রুনা অ্যানেকডোট্যাল

রুনা অ্যানেকডোট্যাল

ঘুমাইবার সময় উনারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়, কেননা ভারত বলেছে বাগে পাইলে উনার গলার রগ কেটে নেবে। কেন? গলার রগ কেটে নেবে কেন? গবেষণা করে দেখবে এমন সুরেলা গলা কেমন করে হলো। ওদের দেশে এমন একটা গানকণ্ঠী নাই বলেই ওরা রুনা লায়লাকে অ্যাবডাক্ট করে নিয়ে যেতে চেয়েছে বহুবার, রুনাকে ওদের নাগরিকত্ব দিতে চেয়ে বহু সাধ্যিসাধনা করেছে, এমনকি দুই সরকারের মধ্যে নাকি ডিপ্লোম্যাটিক বৈঠকও হয়েছে! রুনা লায়লা তাইলে তো বাঁচবেন না! হায় আল্লা! হ্যাঁ, সেইজন্যেই তো ঘুমাইবার সময়ও উনারে কেয়ার্ফ্যুল থাকতে হয়, ইন্ডিয়া এসে যদি গলার রগ নিয়া যায়!

আমাদের ছোটবেলায় এই কিচ্ছাটা প্রায়ই শুনতাম এবং বিশ্বাসও করতাম। রুনা লায়লার গলা ভালোবাসতেন আমাদের আম্মা-চাচিআম্মা আব্বা-চাচারা। আশির দশকের শেষদিকটায় বা নব্বইয়ের গোড়ায় টেলিভিশন গাইড নামে একটা ম্যাগাজিন মোটামুটি সব বাড়িতেই রাখা হতো। কবে এবং কখন কোন অনুষ্ঠান টিভিতে টেলিকাস্ট করবে সেইসব তথ্য ও সময়সূচি থাকত পত্রিকাটায়। একদিন দেখা গেল ঘোষণা এসেছে যে রুনা লায়লার একক গানের অনুষ্ঠান প্রচার করবে বিটিভি। বিশ্বাস-অবিশ্বাস মেশানো গলায় বাড়িতে এই ঘোষণার বাস্তব সম্ভাব্যতা নিয়া আলাপ হবার সময় শুনেছি যে রুনা লায়লা তো বিদেশে থাকেন, কাজেই লাস্ট মোমেন্টে টিভির সামনে বসে দেখা যাবে ‘অনিবার্য কারণবশত পূর্বঘোষিত রুনা লায়লার একক সংগীতানুষ্ঠান প্রচার করা যাচ্ছে না বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত’ বলবেন সহাস্য টেলিভিশনঘোষক তার মাইঞ্জা-মারা টাইটফিট উচ্চারণে। এমন ঘোষণা তারা ঘনঘনই দিতেন অবশ্য।

সমস্ত জল্পনাকল্পনার শেষে নির্ধারিত দিনে রুনা লায়লার একক অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হলো। অনুষ্ঠান চলাকালীন এবং পরবর্তী কয়েকদিন আমাদের গার্জিয়ানদের আহা-উহু উল্লাস মনে পড়ে এখনও। উনার পরে এমন আর-কেউ নাই শিল্পীভুবনে, আগে আছেন দুই-তিনজন বলতেন তারা; যেমন, ফেরদৌসী রহমান, শাহনাজ রহমতুল্লা বা আরও দুইয়েকজন। রুনা আলাদা সবার চেয়ে। এইটা তারা বলতেন, যদিও বুঝতাম না আমরা আলাদাটা কোথায়। সেই অনুষ্ঠানে যে-গানগুলো রুনা গাইলেন তার মধ্যে “শিল্পী আমি / তোমাদের গান শোনাব / তোমাদের মন ভরাব” গানটা রুনাজি নেচে নেচে গেয়েছিলেন এবং উত্তাপ ছড়িয়েছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠমহলে। এছাড়া ‘যখন থামবে কোলাহল / ঘুমে নিঝুম চারিদিক’ গানটার কথা আমার মনে আছে। পাঁচটা নাকি আটটা গান গেয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে আজ আর তা মনে নাই। কিন্তু অনুষ্ঠানটা প্রায় ঈদেই পুনর্প্রচার করত, মোহামেডান-আবাহনীর খেলার আগে-পরে-ফাঁকে এই অনুষ্ঠানের গান দিয়াই ফিলার প্রচার করত। আম্মা-চাচিআম্মারা বারান্দা বা পাকঘর থেকে দৌড়ে এসে টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন ও শুনতেন। মনে পড়ে এই দৃশ্যগুলো।

রুনা লায়লা সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা আমরা শুনতাম সেগুলো কতটা হাইপ-তোলা আর কতটা সত্যি তা তো ওই বয়সে বের করতে পারি নাই। শুনতাম যে রুলা লায়লা বাংলায় কথা বলতে পারেন না। তাইলে বাংলায় গান গাইতে পারেন কেমন করে? উনাকে নাকি ইংরেজিতে গানের কথাগুলো লিখে দিলে উনি ঠিকঠাক উচ্চারণে গানটা ডেলিভারি দিতে পারেন। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি যে এইটা আসলে একটা টেক্নিক, উচ্চারণের টেক্নিক, রিসিভড প্রোনান্সিয়েশন বা আরপি বলে এই টেক্নিকটাকে। এবং উনার সম্পর্কে আরও শুনতাম যে উনি বিদেশেই থাকেন বছরভর। কোন দেশে? এই তো, পাকিস্তানের করাচি আর ইংল্যান্ডের লন্ডন শহর মিলিয়ে ভাগবাটোয়ারায় থাকেন। চুক্তিমতো অনেক দেশে যেয়ে গেয়ে দিয়া আসেন গানটা। আজকে উইকিপিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি যে উনার জন্ম সিলেটে এবং শৈশব-কৈশোর কেটেছে পাকিস্তানের লাহোরে। এরপর উনি বিয়াশাদি করেছেন তিনবার এখন পর্যন্ত, প্রথমবার সম্ভবত পাকিস্তানি একজনকে, পরেরবার স্যুয়িস এক নাগরিককে এবং থার্ডটাইমে বাংলাদেশের দীর্ঘদেহা নায়ক আলমগীরকে। উনি বাংলা ছাড়াও দুনিয়ার বহু ভাষায় কথা বলতে পারেন, শুনতাম ছোটবেলায়। এখন উইকি জানাচ্ছে যে উনি হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু, বাংলা ছাড়াও দুনিয়ার আঠারোটা ভাষায় দশহাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।

রুনা লায়লা ‘দামাদাম মাস্ত কালামদার’ গানটার জন্য খুব ওভাররেইটে খ্যাত বলেই মনে হয়েছে সবসময়। এই গানটারে উনি মনে হয় ড্যান্সফ্লোরের মজামাস্তির গানই মনে করেন। অথচ ব্যাপার তো উল্টা। অ্যানিওয়ে। এখনও মঞ্চে উঠেই তিনি বিশালদেহে দামাদাম মাস্তি শুরু করে দেন যা দেখে মনে হয় উনি উর্দুটার উপরেও অবিচার ছাড়া আর-কিছু করতে পারছেন না। যা-হোক, আমাদের মা-বাপের জেনারেশন ওই মাস্তিতেই মজেছিলেন কি না জানা যায় না। ছায়াছবির প্লেব্যাকে রুনার গলার আবেদন সত্যি তুলনারহিত, আউটস্ট্যান্ডিং।

সর্বশেষ ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে একটা সিনেমায় লিড রোলে অভিনয় করতে যেয়ে এর নায়ক আলমগীরের সঙ্গে উনার সখ্য হয়। ‘শিল্পী’ নামের ওই সিনেমায় তিনি নামভূমিকায় এবং স্বীয় পেশায় অভিনয় করেন। নতুন শতকের শুরুতেই নায়ক-নায়িকা/গায়িকা গাঁটছড়া বাঁধেন বাস্তবে। আলমগীর তার প্রাক্তনী খোশনূরকে ছেড়ে রুনার সঙ্গে ম্যারেজসূত্রে একছাদে থাকতে শুরু করেন। খোশনূরজিকে আমরা একজন গীতিকার হিশেবে ক্যাসেটযুগের অ্যালবামকাভারে দেখতাম হামেশা। আজকাল আর দেখি না। আঁখি আলমগীর খোশনূর-আলমগীর দম্পতির সন্তান। রুনারও আগের তরফা তানি লায়লা গানটান করেন বোধহয়, আঁখির মতো অত পরিচিতি জুটে নাই যদিও।

রুনাজি থিতু হন বাংলাদেশে শেষ বিবাহের পর থেকে। না, ভারত উনার রগ কেটে ল্যাবরেটোরিতে নেয় নাই, কিন্তু গলা ব্যবহার করেছে বেশকিছু সিনেমায় এবং অ্যালবামে। সেগুলোর মধ্যে বেশকিছু শুনেছি আমরা বড় হতে হতে। ‘ট্যালেন্ট’ আছে উনার গলায়, এইটা আমরা বলাবলি করেছি ইশকুলে-আড্ডায়। আজকে এই বয়সে এসে পেছন ফিরে দেখছি যে উনার স্টাইল, উনার ফাঁপানো চুল, উনার আঁটোসাঁটো ড্রেসআপ, উনার লিপস্টিক, উনার ঠোঁট সুঁচালো করে জিভভঙ্গি ইত্যাদি নিশ্চয় আমাদের আম্মা-খালাম্মাদের কাছে স্টাইল-স্টেটমেন্ট ছিল! উনার বুনো চোখ-নাক আর অঙ্গুলিনির্দেশে-অনিচ্ছুক দেহবাঁক আমাদের বাবা-কাকাদের কাছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আকারে এসে মেস্মেরাইজ করে যেত অনুমান করি।

লেখা : মিল্টন মৃধা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you