বক্সিং ও বাংলা কবিতা

বক্সিং ও বাংলা কবিতা

আচমকা রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে মেষগণনা বাদ দিয়া মোহাম্মদ আলি নিয়া ভাবছিলাম। উনি বিদেহী হয়েছেন জেনে, — ০৩ জুন ২০১৬ উনি প্রয়াতের খাতায় নিবন্ধিত হয়েছেন বলিয়া আখবারে প্রকাশ, — একটু রোমন্থনের সুযোগ অতএব লওয়া যাউক।

সবই তো বোঝা যাইল। কথা হচ্ছে, এর সঙ্গে, মানে বক্সিঙের সনে, বাংলা কবিতার জোড় মিলাইলেন ক্যামনে? ও আচ্ছা, শিরোনামের কথা বলছেন তো? হুম! আজ্ঞে, এইটার সার্থকতা প্রতিপন্ন করার দায় আমার না।

আসলে একটা ছায়াছবি দেখতে যেয়ে আলিজীবনী ফিরে ফিরে মনে পড়ছিল। হিন্দি সিনামা। ‘সালা খাড়ুস্’ (Saala Khadoos) সেই সিনামানাম। বক্সিং নিয়া আখ্যান আবর্তিত। সুন্দর সিনামা বলা যায়। ম্যাসালা ম্যুভি বলেন বোধহয় ম্যুভিলিটারেইট লোকেরা। খানিক উল্টানো-থোঁতা তাচ্ছিল্যই ক্রিয়া করে এহেন বলাবলিকালে। অ্যানিওয়ে। ক্যাটিগ্যোরিক্যাল কম্পার্টমেন্টে ঢুকায়ে ব্যাপারটার তুল্যমূল্য বিচারসালিশের দিকে আমরা খামাখা হান্দাচ্ছি না। হাল্কা চালে, পল্কা স্পিডে, দেখি কদ্দুর চলা এবং চালানো যায়। ফি আমানিল্লা।

মাধবান ভালো করেছেন বরাবরের মতো, উনার এস্টাব্লিশড রোম্যান্টিক মিষ্টি ইমেইজ্ একটা আছে, সেই ইমেইজ্ থেকে বেরিয়ে এখানে একদম অভাবিত অন্যরকম মনে হয়েছে তাকে। মেয়েটা, যার নাম টাইটেলকার্ডে দেখলাম ঋতিকা, মার্ভেলাস্ পার্ফোর্ম করেছে। এত অল্প বয়সের একটা মেয়ে! সেই সিনেমায়, যেহেতু বক্সিং নিয়া ছায়াছবি, বিভিন্নভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে এসেছে আলিকথিকাগুলো। অনুপ্রেরণাপ্রদ আলিলাইফবেইসড অ্যানেকডোট্যালগুলো। কোচ ক্যারেক্টারটার দার্ঢ্য যথেষ্ট শক্তির সঞ্চার করে যেতে পেরেছে গোটা কাহিনিতে। এবং স্লামগার্ল ফিশমাঙ্গার চরিত্রে ঋতিকার অসাধারণ স্টাবোর্ননেস্।

saala khadoos

অ্যানিওয়ে। সেখানে, সেই সিনেমায়, বেশকিছু সংলাপ আছে যেইগুলা আমার লাইফে, — ম্যে বি আপনার লাইফেও, — মনে রাখার মতো হতে পারে বলিয়া বিবেচ্য। নকআউট বিষয়ে একটা সংলাপ যেমন। কোচ একটা-পর্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে বলে যে, শ্রেণিদ্বিভাজিত সমাজে নিচের লোকেরা উপরের লোকেদের সঙ্গে কোনোদিনই পয়েন্ট আর্ন করে জিততে পারবে না, জিততে পারবে এক্কেবারে শুইয়ে দিয়ে, মানে নকআউট করে। কিংবা আরেকটা জায়গায় চেঙ্গিস খান বিষয়ে একটা ব্যাপার ভারি ইন্ট্রেস্টিং মনে হলো। সমস্তই কিন্তু সংলাপবাহিত হয়ে এসেছে, এসে মরমে পশেছে। চেঙ্গিস খান মনে করতেন দুইজন সোলজারের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় না, আদতে যুদ্ধটা হয় দুই অস্ত্রের মধ্যে। অতএব যুদ্ধে জেতার জন্য সৈন্য কতল করার চেয়ে জরুরি হচ্ছে এনিমিপক্ষের অস্ত্র অকেজো করে দেয়া। রাইতের আন্ধাইরে চেঙ্গিসসেনারা প্রতিপক্ষ শিবিরের যুদ্ধতাঁবুতে যেয়ে চুপিসারে উয়্যেপনগুলো অকেজো করিয়া রাখিয়া আসছে, এইটা ছিল নিত্যকার ঘটনা। বহুকাল প্রতিপক্ষের কেউই টের পায় নাই ব্যাপারটা। আর চেঙ্গিস খান এই কৌশলেই জঙ্গের ঘোড়া ও নিশান দাবড়িয়েছেন আবিশ্বভূমণ্ডল ব্যেপে।

এই কথাগুলোই হুবহু হয়তো নয়, সিনেমায় আরও গুছিয়ে বলা হয়েছে, কিন্তু কথা তো ওইটাই। সিনেমায় ক্লাইমেক্স এবং ক্যাথার্সিস্ ঘটে এই পথ ধরেই। সিনেমায় ভার্ব্যাল অ্যাকশন উপভোগ্যই। ইন্ট্রেস্টিং না? হ্যাঁ, চিরদিনই, ইন্ট্রেস্টিং। শার্প সংলাপের সিনেমা ‘সালা খাড়ুস্’, মোটামুটিভাবে, বলা যায়। এইসব ভাবছিলাম, আর একটা বাংলা কবিতা খুঁজতেছিলাম। মোহাম্মদ আলিকে নিয়েই রিটেন্ কবিতা, আবুল হাসান সেই কবির নাম। খুঁজছিলাম, পারিবারিক বিপর্যয়ে ঘুরে মরছিলাম বদ্যিদোকানের দুয়ারে দুয়ারে, এবং ম্যুভিটা দেখার প্রায় দিন-তিনেকের মধ্যেই শুনি আলি নেই। সিলেটে এসেছিলেন আলি, আমাদের ছোটবেলায়, এক্সাক্টলি নিবন্ধকারের জন্মবছরে, এখানকার জিমনেশিয়্যামের প্রেক্ষাগৃহ মোহাম্মদ আলির নামেই রাখা হয়েছে তাই। রিসেন্টলি শুনেছিলাম কারা যেন নাম বদলাইতে চেয়েছেন তাদিগের প্রাণপ্রিয় নেতার নামে। নেতানাম না-শুনেই আমি তারে সমর্থন দিয়া রাখলাম। লেট মি রেস্ট ইন্ পিস্, ড্যুড!

কেসিয়াস মার্সেলাস ক্লে, আই মিন মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলি, এবং তার বাগানো মুষ্টাঘাত, দুর্ধর্ষ পাঞ্চ, ফিস্ট, কাট, আপারকাট। সেঞ্চুরি’স্ গ্রেইটেস্ট বক্সার আলি কিন্তু আরেকটা কারণেও মশহুর ছিলেন, ইন-ফ্যাক্ট ওইটাকে তিনি শিল্পের পর্যায়েই নিয়ে গেছেন, ব্যাপারটা তাঁর ক্ষেত্রে পার্টস অফ স্পোর্টস হয়ে ওঠে কালক্রমে, সেই কৌশল অবশ্য আলির আগে-পরে অনেকেই ইস্তিমাল করেছেন, মশহুর উইনিংকৌশল করে তুলতে পেরেছেন সেইটা আলি। বিষয়টা আলির ক্ষেত্রে একটা ফাইটিং স্টাইলই হয়ে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, ক্রিকেটে যেমন স্লেজিং, বলছি ‘ট্যকিং ট্র্যাশ’ স্ট্র্যাটেজির কথা। আপনি ও আপনারা জানেন নিশ্চয়, কাজেই একটা মাত্র উদাহরণ মনে করা যাক। আলির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রেজিয়ার সম্পর্কে রিঙের বাইরে এন্তার কমেন্ট করেছেন আলি। ভাইস-ভার্সা তো বটেই। কিন্তু আলির কমেন্ট হয়ে উঠেছে লড়াইয়ের অংশ দস্তুরমতো। লোকে এইটা চাইতও খুব, আলির উইটি রিমার্কগুলো — ডিউরিং হিজ্ ফাইট — স্পেক্টেটর্স রোয়ারিং-ওয়েইভ ভয়াবহভাবে বাড়িয়ে দিত, যে-কারণে জেতার অনেক আগেই জিতে যেতেন আলি লোকসমর্থনের দিক থেকে, যে-কারণে আলি বিবেচিত হতেন পিওপলস্ চ্যাম্পিয়্য  হিশেবে জেতার আগেই। অ্যানিওয়ে। উইট ও হিউম্যর কী সাংঘাতিক উয়্যেপন, ভাবুন একবার!

[সংযোজন : উদাহরণটা দিতে ভুলে গেছিলাম, ব্র্যাকেটে ছোট্ট করে দিয়া রাখি। দিন-ক্ষণ তো মনে নাই, কোনো-এক লড়াইয়ের আগে ফ্রেজিয়ার সম্পর্কে তিনি — মোহাম্মদ আলি — বিবৃতি দিচ্ছেন : ফ্রেজিয়ার ইজ ট্যু ডাম্ব টু বি চ্যাম্পিয়্যন! ভাবুন একবার, এই শেল ছোঁড়ার পর ফাইন্যালে ফ্রেজিয়ার কেমন করে শান্ত মাথায় খেলবেন! বেচারা! আলি কিন্তু রিঙে একদম মনোযোগী শান্তিঋষি, নির্ভুল, ধ্যানী।]

saala khadoos

কিন্তু বক্সিং অত নয়, বিটিভিসুবাদে ছেলেবেলা হইতে রেস্লিংফ্যান আমি। ওই সময়ের এক-ডজন রেস্লার আমার পরিচিত। ওদের লড়াইফিচার নিয়ে একটানা আটপৃষ্ঠা বকে যেতে পারব। বক্সিং সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি ইশকুলের জীবনসায়াহ্নে এসে। এর সঙ্গে জড়িত একটা জাতীয়তাবাদী চেতনা। টাইগার জলিল নামে এক বক্সার তখন উঠে আসেন বক্সিং অ্যারেনায়। ইনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ নাম কামায়েছিলেন। সাফ বা অ্যাশিয়্যান গেমস হবে সম্ভবত। তো, সমর্থন করতে হয় যেহেতু, একটু জানিয়াশুনিয়া নিয়াছিলাম খোদ বক্সিংস্পোর্টস সম্পর্কেই। মাথা টানলে তো কান আসবেই। এইভাবে মোহাম্মদ আলি। পরে, অনেক পরে, আলিতনয়া লায়লা আলি ফিমেইল বক্সিংরিঙে অবতরণ করেন। তখন আলিবিদূষীর গেঁজদাঁত ও তার বিশেষ কায়দার নেগ্রোয়েড চুলবিন্যাস ভালো লেগে যায়। দেখি না তারে কত কত যুগ ধরে! অ্যালাস্! হায়!

সমবেত দর্শকবৃন্দ! এই আমার গ্রেনেডের মতো মুষ্টি
আমি চ্যালেঞ্জ করছি, আসুন লিস্টন, জো বাগনার
আসুন আপনারা যা-ই হোন ফ্রেজিয়ার কি অমুক তমুক
আমি চ্যালেঞ্জ করছি আমার আইডেন্টিটির এই
পরিচয়হীন বিশ্বে — আমি কেসিয়াস ক্লে, না মোহাম্মদ আলী
আমাকে জানতেই হবে লিস্টন, তুমি রিঙের ভিতরে ঘুরে ঘুরে
আমাকে কেবলই বলছ — ক্লে ক্লে ক্লে — না — এ আমার
শ্বেতাঙ্গ ঘৃণার চিহ্ন, আমি কালো, আমি আলী, আমি বিস্ফোরিত
কালো মানুষের ক্লিন্ন আর্তনাদ, ক্ষুধা আর তীক্ষ্ণ চিৎকার
শুনে-শুনে-শুনে আমি আজ আর কেসিয়াস ক্লে নাই!

আমি মুহূর্তে মোহাম্মদ আলী বনে গেছি — শোষিত বিশ্বের
বিত্তবান একটি ধ্বনি — আমাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমি আলী!
যেমন পেখম দেখলে ময়ূরের তোমরা স্বীকৃতি দাও
থাবা দেখলে দারুণ ব্যাঘ্রের — সমবেত উল্লুক, ভল্লুক
ওরাং-ওটাং — শোনো, পেশাদার নই — আমি,
এ আসলে আমার স্ট্র্যাটেজি, যুদ্ধ করি আমার সত্তায়
সত্য ও মিথ্যার — কানা অন্ধ অহমিকা আর অস্ত্র বীরত্বের
বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ — আমি কবি মাংসের ছন্দের
ধনুকে আমার যুদ্ধ — মুষ্টাঘাত করি ধূর্ত কর্মের চোয়ালে
দ্রুত ক্ষীপ্র এ আমার যুদ্ধরীতি হতে হয় ভিতরে বাহিরে একই
অটুট নিটুট ক্রোধ, ফলবান মর্যাদা বাহক — কোনো পরাজয়
আমার মানতে নেই কোনোখানে, এশিয়ায় সাউথ আফ্রিকায়
যে-কোনো কালের গর্ব আমি নাইজেরিয়ায় আমি আমার
আমারই ভাইয়ের সঙ্গী — অনাবৃষ্টি, বিপন্ন খরায় তাই
কালো মানুষের মুখে অন্ন যোগান দিতে পিছপা হই না, শোনো
ভরাপেট ক্রীড়ারতিময় যত মুষ্টিযোদ্ধা, শোনো এই রিং
আসলে আমার সত্তা, যত যুদ্ধ করি আমি উল্লোল নৃত্যের
সাথে স্বার্থবাদী সমস্ত গর্বের গাল যত আমি চূর্ণ করি
ফ্রেজিয়ার অথবা জো বাগনার…
ভিতরে আমার চলে অন্য খেলা, আমি কাঁদি, আমার সত্তার
অংশ, কালো মানুষের বংশ পদানত দেখে দেখে আমি কাঁদি।

উপরের কবিতাটা ‘আবুল হাসান রচনাসমগ্র’ — বিদ্যা প্রকাশ, ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ ২০০২ — অগ্রন্থিত অংশ হইতে উৎকলিত।

কথাটা আজকাল প্রায়ই মনে হয় যে, খেলাধুলা, এবং খাস করে রেস্লিং-বক্সিং ইত্যাদি, নিষিদ্ধ হবে না কেন? মোদ্দা বাত ইয়্যে হ্যায় কি যে যে-কোনো স্পোর্টস, এমনকি ক্রিকেট-ফুটবলও, দর্শকদের ভিতরে জিঘাংসা জাগায়ে দেয়। তা আপনি যতই বলুন না কেন যে এইটা শ্যামপীরিতি আর সৌহার্দ্য উন্নয়নের মাল। বাস্তবে আমি নিজে খেলা দেখতে বসে জিঘাংসু হয়ে উঠি। বক্সিং-রেস্লিং দেখতে যেয়ে তো খুনিয়ার মতো দৈত্য হয়ে যাই নোটিস করেছি। শিকার/হান্টিং যদি নিষিদ্ধ হয়, জিম কর্বেট যদি সুশীল সুধী সমাজে আলোচ্য না-হয়, খেলায় এত দিলচস্পি কেন তবে? কেন ম্যুভিতে বন্য প্রাণিহত্যার সাজানো দৃশ্যেও সেন্সর করার সভ্যতাবাঁদরামি? সিগ্রেটে একটাও টান দ্যায় না নায়ক এমনকি ভিলেনও, সভ্যতার এহেন বর্ণচোরামি কেন তবে?

এইসব অবশ্য অনর্থকরী কথাবার্তা। খেলাধুলা, বা জিঘাংসা জাগ্রতকরণ, আজকের দুনিয়ার বিগ-বাজেট ইনভেস্টমেন্টের ইন্ডাস্ট্রি। আমরাও এই ইন্ডাস্ট্রিতে শামিল রয়েছি। বক্সিং তো মোট-কথা আমাদেরই প্রাণের খেলা। পারি না-পারি কোয়ি শরম নেহি, কিন্তু বক্সিং ছাড়া আমাদের একমুহূর্তও চলে না। বাংলাদেশে গণ্ডায় গণ্ডায়, রাস্তাকিনারে চাদোকানির ছাপড়া চালার নিচে পায়াভাঙা বেঞ্চে, হ্যাভিওয়েট চ্যাম্পিয়্যন লক্ষ করা যায়। এই দেশে দশকে দশকে চ্যাম্পিয়্যন জন্মায় হাজারেবিজারে চৌষট্টি জেলায়। বাংলা কবিতার করিডোরে একবার ঢুঁ দিয়ে দেখুন, বক্সিং বিষয়ে আপনিও আগ্রহী এবং আশাবাদী হয়ে উঠবেন।

Film Title: Saala Khadoos ।। Released Year: 2016 ।। Genre: Sports drama ।। Duration: 1h 49min ।। IMDb Score: 7.6/10 ।। Director: Sudha Kongara ।। Stars: R. Madhavan, Ritika Singh ।। Music Score: Santhosh Narayanan

ম্যুভিরিভিয়্যুপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you