গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা

গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা

গোপালটিলা আবাসিক অ্যারিয়ায় একটা বাড়ির ছাদে খ্রিস্টবছরের পয়লা মাসের শেষলা ভাগে একটা আসর বসেছিল সংগীতের। কোভিড-নাইন্টিন প্যান্ডেমিকের আউটব্রেইক কুড়িকুড়ি খ্রিস্টাব্দের গোড়া থেকে গেঁড়ে বসা, যাইবার নাম নাই, লকডাউন উঠে গেলেও সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং জারি রাখবার একটা ব্যাপার আছে। বাস্তবে এতটা না থাকলেও সরকার ও রাষ্ট্র সোশ্যালাইজেশন অত মোটিভেইটও করতেসে না। কাজেই শীতকাল এসে বিদায় নিবার লাগলেও কন্সার্ট ইত্যাদির নামও নিতেসে না কেউ। ধুমায়া লাইভ হচ্ছে ফেসবুকে, লাইভের ধুলায় আন্ধাইর অবস্থা ভার্চুয়াল বাংলাদেশের।

এরই মধ্যে নেমন্তন্ন জুটে গেল গোপালটিলায় গানসন্ধ্যায় যাবার। মরণের ডর নাই, কিন্তু জীবনের লালসা আছে। লেলিহান লকলকে জীবনের লোভ, রগরগে ভবসংসারের লালচ, লাস্ট ফর লাইফ। ফলে ফিজিক্যালি ম্যুভ করা আদৌ উচিত হবে কি না, গ্যাদারিং তো হবেই এবং ছোঁয়াছুঁয়ি নিশ্চয় অ্যানাউন্স করে এড়ানো যাবে না, সাতপাঁচ ভাবছিলাম। ফাইন্যালি অর্গ্যানাইজারদের তরফে জানানো হলো যে তেমন ভিড়-হুড়াহুড়ি হবে না। গান করেন এমন মানুষজনই থাকবেন শুধু। উৎসাহিত হলাম আরেকটা কথা শুনে যে এইখানে যারা গাইবেন তারা সকলেই নিজেদের রচনা নিয়া হাজির হতে যাচ্ছেন।

গেলাম। মুখ দিয়া সমানে ধোঁয়া বাইরায় এমনই শীত। ফির্ফিরায়া কাঁপতেসি শীতে। এমন শীত মস্কোতে-লেনিনগ্রাদে পড়লে আপত্তির ছিল না। বা, অ্যালাস্কায়। রাশান ভদকা নাই যেই দেশে, সে-দেশে এত শীতের তজল্লা ভাল্লাগে না। আমাদের দরকার নাতিশীতোষ্ণতা। না-গর্মি, শীতও নরম। জিনিশপত্রের দিক দিয়া হার্ডশিপ আমাদের সঙ্গী। কিছু করার নাই সহসা। আয়োজকদের তরফ থেকে এক্সক্লুসিভ একটা ইভনিং উপহার দিবার ব্যাপারে এককাৎরা গাফিলতিও নজরে ঠেকে নাই। কিন্তু ঘাপলাটা লাগসে অন্যত্র। সংক্ষেপে সেইটা বলেই বিদায় নিব, কুয়্যিক।

উৎসাহিত হয়েছিলাম যে-কারণে যেতে যে একদম ঘটিগরম গানবাজনা শুনতে পাবো, স্বরচিত সুর ও কথাগুলা গাইবেন শিল্পীরা, তা হয় নাই। অনুষ্ঠানে পার্ফর্ম করেছেন সব-মিলায়া আট/নয়জন আর্টিস্ট। কেউ একটা, পাঁচটা কেউ, দুইটা কয়েকজন। তবে গানগুলা বাজারের, যারা গাইসেন তাদের নিজেদের রচনা তা নয়। ভিন্নতা এক্সপেরিয়েন্স করা গেছে একজনের বেলায়, তিনি অসীম দাস। অসীম গোটা-পাঁচেক গান গেয়েছেন গিটার বাজায়া, গানগুলা তার নিজের কম্পোজিশন। ‘লোকালয়’ নামে একটা গানদল আছে তার, জানা গেল। যদিও উয়িদাউট হিজ ব্যান্ড একলা পার্ফর্ম করেছেন তিনি এই ইভেন্টে। ব্যান্ড সম্পর্কে একটু পোঁছতাছ করব তমন্না থাকলেও শো শেষে শিল্পীর কাছে ঘেঁষতে পারিনি। যেমন হয় আর-কি, শিল্পীদেরে ঘিরে-রাখা ভক্তবেষ্টনী ডিঙায়া সান্নিধ্যলাভ সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

অ্যানিওয়ে। কেমন গেয়েছেন অসীম দাস? সচরাচর সিঙ্গার-স্যংরাইটারদের ক্ষেত্রে যেমনটা হতে দেখি আমরা, তা-ই হয়েছে অসীম দাসের ক্ষেত্রেও। খুঁত ধরবেন কেমন করে, যেহেতু স্বয়ং রচয়িতা গাইছেন! কম্যান্ড ওভার দ্য অডিয়েন্স এবং কন্ট্রোল ওভার দ্য রেন্ডিশন ছিল প্রশংসার্হ। খুবই মিনিম্যালিস্ট অ্যাপ্রোচের গিটারিং। অত্যন্ত ট্র্যান্স একটা আবহ তৈয়ার হয়েছিল অসীম গান করবার সময়। কিন্তু অসীম দাসের গলা খুবই খাদে খোলতাই হয় দেখা গেল, চড়া কালোয়াতি শিল্পীর মধ্যে একেবারেই গরহাজির, ফলে একটা আলগ মনোনিবেশ শুরু থেকেই ড্র করে এই কিসিমের কণ্ঠ। প্রোনান্সিয়েশন ধরতে একটু নয় বেশ ভালো বেগ পোহাতে হয়েছে লিস্নারদের। তবে এতে শিল্পীর কসুর অল্প। অর্গ্যানাইজাররা সাউন্ডব্যবস্থা যা রাখসেন তার বাইরে যেয়ে বেশি কিছু করা পার্ফর্মারদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। আপ টু দ্য স্ট্যান্ডার্ড সাউন্ড ছিল না আয়োজনে। হ্যান্ডি একটা ব্যবস্থায় বসতভিটার ছাদে যেমনটা আয়োজন সম্ভব তার সেরা আর মার্জিত অংশটা আমরা হাজির পেয়েছি ইভেন্টের সর্বত্র।

অনুষ্ঠানে আরও যারা গাইসেন তাদের মধ্যে কনক আচার্য উল্লেখযোগ্য। কনকের সাধা গলা। অ্যাপিয়ারেন্সও অতি শিল্পীসুলভ, গিটার প্লে করেন ভালো, সবকিছু মিলিয়েই ইম্প্রেসিভ। গোটা চাইর/পাঁচেক গান করলেন কনক দুইটা পৃথক স্পেলে। বেইসিক বাংলা গানগুলা যা আমরা আদিকাল থেকে যেভাবে শুনে আসছি ইউটিউবে, একদম নোক্তাসমেত হুবহু কনক গাইলেন গলগল করে। এতটাই নিরানন্দ, নিস্তরঙ্গ, মূলের প্রতি বিশ্বস্ত ও শক্তসমর্থ অনুসরণ কনক করেছেন যে অবাক হতে হয়। একটা লালন তো কানে লেগে আছে এখনও।

শুরুতে, ঠিক শুরুর প্যারায় না-হলেও থার্ড প্যারাগ্র্যাফে, একটা ঘাপলার উল্লেখ করসিলাম। ঘাপলাটা এ-ই, আস্ত অনুষ্ঠান জুড়ে একটা জিনিশই থেকে থেকে মনে হচ্ছিল যে, কী রে বাবা, কী তামশা, ইউটিউবের আসরে বসে আছি নাকি! নিশ্চয় ক্ল্যাপ্স কাউন্ট করে একটা সাংগীতিক মজমার মর্তবা মাপতে গেলে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পপুলার নাম্বারগুলার ভার্শন রেন্ডার হয়েছে এবং তা আপ-টু-দ্য-মার্ক। কিন্তু মন তো মাঙ্গে মৌর, থোড়া-সা আননৌন-আনজানার লগে মুলাকাত-মুসাফা না-ই যদি হইল তবে এমন মরণ উপেক্ষা করে মেহফিলে কেন যাওয়া?

যা হয়েছে তা হয়েছে। অ্যানিওয়ে।  যা হয়েছে ডেফিনিটলি ভালো হয়েছে। এই ইভেন্টে আরও গান করেছেন বিমান তালুকদার, সন্ধ্যার শুরুতে ব্রতচারী গুরুসদয় দত্তের ভজনাশ্রয়ী উদ্দীপনাজাগানো জোড়া-গানের পরিবেশনা স্পার্ক ছড়ায়েছে অনুষ্ঠান-মহরতের মুহূর্তে। এরপর প্রদ্যুত দাসও গোটা-কয় গান গেয়েছেন সুন্দর। প্রদ্যুতের সঙ্গে এবং অন্যান্য অনেকের সঙ্গেই দ্বীপ দাস কখনো খমক কখনো কাহন বাজিয়ে গেছেন স্বতঃপ্রণোদিত স্ফূর্ততায়। কিন্তু অনেক জায়গায় খমক ও কাহন উভয় বাদ্যের চড়াগ্রাম বাদন গানশ্রবণে একটু হলেও অস্বস্তি তৈরি করেছে। এছাড়া গান গাইসেন সরোজ কান্তি। সরোজের গানগুলো স্বসৃজিত। প্রচুর বাগ্মিতা আর দেশ ও দশের দুশ্চিন্তায় ভরা আশাকরোজ্জ্বল বিপ্লবের ভাষাভরা গান। মন্দ নয়, মাহমুদুজ্জামান বাবুর কথা মনে পড়ায়া দ্যায়। গান গাইসেন আশফাক, রেডিয়োহেডের সফট-মেলোডিক ইংলিশ একটা নাম্বার। ওয়েল রেন্ডার্ড। পূজা তালুকদার ও তৃণা তালুকদার স্বতন্ত্র পরিবেশনায় চমৎকার গান করসেন। এর মধ্যে তৃণা গাইসেন অর্ণবের গান, মাইন্ডব্লোয়িং। অ্যামেচারিশ গায়নের যা-কিছুই বিউটি তা পুরামাত্রায় ছিল উনার পার্ফর্ম্যান্সে। আরেকজন অতিথি শিল্পী, পুরুষ, একজোড়া গান গাইসেন তার নিজের। উনি ইলেক্ট্রিক গিটারে এত সময় নিসেন চেক-রিচেক করতে যেয়ে, এবং সাউন্ডও তখন এতই ডিস্টার্বিং ছিল যে একবর্ণও বোঝা যায় নাই গানের মাথামুণ্ডু। বাণীপ্রধান/বাণীনির্ভর গানের বাণীটাই যদি না-পশিল কর্ণকুহরে, তখন তো মুশকিলেরই জিনিশটা। আর অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বেখাপ্পা পার্ফর্ম্যান্স করসেন মিঠু তালুকদার। উনার গলাটা গানোপযোগী হলেও বহুকাল রেওয়াজের অভাবে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থা তার গায়নসামর্থ্যের। পুরা অনুষ্ঠানে এই অংশটাই ছিল কল্পনাতীত লাউড ও জেশ্চার ইত্যাদি সব মিলায়া আস্ত গ্রস।

সন্ধ্যাটার আয়োজনকারী  মিঠু তালুকদার। উনারই নিবাসের ছাদে চমৎকার সন্ধ্যাটা সাধিত হয়েছে ২০২১ জানুয়ারি এন্ডে। এমন আয়োজন কি দ্বিতীয়বার হবে এবং তখন প্রথমবারের গ্রস মিস্টেক ও আনপ্ল্যানড অকারেন্সেস এডিট করে আরও উৎফুল্লকর নয়া গানের অনুষ্ঠান করা যায় কি না ইত্যাদি প্রসঙ্গে নবীন ব্যবসায়-উদ্যোক্তা ও ‘ইকোইট’ ভেঞ্চারের স্পোক্সপার্সন মিঠু তালুকদারের লগে একটু কথা বলা গেল অনুষ্ঠানের এক ফোকরে। উনি আশ্বস্ত করলেন উয়িদিন অ্যা শর্ট-হোয়াইল এই-সংক্রান্ত কতিপয় ফিউচার প্ল্যান উনারা ড্রাফট করতেসেন এবং অচিরে তা অ্যানাউন্স করবেন।

আশ্বস্ত হওয়া গেল। অর্গ্যানাইজারদের দিক থেকে অনুষ্ঠানে সমবেত শিল্পী, কলাকুশলী ও অভ্যাগতদেরে আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি পাওয়া যায় নাই। নম্রভদ্র পানীয় তথা বাংলাদেশের বেভারেজ কোম্প্যানির সফট ড্রিঙ্কস্ ছিল অপরিমেয় পর্যাপ্ত। রসগোল্লা আর পলান্ন তো ছিলই। বিউটিফ্যুল।

অনুষ্ঠানের অ্যাঙ্কর বা প্রেজেন্টর, পুং, গোটা আয়োজনে বেশ ভজকট পাকায়ে ফের উৎরে গেসেন বলা যায়। বেচারারে একেবারেই অপ্রতিভ লাগতেসিল। হতে পারে যে পার্ফর্মার কারোর ফিচার না-জানা থাকায় এমন ঘাপলা। তা, হতে পারে। যেমন খুশি তেমন সাজো যেমনে ইচ্ছা তেমনে গাও অনুষ্ঠানে প্রেজেন্টর তো মুখ্যও নয়। হ্যাঁ, তা-ই।

সিলেটের গোপালটিলায় এমন একটা ছাদসন্ধ্যা, গান ও আগুন পোহানোর এমন নান্দনিকতা, আগত সকলেই নিরঙ্কুশ অ্যাপ্রিশিয়েইট করসেন। আর ক্যাম্পফায়ারের চারধার ঘিরে সান্নিধ্য ও সাহচর্যের এমন সুন্দর সন্নিহিতি নিয়মিত হোক চাইতেসিলেন সকলেই।

ফিরতে ফিরতে রাত বারো পারায়া গেসিল সেদিন।

বি.দ্র.  অনুষ্ঠানের কোনো ভিশ্যুয়্যাল বা ফটোগ্র্যাফ কালেক্ট করা যায় নাই।

লেখা : সুবিনয় ইসলাম

… …

সুবিনয় ইসলাম
Latest posts by সুবিনয় ইসলাম (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you