গ্রাম, শহর কী দেশ নয় পুরো দুনিয়া যখন লকডাউন হয়ে আছে তখন হাজারে হাজার গার্মেন্টসশ্রমিক হাঁটছে রাস্তায়। গ্রাম থেকে গাদাগাদি করে নাকেমুখে ছুটে আসছে কারখানার দিকে। চাকরি বাঁচানো আর মজুরির আশায়। করোনার কালে এমন নৃশংস সিদ্ধান্ত কী কেবল একা দেশীয় গার্মেন্টস মালিকেরাই নিয়েছেন? এটি কী হতে পারে? এই সিদ্ধান্ত কী নয়াউদারবাদী কর্পোরেটব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত নয়? দেশীয় মালিকেরা কী আর এইসব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন? — করে তো দুনিয়ার সব দশাসই কর্পোরেট কোম্পানি। গার্মেন্টসের মতো দুঃসহ বৈষম্য জিইয়ে রাখা বাণিজ্য মূলত সচল রাখে নয়াউদারবাদী বৈশ্বিক কর্তৃত্ব। করোনার কালে দেশের গার্মেন্টসশ্রমিকদের এইভাবে বিপজ্জনক ছুটে আসার পেছনে মূলত এই নয়াউদারবাদী ব্যবস্থাই দায়ী। এভাবে মেহনতি বস্ত্রমজুরদের মাধ্যমে যদি পুরো দেশ করোনায় আক্রান্ত হয় এর দায় কে নেবে? কর্পোরেট কোম্পানিগুলো? নয়াউদারবাদী ব্যবস্থা? নাকি দেশীয় কারখানামালিক ও ব্যবসায়ী? এর উত্তর আমাদের গভীর থেকেই খোঁজা জরুরি। দেশের গাওগেরামের একজন মেয়ে বা ছেলে চায় বলেই কি গার্মেন্টস কারখানা তৈরি হয়? দেশীয় মালিকেরা চায় বলেই কি এই বৈশ্বিক বাণিজ্য চাঙ্গা হয়? নিশ্চয়ই তা হয় না। মূলত নয়াউদারবাদী ব্যবস্থা দুনিয়ায় সস্তা শ্রমের এমন মেরুকরণ চায়। গরিব দেশের মেহনত পুঁজি করে মুনাফা করতে চায়। আর কারা এই বাণিজ্যের পণ্যগুলো ব্যবহার করে? ধনী দেশের ভোগবিলাসী মানুষেরা। দুঃখজনকভাবে সেই ফ্যাশনদুরস্ত ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, লন্ডন কী মার্কিন আজ করোনার সাথে লড়ছে। অথচ তাদের বস্ত্রচাহিদা মেটাতে আমাদের দেশের বস্ত্রমজুরদের করোনার ঝুঁকি নিয়ে ছুটতে হচ্ছে কারখানার দিকে। করোনার মতো এই তীব্র বৈশ্বিক সংকটেও যদি এমন নয়াউারবাদী বৈষম্য টিকে থাকে তবে কীভাবে আমরা করোনার বিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাব? কার সেই সাধ্যি আছে? এটি তো আর কেবলমাত্র কোনো জনস্বাস্থ্যের বিষয় নয়, তৈরি করেছে বৈশ্বিক মহামারী।
২.
আমরা কখনোই ন্যায্যতার সাথে আমাদের বস্ত্র-ইতিহাস ঘাঁটাবাছা করিনি। দেশীয় বস্ত্রকারিগরি খুন করে দাবিয়ে রেখে প্রশ্নহীন কায়দায় শুরু হয়েছে কর্পোরেট ‘তৈরি পোশাকশিল্প বাণিজ্য’। গ্রামীণ সুই-সুতা আর তাঁত উদ্বাস্তু নারীদের শরীর আর মগজ ঘষে ছেনে তৈরি হচ্ছে দুনিয়াজোড়া ফ্যাশনদুরস্ত কাপড়ের ব্র্যান্ডিং ঝকমারি। আর প্রশ্নহীনভাবে ধসে পড়ে ঝলসে যায় একটার পর একটা স্পেক্ট্রাম, তাজরীন কি রানা প্লাজা । এমনকি আজ এই দুঃসহ করোনাসংকটে আমাদের বস্ত্রকারিগরদের ঘরে থাকাকে কেউ নিশ্চিত করেনি। জোর করে ঠেলে দিয়েছে করোনার সংক্রমণ ও বিস্তারের এক নির্দয় রাস্তায়। এভাবেই আমাদের কণ্ঠ ও কলিজা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে গার্মেন্টসশ্রমিকের লাশের পরিসংখ্যানে। একের পর এক লাশের বলিরেখা ও চিহ্নে বারবার ছলকে উঠছে নিম্নবর্গের এক করুণ দ্রোহী ঐতিহাসিক আওয়াজ। কেউ এ আওয়াজ পাত্তা দিচ্ছে না, আড়ালের ঐতিহাসিকতাকে বাহাসে টানতে চাইছে না। কেন একটার পর একটা বৈষম্যমূলক ঘটনা ঘটে চলেছে গার্মেন্টসশিল্পে তার একটি ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা আছে। আছে নিম্নবর্গের সাথে ক্ষমতাশালীর এক ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা। রাজনৈতিক বিপ্লবের ভেতর দিয়েই এ দ্বন্দ্বসংঘাতের ফায়সালা হতে হবে।
৩.
আজকে যারা কমদামে একটা অ্যাডিডাস কি জেসিপেনির টিশার্ট গায়ে দেয়াকে ফ্যাশনদুরস্ত দুনিয়ায় ‘জাতে ওঠা’ মনে করে, হয়তো সবাই জানে না তা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় দুনিয়ার গরিব নারীর লাশের দামে। এমনকি ফ্যাশনদুরস্ত উত্তরের ধনী দেশগুলো নিজেরাই যেখানে করোনাসংকটে কাহিল তারা হয়তো জানেও না তাদের কাপড়গুলো যারা তৈরি করছে তারা এখনো কাজ হারানোর দুশ্চিন্তায় হাঁটছে রাস্তায়। যাদের কোনো হোমকোয়ারেন্টিন কী লকডাউনের বালাই নেই, হ্যান্ডস্যানিটাইজার কী শারীরিক দূরত্বের নিয়ম নেই। এই গরিব শ্রমিকেরা কেবলমাত্র একটি মানুষ নামের সংখ্যা, দুনিয়া আরেকদিকে হেলে পড়লেও এদের কাজ করেই যেতে হবে। এই করোনারকালেও কী আমাদের কোনো হুঁশ হবে না? এই সংকটে একজন-কেউ সংক্রমিত হওয়ার মানে তো আমি নিজেও আক্রান্ত হতে পারি। করোনার বিশ্বায়ন আমরা কী আটকাতে পেরেছি? তাহলে কোন কাণ্ডজ্ঞানে আমরা গার্মেন্টসশ্রমিকদের তাদের ঘরবাড়ি থেকে তুলে এনে কেবল দেশ নয়, গোটা দুনিয়ার বিপদকে আরো বাড়িয়ে তুললাম? আমাদের এই মনস্তত্ত্ব প্রবলভাবে তৈরি করেছে যে নয়াউদারবাদী ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থা তো এই করোনাসংকট মোকাবেলা করতে পারছে না। তাহলে কেন আমরা আমাদের এই নয়াউদারবাদী বাহাদুরি বদলাব না?
৪.
বস্ত্রবাণিজ্যের ইতিহাসে দুম করে হুট করে কোনো ছাপ কি ছাপ্পড় না রেখে এই নিগ্রহ ও নিপীড়ন কিন্তু শুরু হয়নি। ফ্যাশনদুরস্ত জাতে-ওঠার মাপকাঠি হিসেবে কাপড়ে নীল দেয়ার প্রচলনও শুরু হয়েছিল ইউরোপে। সেই নীল তৈরি হয়েছে বাংলার শতসহস্র গরিব কৃষকের লাশের দামেই। বস্ত্রনির্ভর ‘আধুনিক ফ্যাশনবাণিজ্যের’ ভেতরেই টানটান হয়ে আছে গরিব মানুষের লাশের দীর্ঘ সারি। নীল চাষ না করতে চাইলে চাবুকের ছোবল, মসলিন বুনন ভুলিয়ে দিতে হাত কেটে নেয়া কি আজকের দিনের গার্মেন্টস দালান ধস সবই কিন্তু একই ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্বের মেদ-মাংশে রূপান্তরিত। একেকটা লাশের জমায়েতের পর কিছুটা ‘হট্টগোল’ হয়, আর আমরা দেখি দুনিয়া-কাঁপানো কর্পোরেট গার্মেন্টস কোম্পানিগুলোর কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির মায়াকান্না। তারপর সব নিশ্চুপ, আবার রাষ্ট্র লাশের অপেক্ষা করে। গৃহস্থালি বস্ত্রবুনন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ‘তৈরি পোশাক শিল্প’ ঘিরে বিরাজিত আলাপ-বাহাসে আমরা বারবার এ রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতা আর ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি। নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদের কাছে এ নিগ্রহ ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ আর নারীবাদী তাত্ত্বিকদের কাছে ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’ হিসেবে পাঠ্য হলেও এর আরো গলিঘুপচি আছে। বলা হয়ে থাকে বিশেষ একজাতের কার্পাস তুলার আদিভূমি মধুপুর গড়। কার্পাসের সেই স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছে ভাওয়াল গড়ের কাপাসিয়া। পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়ার এক কেন্দ্রীয় তুলামহাল হিসেবে টেনে এনেছিল দুনিয়ার বহিরাগত বিলিতি বণিকদের। বস্ত্র-ইতিহাসের সূতাবুনন-ঐতিহ্য মসলিন জন্ম নিয়েছিল শীতলক্ষ্যা অববাহিকায়। মসলিনের মাকু ধরে জামদানি বুটি মেলেছে এ অঞ্চলেই। নরসিংদী, টাঙ্গাইল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মৌলভীবাজার, সিলেট, রাঙামাটি, বান্দরবান, সুনামগঞ্জ, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর অঞ্চলের মতো বিশেষ বিশেষ তাঁত-ঐতিহ্য নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলার করুণ বস্ত্র-আখ্যান। এ আখ্যানের পরতে পরতে আছে রক্ত আর দুঃশাসনের দাগ। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আজকের দুনিয়ার কর্পোরেট কোম্পানি সকলেই কেবলমাত্র বাণিজ্য আর দখলের স্বার্থে টেনেহিঁচড়ে ফালি ফালি করেছে এই ইতিহাস। আদিবাসী কি বাঙালি নিম্নবর্গের বস্ত্রকারিগরিকে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্র গড়ে তোলেনি পোশাকের ন্যায্য শিল্প। বরং রাষ্ট্র নয়াউদারবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় নিজের মাথা নুইয়ে রেখেছে। আর তাই রাষ্ট্রের গরিব নাগরিকদের তরতাজা লাশের বিনিময়ে তৈরি হচ্ছে একটার পর একটা ‘নয়াউদারবাদী টিশার্ট’। মানুষের অধিকার আর শখের বিন্যাস আটকে যাচ্ছে বহুজাতিক ‘পোশাক ব্র্যান্ডিং’ বাণিজ্যের ঘেরাটোপে। Reebok, Mothercare, Lee, Wrangler, Eagle, Decathon, Lafuma, JC Penny, Walmart, KMart, OSPIG, Docken, NAB, Tommy Hilfiger, Addidas, Decathon, Phillip Morris প্রভৃতি কর্পোরেট বস্ত্রবণিকই আজ নিয়ন্ত্রণ করছে বস্ত্রবাজার ও বস্ত্রকারিগরি। দেশীয় বস্ত্রপরিসর থেকে উচ্ছেদ হওয়া গরিব নারীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ এসব কর্পোরেট গার্মেন্টসে কাজ করে কারখানা ধসে লাশ হয়ে গুম হয়ে যাওয়া। অথবা তীব্র করোনার কালেও সংক্রমণ আর বিস্তারের ঝুঁকিকে বগলদাবা করে কাজ ও তার মজুরির তরে কারখানার দিকে ছুটে আসা। আজ যারা এভাবে গার্মেন্টসশ্রমিকদের রাস্তায় টেনে আনলেন এই ঘটনা একইভাবে রানাপ্লাজা কী তাজরীনের মতোই সাংঘাতিক বিপজ্জনক এবং অন্যায়।
৫.
দেশে সমসাময়িককালে প্রতিটি গার্মেন্টসবিপর্যয়ে আমরা স্থানীয় কারখানামালিক আর এর সাথে জড়িত জাতীয় রাজনৈতিক দেনদরবারকেই আলাপের ময়দানে দেখি। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় কর্পোরেট বস্ত্রকোম্পানিগুলো। যাদের সীমাহীন বাণিজ্যের লাভ ও লোভই আজকে দেশে রানা প্লাজার রানাদের মতো ‘দেশীয় লুটেরা’ তৈরি করছে। কিংবা করোনার কালে শ্রমিকদের গাদাগাদি ঢল নামিয়েছে রাস্তায়। রাষ্ট্র যখন করোনাসংকট উত্তরণে সামগ্রিক প্রণোদনা ও এই শিল্প সুরক্ষার ঘোষণা দিয়েছে তখনো এই নয়াউদারবাদী মনস্তত্ত্ব এই ঘোষণা বিশ্বাস করেনি। করোনাসংকটে রাষ্ট্রের সকল বিধি ও নিয়ম উপেক্ষা করে গরিব মজুরদের এক এমন বিপদে ফেলেছে যা পুরো দেশকেই এর যন্ত্রণা সইতে হতে পারে।
বিশ্বায়িত কর্পোরেট দুনিয়ায় গার্মেন্টসই চলতি সময়ে কমপুঁজি লগ্নি করে এক দুর্দান্ত লাভের বাণিজ্য। চীন একতরফাই এ শিল্পের গোটাটা গিলতে চায়। যেসব দেশে শ্রম সস্তা, রাজনৈতিক ক্ষমতার বাহাদুরি ও বৈশ্বিক দেনদরবারে রাষ্ট্র হিসেবে যারা দুর্বল সেসব দেশই এ শিল্পের নিশানা। গার্মেন্টস নিয়ে এ চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাণিজ্যবাহাদুরির নির্মম শোকগাথা নিয়েই দিন কাটে রাত কাটে এক দমবন্ধ দশফুট-বাই-দশফুট ঘরের ভেতর আমাদের একেকটি গার্মেন্টসশ্রমিক পরিবারের, যারা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বস্ত্রকোম্পানিগুলোকে বুকের রক্তবুদবুদ ঢেলে তরতাজা করে চলেছে। আর জাগিয়ে রাখছে বাংলাদেশকে। করোনার কাল কাটবে, কিন্তু গার্মেন্টসশ্রমিকদের ওপর চলমান নয়াউদারবাদী বাহাদুরি কী থামবে? তা না হলে এক করোনাসংকটের পর আরেক সংকটকালেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবারো এই মেহনতি মানুষদের নামতে হবে রাস্তায়। হয়তো ছড়িয়ে পড়বে আরো কোনো নিদারুণ সংক্রমণ। করোনাসংকটের পাশাপাশি এই বৈষম্যমূলক মনস্তত্ত্বেরও বদল চাই।
… …
- করোনাকালে একটা নয়া হালখাতার খোঁজে || পাভেল পার্থ - April 29, 2020
- করোনার কালে জীবজন্তুর সুরক্ষাপ্রশ্ন || পাভেল পার্থ - April 23, 2020
- নয়াউদারবাদী টিশার্ট ও দুঃসহ করোনাকাল || পাভেল পার্থ - April 8, 2020
COMMENTS