সহজিয়া বলতে আমি যা বুঝি, সহজ মাধ্যমে গভীর আরাধনা। দেখা যায় যে, আপনার কাছে বিশাল ধনভাণ্ডার বা শব্দভাণ্ডার যা-ই বলুন না কেন কোনোটাই নাই, কিন্তু আছে একপ্রকার সরল মাধ্যম, সুহৃদ আবেগ, বিশুদ্ধ আবেগ, প্রেম — যার অঙ্কন তুলে নিয়ে যায় গভীর মগ্নতায় — যেখানে আরাধনার ধ্যানে যাত্রা শুরু হয় — “তোমার-আমার ঘরেই কিন্তু ঈশ্বর রঙ পেল / স্বপ্নের মতো সত্যি একটা রঙঘরে / একটা কথা এখন বলি একটা শুনো পরে / একটা ভাঙা পেন্সিল আর অর্ধেক খাতা লেখা / অর্ধেক রঙ চুরি গেল তাই অর্ধেক ছবি আঁকা”। প্রথম যখন সহজিয়া শুনি তখন এই কয়টা লাইন নিয়েই পথে পথে হাঁটা শুরু করি বাকি অর্ধেক ছবির সন্ধানে — শহর থেকে শহরের শেষ পথ; আন্তঃনগর বাস থেকে নদীর ওপারের পথে-ঘাটে-গ্রামে সবখানে খুঁজি — “রঙটা কোথায় ছিল! রঙটা কোথায় গেল!” — এই যে মনের ভিতর রঙের পরাবাস্তবতা আর বাস্তবতা যা-ই বলুন না কেন — কোনো ফর্ম্যাটে অন্তর্ভুক্ত না করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্তহীন অরণ্যের পথে এবং এরপর ভাসিয়ে নিয়ে যায় যেখানে মানুষের বসবাসের সাথে সূর্যের খেলা জেগে ওঠে।
“’নীল মানে আকাশ ওড়ে সাগর গাঙচিল” — “আমি এপারে ডাকাডাকি আর কতটা একা থাকি?” চৈত্রের খরা তাপ — আর বিষণ্ণ দিন ও রঙের ক্যানভাসে রঙতুলির অবসাদ — আমি সৃষ্টি করি — মৃত্যুপুরীতে আত্মার হত্যার দিনগুলি গণনা করা পর্যন্ত — যেখানে — “সব রঙ, সব রূপ চুপচাপ এঁকে যায় কোন সুর?” সুরের বহতায় আমি বয়ে যাই — “দূর দেশ, দূর দ্বীপ কোথাও আছে কি না জানি না তবুও খুঁজছি, খুঁজেই ফিরি সেই ঠিকানা”। রচনা করি অমৃতের গান — তুমি বিষাদের সুরে যাকে ডাকো আমার প্রেম — “কত ঢেউ, কত গান আমি আর পাঠাব কতদূর?” ক্ষমা করে দেও — আমার পবিত্রতম প্রেমিকা — তোমার ক্যানভাসে সেইসব গান বেজে ওঠে — “এইসব মায়ার খেলা নাকি! আর কতটা একা থাকি?” শুরু ও শেষ স্তবকে — “যতদূর চোখ যায় ঢেউ, ঢেউ ওপারে আছো কি কেউ / কে ও, কেউ / কে ও? আমি এপারে ডাকাডাকি আর কতটা একা থাকি? / যতদূর চোখ যায় ঢেউ, ঢেউ”।
সুরে সুরে গেলে আরো দূরে একটা গান হয়তো হতে পারে কি — যন্ত্রণাময় যন্ত্রণা দিয়ো না, খুব কষ্ট হয় কিছু নষ্ট হয়, অস্পষ্ট হয় — সুর এক ভয়ানক ভয় — আমি যাকে ভয় পাই খুব — Nikolas Asmios-এর গ্রিক গান যদিও আমি ভাষাগত কিছু বুঝি না, কিন্তু আমার আত্মহত্যার গানের সুর বেজে ওঠে এই গানে। বুকের ভেতর যে ভাংচুর, যে মোচড় দেয় তা আমি লিখে বুঝাতে পারব না — যা ‘অস্পষ্ট হয়’ — তারপর আমি চলে যাই পরবর্তী লাইনগুলোতে যেখানে — “সারারাত জেগে জেগে আয়না কোনো কথা বলে না এতবড় শহর কেন? একটুও রাতে ঘুমাতে দেয় না” — শহরের গানের বিষণ্ণতা ও বিষাদের সুরে যেসব গান আমাকে ঘুমাতে দেয়নি তার ভিতর মহীনের ঘোড়াগুলি, মেঘদল ও আরো অনেকেই ছিল — যাদের গানের সাথে প্রজাপতিরা আমার সাথে খেলা করেছে — সেইসব গান আর দিনগুলো বোঝার আগেই অনেকে ভুল বুঝে চলে গেছে। তাই তো বলি — “থামিয়ে দিয়ো না যদি চলতে চায়, কিছু বলতে চায়, একটা গল্প হয়”। চুলের মতো মনও আমার উসকোখুসকো হয়ে এবড়োখেবড়োভাবে এলোমেলো হয়ে দগ্ধ বাতাসে উড়ে বেড়ায় — এবং অশুভ পুষ্পক (শার্ল বোদলেয়ার) পুড়ে পুড়ে গেয়ে ওঠে — সন্ধ্যা নদীর গান — সংগ্রহে রাখা থাকা গানের কথা মনে পড়ে না, সন্ধ্যানদীর পথে বহুদিন হলো হাঁটতে যাই না, শব্দ লেখা শেখা দেখার খাতা হারিয়ে গেলে তুমিও ভাবছ কেন এখনই যাবে পথটা ফেলে —।
পুনরাবৃত্তি গানের এক পরম ধর্ম। তুমিও এই ধর্মের মতো আমার প্রেম হয়ে ওঠো — শুদ্ধ প্রেম। “ব্যথা দিয়ো না, খুব কষ্ট হয় কিছু নষ্ট হয়, অস্পষ্ট হয়” … “তুমিও ভাবছো কেন? এখনি যাবে পথটা ফেলে” … এরপরই আমার দৃশ্যের যাত্রা শুরু — দৃশ্যপট নিয়ে ভাবতে থাকি। যে-দৃশ্যের জন্ম হয় — “হারিয়ে থেকো না যদি ধরতে চায় কিছু করতে চায় একটা দৃশ্য হয় / হারিয়ে থেকো না যদি ধরতে চায় কিছু করতে চায় একটা দৃশ্য হয়” (বিষাদসুর)। “সম্পুর্ণ গান আমি জানি না / একটা পাখি গলা ছেড়ে গায় / আমি তার পাশেই পাতা হয়ে রই / গান শিখে নেই কথায় কথায়।” সহজিয়ার এই কয়টা লাইন আমাকে সহজিয়া নিয়ে ভাবতে উদ্যোগী করেছে — লেখকের মনের পবিত্রতা প্রকাশ পায় এখানে (আমার মতে), যা একটা বিশুদ্ধতার প্রতীক। মহৎ না হলে এমন লাইন লেখা যায় না খুব সহজে, গভীর আরাধনায়।
চারপাশে যা আছে আমরা তার থেকেই সবকিছু শিখে নিই — আমি প্রায়ই বলি আমার বন্ধুদের সাথে, শিখতে হলে প্রকৃতির কাছে ছুটতে হবে। যতটুকু এর থেকে শেখা যাবে ততটুকুই পবিত্র বা পবিত্রতা — যার কোনো ব্যাকরণ নেই। “একটা পাখি গলা ছেড়ে গায় / আমি তার পাশেই পাতা হয়ে রই” — এই যে পাতা হওয়ার ক্ষেত্রটা আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়, দাগ কাটে অন্তরগহীনে — পাতা সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি ও মানুষের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কার্বনডাইঅক্সাইড শোষণ করে। মানবসভ্যতা যে গান ও সুর শিখে নিয়ে তার গুণগান করছে এটাই মাহাত্ম্যের লক্ষণ — আর বেশি কিছুর দরকার নেই। “পাওয়া না-পাওয়ার কথা ভেবেই চাওয়া”। মা — সহজিয়ার এই গান নিয়ে আমি কিছু লিখতে চাই না। মা আমার কাছে আলাদা কেন্দ্রবিন্দু যা আমার মন ও মস্তিষ্কের আলাদা ভাবনাজগৎ ও সাদা পৃষ্ঠার মতো মহৎ। সেই ভাবনার রূপ আমি লিখে প্রকাশ করতে চাই না (যতদিন পারি)। লেখাও আমার কাছে এক-ধরনের ভণ্ডামি মনে হয় (আমার ব্যক্তিগত দিক থেকে, এর সাথে আমি কারো মতামত মিলাতে চাই না। শব্দ ও অক্ষরকে আমি প্রচুর ভয় পাই — এই শব্দ ও অক্ষর প্রতিশোধ তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করে না।
ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে আমার কাছে সহজিয়া তার বিশেষ কয়েকটি গান দিয়ে আমার মনের কাছে পৌঁছায়। যদিও ব্যান্ডের সদস্যের সাথে কোনোপ্রকার পরিচয় আমার নেই এবং তাদের কার কি নাম আমি পুরোপুরি জানি না — আমার কাছে সহজিয়া তার কর্মের মাধ্যমে পৌঁছায়। তাই তাদের কর্ম নিয়ে এই লেখাটা লিখতে চেষ্টা করছি। কোনো দায়বদ্ধতার খাতিরে আমি লিখি না বা লেখার চেষ্টা করি না। লেখকরা চাইলে যে-কোনো বিষয়ে নিয়ে লিখতে পারেন, আমি লেখক নই, আমি কেবলই একজন শ্রোতা। কোনো গান আমার মনে দাগ কাটলে, তা নিয়ে যদি কোনো বিশেষ ভাবনা মাথায় কাজ করে, সেই প্রেক্ষিতে কয়েক লাইন লেখার চেষ্টা করি একজন শ্রোতা হিসাবে, মিউজিক বা গান নিয়ে ক্রিটিক হবার ইচ্ছে আমার নেই (আপাতত) এবং গানপারকে অশেষ ধন্যবাদ আমার মতো শ্রোতার মনের ভাবটুকু লেখক ও পাঠকের কাছে প্রকাশ করার জন্য। কতটুকু পেরেছি তা আমি জানি না। কিন্তু এর পর্যবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, আড্ডা-আলাপ-আয়োজনে লিরিকাল লাইনগুলো নিয়ে কথা বলেছি। তাই সহজিয়ার জন্য বিশেষ কিছু লাইন আমার অনুভূতি থেকে — কবিতা নয়, কিন্তু একজন সহজসরল শ্রোতার প্রেম বলতে পারেন — “সমুদ্রের গভীরতা মাপার স্কেল দিয়ে মেপে দেখি নাই সহজিয়া তুমি কত দূর। বলতে এসেও না বলে চলে যাওয়ার নাম ব্যর্থতা — খুব সহজে যা বলে শেষ করা যেত। তুমি সহজিয়া — অনেক দূরে বসে থাকা একটা ছোট পাখি — পৃথিবীর পরে।”
‘সূর্যের ভিতর বাসা বেঁধে সূর্যকে খুটে খুটে খায়’ — আমার একটা কবিতার লাইন। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সহজিয়া নিয়ে লিখে, দুপুরে বিশ্রাম নেয়ার কিছুক্ষণ পর কবিতা পড়তে মন চাইল। এরই মধ্যে জীবনানন্দের ‘সহজ’ কবিতাটা চোখের সামনে পড়ে যায় — যা আজই প্রথম পড়লাম সম্ভবত। লেখাটা গান ও সুরের প্রবণতা ধারণ করে রেখেছে; পড়ে তা-ই মনে হলো। কয়েক লাইন নিচে দেওয়া হলো — কবিতার তৃতীয় স্তবক থেকে — “তুমি জল, তুমি ঢেউ — সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন তোমার দেহের বেগ — তোমার সহজ মন ভেসে যায় সাগরের জলের আবেগে; কোন্ ঢেউ তার বুকে গিয়েছিল লেগে কোন্ অন্ধকারে জানে না সে; কোন্ ঢেউ তারে অন্ধকারে খুঁজিছে কেবল জানে না সে; রাত্রির সিন্ধুর জল রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ তুমি এক; তোমারে কে ভালোবাসে; তোমারে কি কেউ বুকে ক’রে রাখে? জলের আবেগে তুমি চ’লে যাও — জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধুধু জল তোমারে যে ডাকে।” এবং শেষ স্তবক, “আদিম রাত্রির ঘ্রাণ বুকে ল’য়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান — তুমি সেইখানে। নিঃসঙ্গ বুকের গানে নিশীথের বাতাসের মতো একদিন এসেছিলে, দিয়েছিলে একরাত্রি দিতে পারে যত।” সহজিয়ার জন্য থাকবে বাউল শাহ আবদুল করিমের ‘মুর্শিদ ধন হে’ গানের একটি বিশেষ লাইন, এই বলে লেখাটা শেষ করতে চাই — ‘ভক্তের অধীন হও চিরদিন, থাকো ভক্তের অন্তরে’ …
এই রচনাটা গানপারের ইনবক্সে পাঠিয়ে লেখক ছদ্মনামে প্রকাশের ইচ্ছা জানিয়েছেন এবং ‘মিআ’ নামটি নিজের নাম হিশেবে প্রস্তাব করেছেন। উল্লেখ্য, লেখকের ফেসবুকআইডি রিয়্যাল এবং তিনি গানপারে এর আগে একাধিক রচনাও কন্ট্রিবিউট করেছেন। সহজিয়াফ্যান ও সংগীতসমুজদারের কাছে লেখাটা গ্রাহ্য হতে পারে বিবেচনায় লেখকের/প্রদায়কের প্রকৃত নামপরিচয় আড়ালে রেখেই লেখাটা পাব্লিশ করা হলো। — গানপার
… …
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
COMMENTS