কিন্তু সবাইকে দিয়ে সবকিছু তো হয় না, আমাকে দিয়ে যেমন অবিচুয়ারি। লিখতে চেয়েছি, ইরফান, বিদায়বাক্য অত্যন্ত ব-কায়দা আপনার জন্য। বদনসিব যে আমি কবি নই, শায়ের নই, চিত্রী কিংবা সাংবাদিক নই যে একখোঁচায় এঁকে ফেলব অঘ্রান ও অন্যান্য সমস্ত সিজন্যাল অনুভূতিমালা। আমি শুধু বলতে পারি যে আমি লিখতে চেয়েছিলাম। আমি শুধু বলতে পারি আই উইশ! যদি পারতাম, ইরফান, অবিচুয়ারি লিখতে! অ্যাট-লিস্ট নিজের জনদের নিয়ে এক-দুইটা আদরফোটা বাক্য! প্রণয়জ্ঞাপক পঙক্তি থোড়া-সা! আই উইশ আই ক্যুড প্যে ট্রিবিউট টু য়্যু!
সকালে ফেবুকবিদের স্ট্যাটাসগুলাতেই নিউজটা পাই। কিন্তু অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল অসুখটার খবর। কবে যেন অসুখটা নিয়া খানিক গ্যুগল করে জেনেও নিলাম কি কি সব তথ্য। মনে নাই এখন আর। অসুখের কথা মনে রাখি না আমি। অসুখ মনে রাখতে নাই। সুখ মনে রাখতে হয়। অসুখের নিকট নত হতে নাই। সুখের নিকট নত হতে হয়। হ্যাপিনেসের নিকট নত থাকতে হয়। নতজানু হতে হয় সুখের কাছে। গ্রেইটফ্যুল থাকতে হয়। যারা সুখী করে, যারা সুখ বিলায়, হ্যাপিনেসের কারবারি যারা, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হয়। কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় প্রকাশ্যে। কেবল নিজের বাপমায়ের প্রতি ইন-পাব্লিক কৃতজ্ঞতা জানানো প্রহসনমূলক। রক্তজ্ঞাতিদের প্রতি প্রকাশ্য কৃতজ্ঞতা জানানো কেন প্রহসনমূলক, ইরফান, তা আজ না, আরেকদিন বলব।
ভুগছিলেন কয়েক বছর ধরেই বিগত। অসুখটা নাকি বিরল। অসুখের কথা তো কইব না আগেই মিউচুয়াল সমঝোতা করে নিয়েছি। মৃত্যুর কথাও নয়। মৃত্যু তো রয়েছেই। পিছে পিছে প্রতিমুহূর্ত প্রতিপলে এই মৃত্যু। অতএব মৃত্যু নিয়া আলাদা আলাপের কোই জারুরাৎ নাহি। জীবনের কথা বলি। বিরলপ্রায় জীবনের কথা বলি। সিনেমা ও সব্জিতে যে-জীবন তরতাজা, আতাগাছের পাতার মতোই গ্রিন যে-জীবন, সম্পন্ন গৃহস্থের মতো সোনালি যে-জীবন, শালপ্রাংশু অরণ্যের মতো সবুজ যে-জীবন, অনর্গল অবিরল অনবরত সেই জীবনের কথা ভাবতে চাই দেখতে চাই শুনতে চাই বলতে চাই বলেই আপনার সঙ্গে আমার খাতির হয়েছে। সেজন্যে এক্সট্রা আদবকায়দা দরকার হয় নাই, তোয়াজ করতে হয় নাই আপনারে, কিংবা আমারেও আপনি বৃথা ফ্যান বানাইবার কসরত করেন নাই, কেননা আপনি নিশ্চয় জানতেন যে জ্যান্ত মানুষের ফ্যানবেইস হয় না, জ্যান্ত মানুষ সচল সর্বদা, আজ ভালোবাসে কেউ তো পরদিন মন্দবাসে, এরই ভিতর দিয়ে নিজের কাজটা করে যেতে হয়, নিজের এবং অপরের জন্য পথটা সাফ করে যেতে হয়, কেটে যেতে হয় প্রশান্তিপুকুর। য়্যু হ্যাভ ডান ইট, ব্রো, ওয়েল ডান!
তিন-তিনটা খানের সালতানাতে এসেছেন আপনি, দেখেছেন, জিনে নিয়েছেন। বিনা আয়াসেই যেন জয়। খানকিংডম আপনার সঙ্গে কেউ কোনোদিনও তুলনায় আনবে না; যারা আপনাকে স্মরণ করবে তারা তো বাজারি বাঁটু নয়, তারা জিন্দেগিবিবেচক, তারা সব্জি ও সিনেমার সমুজদার, তারা জানে এবং জানবে চিরকালই যে ইরফান খান বাজারি ইমেজের খান নন। ইরফান খান মাচো নটরাজ নন। ইরফানের খানদানি টিকাইতে যেয়ে খ্যামটা নাচতে হয় নাই তারে একবারও, সুপারহিরোগিরিও করতে হয় নাই, ইরফান খান ইজ অলোয়েজ অ্যা নেইম অফ নর্ম্যালসি। ইরফানের পাশে যে-নায়িকাকে দেখেছি যখনই, সেই নায়িকার গুণপনা খুঁজে বের করেছি ঘেঁটে ঘেঁটে। কেবল একটা জায়গায় ব্যর্থ হয়েছি, সেইটা বাংলাদেশের এক নায়িকা। খানজি অভিনয় করেছিলেন ‘বাংলাদেশি ইন্টার্ন্যাশন্যাল’ এক সিনেমায়। সেই সিনেমা আমি আস্ত গলাধঃকরণ করতে পারি নাই, জিন্দেগিতে পারব বলেও ভরসা পাই না, যেমন আমি লিলা বান্সালির দেব্দাস কোনোদিনও পুরা দেখতে পারি নাই, বিরক্তিতে দেহ অব্দি বিদ্রোহ করে বসে, এমন হয়, এমন তো হতেই পারে। সবকিছু তো আর মাই কাপ অফ কফি হবে এমন কোথাও বলা নাই।
ট্রিবিউট জানাইতে চেয়ে বেশকিছু বইয়ের নামধাম নোট নিয়া রাখসিলাম। রোজারমজানের দিন, গ্লুকোজের সাপ্লাই কম হওয়ায় একটানা হাত চালানো যায় না কিবোর্ডে, ব্রেইন খুব-একটা সাপোর্ট দেয় না বাক্যবুননের কাজে। সেজন্য হোমেইজ জানাইবার সদিচ্ছা সত্ত্বেও উপস্থিত পরিস্থিতিতে কেবল বলে রাখি যে চেয়েছিলাম লিখতে একটা ভালোমতো শ্রদ্ধাগদ্য। নৈবেদ্য তর্পণ করব ভেবেছিলাম আপনার অভিনীত শিল্পকাজগুলোর নামাবলি জপে। এ-যাত্রা হলো না। বাদ-ইফতার যদি সিজিলমিসিল করতে পারি, লেট’স্ সি। কিন্তু মোটামুটি আপনার অভিনয়-করা প্রায় বেবাক বইপত্রই দেখেছি খিয়াল করলাম। শুধু ওই বাংলা-আন্তর্জাতিক স্বামীস্ত্রীসিনেমা আর ধরেন আরও গোটা-পাঁচেক হবে ম্যে বি মিসড আউট। মুক্তিপ্রতীক্ষায় ‘আংরেজি মিডিয়াম’ দেখবার বাসনা জানায়া রাখলাম বন্ধুর কাছে, যে আমারে অবৈধ উপায়ে নেট থেকে ম্যুভি কালেক্ট করে দ্যায় নিয়মিত। রোজারমজানে শুধু নয়, অর্ডিন্যারি দিনেও অবৈধ-অনৈতিক কোনো কার্যকলাপ আমারে দিয়া হবার নয়, আমি অন্যরে দিয়া করায়া নিই। মাবুদ তুমি মাফ করিও।
ম্যুভিগুলা ভাল্লাগত, সত্যি, ইরফান, ভুয়া বলিউডটারে যে-কয়জনের কারণে ভাল্লাগে আপনি তাদের একজন। তবে একমাত্র নন, হুদা তেলাইব কেন আপনারে বলেন? আপনি বলিউডগ্রেইটদের একজন। আসলে আপনার স্ক্রিনপ্রেজেন্স বলিউডের চিহ্ন ইরেইজ করে ফেলত লহমায়। আপনার উচ্চারণে একটা বাধো-বাধো বোল, হাল্কা স্ট্যামারিং, হিন্দি লব্জে একটু গেঁয়ো এক্সেন্ট আনা, আপনার আর্লি ডেইজ থেকেই নোটিস করেছি চেহারায় একটা ক্লান্তিশ্রী, কিছুটা ম্লানিমা যে মানুষকে কেমন বিউটি দিতে পারে এর একটা নজির হিশেবে আপনারে হাজির করেছি ইয়ারবখশি আড্ডায়, আপনার ফোলা-ফোলা আঁখিজোড়া অসুখবিসুখের অনেক আগে থেকেই নিয়া যাইত অশ্রুনদীর সুদূরপারে আমারে, যেখানে দেখতে পেতাম দি বিউটি অফ অদ্ভুত উদাসীনতা। আপনি ছিলেন বলিউডের ভিতরে একটা আলগ হাওয়া।
আপনাকে একটা ট্রিট দিতে চেয়েছিলাম, ইরফান, য়্যু ডিজার্ভ ইট, ম্যান! অ্যাট-লিস্ট একটা ট্রিবিউট! হলো না। আমাদের দেশে, আমাদের দুনিয়ায়, একটা ক্রান্তির সময় কাটাচ্ছি আমরা, দেখেই তো গেলেন। কি মনে হলো, টিকব তো আরও কিছুদিন? আমি না টিকি, আমার প্রণয়পুষ্পটি যেন টেকে। আমি না বাঁচি, আমার বসুন্ধরা যেন বাঁচে। আমি মরি দুঃখ নাই, কিন্তু আমার মনের মানুষেরা যেন বাঁচে। কিন্তু, হায়, আমি মরে গেলে আমার মেয়েটির প্রথম স্কুলযাত্রা কে দেখবে? মহাচিন্তায় আছি, আমার মৃত্যুর পরে আমার আত্মীয়দেরে যদি দুর্ভোগ পোয়াতে হয়! কিন্তু আগেই বলেছি মৃত্যুর কথা নয়, ইরফান, স্যরি, মৃত্যুর কথা থাক। আসুন, জীবনের কথা বলি। সিনেমার কথা বলি, আসুন। সব্জি ও শোলক-বলা শালিকটির কথা বলি। কিংবা লার্জার দ্যান লাইফ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি স্ক্রিন অন্ধকার করে।
দেশেবিদেশে পত্রিকাগুলা আপনারে ট্রিবিউট জানাইতেসে দেখে এলাম লাফায়ে লাফায়ে। এত তথ্যের সমারোহ! কত তথ্য জানে দ্যাখো দুনিয়া! আর তথ্যের দাঁড়িপাল্লা-বাটখারায় মেপে নেয়া মানুষের মহাযাত্রা, মহাপ্রস্থান, মহাজীবনের জড়োয়া গহনারাজি! কিন্তু তবু তারেই তো ট্রিবিউট বলে জানে দুনিয়া। আই উইশ!
পরিশেষেপ্যারাগ্রাফটা লিখবার টাইম এসে গেল বোধহয়। অ্যাট লাস্ট, পরিশেষে, একটা দুঃখের কথা বলি। সিনেমাহীন একটা দেশের মানুষ আমরা। আমি যদি লিখতে পারতাম তবে একটা বই প্রকাশ করতাম ‘যে-দেশে সিনেমা নাই’ শিরোনাম দিয়া। আমরা সাহিত্যে এবং সিনেমায় পরমুখাপেক্ষী। শখে না, বাধ্য হয়েই। কিন্তু কবিতা লিখি আমরা। কোটি-তিনেক কবি আছে এই মুহূর্তে দেশে। এরা সকলেই নিজের কবিতার ভাষা পায়া যায় ফেব্রুয়ারি এলে, কেউ নয়া গ্রাম বানায়, কেউ শহর, কেউ মহাবিশ্ব বানায়া বাজারে ছেড়ে ক্রেতাভোক্তা পুঁছে দেখে না বলে রাগে গজগজায় আর খিস্তি করে বেড়ায় স্ট্যাটাসে স্ট্যাটাসান্তরে। কিন্ত সিনেমা নাই। সিনেমাছাড়া রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা ফলে ইচ্ছামাফিক সিনেমা বানায় রাষ্ট্রীয় মসনদে আসীন হয়া পাব্লিকেরে চাবকায়া চাবকায়া। আমি সিনেমাহীন ভূখণ্ডের বাসিন্দা। ভূমণ্ডলে বিরল এমন সিনেমাহীনতার নজির। মামা-ভাগ্না আলমগীর কবীর আর তারেক মাসুদের নাম আনবেন তো? ওই তো। নুরুল আলম আতিক? শুরু হইয়াও হইল না, জিন্দেগি গইয়া যায়। তাছাড়া গাদাগুচ্ছের ভাইবিরাদর, তৌকির-সৌদ গংদের গাবরগিরি, ছি ছি, সিনেমার কথা বলতে লেগে এসব কেন? ড্রপ ইট। ফলে বিদেশি সিনেমায় আমাদের বেড়ে-ওঠা, যাপন ও যৌবন উদযাপন আমাদের, প্রৌঢ়ত্বের জাবরকর্তন। মধ্যে মধ্যে বলিউড। এইভাবেই চিনপরিচয় আমাদের, খাতিরদারি, এবং অবিচুয়ারি লিখতে যেয়ে ব্যর্থ হওয়া।
টাইমটা আপনি তো আর বাছিয়া নেন নাই, নিলে বলতাম এইটা বাছাই হিশেবে ব্যাপক নিন্দার্হ সময়। এই সময়ে মরতে নাই। ইট’স্ নট অ্যা গ্যুড চয়েস্, ব্রো! নট অ্যাট অল্! আপনি তো মরেনও নাই, মরেছেন? ওয়েইক আপ, ইরফান, লাইভে আসেন! লোকে দেখতেসেন না মরে পচে যেতেছে চাদ্দিকে, আর খালি লাইভে যাচ্ছে, রাইতদুপুরে সুবেসাদিকে দুপুরে বিকেলে লাইভে যাচ্ছে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে বেশুমার কাতারে কাতার। লাইভে আসেন, ইরফান, লাইভে আসেন! ইট ইজ্ টাইম টু গ্য ফর লাইভ ওনলি, নাথিং এল্স্! জীবন যখন শুকায়া যায়, লাইফে নয়, লাইভে যাবার আওয়াজটাই দিকে দিকে ভেসে বেড়ায় দেশগ্রামে দখিনা হাওয়ায়। আমিও কিবোর্ড থেকে হাত উঠায়া লাইভে যাব এবার। লাইভে আসেন, ইরফান, গেট অ্যালাইভ!
নো, ব্রো, স্ক্রিনে নয়, বক্সঅফিসে নয়, লাইফে এবার শুরু হোক লীলা, প্লেজার! হ্যাপি জার্নি!
লেখা / সুবিনয় ইসলাম ২৯ এপ্রিল ২০২০
… …
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS