবস্তু ও প্রাণ নেই। বলার নাম করে বিস্তর ত্যানা প্যাঁচানোই সার হচ্ছে কেবল! খুক-খুক কাশির সঙ্গে ইনিয়ে-বিনিয়ে জাস্টিফাই করছি ওইসব অনাচার যার মধ্যে থাকাটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। দেশটা পয়দা হওয়ার পর থেকে আমরা তো এসবের মধ্যেই আছি। দিনের-পর-দিন এভাবে টিকটিকির প্রাণ নিয়ে চরে খাওয়ার ধান্ধা ভীষণ বিপজ্জনক। সবকিছু গাসহা হয়ে যায় তখন। আমাদের যেমন হচ্ছে! বিভক্ত ও বিভাজিত হওয়ার বাইরে কারো কোনো বক্তব্য, শানিত ন্যারেটিভ নেই! না থাকার পরিণাম চোখের সামনে দেখছি সবাই!

সাক্ষাৎকারে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে সায়ান কবি-লেখক-শিল্পীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আসলে কবি-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী বলে কিছু নেই। এই মালগুলা নিছক রেটোরিক। সকলের মধ্যে নিজেকে পৃথক ও বিশিষ্ট জীব ভাবার চাপা পরিতৃপ্তি নিয়ে তেনারা  আমাদের চারধারে ঘোরেন-ফিরেন। নিজেকে বিশিষ্ট ভাবার অভ্যাস অথবা ক্ষেত্র যা-ই বলি, রাষ্ট্রসমাজ স্বয়ং করে দেয়। বোকাগুলোকে এভাবে খুশহালে রেখে রাষ্ট্র তার আখের গোছায়। যা-ই হোক, কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী নয় বরং নাগরিক মাত্রই তার নিজেকে সচেতন সাধারণ বলে গণ্য করুক। এতে চোখকান খোলা রেখে চারপাশকে নজরে নেওয়া সম্ভব। সায়ানকে আপাতত ওই দলের ভাবতে চাই। তো এই আপামর সচেতন সাধারণের (সায়ান তাদের একজন) কাজ একটাই হওয়ার কথা ছিল—ক্ষমতার সাথে না-থাকা। ফস্টিনস্টিতে না-জড়িয়ে তার কাজকারবার নিয়ে প্রশ্ন তোলা। সে যখন অনাচার ও অনিষ্টের কারণ হয়, তার খপ্পরে পড়ে অজস্র জখমের জন্ম হতে থাকে, ওইসব জখমের কারণ ও পরিণামকে ধরে-ধরে দেখানোই সচেতন সাধারণের দায়িত্ব বটে!

মাখামাখি বা ইনিয়ে-বিনিয়ে ক্ষমতাযন্ত্রে আসীন কাউকে বৈধতা দান কিংবা অন্য একজনকে যন্ত্রে ওঠানোর স্বপক্ষে গলাবাজি তার কাজ হতে পারে না। সোজাসাপটা কথায় সায়ান সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। কি করেছে তোমার বাবা, কি করেছে স্বামী, / গল্প সেসব তোমার চেয়ে কম জানি না আমি;—গানটি তো তাঁর যাত্রালগ্নে তিনি আমাদের গেয়ে শুনিয়েছিলেন। গানের ভাষায় সোজাসরল ক্রিটিক। চায়ের স্টলে বা ঘরের দেহলিজে মানুষ যে-কথাগুলো হরদম আওরায়, গিটার হাতে তাদের কাতারে দাঁড়িয়ে এরকম বলতে পারা মোটেও সহজ নয়। আটঁফার্টের বারোটা বাজার ঝুঁকি থাকে! সায়ান কিন্তু পেরেছিলেন, সকলে পারে না।

ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ সায়েব-বেগমদের মাস্তানী পৃথিবী জুড়ে চলছে রকমফের মেনে। এই ন্যারেটিভকে প্রশ্নবিদ্ধ কম করা হয়নি। অতীতে করা হয়েছে, এখন হচ্ছে, আগামীতেও হবে। এক ধরনের ক্লান্তি ও একঘেয়েমি আছে এখানে। নিস্ফল জেনেও এভাবে অবিরত রাষ্ট্রক্ষমতার মতো সামাজিক ঘটনায় নিহিত যত রাজনীতি, তার গলাপচা কাজকারবারের চাপে খোদ সমাজটাকে গুম হতে দেখা…ইত্যাদি নিয়ে ক্যাচাল, গিটার বা কলম অথবা অন্য কিছু নিয়ে নিরন্তর জঙ্গে থাকাটা একসময় বিরক্তি ও মন্দাবস্থা পয়দা করে বসে। এর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে মন চায়, তবু এই হলো একমাত্র পুঁজি, সেইসব মানুষের জন্য, যারা ক্ষমতার পা চাটতে নাচার। তারা কিছু বদলাতে পারে না কিন্তু যা চলছে তার গড্ডলপ্রবাহে গা ভাসাতে তাদের অন্তরাত্মা আপত্তি ঠোকে। কিছু করতে না পারার আক্রোশটা তখন পোড়ায়। সায়ানের গানে এরকম এক সক্রিয়তার রেশ কানে বাজে বৈকি। এই সক্রিয়তার আপাত কোনো সাফল্য নেই কিন্তু এটা ভীষণ দরকারি, এজন্য যে,—সবকিছুকে বৈধতা দিতে-দিতে আমরা কমবেশি নিজের কাছেই ক্রমশ অচেনা ও অবৈধ হয়ে উঠছি। — আহমদ মিনহাজ

ক্ষমতার সঙ্গে সখ্য শিল্পীর জন্য ক্ষতিকর : সায়ান


তাৎক্ষণিকামালা
গানপার ইন্টার্ভিয়্যু

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: