আরআইপি, রিশি!

আরআইপি, রিশি!

কপুরদের ফ্যামিলি ট্রি ঠিক কত উঁচা আর আড়েবেড়ে মেলান-ডালপালা ঠিক কতটা, মানে রেডিয়াস কতটা, আন্দাজ করতে যেয়ে দেখলাম হুদা ট্রাই। চিনি তো অনেকেরেই আমরা। ভারতীয় ম্যুভিপিপলদের স্টলোয়ার্ট  প্রায় সবাইকেই নামে এবং কামে চেনে বাংলাদেশের আমজনতা। ব্যাপারটা ইন্ট্রেস্টিং। তবে ব্যাখ্যেয়। বুঝায়া বলা যায়। বিশেষত কর্মক্ষেত্রে ইংলিশস্পিকিং কোনো ফরেন সহকর্মীকে এই কথাটা আমরা চায়ের আড্ডায় যখন বলি, চোখে অবিশ্বাস ঠিকরায়। পরে যখন সপ্রমাণ বলিউড হাজির করি ফরেনারের সামনে, সেইসঙ্গে হলিউডও, যে আমরা তাদেরে চিনি এবং তাদের কাজ দেখি ও গভীরতর খোঁজখবরও রাখি, বিশ্বাস করলেও বিস্মিত রয়েই যায়।   হাউ কাম! — এমনতর বিস্ময়বিপন্ন বিদেশিদেরে আমরা তখন অভয় দিয়া বলি যে বাংলাদেশে শুধু নয়, বাঙালিদের মধ্যে একটা ব্যাপার দেখা যায় যে এদের জেনারেল নলেজ অনেক বেশি। নিজেদের ঘরের খোঁজখবর যতটা না রাখি তারচেয়ে বেশি রাখি প্রতিবেশীর খোঁজ। ও, আই সি — বিদেশির চোখজোড়া কপাল থেকে ফের যথাস্থানে নেমে আসে।

কিন্তু ভুল বলি। কিংবা আসল কথাটা বলি না। বাঙালি নিজের ঘরের খবর ঠিকই রাখে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই রাখে, এরপরও অগাধ তার খবরের সাধ। বুঝতে হবে যে তার ঘরে আছেটাই-বা কী! শিকেয় তোলা খানিক গব্য ঘৃত, দুইতিনখানা নাড়ুবাতাসা আর হাঁড়িতে দুইটা চালসেদ্ধ ও একটাকিছুর লম্বা সুরুয়া। মালসামান এইটুকু লইয়া বাঙালি যে সারাক্ষণ লুঙ্গিনৃত্য করে না তাতেই আলহামদুলিল্লা। নাইলে উপায় ছিল? ভুরুঙ্গিনৃত্যের ঠাপে ব্যাটাদের জিনিশপত্র খসে পড়ত শইল্লের মাঝভাগ থেকে! অ্যানিওয়ে। অ্যাজ অ্যা রেজাল্ট বাঙালি তার নেইব্যরের দিকে তাকায়, হাতে একটু টাইম থাকলে আরেকটু পাড়া বেড়াইতে তার মন চায়। নিজের খবর রাখে না, বা নিজেরে জানো ধরনের আপ্তবাক্য সে জানে না বা আমল করে না, ব্যাপারটা আদৌ ট্রু না। যা আছে, যেটুকু আছে, কড়ায়গণ্ডায় ক্যাল্কুল্যাশন তার ফিঙ্গারডগায়। আমাদের ঘরের ভিতর সিনেমা নাই বলেই পরের সিনেমার খোঁজপাত্তা আমাদেরে রাখতে হয়। আদিকাল থেকেই তা আসতেসে চলে। এই কারণেই হিল্লিদিল্লি, হলিউডবলিউড। অথচ হুদা আমরা বুদ্ধিজীবীগিরি মারাই যে আমরা নাকি কলোনিয়্যাল  না কীসব মাইন্ডসেট নিয়া খাইদাই ঘুরে বেড়াই। কিন্তু তবু কবুল করি না যে আমরা খামাখা নিজেদেরে নিয়া মিথ্যাচার করি, বিদেশিদের কাছে বড়াই করে বেড়াই, নিজেদেরে মিছা বুঝাইতে চাই যে এভ্রিথিং ইজ ঠিকাসে। হ্যাঁ, এই মিথ্যাচারটা ছাড়া, জাতিগত এই ফল্স্ প্রাইডটা ছাড়া, বাকি সবই ঠিকাসে।

আমাদের সিনেমা নাই। দ্যাটস্ হোয়াই হিরোয়িন নাই হিরো নাই। ফিল্মডিরেক্টর নাই ফিল্মপ্রোডিউস্যর নাই। মিথ্যাচার না করে বেহুদা দেশাত্মবোধ না দেখায়ে এই জিনিশটা কনফেস্ করে নিলে এদ্দিনে ম্যে বি সিনেমাটা খাড়ায়ে যেত। কপুর খান্দানের মতো হয়তো-বা আমাদেরও এদ্দিনে একটা বা কয়েকটা ডাইন্যাস্টিই গড়ে উঠত। ম্যুভিপরিবার ও পরম্পরা গড়ে উঠত। বর্তমানে স্বামীস্ত্রী ভাইবিরাদর মিলে টেলিকমেডি বানানোর ধুমটাকে এই একটা কারণে সাপোর্ট করি আমি। সিনেমা বানাইসি, বিদেশে অ্যাওয়ার্ড পাইসি, ইত্যাকার মিথ্যা প্রবোধে নিজেরে এবং দেশের মিডিয়ারে এবং দেশবাসীরে ঠকাইলেও সপরিবার হাস্যবিদূষণের এই টিভিবিচিত্রা বানাইবার পথ ধরে একদিন আমাদেরও কপুর-খান্না-খান মুগালদের মতো লম্বা পারিবারিক সিলসিলা গড়ে উঠবে। দেশের ভিতর তখন হয়তো দুইয়েকটা ছায়াছবিও হবে।

ক্যান্সার হয়েছিল রিশি কপুরের। উইকিপৃষ্ঠায় ক্যজ অফ ডেথ লিখিয়া রাখে দেখি। কিন্তু পরিণত বয়সে মৃত্যুর তো কোনো কারণ না হলেও চলে। দেখলাম গত শতাব্দীর, এবং সহস্রাব্দেরও, বায়ান্ন সনে উনার জন্ম হয়েছিল। তার মানে আটষট্টি বা প্রায় সত্তরছুঁই গিয়েছেন বেঁচে। বেশি না, বাট ফেয়ার এনাফ। উনার ফিল্মোগ্র্যাফি স্ক্রল করে দেখে গেলাম গ্যুগল সার্চইঞ্জিনে। দেখলাম অনেক উনার অভিনীত ম্যুভি পিচ্চিবেলায় দেখেছি, কিন্তু মনেই ছিল না। বাবা-কাকার সঙ্গে দেখা ভাড়ার ভিসিয়ারে সেইসব সিনেমা। আমরা যখন স্কুলে পড়ি, শ্রীদেবীজির সঙ্গে উনার ‘চাঁদনি’ হিট হয়েছিল খুবই। বিশেষত ছবির গানগুলা। আজও ঠোঁটস্থ আছে অ্যাট-লিস্ট একজোড়া গান। উনার ক্যারিয়ারের প্রায় ডেব্যু ম্যুভি ‘ববি’। ডিম্পল কাপাডিয়ার ডেব্যু তো অবশ্যই। এই সিনেমাও বহুবার বাড়িতে ভিডিয়োক্যাসেট এনে দেখা হয়েছে। এছাড়া আরও যত সিনেমা আপনি রিশিফিল্মোগ্র্যাফি নেড়েচেড়ে দেখতে পাবেন, গত শতকের সেই সিনেমাগুলার বেশিরভাগই হিট।

নব্বইয়ের দশকে উনার ক্যারিয়ার পড়তির দিকে, ফ্যাট জমেছে গায়ে-মুখে, বয়সের শ্যাওলা আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে দেখা যাচ্ছে। সেইসময় একই জিনিশ দেখা যাচ্ছিল অমিত-মিঠুনদের ক্ষেত্রেও। তবু মধ্যবয়স-উপচানো শরীরেও উনারা নায়কের লিড পাচ্ছিলেন, করছিলেন, মোটামুটি। কিন্তু নব্বইয়ের লেজের দিকটায় একঝাঁক নয়া নায়কনায়িকা এসে বলিউড দখল করে নেয়। স্ক্রিপ্ট থেকে স্টার্ট করে মেইকিং মার্কেটিং সব সেক্টরেই চেইঞ্জ এসে যায় রাতারাতি। রিশিদের যুগ অবসিত হয়। এরপরও রিশি জীবনের শেষ পর্যন্ত ম্যুভিতেই কাজ করে গেছেন। দাদু ইত্যাদি রোলে একটা আলাদা ম্যানারিজমই ছিল তার। খুব জলি। ইয়াং রিশির মতো সদা হাসিখুশি বৃদ্ধ রিশিজি। গত বছরও কোন সিনেমায় যেন উনারে দেখলাম, মনে পড়ছে না নামটা সিনেমার।

শুধু উনারে তো নয়, উনার বাপেরে চিনি, রাজ কপুর, উনার বাপের বাপ প্রিথ্বিরাজ কপুর, উনাদের প্রত্যেকের অভিনয় আমরা দেখেছি। উনার ছেলের নাম আর নাই-বা আনলুম মুখে। মেয়েরা আনবেন। উনার স্পাউস্ নিতু সিং, অভিনয়শিল্পীই, লিড নায়িকা ছিলেন সেভেন্টিসের বেশকিছু ম্যুভিতে। এই ফ্যামিলির প্রায় সবাই, চাচাতো ফুপুতো পিসতুতো খুড়তুতো মাসতুতো ঘাসতুতো সমুদ্রতুতো, ফিল্মি লাইনেরই লোক। ফুঁয়ে উড়াবার মতো নয়, ঘাগু সকলেই। কাজেই কীর্তন শুরু করি না আর হুদাহুদি। কপুর ফ্যামিলি ইন হিন্দি সিনেমা লিখে তল্লাশি দিন, গলগলিয়ে বেরিয়ে আসবে ফ্যামিলির নাড়িভুঁড়ি।

জিগ্যেশ করা হয় নাই কোনোদিন, উপায় নাই আর জিগ্যেশ করবার, রিশি হয়তো আমার আব্বার ফেব্রিট অ্যাক্টর ছিলেন, হয়তো-বা আম্মার ড্রিমকাস্ট, আমার পূর্বনারী পূর্বপুরুষদের অনেকেরই দিল-কো-টুকড়া ছিলেন হয়তো তিনি! কাজেই, এই লোকগুলা আমাদের বাইরের তো নয়, রাজ্জাক-রহমান-ওয়াসিমের মতো, আপনজনই।

বিদায়! আরআইপি, রিশিজি!

লেখা / সুবিনয় ইসলাম ৩০ এপ্রিল ২০২০

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you