স্লটার প্ল্যানেট || আহমদ মিনহাজ

স্লটার প্ল্যানেট || আহমদ মিনহাজ

কুরবানি ঈদ এলে পশু জবাইয়ের মচ্ছব নিয়ে বাঙালি লেখকসমাজে পক্ষে-বিপক্ষে আওয়াজ শুনতে পাই। এক দিনে লক্ষ-লক্ষ পশুকে এভাবে অকাতরে হত্যার বাতিকটাকে একমাত্র গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে চোখের আবডালে প্রোটিনের চাহিদা পূরণে প্রতিদিন যেভাবে পশু পালন, প্রজনন, হনন ও প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে হাজির করা হয় সেটাও কম ভয়ানক নয়! আমাদের মনে যদিও ঘটনাটি বড়ো কোনো প্রতিক্রিয়া আজো ঘটায় না। ঘর কিংবা রেস্তোরাঁয় প্রোটিনের স্বাদে ভরপুর জীবকে উদরে আত্মসাৎ করার সময় মনেই থাকে না হাজারো উপায়ে তাদেরকে আমরা প্রতিনিয়ত শিকার করে চলেছি। তাদেরকে আমরা বন্য থেকে গৃহপালিত জীব করে তুলছি। প্রজনন বৃদ্ধির নামে ভয়ানক সব পন্থায় লালন, হত্যা ও মোড়কবন্দি পণ্য রূপে বাজারে চালানের ব্যবসাটা সেরে নিচ্ছি ফাঁকতালে! মুসলিম উম্মাহ কর্তৃক পশু জবাইয়ের মচ্ছব পীড়াদায়ক বা অশ্লীল হলেও সম্বৎসর দুনিয়া জুড়ে পশুহত্যার যেসব মচ্ছব চলে সেগুলোকে বোধহয় আমাদের ভাবনায় প্রাসঙ্গিক করার সময় হয়েছে। পশুপ্রেমী লোকজন কিংবা ব্যবহারিক দর্শন চর্চার সপক্ষে সোচ্চার পিটার সিঙ্গারের মতো দু-চারজন ছাড়া এসব নিয়ে কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া ভার হয়।

কুরবানির ঈদে পশু জবাইয়ের চলটা আমাদের সমাজে সকলের চোখের সামনে ঘটায় মন আঁতকে ওঠে। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে গোটা দিন ধরে একটা সম্প্রদায়কে সিরিয়াল কিলারের  ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখার চাপ আতঙ্ক ও বিবমিষা জাগায় বটে! ছুরি-চাপাতি দিয়ে গলাকাটার এই মহোৎসব আমাদের সভ্যভব্য থাকার ভানটাকে এক নিমিষে নগ্ন করে দেখে কি নিজেকে যারা সংবেদনশীল বলে জ্ঞান করি তারা শিউরে উঠি? জীবহত্যাটা যদি উন্নত বহু দেশের মতো স্লটার হাউজে  নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ঘটানো হতো তাহলে কি এটা নিয়ে লেখার বন্যা বইত দেশে? দেশে এক দিনে এত লক্ষ পশুকে কসাইখানায় কোতল করা হয়েছে; — এ-রকম তথ্য আমাদের বিচলিত করলেও তাকে হত্যাদিবস ভাবার কাব্যিকতায় উতলা করত বলে মনে হয় না! পুষ্টি ও প্রোটিনের চাহিদা মিটাতে গৃহপালিত জীবকুলকে যেভাবে প্রতিদিনি হত্যা ও বাজারজাত করা হয় সেটা মোটের ওপর সকলে অবগত হলেও একে হত্যাদিবস বলে দাগানোর রুচি কারো হয় না, যেহেতু ঘটনাটি সুশৃঙ্খল নিয়মে চোখের আড়ালে সচরাচর ঘটে থাকে। যারপরনাই কুরবানি ঈদে পশু জবাইয়ের মচ্ছবটা বীভৎস হলেও এর জন্য মুসলমান সম্প্রদায়কে একলা গালমন্দ বা সমালোচনায় কী উপকার ঘটছে সেটা মাথায় ঢোকে না। চোখের আড়ালে বা প্রকাশ্যে যেভাবেই ঘটুক…হত্যা তো হত্যাই, আর কাণ্ডটি মুসলমান নির্বিশেষ সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে কমবেশি সত্য এখন।

মানুষ তার জন্মলগ্ন থেকে হত্যাকারী। নিজের অন্তিম প্রয়োজনে সে যেমন জীবহত্যা করে, অপ্রয়োজনকে প্রয়োজনে পরিণত করেও হত্যাকাণ্ডে জারি থাকে অহর্নিশ। স্রষ্টার উদ্দেশে পশু বলিদান বিচিত্র উপায়ে হত্যায় পারঙ্গম মানবজাতির জীবহত্যার একটি দিক মাত্র। বুদ্ধভাবে মাথা মোড়ানো অথবা নিরামিষ ভক্ষণে অভ্যস্ত ব্যক্তি প্রাণীহত্যা করছেন না ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকেন, যদিও উদ্ভিদের প্রাণ আছে বলে যদি স্বীকার যাই সেক্ষেত্রে তিনি উদ্ভিদপ্রাণ হত্যার অপরাধে অপরাধী নন কি? হত্যা ব্যতীত মানুষ তো বটেই, কোনো প্রাণীকুলের পক্ষেই জীবনধারণ সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, হত্যায় ভারসাম্য বজায় রাখা দরকারি। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে এক জীব অন্য জীবকে হত্যা ও ভক্ষণ করেই বাঁচে; — ডারউইনের সূত্র যদি স্মরণ করি তবে এটা প্রকৃতির অর্থনীতির অনিবার্যতা বলে মেনে নিতে হয়। একে অন্যকে ভক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে লালিত জীবকুলের জনমিতি নিজের অস্তিত্ব, প্রজনন ও ভারসাম্যে থিতু থাকে। ডারউইন যেমন উদাহরণ দিয়েই দেখিয়েছেন, হাতির মতো চমৎকার প্রাণীকে নির্বিঘ্নে বাড়তে দিলে একটা পর্যায়ে তার সংখ্যা এতটাই অতিকায় আকার ধারণ করবে যে তখন ভারসাম্য বলে কোনো ব্যাপার নাকি সেখানে থাকবে না। মানুষের ক্ষেত্রে সমস্যাটি বোধ করি ঘটছে। বেশ নির্বিঘ্নে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বাড়তে থাকায় তার সংখ্যাটা এই মুহূর্তে সামগ্রিক প্রাণীকুলের জনমিতি বিবেচনায় ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে নেই।

ভারসাম্যহীনতার কুফল ইউভাল নোয়া হারারি-র কিতাবে গমন করলে খানিক মিলে। হারারি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষ করে দেখিয়েছেন মানবজাতির অস্তিত্বরক্ষার জিহাদ কীভাবে ক্রমশ সেইসব উপযোগের জন্ম দিয়েছিল যার কারণে প্রকৃতিতে প্রজাতিবিলুপ্তির ঘটনা বারবার অমোঘ হয়েছে। শিকারি থেকে কৃষিজীবী সমাজে মানুষের উত্তরণ ছিল আদি ধাপ যার কারণে গণপ্রজাতি বিলুপ্তির ঘটনা তখন ঘটেছিল। দানাদার শস্য তাকে যাযাবার জীবনের ক্লেশ থেকে মুক্তি দিলেও চাষের প্রয়োজনে অরণ্যসংহার সামগ্রিক পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছিল। কেবল তা-ই নয়, তার খাদ্যগ্রহণের ভারসাম্যে সেদিন থেকে বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটে। শিকারির দিনগুলোয় মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য ও পুষ্টিগুণ ছিল। সে হয়তো সকালের নাস্তা সেরেছে বুনো ফল বা শামুক জাতীয় কোনো প্রাণীকে ভক্ষণ করে। দুপুরে পাখি শিকার করে পেটের খিদে মিটিয়েছে। পশুর মাংসে রাত্রিভোজ সেরেছে তখন। দানাদার শস্য উৎপাদনের দিন থেকে বৈচিত্র্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। তিন বেলা গম, ভুট্টা বা ধান তার খাদ্যে পরিণত হলো! সেখানে আবার সমবণ্টন নামক ব্যাপারটা ক্রমশ উধাও হতে শুরু করে। শিল্পযুগে পা রাখার দিনে খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য ব্যাপক হলেও গণপ্রজাতি বিলুপ্তির দ্বিতীয় ঘটনার দায় সে এড়াতে পারে না। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পা রাখার দিন থেকে তৃতীয়বার ওটা ঘটছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে অগত্যা ভাবনা করা প্রয়োজন।

আসন্ন খাদ্যসংকট মোকাবিলায় মানুষকে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত জৈব খাদ্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে এখন। কৃত্রিম পন্থায় ডিম উৎপাদন দিয়ে ওটা শুরু হলেও থ্রিডি প্রযুক্তির কল্যাণে সিনথেটিক মিট  উৎপাদনের চেষ্টায় সে মেতে উঠেছে। স্বাদ ও পুষ্টিগুণে প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত অথবা খামারে উৎপাদিত মাংসের সমতুল হলেও পুরোটাই সেখানে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত হয়ে থাকে। মানবজাতির ভবিষ্যৎ খাদ্যাভ্যাসে একে অপরিহার্য বলে অনেক বিজ্ঞানী আজকাল কামান দাগিয়ে থাকেন, যেহেতু পোল্ট্রি ও খামার নির্ভর পদ্ধতিতে মাংসের চাষ সামগ্রিক পরিবেশের ওপর চাপ তৈরি করছে বলেই তাঁরা মানছেন। কুরবানির সুবাদে কথাগুলো কেন জানি মনে পড়ছে এইবেলা। ধর্মাচারের নামে গণহারে পশু জবাইয়ের মচ্ছবের চেয়েও দুনিয়া জুড়ে মাংসজাত খাদ্যে মানবজাতির দুর্নিবার ঝোঁক বড়ো বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করে।

প্রকৃতির জনমিতিতে মানুষের বাড়বাড়ন্তের কারণে মাত্রাছাড়া যত কাণ্ড ঘটেছে গোটা একটা দিন ধরে অবলা জীবকে কুরবানির নাম করে গণহত্যা হয়তো তার একটি। সমস্যা হলো একে একলা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফায়দা নেই, যতক্ষণ না মানুষ এটা বুঝতে সক্ষম হচ্ছে, — স্রষ্টার উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা বা নিজের তাকওয়া  প্রমাণে পশুবলিটা অনিবার্য নয়, অন্য বহু উপায়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো যেতে পারে বা সেটা সম্ভব। যারপরনাই হত্যা সে কীভাবে করছে বা সেটা তার জন্য আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল কি না এ-নিয়ে হয়তো কথা বলা যেতে পারে।


মানুষকে তার প্রয়োজনে জীবহত্যা করতে হয়। দেহের পুষ্টি মিটানোর ব্যাপার সেখানে রয়েছে। আবার দেশকাল, পরিবেশ, ধর্মাচার ও সংস্কৃতি ভেদে কোনো-না-কোনো জীবকে মানুষ তার উদরপূর্তি থেকে শুরু করে শতেক প্রয়োজনে যেমন সংহার করে তেমনি লালনও করে। সাংগঠনিক আকারে যবে দীনচর্চার বালাই ছিল না তখনো লোকে সমানে পশু বলি দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। সনাতন প্রথাটিকে মন্দ বলে খারিজ করা যেমন সম্ভব নয়, একে ভালো বলে দাগানোও কঠিন। কোরানে বলা আছে বটে, জবেহ করা পশুর রক্তমাংস কিছুই স্রষ্টার কাছে পৌঁছায় না, যেটা পৌঁছায় সেটা হচ্ছে তাকওয়া। শরিয়তপন্থী ইসলাম পশু জবেহ করার একগুচ্ছ বিধান মুসলমানকে স্মরণ রাখতে বলে : পশুটি যথাসম্ভব খুঁতহীন হতে হবে; জবেহ করার আগে তার যত্ন নেওয়া জরুর; এক পশুর সামনে আরেক পশুকে জবেহ করা যাবে না; কষ্টকর পন্থায় তাকে জবেহ করা মানা; জবেহর উদ্দেশ্য কেবল মাংসভক্ষণ বা ফ্রিজে বোঝাই করা নয় বরং সেই মাংস কীভাবে বিলিবণ্টন করা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ইত্যাদি। স্রষ্টার সৃষ্টিকে হত্যার ক্ষণে তার প্রতি দরদ বোধ করা মুসলমানের জন্য অন্তিম। এইসব বিবেচনা মাথায় নিয়ে খুব কম মুসলমান পশু ক্রয় ও তাকে জবেহ করে থাকেন।

পশু কুরবানির ঘটনায় ক্রেতার চেয়ে বরং বিক্রেতাকে উত্তম মুসলমান মানতে হয়। পশুকে নিজের জীবিকার অবলম্বন রূপে সে লালন করে এবং তাকে বিক্রির সময় তার চোখে জল বহে বা মন বেদনায় ভরে ওঠে। স্রষ্টা যদি তামাম জাহানকে সৃষ্টি করেই থাকেন তাহলে ধরে নেওয়া সমুচিত মানুষকে তিনি এর সঙ্গে মিল করে সৃষ্টি করেছিলেন। তাকে তিনি বোধ ও বিবেচনাশক্তি যেমন দিয়েছেন, এর লঙ্ঘনে তার পরিণতি কী হতে পারে সেই ইশারা দিয়েছেন বৈকি! পৃথিবীর সকল ধর্মীয় কিতাবে কমবেশি একই সুর ধ্বনিত দেখতে পাই। এখানে দাঁড়িয়ে হয়তো আগে ভালোবাসো, তারপরে ত্যাগ-এর মারেফতকে নিজবক্ষে ধারণ করা প্রয়োজন। বলা বাহুল্য সেটা কেবল মুসলমান নয়, প্রোটিনবুভুক্ষু সমগ্র মানবজাতির হয়তো এই সংবেদী ভাবনায় গমন করা প্রয়োজন।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
কুর্বানির ঈদ ২০২২ : গানপার সংকলন

COMMENTS

error: