গতকাল রাত জেগে শাটিকাপ ওয়েবসিরিজটা দেখলাম। কাহিনি, ভাষা, চিত্রনাট্য, কলাকুশলী থেকে শুরু করে আগাগোড়া সবটাই রাজশাহীকে মাথায় রেখে বানানো বটে! পরিচালক থেকে শুরু করে পাত্রপাত্রী সকলে রাজশাহীর ছাওয়ালপাওয়াল। সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় সিন্ডিকেট ও বিবিধ কারবার, সোজা কথায় চেনাজানা কাহিনিছক নির্মাণগুণে অন্য মাত্রা লাভ করেছে সেখানে।
রাজশাহী শহরে মাদকের ব্যবসাকে ঘিরে সচল কাজকারবারের কিয়দংশ পর্দায় তুলে আনার ক্ষেত্রে নির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম কোথাও বাড়তি অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেননি। শাটিকাপ-র বয়ান আগাগোড়া Realistic। একরত্তি মেদ কোথাও চোখে পড়েনি! রাজশাহীর অপরাধজগতে যাদের দিনরজনি কাটে তাদের মুখে যে-ভাষা মানায় অর্থাৎ Local Accent-র ব্যবহার ওয়েবসিরিজটাকে অন্য মাত্রায় পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। কাহিনি সাদামাটা হলেও স্থানীয় কলাকুশলীরা যেভাবে এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে অভিনয় করেছেন, কাহিনির গতির সঙ্গে মাত্রা বজায় রেখে স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি দিয়ে গেছেন, খিস্তিখেউড় থেকে আরম্ভ করে আবহ সংগীতের সবটাই একে অন্যে গলেমিশে আট পর্বে বোনা সিরিজটাকে গতির ওপরে ভর দিয়ে দৌড়াতে সাহায্য করেছে।
শাটিকাপ-এ নারী চরিত্র বেশ বিস্ময়করভাবে সাকুল্যে একজন বলতে হয়! কাহিনির পুরোটাই হেরোইনের চালান দিয়ে বাজার গরম করার সাপলুডোর খেলায় জমজমাট উঠতি বয়সী যুবাদের কাণ্ডে ভরাট। বেহুদা যৌনদৃশ্য থেকে শুরু করে দর্শক সোফায় হেলান দিয়ে খানিক চোখ মুছবেন অথবা দুঃখে আর্দ্র হবেন সে-রকম Emotion-র বালাই নেই বললে চলে। মাদক ব্যবসার ইতিনেতি ইত্যাদি নিয়েও বাতেল্লা নেই কোথাও। সমাজকে Positive Message দেবার খায়েশ নির্মাতাকে তাতিয়ে তোলেনি একটিবার। মাদকের কারবারে শ্রেণির ভিতরে শ্রেণি থাকে, একটি থাকের ভিতরে আরো শত হাজার থাক সক্রিয় হয় সেখানে। তাওকীর ওইসব শ্রেণি বা থাকের মধ্যে নিচের সারিটাকে গল্পের প্রয়োজনে বেছে নিয়েছেন, যার পুরোটাই ভীষণ Raw হওয়ার কারণে রগরগে থ্রিলার ধাঁচে শাটিকাপ নিজেকে উপস্থাপন করেনি। গল্পের গতি যে-কারণে অনেক সময় মন্থর মনে হতে পারে। যদিও অধমের ব্যক্তিগত বীক্ষণে মন্থরতাটি আদৌ বিঘ্ন বা বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠেনি।
মাদকের কারবারে নেমে নিজের আধিপত্য তৈরিতে মরিয়া দুই উঠতি যুবক আর প্রতিষ্ঠিত সিন্ডিকেট গ্যাং ও পুলিশ কর্মকর্তার Hide and Seek-র দৌড়ানি আলগা আবেগকে কাহিনির কোনো পরতেই উড়ে এসে জুড়ে বসার সুযোগ দেয়নি। সিরিজে একটা চরিত্রও নেই যার প্রতি দর্শক সহানুভূতিতে বিগলিত বোধ করতে পারেন। Emotional বাগাড়ম্বর ছেটে ফেলতে পারা অন্তত শাটিকাপ-এ জরুরি ছিল আর তাওকীর সেটা করতে পারায় তথাকথিত জমাট থ্রিলার দেখার একঘেয়ে রোমাঞ্চ থেকে দর্শকের খানিক হলেও রেহাই মিলেছে। যেমন করে হোক নিজেকে টিকিয়ে রাখার বাজিটাই শাটিকাপকে এই ঘরানার ওয়েবসিরিজ থেকে একদম পৃথক করে রাখে। বরেন্দ্রর রুখু মাটির মতো শক্ত আর পদ্মার চরের মতো বিস্তৃত এক সীমানায় দাঁড়িয়ে তাওকীর কাহিনিটা দর্শককে বলে যেতে পেরেছেন। তাঁর গল্প বলার ভঙ্গিটা আমার কাছে যারপরনাই বেশ চমৎকার লেগেছে।
কথাটি না বললেই নয়, তাওকীরের নির্মাণশৈলী ভীষণ সিনেমাটিক বটে! এক-এক সময় মনে হয়েছে নাটক নয় বরং ক্যামেরার কুশলী প্রক্ষেপণে বোনা কোনো সিনেমাই দেখছি বুঝি! ড্রোন দিয়ে তোলা শটগুলো এক-কথায় চমৎকার ছিল। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় র্যাপ ধাঁচে গীত গানের অংশটি আমোদ-পরিহাসের সঙ্গে মনকাড়াও বটে! খিস্তি ব্যাপক হলেও অপ্রাসঙ্গিক উৎপাত মনে হয়নি। পদ্মার চর ও সীমান্ত দিয়ে হেরোইন বা গরু পাচারের কারবারগুলা আর সিন্ডিকেটসর্দার সোহেলের ভাড়াখাটা ডিবিআই কর্তা উত্তমের অভিনয় সোজা কথায় জবরদস্ত ছিল। ওয়েবসিরিজ বানানোর তরিকায় সিনেমার ভাষা ও বুলি আমদানির কুশলতা বুঝিয়ে দেয় এই নির্মাতা সামনে বহুদূর যাবেন, যদি হ্যাঁ, সে-রকম সুযোগ তিনি পান। আফটার অল, শাটিকাপ (রাজশাহীর স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ ঘাপটি মেরে থাকা) বাজেটস্বল্পতা থেকে শুরু করে বহুবিধ প্রতিকূলতা পেরিয়ে তবে চরকিতে নিজেকে অবমুক্ত করার সুযোগ করে নিয়েছিল। গায়ে-শিহরণ-তোলা রোমাঞ্চ ও যৌনদৃশ্য অনুপস্থিত থাকলেও কাহিনির বিষয়বস্তু ও ভাষার কারণে সিরিজখানা আণ্ডবাচ্চা সহ সপরিবার দেখবার জিনিস নয়। শাটিকাপ একলা মনিটরের পর্দায় ঘাপটি মেরে বসে দেখার জিনিস। বাংলা ওয়েবসিরিজের সাবালকত্বের আন্দাজ পেতে যারা এখনো সিরজিখানা দেখেননি, এইবেলা দেখে নিতে পারেন, যদি মন চায়।
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
COMMENTS