ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না, অনুভবে বুঝি, মানুষের রক্তে নদী থাকে। মরমিয়া বোধে মানুষ বারংবার নদীর কাছেই ফেরে। এই কংশ, মগড়া, ধনু, সুরমা, কালনী, সুমেশ্বরী কিংবা যাদুকাটার প্রবাহ থেকেই আমরা এসেছি। এই চিরসখা মেঘমালা, ধানক্ষেত, হাওরের বিপুল তরঙ্গ আমার জাহ্নবী। আমি যে-মানুষের কাছে যাই, যে-মানুষকে কাছে পাই, সে-মানুষও নদীর মতো। প্রকৃতির স্বাভাবিকতায় নদী গতির সত্যকে যাপন করছে। মানুষও গতির সন্তান।
খালিয়াজুরির কৃষ্ণপুর সরকারি কলেজে চতুর্থ বর্ষের ভাইভা পরীক্ষায় এসেছি। কৃষ্ণপুর কলেজটা আমার খুব ভালো লাগে। কিশোরগঞ্জের ইটনা এবং সুনামগঞ্জের শাল্লার সীমানায় কলেজের যে-কোনো জানলায় দাঁড়ালে দেখা যায় হাওরের বিশাল রূপ। পাশেই হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ। খুব বেশি দূরে নয় উজানধল। সেখানেই গ্রামবাংলার মাটির ভাবুক, লৌকিক ধারার আপন কবি বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম ঘুমিয়ে আছেন। আজ ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তাঁর ১৬তম প্রয়াণদিবস।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে মনে হলো, এই অঞ্চলের মানুষের যুক্তির চেয়ে ভাবের জেল্লা বেশি। জলের ধর্মকে এরা মানে, ভাবের ধর্মকেও ধারণ করে বিপর্যয় ও পরিত্রাণে। এদের মনে কর্ম ও গানের শান্তি। এদের মনে সুরের মানবিক সম্প্রীতি। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের লৌকিক ভাবুকতাকেই শাহ আবদুল করিম তাঁর গানে মেখে দিয়েছেন। সুফির শান্তি ও জিকিরকে, বৈষ্ণবের প্রেমময়তাকে তিনি মাটির সুরে মাখিয়ে নিয়েছেন। তিনি একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। তত্ত্বগানে, পালাগানের মাধ্যমে তিনি মানুষের কাছাকাছি আসতে চেয়েছেন। পরমকে বলেছেন : “ভক্তের অধীন হও চিরদিন / থাকো ভক্তের অন্তরে”।

সংস্কৃতি কীভাবে মরে যায় সেটা করিম বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আক্ষেপজাত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন : “গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান / মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটুগান গাইতাম / আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম”। জলের সংস্কৃতিতে না দাঁড়ালে এই গানের মর্মার্থ উপলব্ধি করা যাবে না।
উজানধল গ্রামে করিম ঘুমিয়ে আছেন। আজকে তাঁর ভক্তরা তাঁকে হয়তো স্মরণ করবে। সুফিকে স্মরণ করবে সুফির উত্তরাধিকার। পৃথিবীতে সুফিরা থাকবে, থাকবে সুফির জিকির।
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে শাহ আবদুল করিম
- জীবন জানাবোঝার এই অনাড়ম্বর আয়োজন || সরোজ মোস্তফা - October 23, 2025
- রকিব হাসান : অকাল প্রস্থান - October 16, 2025
- সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এক সাহিত্যিক ও সমাজশিক্ষক || সরোজ মোস্তফা - October 13, 2025

COMMENTS