দামান্দর গাড়ি আগালাল || সত্যজিৎ রাজন

দামান্দর গাড়ি আগালাল || সত্যজিৎ রাজন

সেই পুরাতন মৃত্যু, যার সমীকরণ কখনোই জটিল হয় না, আগালালকে গ্রাস করে নেয়। সে অন্যের জমিতে পড়ে যায় ধান রুইতে গিয়া। দাঁড়িয়ে  থাকা অবস্থায় যে দইয়ের মতো কাদায় তার পায়ের ঘণ্টা অবধি ডুবেছিল সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে  আগালালের কান অবধি ডুবে যায়। এই অবস্থায় তার সঙ্গের কামলারা তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যায় তার বাড়িতে। নিয়ে শুইয়ে দেয় তার বহুদিনের পুরানো কালো-হয়ে-যাওয়া কাঠের চৌকিতে।

আগালাল সহজ সরল ক্ষ্যাপা মানুষ ছিল। তার আসল নাম কেউ মনে করতে পারে না এখন আর। আগালাল নামটা গ্রামের পিছলা চরিত্রের মানুষের দেয়া। এই নাম দিয়া তারে ক্ষেপিয়ে বেড়াত সবাই। আগালাল বললেই সে ক্ষেপে যেত। বহুদিন পূর্বে কোনো-এক বিয়ের বর্ণনায় সে বরপক্ষের গাড়িবহরের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই বাক্যবন্ধটি উচ্চারণ করেছিল এক্সক্লুসিভ বুঝাতে।  বলেছিল, — কত কিসিমর গাড়ি যে আনছে এর মাঝে দামান্দর গাড়ির আগালাল! মানে, অনেকগুলো গাড়ি আসছে, বরের গাড়ির সম্মুখভাগ লাল। মানে, যে-গাড়িতে চড়ে নতুন বর আসছে তার অগ্রভাগ লাল। এই কথাটাই গ্রামের মানুষ পেয়ে বসে আর তাকে নিয়ে মশকরা শুরু করে। তাকে দেখলেই লোকে হাসত আর বলত ‘দামান্দর গাড়ি আগালাল’! এতেই ক্ষেপে যেত সে আর সারাগ্রাম দৌড়ায়ে বেড়াতো মশকরাকারীদের।

আগালাল সমাজের হিসাবনিকাশ বুঝত না অতটা। সে কেবল রঙ চিনত। সে বিশ টাকাকে বলত কচুয়া লোট আর দশটাকা লাল লোট।

আগালাল ক্ষ্যাপা মানুষ — ঐটুকুই তার সম্পর্কে শেষ। একদিন বিষণ্ণ বিকেলে আর স্যাঁতসেঁতে সন্ধ্যার মাঝামাঝি টাইমে আগালাল জীবনদৌড়ের সীমানাদড়িতে লম্বা হয়ে পুরো শরীর তুলে দিয়ে ছুঁয়ে ফেলতে চায় ফিনিশিং লাইন। বারবার হাত বাড়িয়ে দেয় আর কব্জি নাড়াতে থাকে। একপর্যায়ে ছুঁয়ে ফেলে আর জিতে যায়। মরে যায় আগালাল। এতদিন যাদের বোঝা বয়ে জীবন চলত তার, আজ তাদেরই কাঁধে চড়ে রওয়ানা দেয় ছায়াঘেরা সেইখানটায়; যেখানে তার মাপের ক্যাপ্সুলঘর বানিয়ে অস্তিত্বের সাক্ষ্যপ্রমাণ রেখে দেবে গ্রামবাসী। যদিও এ-বিষয়ে তার মোটেও মাথাব্যথা ছিল না এখন তো আর নেই-ই।

পুবরগাঁও আর পচিমগাঁও — এর মাঝামাঝি শরিফাদের বাড়ি; চারদিকে ধানক্ষেত মাঝখানে সাত শতাংশ জায়গা নিয়ে তার ছায়াময় বাড়ি।  শরিফার মা আগালালের স্ত্রী। শরিফা আগালালের একমাত্র মেয়ে। বয়স পনেরো-ষোলো বছর হবে। সেই আদরের মেয়েকে ছেড়ে যেতে হলো আগালালকে। মৃত্যুর কোনো নীতি দরদ কিংবা উচিত অনুচিত নেই। যে-কোনো সময় যে-কোনো মুহূর্তে সে অনাহূতের মতো উপস্থিত। কোনো অজুহাত নেই ওয়ারেন্ট-নিয়ে-আসা পুলিশের মতো একটু ভদ্রস্থ হওয়ার, স্নান সেরে পূতপবিত্র হবারও টাইম নেই। এই সভ্য জগতে, আদবকায়দার জগতে, মৃত্যুর মতো অসভ্য বেয়াদব কোনো এন্টিটি আর নেই। তারপরেও দিনশেষে এই আদবলেহাজহীন মরণই তার মতো মানুষকে সফল করে দেয়। সমাজের আর-দশজন মানুষ তার পরিত্যক্ত দেহের বোঝা বয়ে নিয়ে যায়। যে-শরীর জীবিত থাকাকালীন কেবল অন্যের বোঝা বহন করে এসেছে আগামীকাল বেঁচে থাকার জন্য, আজ সে নিজেই অন্যের কাঁধে চড়ে যাচ্ছে তার কবরগৃহের উদ্দেশ্যে। ইল্লাল্লা ধ্বনিতে কেমন মৌমাছির চাকের মতো গুঞ্জন তুলছে আশেপাশের পরিবেশে। কেমন এক দম-ধরা ভেজা ভেজা বিষণ্ণ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে আগালালের লাশ ষোলো পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ক্যাটারপিলার পোকার মতো।

লাশেরা ষোলোপায়ে হাঁটে। ধানক্ষেতের সরু আল পেরিয়ে ঠাকুরবাড়ি আর তামাকুলির বাড়ির মাঝখানের গোপাট পেরিয়ে সুলতানের বাড়ির সামন দিয়ে আলালের বাড়ির প্রবেশমুখের অর্ধসমাপ্ত বিমানের ভাস্কর্য পেরিয়ে লম্বামুল্লার বাড়ির নুয়ে-আসা বাঁশগাছের তলা দিয়ে আগালালের লাশ চলবল করে আগাতে থাকে। গন্তব্য তার কালাচাঁদের মন্দিরের উপর ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন কদমগাছটার নিচ দিয়ে গিয়ে গ্রামের মসজিদের কবরখানা। সেখানে সে এখন থেকে ঘর বেঁধেছে গ্রামের মানুষের দেয়া জমিতে। জীবিত থাকতেই যার ঘরবাড়ি সম্পত্তির হিসাব ছিল না মৃত্যুতেই বা তার এসবে কী আসে যায়।

সবাই যখন কালাচাঁদের মন্দির পেরোচ্ছে খাটিয়ায় আগালালের লাশ নিয়ে ঠিক সেই মুহূর্তে উঠে বসে আগালাল। উপর দিকে তাকায়। আর লাফ দিয়ে ধরে বসে কদমের ডাল। কড়ালিপোকায় খাওয়া ডাল আগালালের ভুঁড়িওয়ালা শরীরের ভারেও ভেঙে পড়ে না। জীবিতের স্বাভাবিকতাবশত সে ভয় পায় ভেঙে পড়ে কি না ভেবে। সে লক্ষ করে তার কোনো ওজন নাই। ডালে বসেই যেখানে প্রথম চক্ষু স্থির হয় দেখে তার লাশ নিয়ে গ্রামের মানুষরা অনেকখানি দূরে চলে গেছে। আগালাল যে তাদের খাটিয়ায় নাই তারা লক্ষ করে না। তারা ক্রমশ দূরে ক্ষীয়মাণ হয়ে যায়।

ঐ দূরে তার লাশবাহী হরিধ্বনিকারী মানুষের দল, যেন মনেহয় অনেকগুলো ছায়াপুতুলের সারি। ছোট ছোট যেনবা তেলিপিঁপড়ার দল। তারা কি হরিধ্বনি করছিল নাকি ইল্লাল্লা জিকির করছিল মনে করতে পারে না আগালাল। আগালালের দুনিয়াবি স্মৃতি যা ছিল তা এই লাশবাহী দলের মতো যেন ক্রমশ অপস্রিয়মাণ।

হঠাৎ আগালালের মনে পড়ে তার ছোটবেলার কথা। তার বাপ তার নাম রেখেছিলেন সিকন্দর। তার বাপের দেয়া নাম সিকন্দর। আহ সিকন্দর! ওহ সিকন্দর! সে তার নিজের নাম নিয়ে বিলাপ করতে থাকে। হঠাৎ সবকিছু সাদা হয়ে যায়। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কদমগাছের ডাল থেকে ছিটকে সিকন্দর সেই সাদা অন্ধকারের

গহ্বরে পড়ে যেতে থাকে। এভাবেই মরে যায় আগালাল তার স্মৃতি ও বিস্মৃতি সমেত।

সত্যজিৎ রাজন রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you