নির্দলীয় দলছুট

নির্দলীয় দলছুট

অনেককেই ইন্ট্রো বলতে শুনি, বিশেষত বৈঠকী আড্ডায়, দলছুট ব্যান্ডের সঞ্জীব। গুলতানি গানের বা সান্ধ্য পথপার্শ্বের চা-চুরটের আড্ডায় সঞ্জীবস্মারক কথাবার্তার শুরুতে কেউ কেউ বলে ওঠে প্রায়শ ‘দলছুট সঞ্জীব’। সঞ্জীবের নামের সঙ্গে দলছুট অঙ্গাঙ্গী মিশে গেছে যেন। অসত্য নয়। যেহেতু সঞ্জীব দলছুটই ছিলেন, দলছুট হন নাই, দলছুট হতে হয় নাই তাকে একদশকহ্রস্ব তার সংগীতক্যারিয়ারে। এই কথাটা প্যারাডক্সপূর্ণ। দলছুটই ছিলেন, দলছুট হন নাই, দলছুট হতে হয় নাই তাকে — এই কথাটার কূটাভাস খোলাসা করার দরকার নাই। কূটাভাসের প্রয়োগ ব্যাহত হয় ব্যাখ্যায়, কাজেই নিজের মতো করে এই সিদ্ধান্তগন্ধী জিনিশগুলো গ্রহণ অথবা খারিজের ক্ষেত্রে কূটাভাস অনুঘটক হিশেবে সবসময় সক্রিয়।

সঞ্জীব ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সংগীতশিল্পী হিশেবে দেশে-বিদেশে বাংলা গানে যে-খ্যাতি পেয়ে গেছেন, দলছুট ছাড়াও ধরেবেঁধে যে-কোনোভাবে তাকে গানের লাইনে আনতে পারলেই মিউজিকে এই কাজগুলোই করে যেতেন সঞ্জীব। সঞ্জীবের গানের সঙ্গে যে-মিউজিক অ্যারেইঞ্জমেন্ট, বাপ্পা তথা দলছুট এই মিউজিকের অ্যারেইঞ্জার, সেইটা এমন কোনো মিউজিক নয় যে ব্যান্ড ফর্মেশন ব্যতিরেকে এইটা ডিফিকাল্ট ছিল। মূল যে-কাজটা বাপ্পা বা দলছুট করার জন্য স্মরণযোগ্য, সঞ্জীবকে বেঁধেধরে গানে বসানো। উড়নচণ্ড সঞ্জীব চৌধুরীকে সেই টিএসসিকেন্দ্রিক দুইয়েকটা প্রতিবাদমঞ্চে ম্যে বি পাওয়া যেত, মৌলিক বাংলা গানের এই দিশারী ব্যক্তিটির সুরস্বরলিরিকসম্ভার আমরা পেতাম না বাপ্পার ইনিশিয়েটিভ ছাড়া। বাপ্পা এই জহুরীর কাজটা করেছেন।

অন্যদিকে বাপ্পার জন্যও দলছুট না-হলে এমনকিছু ক্ষতি হতো না। চাঁদফুলজোছনা নিয়া প্যানপ্যানানি লিরিকে উনি বিশেষ একটা সুর ও আবহ তৈয়ার করে যেতেন যেমন তিনি যাচ্ছিলেন ও বাজার পাচ্ছিলেন। দলছুট হবার কারণে এতদিন যারা বাপ্পার নাকিকান্না লিরিকের গানগুলো শুনত না, তারাও সঞ্জীবমদ্যের হাতছানি এড়াতে না পেরে দলছুটের কাছে ভেড়ে এবং বাপ্পাকেও পুনরাবিষ্কার করে। দলছুটে বাপ্পার গানগুলো তবু সহনীয়, সোলো অ্যালবামে কেমন যেন ন্যাতানোপুঁতানো। সঞ্জীবের প্রস্থানের পরে যে-দলছুট পুনর্গঠিত হয়ে এল বাজারে, এর একটা সঞ্জীবস্মারক আবেদন যতই-না বাপ্পা করে যান, ক্রেতাশ্রোতাসমুজদার কেউ কি দ্বিতীয় সুযোগ দিতে রাজি হয়েছে? এমন কোনো তথ্য হাতে আছে কারো? সঞ্জীবছাড়া ব্যান্ড দলছুট অকল্পনীয়।

দলছুটছাড়া সঞ্জীব হয়েছিল, দুর্দান্তভাবেই হয়েছিল, বললে বেশি শোনাবে না যে ব্যাপক না-হলেও অনেকটা আলগ সঞ্জীব স্বতন্ত্র সঞ্জীব পাওয়া গিয়েছিল সঞ্জীবের একমাত্র সোলোঅ্যালবাম ‘স্বপ্নবাজি’ টিউন-লিরিক-কম্পোজিশনের ভিতরে। এর পরেও সঞ্জীবের কিছু গানে টের পাওয়া গিয়েছিল দলছুটছাড়া সঞ্জীবের আলাদা অস্তিত্ব সম্ভব। সঞ্জীব নিজে একজন বাগগেয়কার, এইটাই দলছুটছাড়া সঞ্জীবের সম্ভবপরতা আন্দাজ করার একমাত্র কারণ নয়। এমন কয়েকজন ব্যান্ডমিউজিশিয়্যান আছেন যারা একাধারে সিঙ্গার, স্যংরাইটার, কম্পোজার; যাদেরে এককথায় বাগগেয়কার বলে বাংলায়, ব্যান্ড ছাড়া তাদেরে কল্পনাও করা যায় না। কাজেই, সঞ্জীবের মধ্যে এমনকিছু ছিল যা তাকে ব্যান্ডে যেমন তেমনি ব্যান্ডভিন্ন সোলো সংগীতেও সমান মানানসই করে তুলেছিল। সঞ্জীবের জন্যে ব্যান্ড জরুরি ছিল না, মাস্ট তো নয়ই, ব্যান্ডের দরকার ছিল সঞ্জীবকে। ব্যান্ড দাঁড়িয়েছেও সঞ্জীব ভর করে, ব্যান্ড দলছুট আইডেন্টিক্যাল হয়েছে সঞ্জীবের কারণে, বাপ্পার একক ক্যারিয়ার আগে থেকেই ছিল। সোলো গানগুলো থেকে তেমন ভিন্নতা আনতে কি পেরেছিলেন বাপ্পা ব্যান্ডকম্পোজিশনগুলোতে? একটুও না। ব্যান্ডের আইডেন্টিক্যাল হয়ে ওঠার পেছনে সঞ্জীবই জিয়নকাঠি, বিষাদস্পন্দী নিঃসীম নৈসঙ্গ্যনিমজ্জিত সঞ্জীবকণ্ঠ।

‘স্বপ্নবাজি’ ছিল সঞ্জীবের প্রথম এবং শেষ এবং একমাত্র সোলো স্টুডিয়োঅ্যালবাম। পরে বেশকিছু মিশ্র সংকলনে সঞ্জীবের গান পাওয়া গিয়েছিল বটে, সেসবও সংখ্যায় বেশি নয়। মিক্সড অ্যালবামে ঠেলেঠুলে জায়গা জোড়ার সেই ধুন্দুমার সময়ে যে-কয়টা ব্যান্ড এবং যে-কয়জন ব্যক্তি তফাতে ছিলেন হুজুগের রোজহাজিরা থেকে, ব্যান্ড দলছুট ও শিল্পী সঞ্জীব গুটিকয় সেই স্বাতন্ত্র্যাভিসারীদের অন্তর্গত। স্বপ্নবাজি রিলিজের পরে যে-সাফল্য, সঞ্জীব চাইলেই সেই ট্র্যাকের চর্বিতচর্বণ করে যেতে পারতেন। করেন নাই। কিছু সোশ্যাল ক্যাম্পেইনে, টেলিভিশনে, তাকে এক-দুইটা গান কম্পোজিশনে দেখা গিয়েছে, সেগুলোও মন্দ হয় নাই। উদাহরণ খুঁজতে যেয়ে মনে পড়ছে ফাহমিদা নবীর সঙ্গে একটা ডুয়েট, ‘হাতছানি দ্যায় বাংলাদেশ’, স্বদেশের আভ্যন্তরীণ পর্যটন উন্নয়ন ও বিকাশের কাজটাকে স্পিডআপ করার লক্ষ্যে এই গান রচিত হয়েছিল। প্রচারাভিযানের পার্পাস্ সার্ভ করেও কম্পোজিশনটা আবহমান দেশাত্মবোধক বাংলা গানের ধারায় একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। খুঁজলে এমন কয়েকটা আরও কম্পোজিশন পাওয়া যাবে যেগুলো সঞ্জীবের ব্যান্ডভিন্ন স্বতন্ত্র অস্তিত্বের সম্ভাবনা হাজির করে।

এইখানেই কথাটা পাড়া যায় যে, একটা আশ্চর্য নির্লিপ্ততা আমরা লক্ষ করি শিল্পী সঞ্জীবের মধ্যে। ব্যান্ড সফল হলো, পয়লা অ্যালবামেই লিস্নারদের কান কাড়ল, তবু হুড়মুড় করে এই সাফল্য পুনরুৎপাদনের বেহুঁশ দৌড়ে — যেমন আর-সবাই যেত — দলছুট রইল সংযত। সঞ্জীব, ডুয়ো দলছুট, রইল নির্লিপ্ত। দশবছরে অ্যাট-লিস্ট দশটা না হোক সাতটা অ্যালবাম হতে পারত, দলছুটের যে মার্কেটক্রেইজ ছিল তাতে এই-সংখ্যক অ্যালবাম প্রোডিউস করার জন্য খুব বেশি দিগদারি পেতে হতো না তা অনুমেয়, হলো সাকুল্যে চারটে অ্যালবাম। মোটামুটি চল্লিশটা গানের ভিতর সঞ্জীবের গান অর্ধেকেরও কম। রইল একটামাত্র সোলো। স্বপ্নবাজি। বাপ্পার আগের-পরের হিসাব বাদ দিয়ে এই দশ বছরের আওতায় মিক্সড-সোলো কতগুলো গুনে দেখিনি।

কিছুদিন আগে, এ-বছরের মার্চে, ২০১৮ মার্চে, একটা পাব্লিক কন্সার্টে দলছুট ব্যান্ডের পার্ফোর্ম্যান্স দেখতে দেখতে এই কথাগুলো ছত্রভঙ্গ মনে পড়ছিল। ‘অগ্রযাত্রায় দূর্বার বাংলাদেশ’ শীর্ষক (ওই বানানেই কিন্তু দুর্বার, দীর্ঘউকারে, তোরণে ব্যাকস্ক্রিনে সাইডস্ক্রিনে মাল্টিপ্রোজেক্টরে লেটারহেডে ব্যানারে গেটপাসকার্ডে ‘দূর্বার’ সর্বত্র) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজন করেছিল কন্সার্টটা। বাহাদুরের আয়োজন, সরকার বাহাদুরের, অতএব ধামাকা থাকবেই। ছিলও ধামাকা। ফায়ারওয়ার্ক্স। জায়ান্ট স্টেজ এবং ডিভ্যাস্ট্যাইটিং ডেকোর। ওইসব তো আর কন্সার্ট না, পার্ট অফ কন্সার্ট যদিও, বাপ্পা ছাড়াও কন্সার্টে জেমস্ ও মমতাজ পার্ফোর্ম করলেন। দলছুট ব্যান্ড লগে লইয়া বাপ্পা হাজির হয়েছিলেন, নয়া ব্যান্ডমেম্বার্স, যদিও ধরনধারণ দেখে সোলোই মনে হচ্ছিল। হয় এমন, দুই-তিনদশক ধরে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত ব্যান্ডের ক্ষেত্রে এ-কথা প্রযোজ্য। সোলো মনে হয় ব্যান্ডের পরিবেশনাও। দলছুটের মঞ্চপরিবেশনা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল কাউকে জিগাই যে সঞ্জীবছাড়া গানের এই একদা মাতোয়ালা দলটাকে কি দলছুট বলা ভালো হচ্ছে?

গেয়েছেন বাপ্পা মজুমদার। দলছুট বলা যেত সঞ্জীব থাকলে বেঁচে। এখনও দলছুট বলা হয় ব্র্যাকেটে যদিও। পদ্মলোচন নামে একটা কানা ছেলে। সঞ্জীব চৌধুরী রিপ্লেইস করা মানবসংসারে সম্ভব? এ পৃথিবী একবার পায় তারে, দুইবার পায় না। বাপ্পা ব্যর্থ বলা হচ্ছে না, বাপ্পার হাত নাই এইসব মনেপড়াপড়ির পিছনে, তালে-লয়ে-বাদ্যিবাজনায় বাপ্পা পারদর্শী। কিন্তু দলছুট তো নয়। বাপ্পার পক্ষে দলছুট সম্ভব নয়। মিউজিকে নিপুণ বাপ্পা, ম্যাজিকে নয়। ম্যাজেস্টিক ম্যাজিশিয়্যান কষ্ট পেয়ে চলে গেছে, ফেরানো সম্ভব হয় নাই, ফেরানো যাবে না তারে এই সুরের শোহরতভরা পারাবারের পৃথিবীতে। এইটা কাজেই বুঝে ফেলা গ্যাছে যে সঞ্জীবের প্রত্যাগমন সম্ভব না-হলে দলছুট সম্ভব নয়। বাপ্পারও দশা হয়েছে ‘নট উয়িথ য়্যু নর উয়িদাউট য়্যু’। দলছুট পুনরুৎপাদন সম্ভব নয়, দলছুটস্মৃতি ইরেইজ করাও সম্ভব নয়। বেচারা! পার্ফোর্মার এবং কম্পোজার বাপ্পা অ্যাপ্রিশিয়্যাব্লি গ্যুড, বাট প্রেডিক্ট্যাবল্। ম্যাজিশিয়্যানের চাই আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি। জিনিশটা বাপ্পায় নাই। মিউজিকে আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি না-থাকা আদৌ দোষের নয়। কালেভদ্রে একাধজন শুধু অতিকায় আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি নিয়া আল্লার দুনিয়ায় আবির্ভূত হয়।

ঠিক মাগ্রেবের আজানের পরে, এশা-মাগ্রেব সন্ধিক্ষণে, স্টেজে আবির্ভূত হন বাপ্পা। ধারাবাহিক গেয়ে গেলেন হালি-দুয়েক। মন্দ না। ভালো। শোভন চেয়ারে বসা বাংলাদেশ রেলওয়ের প্যাসেঞ্জার মনে হচ্ছিল শ্রোতার জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেদেরে। প্ল্যানড রেলগাড়ি চালিয়েছেন অবশ্য। ধুপধুপ ধিমধিম ঝিকঝিক ঠাশঠাশ আওয়াজে স্টেডিয়াম কোলাহলখলবলিত। জুধা করা না-মুমকিন কোথায় গিটার বাজছিল কোথায় প্যাড-বোর্ডস্-ড্রামস্। দৌড়ের উপ্রে বেবাক দুনিয়া। আখাউড়া জংশনেও থামাথামি নাই। পিনিকের শিশিওয়ালা বাপ্পা হতে পারেন নাই সিলেট স্টেডিয়ামে ১৮ মার্চের উন্নয়ন ক্যানভ্যাসিং কন্সার্টের সন্ধ্যায়। গান গেয়েছেন যদিও ‘পরী’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘বায়ান্ন তাস’ ইত্যাদি। ‘তীরহারা ওই ঢেউয়ের তরী পাড়ি দেবো রে’ গাইলেন। বোধহয় ইন মেমোরি অফ মার্চ। বৈশিষ্ট্যহীন রেন্ডিশন। পরে, শেষের দিকটায়, একদম ঘোষণা দিয়া গাইলেন ‘গাড়ি চলে না’। কাভারভার্শন অফ আবদুল করিম বাই দলছুট। সঞ্জীবের গলায় এইটা মাতোয়ালা করেছিল বদ্বীপবাসীদিগেরে। ঢের বছর চলে গেছে এরপর ধূসর অতীতে। এখনও অমলিন। মধ্যমার্চরজনীতে বাপ্পার গাওয়া ওই একটা গানেই জোয়ারি ছিল। জোয়ারি মিউজিকে, রেন্ডিশনে, প্রেজেন্টেশনে। ব্যাড না। ভালো। শুকনা গলায় ভালো।

দলছুট শুনলেই লোকে এখনও সঞ্জীব বোঝে, যেমন সঞ্জীবের নামের আগে সাদরে দলছুট লাগায়। কিন্তু দলছুট সঞ্জীব মানে ব্যান্ডের সঞ্জীব, বোধহয় এই কথাটা কারো মুখে কেন মনেও আসে না। ব্যান্ড একটা বাহন মাত্র, সঞ্জীবের মতো সংগীতশিল্পীদের বহনের লাগিয়া বাহন, সঞ্জীব ব্যান্ড ছাড়াও সঞ্জীবই। ইভেন বাজারে একটাও সংকলন যদি রিলিজ না হতো, যদি টিএসসিভিত্তিকই সীমায়িত রইত তার গানচেষ্টাগুলো, সঞ্জীবের মতো সংগীতশিল্পীরা তার/তাদের ঘনিষ্ঠ বলয়ে স্মরণীয় হতেন সংগীতেরই জন্য। হয়তো খুব ছোট বন্ধুবৃত্তে সেই স্মরণ, তবুও। সঞ্জীবের মতো শিল্পীরা আবহমান, — ধ্বংসে, নির্মাণে, বেদনায়, বিষাদে, প্রেমে, সংগীতেও। সঞ্জীবের ন্যায় শিল্পী চিরদিনই নির্দলীয় দলছুট।

লেখা : সুবিনয় ইসলাম

… …

সুবিনয় ইসলাম
Latest posts by সুবিনয় ইসলাম (see all)

পরের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you