ক্রিশ্চিয়ান বেইলের অভিনয় প্রাণভরে দেখতে চাইলে এই ম্যুভিটা আপনে একটা ট্রাই দিতে পারেন। অবশ্য বেইলের অভিনয় বলতে আবার হাতপাও ছোঁড়াছুঁড়ির ধুমধাড়াক্কা মারদাঙ্গা টাইপের জিনিশ নয়, কিংবা নায়কের মতো মুচকা হাসি কি স্টাইল কইরা তাকানো বা কথা বলার সময় শ্রাগ করা এইসব কিছুই নয়, বেইলের অভিনয় যে কী নিরুত্তাপ নিস্তরঙ্গ অভিনয়হীন অভিনয় তা দেখতে চাইলেই শুধু স্ক্রিনের সামনে যুৎ হয়ে বসবেন। তবে বেইলের কথা বইলাই বিদায় নিলে আল্লা বেজার হবেন, অভিনয়ে কেউই কিন্তু মন্দ করেন নাই। ইন্ডিয়ান অ্যাপাচি ক্যারেক্টারের প্রত্যেকে, স্পেশ্যালি দি শামান, অ্যাস্টোনিশিং লো-প্রোফাইল থেকেছেন আগাগোড়া সিনেমায়। আর রোজ্যামান্ড পাইক? দুর্দান্ত, কুসুমিত ইস্পাত, বরফের ফুল যেন। প্রধান দুই ক্যারেক্টারই, ক্রিশ্চিয়ান বেইল এবং রোজ্যামান্ড পাইক উভয়েই, ইন্টেগ্রিটির দিক থেকে মনে রাখবার মতো।
ম্যুভিটার স্টোরি ডেভেল্যপ করেছে এইটিন-নাইন্টিটু পটভূমিকায়। আর্মি ক্যাপ্টেইন জোসেফ ব্লকার গাঁইগুঁই করে শেষমেশ রাজি হন চিয়েনি গোত্রপতি ইয়েলো হক্ এবং উনার ফ্যামিলিরে কাস্টোডি থেকে এস্কর্ট করে বাড়ি পর্যন্ত সহিসালামতে পৌঁছায়া দিতে। বিপদসঙ্কুল পথ দিয়া যাত্রা। টাইমও লাগবে মেলা। প্রায় ভাবলেশহীন আর্মিম্যান জোসেফ মধ্যবয়স-পারানো শক্তসমর্থ শরীরের চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। ম্যুভির শুরুতেই জিনিশগুলা আমরা জানতে পারি। জিম্মাদার জোসেফ শুরু করেন যাত্রা তার লটবহর নিয়া। যাত্রাপথেই সিনেমার বাকি ইতিহাস। গল্পের ভিতরে এসে ঢোকে উপগল্প। সবই সিগ্নিফিক্যান্স নিয়া আমাদের সামনে বিকাশ পায়। বিপজ্জনক টেরিটোরি দিয়া যাত্রাকালে থেমে থেমে জিরান নিয়া রাইত পোহায়, দিন আসে, গা ছমছম করে, কিন্তু খুব ধুমধাম বন্দুকযুদ্ধ হবে এমন মনে হলেও তা নয়, বিতিকিচ্ছিরি রক্তারক্তি কিচ্ছু হয় না, ছায়াছবির কালার বা জিয়োগ্র্যাফিক্যাল সেটিং দেখে তা-ই মনে হয় যদিও। ম্যুভিটার বিশেষত্ব এইখানেই। এইটা মানুষের একটা যাত্রার গল্প। বাড়ির দিকে যাওয়া শুধু। বাড়ি কোথায়? কতদূরে? শেষ পর্যন্ত যেয়ে কি পৌঁছা যায়, বাড়ি?
মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ গোত্রপতি আর তার ফ্যামিলিটারে নিরাপদে বাড়ি ফিরাই দিবার গল্প। অষ্টাদশ শতকের রুখোশুখো পাথুরে অ্যামেরিকা। ব্যাপক রইদ আর বিরান পর্বতভূমি। জনবিরল। জলবিরল। ওয়াইল্ড ওয়েস্টার্ন ম্যুভি ঘরানায় এইটা আলাদা মর্তবার ম্যুভি। ক্লিন্ট ইস্টউডের ম্যুভিগুলায় যেমন রুক্ষ প্রতিবেশের দেখা আমরা পাই, ঠিক সেই স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে ম্যুভিটা। আরও পরিস্কারভাবে। কেবল গানফাইটের হিসাব মাথায় রাখলে এই সিনেমা আলাদা বলিয়া গ্রাহ্য হবে দর্শকদের কাছে। এত পরিমিত ঢিশুমঢিশুম, বলতে গেলে শেষের ক্লাইমেক্স আর মাঝখানে একবার-আধবার ছাড়া ফাইট সেই অর্থে নাই-ই, ফলে এই ম্যুভি থম ধরায়ে রাখে দেখবার পুরা টাইমটা।
মাঝপথে দেখা হয় আরেকটা ফ্যামিলির লগে, সেই ফ্যামিলির সবাই অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ভায়োলেন্সের শিকার হয়ে নিজেদের নয়া বাড়িতেই নিহত হয়, কেবল বেঁচে থাকে একজন নারী, যিনি আমাদের সিনেমার নায়িকা বলতে পারি, ট্র্যাডিশন্যালি হিরোয়িনরা যা করে থাকে তা না করেও উনি হিরোয়িন, উনিই রোজ্যামান্ড পাইক। স্বামী ও দুই সন্তান হারাইবার ট্রমা নিয়া পাইকের অভিনয় এত অবিশ্বাস্যভাবেই বিশ্বাসযোগ্য যে, প্রায় দেড়-বছর আগে দেখা ম্যুভি এখনও চোখে লেগে আছে আমাদের।
ক্রিশ্চিয়ান বেইলের চরিত্রে এমন একটা দার্ঢ্য ও সুস্থির শীতল সঙ্কল্প, বেল তা চারিত্রিক বিশ্বস্ততা সহ ফুটিয়েও তুলেছেন দুর্ধর্ষভাবে। রোজ্যামান্ড পাইকের ক্যারেক্টারে আমরা পাই ট্রমাতাড়িত এক সর্বস্বখোয়ানো নারীর শান্ত প্রতিশোধস্পৃহা, আমাদের মাথার ভিতরে এই স্পৃহার রেশ রয়ে যায় সিনেমা শেষ হবার অনেক পরে অব্দি। গোত্রপতির চরিত্রটায় ওয়েস স্টুডি বরাবরের মতো সাবলীল। উনারে এই ধরনের ক্যারেক্টারেই সিনেমায় দেখি আমরা। পাহাড়ি দৃঢ়তা আর দার্শনিক উদাসীনতাময় একটা সারল্য উনার চেহারায় আছে জন্মগত উত্তরাধিকার হিশেবেই। দেখেই মনে হয় এই লোক অনেক লড়াইয়ে পোড়-খাওয়া মানুষ। খুবই আন্ডারটোন অভিনয় প্রত্যেকেরই।
নিউ মেক্সিকো ধরে মন্টানা যাওয়ার গল্প নিয়াই সিনেমা। রাস্তার দুই দিককার দৃশ্য মহাকাব্যিক, বাংলায় যারে বলা চলে এপিক। বহুদিন বাদে এমন এপিক ওয়েস্টার্ন নৈসর্গিকতা আমরা প্রাণভরে দেখে উঠলাম। আর আঠারো শতকের বুনো অমানুষিক অমানবিক অ্যামেরিকা ছায়াছবিটিতে চিত্রায়িত হয়েছে এমনভাবে যে দেখে মনে হয় আমরা একুশ শতকে না, আঠারো শতকেই আছি। অবশ্য ২০১৯-এর বাংলাদেশ সেই আঠারো শতকের খুনতৃষ্ণ লুম্পেন আগ্রাসী হত্যামুখর বুনো অ্যামেরিকারই একটা টাইপ। এইটা অবশ্য সিনেমায় বলা হয় নাই। ভালো সিনেমা তো সেইটাই যা আমাদেরে আঙুল তুলে দেখায়ে দেয় না, গাইধড়ের মতো চিল্লায় না, ভাবায় এবং ভাবতে বাধ্য করায়। নিউ মেক্সিকোর কর্কশ চারপাশ, উন্মত্ত জন্তু কোম্যাঞ্চি রেইডারদের নৃশংস রক্তলালসা, মাটি দখলের মদমত্ততা ইত্যাদি কিছুই তো বর্তমান বাংলায় গরহাজির বলা যাবে না। খালি অ্যাকশন ঘরানার বাংলা ছায়াছবিগুলা মাথাওয়ালা স্মার্ট ডিরেক্টরের হাতে পড়ার অপেক্ষায়।
এইটিন সেঞ্চুরির অ্যামেরিকায় ‘মারো অথবা মরো’ পন্থায় বাঁচতে হতো। ল্য অ্যান্ড অর্ডারের অবস্থা আজকের বাংলাদেশের মতোই ছিল। প্যুলিসের আর কোর্টকাচারির দ্বারস্থ হলেই বরং মরা ত্বরান্বিত হবে। ধুকে ধুকে অমর্যাদার মরা। আগে মারতে পারলেই বরং পরে মরবে তুমি, নীতি ছিল এই-ই। আমাদের দেশের সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন সিরিজ পেপারব্যাক সাহিত্যের মধ্যস্থতায় সেই বনুয়া অ্যামেরিকা ভালোই চেনা আমাদের। এই সিনেমায় সেই স্মৃতি চাগিয়ে ওঠে বেশ।
তবে একটা কথা হাল্কাভাবে বলা যায় যে এই সিনেমা যা দেখায় তার বাইরে নিয়ে যেতে সেভাবে পারে নাই। কিছু খোলাসা করতে গেলে বলতে হয় যে অ্যামেরিকান শাদা আধিপত্যশীল সাম্রাজ্যলোলুপ রক্তপায়ীদের অকল্পনীয় অন্যায় আর আগ্রাসন-রাহাজানির দিকে এই সিনেমাতেও স্পষ্ট আঙুল তুলতে দেখি না আমরা। পাশ্চাত্য বুনো ম্যুভিগুলোর এই দোষের বা জাতীয়তাবাদী গুণের চরিত্র এইখানেও বহাল।
সিনেমায় প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ক্রিশ্চিয়ান বেইল এবং রোজ্যামান্ড পাইক। ওয়েস্টার্ন ঘরানার ম্যুভি দেখতে যারা লাইক করেন তারা তো দেখবেনই, যারা লাইক করেন না তারাও এই সিনেমাটা দেখতে পারেন। মনে হয় কেউই সিট ছেড়ে উঠতে চাইবেন না সিনেমা খতম দিবার আগ পর্যন্ত। ছবিটার নাম ‘হোস্টাইলস্’। ২০১৭ সালের ম্যুভি। ডিরেক্টেড বাই স্কট ক্যুপার।
Movie-title: Hostiles ।। Released in 2017 ।। Genre: American Western film ।। Written and Directed by Scott Cooper, based on a story by Donald E. Stewart ।। Stars by Christian Bale, Rosamund Pike, Wes Studi, Ben Foster, Stephen Lang, Jesse Plemons, Rory Cochrane, Adam Beach, Q’orianka Kilcher, Timothée Chalamet and Scott Wilson
লেখা : মিল্টন মৃধা
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS