জঞ্জালভরা জগৎসংসারে সৎ ও নির্লোভ থাকা বড়ই কঠিন। রঙেভরা বঙদেশে তো ভয়াবহ ব্যাপার। দীনহীন বাউল মকদ্দস আলম উদাসী চারপাশের এই জঞ্জালকে থোড়াই কেয়ার করে নিত্য অভাব অনটনের মধ্যেও সিনা টানটান রেখে সোজা মেরুদণ্ড নিয়েই আজ ১৪ জুলাই ২০২২ ভোরে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাকে কুর্ণিশ। অতল শ্রদ্ধা।
তিনি জীবদ্দশায় দেশের শ্রেষ্ঠ বাউল সাধক ছিলেন। এক ঘোরলাগা নিভৃতচারী জীবনপথিক ছিলেন তিনি। বাউলামির পরম্পরার মধ্যেও তিনি আলাদা ও প্রোজ্জ্বল ছিলেন। উদাসীভাই প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন। সংরক্ষণের অভাবে অনেক গান হারিয়ে গেছে, চুরি হয়ে গেছে। তার গানে আঞ্চলিক শব্দের বিরল ব্যবহার এবং প্রতীকী রূপ এক ভিন্নরকম দ্যোতনা দেয়।
এই লেখাটি সংক্ষিপ্ত স্মৃতিপাঠের জন্য।
থাকতেন জগন্নাথপুরের এক বস্তিতে। অর্থসম্পদ জাগাজমিনের প্রতি ভীষণরকম উদাসীন ছিলেন। বাউল-অনুরাগী পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক জেলা প্রশাসনকে মুজিববর্ষের একটি ঘর বাউলকে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। জগন্নাথপুরের তৎকালীন ইউএনও আমাদের বন্ধু মেহেদি হাসান নুয়েলের সঙ্গে গত পৌরনির্বাচনের সময় আমার দেখা হলে আমিও তাকে বাউলকে সহযোগিতার অুনরোধ করি। তখনই উনি আমাকে জানান বাউলকে জরুরি কাজের জন্য খুঁজতেছেন। পাচ্ছেন না। আমি তার সামনেই ফোন দিয়ে অনুরোধ করি ইউএনও অফিসে আসার জন্য। আধাঘণ্টা পরেই উদাসীভাই চলে আসেন। তখন নুয়েল প্রস্তাব করেন জমি সহ একটি ঘর উপহার দিতে চান। আমাদেরকে বিস্মিত করে বাউল সগর্বে বলেন, ‘মায়ার সংসারে আমি সম্পদের কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চাই না। আমার এসবের দরকার নেই।’ তার ব্যক্তিত্বের কাছে আমরা হোঁচট খাই, ঝেড়ে কাশি। আমি বাউলের কানে কানে কথা বলে কিছু সহযোগিতার অনুরোধ করি। তিনি নীরব থাকেন। পরে অনুমতি দিলে ইউএনও তাকে একটি খামে কিছু নগদ সহায়তা দেন। এভাবে নুয়েল যতদিন ছিল বাউলের জন্য সহযোগিতার দরজা উন্মুক্ত ছিল।
গত বছর এই সময়ে সুনামগঞ্জে ডিডিএলজির দায়িত্ব নিয়ে আসেন কবি জাকির জাফরান (Zakir Zafran) ভাই। তিনি ছুটে যান বাউলের ডেরায়। জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন থেকে বাউলের অনুমতি নিয়ে আর্থিক সহযোগিতা দেন যাতে তিনি চিকিৎসা করান। আমরা সিলেটের চিকিৎসক বন্ধুদের দিয়ে ওসমানীতে তাকে বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। কিন্তু তিনি পুরো চিকিৎসা না নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে আসেন। তাকে ধরেবেঁধে রাখা যেত না। জগন্নাথপুরের বস্তি তাকে টানত।
কোনো সমস্যা হলেই আমার সঙ্গে কথা বলতেন। আমি চেষ্টা করতাম তার পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে নানাভাবে সহযোগিতার। জাকির জাফরান ভাই আসার পর বাউলের সবকিছু তাকে অবগত করতাম। সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় তার বস্তি ভেসে যায়। তার নিরন্ন জীবনের সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়। আশ্রয় নেন আব্দুস সামাদ আজাদ অডিটরিয়ামে। তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। কয়েকদিন পরে আমাকে ফোন দেন। নতুন সেট নেওয়ায় স্টোর থেকে নম্বরটি হারিয়ে যায়। প্রথমে আমি চিনতে পারিনি। পরে কণ্ঠ চিনে জাকিরভাইকে তার অসহায়ত্বের কথা অবগত করি। জাকিরভাই ইউএনওকে দিয়ে তার বস্তিতে খাবার ও অর্থসহায়তা পাঠিয়ে দেন। তবে এই সহায়তাও আরেক মধ্যস্বত্ত্বভোগী মেরে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ঈদের আগের দিন আমি ও জাকিরভাই দুইজনেই আলাদাভাবে কিছু সহায়তা পাঠাই।
এর মধ্যেই দেখি বন্যার ভয়াবহতায় প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। কথা জড়িয়ে যায়। বুঝতে পারি তিনি মাইনর ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। কিন্তু চিকিৎসা নিচ্ছেন না। ঈদের আগের দিন রাতেও আমি এবং জাকিরভাই তাকে চিকিৎসা নেওয়ার অনুরোধ করি। তিনি তখন জগন্নাথপুরের বস্তি থেকে দোয়ারাবাজার উপজেলার নরসিংপুর ইউনিয়নে তার ভাগ্নির বাড়িতে চলে আসেন। সেখানেই আজ প্রয়াত হলেন। সেখানেই তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী গোরদাফন হবে।
মানুষ হিসেবে প্রশ্নহীন সৎ ছিলেন তিনি। ছিলেন দেশপ্রেমিকও। মানুষের জয়গান গেয়েছেন বর্ণ, গোষ্ঠী, জাতপাতের বিরুদ্ধে গিয়ে। আঞ্চলিক ভাষা, ভাব ও ভঙ্গিতে অসঙ্গতিকে গণগীতিতে তুলে ধরেছেন।
১৯৭১ সনে এই দেশের মানুষের প্রতি পাকিস্তানি জল্লাদ ও তাদের দোসরদের ভয়াবহ রকম নির্যাতন দেখে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। নাইন্দার হাওর পাড়ি দিয়ে ৩১ জন যুবকের সঙ্গে জুলাই মাসে রওয়ানা দেন ভারতের উদ্দেশ্যে। এলাকার রাজাকার দিলু ও তার দলবল খবর পেয়ে তাদের পাকড়াও করে। মুক্তিযুদ্ধে গেলে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবে, মা-বাবা ও ভাইবোন সহ পরিবারকে নির্বংশ করবে হুমকি দেয়। এই অবস্থার মধ্যে উদাসীভাইরা ৫ বন্ধু পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। উদাসী সহ ২৬ জন ফিরে আসেন। খুব নীরবে সময় পার করেন। একাত্তরের আগস্ট মাসের দিকে মুক্তিবাহিনীর স্পাই সন্দেহে তাকে পাকড়াও করে হানাদার দোসররা। বালিউড়া ক্যাম্পে চোখ বেঁধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। আরেকবার নিজ বাড়ি চরবাড়ায়ও নির্যাতন করে।
কিছুদিন মাদরাসায় পড়ার সুবাদে তিনি উর্দুতে কিছু বাৎচিত করতে জানতেন। বাউল হিসেবে এলাকার মানুষও তাকে ভালোবাসত ও শ্রদ্ধা করত। তাই এলাকাবাসীরা হানাদারদের কবল থেকে তাকে রক্ষা করে। এভাবে একাত্তরে দুইবার হানাদারদের কবল থেকে জীবন রক্ষা করেন তিনি। বিজয়ের খবরে রাস্তায় একতারা নিয়ে বেরিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা জনতার সঙ্গে মিশে বিজয় উদযাপন করেন।
১৯৬৯ সনে বাউল দুর্বিণ শাহর সান্নিধ্যে গণআন্দোলনের পক্ষে হাটে-বাজারে গান করেন। এভাবে আমৃত্যু দেশের পক্ষে, মানুষের পক্ষে ছিলেন। জীবনের একেবারে শেষবেলায় বন্যাশ্রিত হিসেবে অসহায়ভাবে তার চলে যাওয়া কষ্ট দিচ্ছে। তবে মানুষকে কষ্ট না দিয়ে, না ভুগিয়ে নীরবে চলে যেতে চেয়িছেলেন তিনি। তার প্রাণেশ্বর তার আহ্বান শুনেছেন।
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS