স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৫ || সানজিদা শহীদ

স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৫ || সানজিদা শহীদ

২০০৫ সাল। আমি গত পর্বেই বলেছি, আমার জীবনের পুরো মোড় ঘুরিয়ে দেয়া একটা বছর। মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য প্রচুর পড়তাম। এক্সামের ঠিক আগের একমাস আমি অমানুষিক পরিশ্রম করেছি। দিনে এক ঘণ্টা, আর রাতে তিন ঘণ্টা ঘুমাতাম মাত্র। হয়তো রাত একটায় ঘুমিয়েছি তো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম চারটার। উঠে পড়া শুরু করতাম, বইখাতা আমার বিছানার পাশেই থাকত, মশারির ভিতর। আম্মা আমাকে লাইটের বেডসুইচ করে দিয়েছিলেন, উঠে লাইট জ্বালিয়ে রোবটের মতো পড়তাম। আমি আমার মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, নিজের একটা পরিচয়ে পরিচিত হবার জন্য, আব্বা-আম্মার স্বপ্ন ওনাদের বড়মেয়েটা একটা সাদা অ্যাপ্রোন, স্টোথোস্কোপ গলায় পরে ডাক্তার হোক — সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য, আম্মাকে সারাজীবন দাদাবাড়িতে অনেক অসম্মান করা হতো ছেলে নেই দেখে, বংশের প্রদীপ একটা ছেলে দরকার — এই অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, সারাজীবন সেই ছোট থেকে আমার গায়ের রঙটা শ্যামলা ছিল, পরিবারের বাকি সব মেয়েরা ফর্শা ছিল — আমি ফেলনা কেউ ছিলাম না, এটা প্রমাণ করার জন্য, আব্বার অফিসের দুই বসের মেয়ে আমার চেয়ে খারাপ ছাত্রী ছিল, আব্বাকে প্রতিদিন ডেকে নানাভাবে অপমান করা হতো, সেই প্রতিশোধ নেবার জন্য … আরো অসংখ্য কারণে আমি মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম শুধুমাত্র মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য। আমি সরকারি মেডিকেল ছাড়াও আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আমি প্লেসই করি, এসব জায়গায় আমি চান্স পেয়েছিলাম সে-সময়। আমি হেরে যেতে চাইনি জীবনের কাছে কখনো, অন্তত নিজের কাছে তো কখনোই না।

আমার ম্যাচুরিটিও এসেছে অনেক অনেক দেরিতে, ছেলেদের মতো। একটা ভালো বিয়ে হওয়ার জন্য যে আমাকে এই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বের হয়ে পড়ালেখা করে উপরে উঠতে হবে, এমন চিন্তা আমার মাথায় কখনোই আসত না। আমি পুতুল খেলেছি অনেক বছর বয়স পর্যন্ত। অনেক শৌখিন আর গোছানো ছিল আমার সেই কাপড়ের পুতুলখেলা। একা একাই সুন্দর করে কাপড়ের পুতুল বানাতাম। দু-একসময় আব্বার সাথে বাজারে দর্জির দোকানে যেতাম, নানা কাতান কাপড়, লেইস সুন্দর সুন্দর এগুলো নিয়ে আসতাম। তারপর মার কাপড়-কাটা কাচি দিয়ে নানা ঢঙে ছোট ছোট জামা বানাতাম পুতুলের। ছোটবোনও পুতুল খেলত কিন্তু ওর লোভ থাকত সবসময় আমার পুতুলের বাকশের দিকে, কখনো চুরিও করত, কারণ ও এ-রকম বানাতেও পারত না, গুছিয়েও রাখতে পারত না, আমি আবার ধরে ফেলতাম প্রায়ই ওর চুরি করা। অন্য মেয়েরা যে বয়সে ঋতুস্রাব, বিভিন্ন যৌন ব্যাপারগুলো জানত, আমি সে-সময় নির্বোধ ছিলাম এসব ব্যাপারে পুরোটাই। কারণ আমাকে স্কুল বদলের পর কারো সাথে সে-রকম মিশতে বা গল্প করতে দেয়া হতো না, আমিও সময় পেতাম না।

তবে আমি ছোটবেলা থেকেই অন্যকিছুর সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও ক্যারিয়ারের নানা সিদ্ধান্তগুলো একা-একাই সাহস করে নিয়ে ফেলতাম, ঐ যে বললাম-না ছেলেদের মতো কিছুটা। আমি স্বাধীনচেতাও ছিলাম অনেকটা, যতই বয়স হয়েছে ততই এই স্বাধীনচেতা মনোভাবটা বেড়েছে। আজ এত বছর পর, যখন আমার অন্য বান্ধবীরা দিব্যি ঘরসংসার, স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে আমি এখনো নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করায় ব্যস্ত। আমার এজন্য সে-রকম কোনো আফসোস হয় না। যার যার জীবন যে-রকম। আমি কারো সাথে আমাকে কম্পেয়ারও করতে যাই না, আমার জন্য যেটা দরকার ছিল আগে, সৃষ্টিকর্তা আমাকে সেটাই দিয়েছেন।

আমি শুরু করেছিলাম যশোর থেকে কারণ ওটা পুরোপুরি আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। কিন্তু তারও আগে আমার আব্বা-আম্মার সংসার শুরু হয় ঢাকায় এবং জন্মেছিও সেখানে। সেখান থেকে আমরা রাজশাহীতে যাই বাবার বদলীর কারণে। রাজশাহীতে শুধু যে-বাসাটায় ছিলাম তার অল্প অল্প কিছু স্মৃতি আমার মনে পড়ে, খুব বেশি না। অনেক পরে রাজশাহীতে গিয়েছিলাম একবার, গিয়েছিলাম আমার স্মৃতির সেই বাসায়। যশোর আমার স্মৃতির তৃতীয় শহর ছিল যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। আর বরিশাল আমার পঞ্চম শহর। বরিশাল সম্পর্কে বলতে গেলে আরো পিছনের অনেক অনেক স্মৃতি ভেসে আসে কারণ আমি বরিশালেরই মেয়ে। আমার দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি … আমার শিকড় সব এখানে। পরের পর্বে আমার সেই সুন্দর স্মৃতির কথা না-হয় লিখব, মেডিকেলের স্মৃতিচারণ শুরু করবার আগে। আজ না-হয় থাক এ-পর্যন্তই।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you