স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৬ || সানজিদা শহীদ

স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৬ || সানজিদা শহীদ

আমার নানিবাড়ি বরিশাল শহরের খুব কাছের একটা গ্রামে। শহর থেকে যেতে আধাঘণ্টার মতো লাগে। নানাবাড়ি না বলে নানিবাড়ি বলছি এ-কারণে যে নানাকে আমি দেখিনি, উনি যখন মারা যান তখন আমার মা, খালা, মামারাই অনেক ছোট। বড়মামা কেবল এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন, ওনার অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন নানা মারা যান। মামার ছোট বাকি ছয় ভাইবোন। মোট সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে নানি অথৈ সাগরে পড়ে যান। সারাজীবন কষ্ট করেছেন। নানা ছিলেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের টিচার, চাকরি করে গ্রামে অনেক জায়গাজমি রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু তা দিয়ে হয়তো বছরের চাল-ডালের হিসেবটা হয়, কিন্তু আরো তো খরচ আছে। মামা খুব অল্প বয়সে চাকরিতে চলে যান ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার জন্য।

যা-ই হোক, নানিবাড়িতে যখন আসতাম তখন অনেকদূর কাঁচা পথ হেঁটে আসতে হতো, পথে তিনটা ছোট ছোট বাঁশের সাঁকো পড়ত, এখন তো ছোট ছোট কালভার্ট হয়ে গিয়েছে সেগুলো। বাঁশের সাঁকো হারিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল থেকে উন্নত প্রযুক্তির কারণে, হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে সেই সাঁকো পার হতাম। কিন্তু মনে কী আনন্দ! কারণ প্রতি বছর আসা হতো না, দু-তিন বছর পর আসা হতো, ঐ যে কারণ একটাই — পড়ালেখা। এসে সেই উত্তরবঙ্গ থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।

খুব ভোর হলেই বাড়ির সবাই উঠে পড়ত, আমাদের তিন বাড়ি মিলে মাঝখানে বিশাল উঠোন, বাড়ির বাইরে সামনে ডিপ টিউবওয়েল, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে রাস্তা, রাস্তার দু-পাশে ক্ষেত। আমরা আসতাম অধিকাংশ সময়ই শীতকালে, বার্ষিক পরীক্ষার শেষে, ডিসেম্বরের দিকে। আমাদের এই তিন বাড়ির যৌথ টিউবওয়েলে পানি নিতে আসতো ‘মাঝের বাড়ি’ বলে ডাকত সেই বাড়ির লোকেরাও। মাঝের বাড়ির পরেই পশ্চিমদ্বার বাড়ি। মাঝের বাড়ির লোকদের নিয়ে আসেন মূলত আম্মার দাদার বাবা, তখন ঐ অঞ্চলে মানুষের বসতি কম ছিল, মানুষ বাড়ানোর জন্য জায়গা দিয়ে নিয়ে আসেন ওনাদের। নানিবাড়ির পিছনদিকটায় ছিল পুকুর, আর পুকুরের চারপাশে জঙ্গলের মতো অনেকগুলো গাছে হয়ে থাকা লাল একটা বুনো ফুল, আসলে ওটা ছিল জবার একটা জাত। আর ছিল প্রচুর ঝুমকোজবা। ওখানে গেলে যে-কারো মন ভালো হয়ে যাবে।

শীতকালে সকালে বিশাল এক পাতিলে চা বানানো হতো, কারণ নানির নাতি-নাতনিরা সবাই আমরা ও-সময়টাতেই বেড়াতে যেতাম। সেই সাথে মাঝের বাড়ির জালালের মাও খুকখুক করে কাশতে কাশতে চলে আসত, নানিকে হেসে বলত — ও বুজি এট্টু চা দেতে পারো মোরে? বরিশালের এদিকের বাড়িগুলোর নিয়ম টিনের আর কাঠের বেড়া আর উপরে কাঠের পাটাতন। একেকটা বিশাল লম্বা লম্বা ঘর, তার দু-পাশে দুটা খাট অনায়াসে বসানো যায়, আর লম্বা লম্বা রুমের মাঝ বরাবর দরজা। নানিবাড়িতে এক রুমে একটা ডাইনিং টেবিল ছিল ছোট, কিন্তু আমরা এত মানুষ অত ছোট টেবিলে জায়গা হতো না। আমরা কেউ বসতেও চাইতাম না। পাটি বিছিয়ে বসে যেতাম খেতে, প্রথমে বাচ্চারা, পরে বাড়ির পুরুষেরা আর সবশেষে বাড়ির মেয়েরা। মা-খালারা সবাই মিলে আমাদের খাবার বিলিবণ্টন করতেন, আমরা সে কী হইচই! প্রতিবেলায়ই একটা পিকনিক আমেজ। কখনো বাড়ির একদিকে আরো একটা ধান শুকোবার উঠোন ছিল, আঞ্চলিক ভাষায় বলতেন ওটাকে ‘খইল্লান’। মা-খালারা সকালে সবাইকে নাস্তা খাইয়ে ভাত নিয়ে সেখানে চলে যেতেন খেতে, শীতের রুইমাছ টমেটো, শিম, ধনেপাতার তরকারি আর লাল মোটা চালের ভাত। শীতে জমাট বাঁধা সেই তরকারি গরম দেবার দরকার পড়ত না, সূর্যের তাপেই গলে যেত, ওনারা শীতে কাঁপতে কাঁপতে উপভোগ করতেন নরম রোদের উষ্ণতা আর গল্প করতেন সারাবছর কার সংসারে মজার কি হয়েছে আর খিলখিল করে হাসতেন। সেখানে সবসময় আমাদের  ছোটদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

সকালের নাস্তা শেষে আমি আর বড়খালার মেয়ে মনিবু বের হতাম গ্রামে কোথায় কি পাওয়া যায় তার খোঁজে। আমি অত খেতাম না, কিন্তু খুঁজে আনতে ভালো লাগত, এতেই আনন্দ। আর গ্রামের মানুষ অন্য কারো ক্ষেত থেকে কিছু আনলে কিছুই বলত না, এসব তাদের কাছে মহামূল্যবান কিছু না, প্রতিদিন এসব খেতে খেতে তারা অভ্যস্ত। আমরা হয়তো কারো ক্ষেত থেকে কুমড়োফুল, তো কারো ক্ষেত থেকে কচি সবুজ কুমড়ো, কচুর লতি, খেসারী শাক, কচু শাক, মিষ্টি তেঁতুল, হিন্দুবাড়ির ওদিক থেকে চালতা, আমড়া এসব খুঁজে আনতাম আর নানির বকুনি খেতাম। উনিও বলতেন — কী সব খাও? এইয়্যা খাইতেই কি গ্রামে আইছো আয়? উনি ওনার খোপ থেকে আগেই একটা বড় মুরগি ধরে রাখতেন দুপুরের খাবারের জন্য, বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলে এটাকে ‘রাওয়া’, তাই দিয়েই হতো মাটির চুলায় মাটির পাতিলে দুপুরের ‘শালুন’। নয়তো পুকুরের তাজা পাঁচমিচাশালী মাছ লাল করে ভেজে মাখা মাখা ‘শালুন’।

সন্ধে নামলেই পুরো গ্রামটা ভীষণরকম চুপচাপ হয়ে যেত, মনে হতো এই গ্রামে কোনো মানুষই নেই। আমার তখন ভীষণ ভয় লাগত কেন জানি। আরো শীতকাল, তাড়াতাড়ি সবাইকে খাইয়ে রাত দশটা না বাজতেই ঘুম। আবার খুব সকালেই নানি এসে মশারি একটু ফাঁক করে ডাক দিতেন — ও মনু, ওডবা না, ওডো ওডো! কীভাবে যেন ছুটির ক’টা দিন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেত, ভীষণরকমের মনখারাপ হতো। চলে আসার দিন নানি আঁচলে বারবার চোখ মুছতেন, সেইসাথে আম্মাও চোখ মুছতেন। নানি জিজ্ঞেস করতেন ভিতরের তৃষ্ণা নিয়ে আম্মাকে — আবার কবে আসবা? আম্মা বলত — জানি না, মা। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না যে যখন তখন চাইলেই মা-মেয়ে একটু কথা বলবে। এখন যখন আমি মার সাথে প্রতিদিন কথা বলি, তারপরেও মনে হয় ছুটি নিয়ে কবে বাসায় যাব? এই বয়সে এসে ভাবি বছরের পর বছর মা-মেয়ে কথা না বলে কীভাবে থেকেছে? আম্মা দিব্যি আমাদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, সংসার করেছেন। ভাবলেই ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস আসে, বুকের ভিতর এক অচিনপুর, সেখানে হু হু করে।

আমি যখন মেডিকেল থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে উঠি, তখন নানি মারা যান। অল্প বয়সে বিধবা হওয়া, সাতটা বাচ্চা নিয়ে আজীবন একা একা জীবনযুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া এই নারী আমার জীবনের অন্যতম প্রেরণা এবং আদর্শ। আমার গায়ের রঙ হয়েছিল শ্যামলা, নানির গায়ের রঙের মতো, নানিবাড়ির সব মেয়েদের গায়ের রঙ ছিল ফর্শা। ছোটবেলা থেকে আমাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে, আমার মন ছোট হয়ে থাকত। কিন্তু নানি খুব জ্ঞানী মহিলা ছিলেন, উনি আমাকে সাহস দেবার জন্য সবসময় একটা কথাই বলতেন, কথাটার অর্থ তখন পুরো না বুঝলেও জীবনের এ পর্যায়ে এসে এখন আমি পুরোপুরি বুঝেছি। আমি যখনই মনে করি, আরো একবার সাহস পাই সামনে এগোনোর, সেইসাথে নানির কথাও ভীষণ মনে পড়ে। কথাটা ছিল —

রূপের গৌরব আর ফুলের সৌরভ নাহি থাকে চিরদিন।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you