শয়নযান : ব্যক্তিগত হাওয়ায় ঝিম মেরে থাকা ভাবনাগুলো || নিবেদিতা আইচ

শয়নযান : ব্যক্তিগত হাওয়ায় ঝিম মেরে থাকা ভাবনাগুলো || নিবেদিতা আইচ

এমন অনেক সময় আসে যখন মাথার ভেতর ভাবনা বলতে কিচ্ছুটি নেই, কেবল উন্মনা হাওয়ার মতো এদিক-ওদিক দুলে ওঠে স্মৃতির ধুলোবালি৷ ঠিক তখন স্বগোতোক্তির মতো বলতে হয় — “আমার ভাবনাগুলোকে নিয়ে আজ আমি একটু খেলা করতে চাইছি।”

ভাস্কর চক্রবর্তীর শয়নযান  বইটি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম সত্যি সত্যি কথাগুলো ব্যক্তিগত হাওয়ায় ঝিম মেরে আছে এমন ভাবনা থেকে লেখা।

“যদি জিততে না পারো তো জিতো না, কিন্তু তুমি হেরেও যেও না তা’বলে।” সে কী ভীষণ অমীমাংসিত খেলা! বইয়ের প্রথম লাইনটিই আমাকে চমকে দিলো আর আমি ভাবতে শুরু করলাম ঠিক এই কথাটি তো সেদিন মনে মনে আওড়েছিলাম। ভাবনা জিনিসটা সত্যি এমন অদ্ভুত!

এই বইটিতে মৃত্যুবোধ নিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনাটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আচ্ছন্ন করেছে। “মৃত্যু ঐরকমই। আসে আর বুকে বাজিয়ে চলে যায়।” জানতে পেরেছি জীবনের সমস্ত মাধুর্য থেকে, আনন্দ থেকে মৃত্যু নামের যে অমোঘ বিচ্ছিন্নতা সেই উপলব্ধি তাকে তাড়া করেছে চিরকাল। জীবনকে তিনি প্রবলভাবে ভালোবাসতেন। তাই তো সেই আসক্তি থেকে বলেছেন — “শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে যদি কোনো লক্ষ্য থেকে থাকে, তা হলো, আত্মহত্যা না করা। এই মহাশূন্যতা যেমনভাবে পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে আছে, সেইরকমভাবে কি ছুঁয়ে থাকা যায় না এই জীবনটাকে?” এমন আকুতি কয়েকটা মুহূর্তের জন্য আহিত করেছে আমাকেও। সত্যি যদি এমন অনন্তকালের ভ্রমণপথ আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেত!

তিনি লিখেছেন — “ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজের মধ্যে টের পেয়েছিলাম এক বিস্ময়কর ভালোবাসার, এক বেদনাময়তার, বেঁচে থাকতে চাওয়ার এক তীব্রতার। প্রেমের স্মৃতিবিষ, আমার জীবনেও চুঁইয়ে পড়েছিল। আমাকে বিষণ্ণ আর অবসাদগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু আমি ভালোবেসেছিলাম কবিতাকে।”

কবিতা সম্পর্কে লেখকের পর্যবেক্ষণ পাঠককে অভিভূত করে দেয় অনায়াসে। কবিতা লেখা মানে শেষ-নেই এমন এক পাহাড়ে চড়তে থাকার অভিজ্ঞতার মতন। এমন আপাতসরল, হাজারমুখো হবে কবিতা যার শুরু কিংবা শেষ হতে পারে যে-কোনো লাইনেই! সমস্ত পৃথিবীটাই যে কবিতা দিয়ে তৈরি! কত সুঘ্রাণ, স্বপ্ন, চাহনি লেপ্টে আছে চারদিকে। এমন বিস্ময়কর কবিতার পৃথিবী।

জীবন নিয়ে তার ভাবনাটাও বেশ জানা গেছে অল্প পরিসরে। যাপিত জীবনের গ্লানির ভারে প্রতিদিন একটু একটু করে নির্জন হয় মানুষ । সেই নির্জনতায় নিমগ্ন হতে হতেও কী প্রবল আকুতি জীবনের প্রতি! “বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার নাম নিঃসঙ্গতা।” এই ট্যাক্স দিয়ে বেঁচে থাকাটা সহজতর হয় যখন তার যুগলবন্দী ঘটে কবিতার সঙ্গে। তার জীবনে এই মেলবন্ধনটি প্রকাশ পেয়েছে এভাবে — “কবিতা ক্রমশই আরো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে আমার জীবনে। আমার বেঁচে থাকাটাকে হয়তো-বা একটু সহজ করে দিচ্ছে। অভ্যাসবশত আমি কোনোদিনই কবিতা লিখিনি। আমার সব কবিতার বই-ই আমার প্রথম কবিতার বই।”

“কোথাও একটা সুন্দর কথা পড়েছিলাম : ‘ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলার দাম একটাকা, ঠিক সময়ে চুপ থাকার দাম দু-টাকা।’ কবিতা লেখার ব্যাপারে আমি বরাবরই ঐ দু-টাকাকেই পেতে চেয়েছি।”


শয়নযান : ভাস্কর চক্রবর্তী ।। প্রকাশক : প্যাপিরাস ।। প্রকাশকাল : ১৯৯৮ ।। কলকাতা

… …

নিবেদিতা আইচ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you