ফিলিংস ও কতিপয় স্মৃতিবিবেচনা

ফিলিংস ও কতিপয় স্মৃতিবিবেচনা

সাতাশি ঈসায়ীতে ‘স্টেশন রোড’ দিয়াই ‘ফিলিংস’ বাংলা গানের হাইওয়েতে ওঠে। একদম পয়লা ট্রিপেই বাজিমাৎ না-হলেও অভীষ্ট শ্রোতাবৃত্ত তরুণযুবাদেরে পেয়ে যেতে থাকে শুরুতেই। কিন্তু পয়লা অ্যালবামে ব্যান্ডের স্বাতন্ত্র্য গোচরীভূত হয় নাই মোটেও; অপেক্ষা করতে হয়েছে ‘জেল থেকে বলছি’ পর্যন্ত। তবু পয়লা অ্যালবামে শ্রুতিমধুর কম্পোজিশন ছিল অন্তত কয়েকটা। ফারুক মাহফুজ আনাম জেমসের গলা বা গায়কী কোনোটাই ঠিক আজকের জেমসকে চেনায় নাই তখনও। প্রথানুবর্তী লিরিক আর সাধারণ রেন্ডিশন দিয়াই ফিলিংস যাত্রা শুরু করেছিল। অভিষেক অ্যালবামে জেমস্ ছাড়াও ভোক্যাল্স্ ছিলেন আরও দুইজন; ফান্টি ও পাবলো। পরবর্তীকালে এহসান এলাহী ফান্টি দীর্ঘদিন ফিলিংসের ড্রামস্ সামলেছেন, ইন-ফ্যাক্ট ফিলিংসের শেষদিন পর্যন্ত, নগরবাউল পর্যায়ে এসে ফান্টিকে আর পাওয়া যায় নাই। কিন্তু পাবলোকে স্টেশন রোডের পরে আর কোথাও লোকেইট করা যায় না। পাবলো কি মিউজিক কন্টিনিউ করেন নাই?

স্বীকার করতে হবে যে, ডেব্যু অ্যালবামে জেমস্ বলি কিংবা ফান্টি কি পাবলো ওইভাবে আলাদা করে খেয়াল করি নাই আমরা কেউই; খেয়াল করার কথাও না। তারপরে, বেশ পরে, জেমসম্যানিয়ায় মাতোয়ারা আমরা ব্যান্ড ফিলিংসের আর্লি দিনগুলায় কে বা কারা ছিল জড়িত খুঁজতেও যাই নাই। ফিলিংসের লাইনআপ মোটামুটি স্থিতি পায় জেমস্, ফান্টি আর স্বপন প্রমুখ ত্রয়ীর এফোর্টে। একটা সময়ে এসে জেমসকেন্দ্রী ফিলিংস খ্যাতির চূড়া ছোঁয়, জেমসেরও সোলো ক্যারিয়ার তুঙ্গে, এবং ব্যান্ড কম্পোজিশন আর সোলো বা মিক্সড অ্যালবাম কম্পোজিশনের মধ্যে ব্যবধান খুঁজিয়া পাওয়া যায় না আর। তারপর একদিন পুরানা কাসুন্দি ঘাঁটতে যেয়ে দেখি ফিলিংসের আদি মেম্বার সবারই ঠিকানা পাওয়া গেলেও পাবলো মিসিং। ফান্টিকে ব্যান্ড অ্যাক্টিভিটি থেকে সরে যেতে দেখা যায় ক্রমে এবং থিতু হতে দেখা যায় বিদেশের মাটিতে। এবং অন্যদেরেও মোটামুটি লোকেইট করা যায়। কেবল পাবলোর দেখা নাই।

Pablo_feelingsইন সার্চ অফ পাবলো অ্যান্ড আদার্স অথবা আদি তথা আস্লি ফিলিংস নিয়া চাইর-পাঁচ নোক্তা বাইর করিয়া আনা যায় কি না এমনই নিয়তে এই নিবন্ধ মুসাবিদায় নেমেছি। কিন্তু সহি ইনফো ছড়াইছিটাই দিবার বাসনা বা সামর্থ্য দুনোটার কোনোটাই নিবন্ধকারের নাই। কিছু পুরানাকালিক স্মৃতি, কিছু জনশ্রুতি, কিছু তথ্যপত্রবাহিত কথাবার্তা অ্যাসেম্বল্ করার পাশাপাশি বিস্তর আন্দাজনির্ভর ইন্টার্প্রিটেশন হাজির হচ্ছে এই নিবন্ধে। এছাড়া হার্ড এভিডেন্স হিশেবে সেই রিলজমানার ক্যাসেটখাপ থেকে বেশকিছু তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে এই নিবন্ধ ড্রাফ্‌টকালে। এসবের বাইরে যে-ব্যাপারটা এই নিবন্ধ রচনায় তাড়িত করেছে তা আর কিছু নয়, ব্যান্ডসংগীতের প্রতি নিখাদ প্রীতি, ব্যান্ডসংগীতের পথরেখামানচিত্র প্রণয়নের একটা তাগিদ। যদি ইতিহাস আর্টিক্যুলেইট করতে কেউ ভবিষ্যতে এগিয়ে আসে, ব্যান্ডসংগীতের বাংলাদেশী ইতিহাস, বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক ম্যুভমেন্টের ইতিহাস, এই ভুলচুকভরা আখ্যান তখন সহায়ক হতে পারে খানিকটা।

ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস্ বাংলা মুল্ক জয় করেন ‘ফিলিংস’ দিয়া। আজ থেকে সেভেন্টিন ইয়ার্স আগে যে-সহস্রাব্দসূচনার শতকটা স্টার্ট হয়, সেই সন্ধিবৎসরে জেমস্ নতুন ব্যান্ড ‘নগরবাউল’ ফর্ম করেন এবং এর মধ্য দিয়াই ‘ফিলিংস’ তামাদি হয়ে যায়। ব্যাপারটা খেয়াল হবে আপনাদেরও নিশ্চয়ই যে ‘ফিলিংস’-এর ‘স্টেশন রোড’ (১৯৮৭) অ্যালবামের বারোটা গানের আটটাতে জেমসের ভোক্যাল, বাকি দুইটা গান ‘দুঃখ কেন করো রে মন’ (মৌলিক) ও ‘রূপসাগরে’ (ফোক, রিমেইক) এহসান এলাহী ফান্টির গাওয়া এবং আরও দুইটা পাওয়া যায় ইংরেজি গান ‘এভার সিন্স ইয়্যু’ ও ‘গ্লাস বিট গেইমস্’ পাবলোর গাওয়া। ক্যাসেটখাপে এই তথ্যগুলো সঞ্চিত।

Fantey_feelingsপয়লা অ্যালবামে ফান্টি গান গেয়েছিলেন দুইটা, পাবলোও দুইটা; ফান্টির গানদুইটা বাংলা, পাবলোর দুইটাই নিজের লিরিকে এবং নিজের কম্পোজিশনে ইংলিশ। শুধু গাওয়া নয়, হ্যাঁ, ইংরেজি গানদুইটার লিরিক্সও পাবলোরই লেখা। পাবলো ওইসময় ফিলিংসের ওয়ান অ্যামাং দ্য ভোক্যাল্স ছিলেন, তিনজনের মধ্যে, যেমন ছিলেন ফান্টি। কিবোর্ডস্, ক্ল্যারিয়োনেইট এবং ফ্লুট বাজাতেন পাবলো। মঙ্গু, গুলু এবং সর্বোপরি ছিলেন মনসুর। তবে অ্যালবামপর্যায়ে এসে আমরা মনসুরের নামোল্লেখ পাই না অবশ্য। মনসুর চট্টগ্রামের লোক্যাল্ ইভেন্টগুলোতে ব্যান্ডের পার্টিসিপেশন্ ও গোটা ম্যানেজমেন্ট সামলাতেন সম্ভবত। তখনও আগ্রাবাদই ছিল ফিলিংসের ডেরা। মার্ক নফ্লার হুবহু, নোট্-টু-নোট্, বাজিয়ে জেমস শোর মাচায়ে দেন হোটেলরেস্তোরাঁভিত্তিক শোগুলোতে। জেমস্ ক্রমশ খ্যাতি পেতে শুরু করলে ব্যান্ডসমুজদারদের কাছে এইসব তথ্য নানাভাবে জানাজানি হতে থাকে। এবং ফিলিংসের জয়যাত্রার পালে হাওয়া লাগে। জেমসকেন্দ্রিক হতে শুরু করে ব্যান্ডটা। বাংলার ‘ডায়ার স্ট্রেটস্’ হিশেবেই ‘ফিলিংস’ খ্যাতি কুড়ায় বিগিনিঙের দিকে। ব্যান্ডের ডেব্যু-অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ এবং জেমসের সোলো অভিষেক ‘অনন্যা’ শুনলেই এর সত্যতা আমরা পাই। জেমসের হয়ে-ওঠা বোধহয় ‘জেল থেকে বলছি’ দিয়ে এবং ‘পালাবে কোথায়’ অ্যালবামে একঝটকায় নিজেকে পোক্ত করে নেয়া।

অ্যানিওয়ে। এটুকু ইতিহাস আমাদের সবার কাছেই সুলভ। কিন্তু আমাদের ইতিহাস অনুসন্ধানের অভিমুখ দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে না যে এতদ্বিষয়ে ইতিহাসের সাক্ষী বুড়াধুড়ারা বিশেষ হেল্প করতে পারবে না আমাদেরে? এরচেয়ে বরং নিজেকেই ইন্ডাক্টিভ লজিক্ খাটিয়ে বের করতে হবে টেন্ডেন্সিগুলো। সোজা বাংলায়, বিশেষ এক-দুইটা দৃষ্টান্ত থেকে বের-করা পর্যবেক্ষণ ধরিয়া সাধারণীকৃত রূপে একটা বোঝাবুঝি করা। দুইয়ে দুইয়ে চার/পাঁচ করা। বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের পথক্রম, পর্যায়বৃত্ত ও প্রবণতা জানতে চাইলে মেমোরি রিকালেকশন ব্যাপারটাতে এম্ফ্যাসিস্ দিতে হয়। এইভাবেই এগোতে হবে। জেনারালাইজ্ হবে, হোক, অ্যানিওয়ে। এছাড়া উপায় কী, যেহেতু লিখিত/রচিত হিস্ট্রি বিলকুল অনুপস্থিত ব্যান্ডগানের ঝড়ো উদ্দাম অতীতের।

ইংরেজি নাম্বার গাইবার একটা চল তখন ছিল সব ব্যান্ডের মধ্যেই। পরে যারা নামজাদা ব্যান্ডস্টার হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই ডেব্যু হয়েছে ইংরেজি গান অ্যালবামে গেয়ে। এক-দুইটা নয়, একটা গোটা ইংরেজি গানের অ্যালবাম করেছেন এমন ব্যান্ডেরও দেখা পাওয়া যাবে সেই সময়টায়। এর একটা কারণ হতে পারে, আন্দাজে বলছি, সেই সময়কার ব্যান্ডগুলো ওপেন এয়ার কন্সার্ট করে কিংবা অ্যালবামে বাংলা গান গেয়ে তেমন রোজগার করতে পারত না। ফলে রেস্তোরাঁ/হোটেলগুলোতে গেয়েই তারা খানিকটা খর্চা উঠাতে পারতেন। তখনকার বিয়াশাদির গায়ে-হলুদ ইত্যাদি সিরিমোনিতে গেয়ে বাংলা নাম্বারগুলো থেকে তেমন আয়-ইনকাম হতো না নিশ্চয়। আর অ্যালবাম বিক্রির টাকা তো অডিয়োকোম্প্যানির জেবেই যেত পুরোটা। আরেকটা কারণ, বাংলা নাম্বারগুলো হয়তো তখনও লিরিক্যালি-মিউজিক্যালি ঠিক ব্রেক-থ্রু পাচ্ছিল না। বাজিয়েরা বিশেষ করে তাদের বাদ্যস্ফূর্তির তাগিদেও মঞ্চে, এবং অ্যালবামেও, একপ্রকার বিশেষ টেম্পো ও বিটের বাজনা পার্ফোর্ম করার মওকা খুঁজতেন। ফলে দেখবেন যে ওই সময়ের অ্যালবামগুলোতে ইংরেজি গান যারা গাইতে পারত না তারাও ইংরেজি ইন্সট্রুমেন্টাল একটাকিছু রাখত। পরে ব্যান্ডগানে বাংলা লিরিক্স সোমত্ত হতে থাকে ক্রমে এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল বা শেরাটন বা ফার্স্ট জেনারেশন ঢাকাই-চাটগেঁয়ে চৈনিক রেস্তোরাঁ ইত্যাদিতে না-বাজিয়েও বাংলা গান নিজের হিম্মতে আগুয়ান হবার সামর্থ্য অর্জন করতে থাকে ক্রমশ। স্বাভাবিকভাবেই ইংলিশ নাম্বার বাংলা অ্যালবামে রাখাটা আউটডেইটেড ক্ষ্যাত হিশেবে গণ্য হতে থাকে আমাদের কাছে, একসময় বিট-টেম্পো ইত্যাদির কারণে এই ইংরেজি গানগুলোই ঈপ্সিত ছিল শ্রোতা হিশেবে আমাদের সকলের কাছে, এখন শুধু ড্রামস্ বা কিবোর্ডস্ বা গিটার্স প্লেয়িঙের স্কিল্ প্রমাণিতে কেউ অন্তত ইংরেজি গানাবাজানার দ্বারস্থ হয় না। বাংলা গান গেয়েই মিউজিকের মাতোয়ালা মোমেন্ট ক্রিয়েটের মতো সম্পন্ন গিরস্তের অবস্থা আমাদের হয়েছে এখন।

প্রসঙ্গত মনে পড়ল, লক্ষ করবেন, ওয়েস্টার্ন পপ্/রক্ মিউজিকের হুবহু অনুসৃতি বলিয়া বাংলা ব্যান্ডসংগীত বহুকালব্যাপ্ত মুরব্বিদের মহানাসিকা সিঁটকানোর শিকার হয়ে এসেছে। এইটা ঠিক যে একেবারে গোড়ার দিকটাতে মেলবন্ধনটা ঠিকঠাকমতো হচ্ছিল না। তাই বলে সেইটাকে যেভাবে ওয়েস্টার্ন রকের/পপের অনুকৃতি হিশেবে ঢালাও প্রচার করা হয়েছে, এইটা আন্দু অবজার্ভেশন্ পক্ববয়স্কদের। ওয়েস্টার্ন রকের/পপের অনুকৃতি ঠিকঠাকমতো গোড়া থেকে হলে পরে তো খুবই ভালো হতো। তখন আলাদাভাবে ইংরেজি লিরিক্সের সঙ্গে বাজিয়ে স্টেজে/অ্যালবামে মিউজিকের মাতোয়ালা আনন্দ খুঁজতে হতো না। আসলে হয়েছে উল্টোটা। ডাঙ্গর হয়ে, বেলা আমার যখন সাঁঝবেলাতে, ব্যাপারটা ভাষায় প্রকাশের মতো করে বুঝতে পেরেছি যে সেই-সময় আসলে বেশিরভাগ মিউজিক/গান হয়েছে ব্যান্ডের দেশাত্মবোধশাসিত, স্বজাতিচৈতন্য নিয়া ব্যান্ডগুলো তখন ভাবত বলেই ফিউশ্যন্ তখনটায় আধাখেঁচড়া হয়েছে। আসলে দেশজ সুরের ও সংস্কারের অনুবর্তী থেকে তখন লারেলাপ্পা বাউলা বা পল্লিগীতিই হয়েছে। এরপরও পক্ববয়স্কদের হেন শত্রুতা! তা, কি করা, আমাদের ব্যান্ডের লড়াইয়ের দিনগুলো সতী নারীর পতির নিকটে গঞ্জনা সইবারই ইতিহাস। পরে জেমস যখন সত্যিকারের স্বাধীনতা কারে কয় দেখাইলেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা আর দুনিয়ার ওপারের পরাধীনবঙ্গকে, তখনই ওয়েস্টার্ন-ইস্টার্ন ব্লেন্ডিংটা আদতে শুরু হলো। এর আগে ব্যান্ডের মিউজিক আসলে, এখন বুঝতে পারি, বেঙ্গলি কান্ট্রি মিউজিকেরই একটা রকমফের্কায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

‘নগরবাউল’ হবার আগেই দেখবেন ফান্টি আর জেমস্ ছাড়া বাকি সবাই ‘ফিলিংস’ ছেড়ে দিচ্ছেন। স্বপন ছিলেন, ব্যাজ্ বাজাতেন, পরে ‘এলআরবি’-তে গেছেন সম্ভবত। ফখরুল বাজাতেন রিদম্, গুলু ছিলেন আরেকজন কিবোর্ডস্ বাজাতেন, এরা সবাই ‘ফিলিংস’ ছেড়ে দিয়েছেন নগরবাউলে শিফ্ট করার আগেই। ৯৯-তে ছাড়েন ফান্টি। পাবলোর খোঁজ পাওয়া মুশকিল হবে, কেননা তখনও দৈনিক/পাক্ষিক পত্রিকাগুলোতে ব্যান্ডঅ্যাক্টিভিটি নিউজ্-আইটেম্ হিশেবে গণ্য হতো না বা ব্যান্ডসংগীতভিত্তিক ফিচার দৈনিক/পাক্ষিকগুলোতে পাব্লিশ্ হতো না। পাবলো সম্ভবত কয়েকটা ব্যান্ডে গেস্ট-আর্টিস্ট হিশেবে কিছুদিন কাজও করেছিলেন, পরে কই গেলেন কোথা হারালেন জানি না। ফান্টি ছাড়ার সময় নিউজ্ হয়েছিল। ফান্টির একটা ইন্টার্ভিয়্যু করেছিল ‘আনন্দভুবন’, অধুনালুপ্ত (লুপ্ত নয় আসলে, ক্যাপিট্যাল সিটিতে এখনও ধুকে ধুকে বেরোতে দেখা যায়; দেশজোড়া সার্কুল্যাশন আর নাই যদিও) পত্রিকাটার ভিতরে ‘সারেগারে’ নামে একটা আলাদা পার্ট-পত্রিকাই ছিল সংগীতভিত্তিক নিয়মিত, খুঁজলে পাবো পুরনো পত্রিকাদির দেরাজে। অ্যানিওয়ে। এই পাবলোকেই কি ‘ইভস্’ বা পরে এই ‘ইভস্’-ই দ্বিবিভক্ত হয়ে ‘দি নিউ ইভস্’ হলো, তখন একটা ব্যান্ড ভেঙে দুইটা হওয়া বা একটা নাট্যদল ভেঙে দুইটা/তিনটা হওয়া হামেশার কাণ্ড অবশ্য, ওই-রকম কোথাও দেখেছি? ঠিক মনে পড়ছে না। আদি ‘ইভস্’-এ নাসির ছিলেন লিড ভোক্যাল, ‘বন্যেরা বনে রয়’-খ্যাত সেই নাসির, আরও বেশকিছু নাম্বার নাসিরের গলায় হিট হয়েছিল, গলায় মিষ্টিমিঠা ব্যাপার ছিল, পরে এই নাসির কিছু সোলো অ্যালবামও করেন এবং একটা পিরিয়ডের পরে আর খবর রাখি না। তা, আমার বিশ্বাস, হাতড়াতে হাতড়াতে এইভাবে এক-সময় পাবলোকে ঠিকই পাওয়া যাবে।

একটা কাজ হয়তো করা যেতে পারে, জেমসের বা ফান্টির ইন্টার্ভিয়্যু নিয়া পাবলোর খোঁজতালাশ করার পাশাপাশি বাংলা ব্যান্ডসংগীতের অ্যাকাউন্ট সার্চ করার দিকে স্টেপ-আপ্ করা যায় কি না ট্রাই করা যেতে পারে একবার অন্তত। খুব কঠিন কিছু হবার কথা না আজকের যোগাযোগসুবিধার দিনে। জেমসকে রিচ করা খানিক ডিফিকাল্ট হতে পারে হয়তো-বা, বা রিচ করতে পারলেও কথা বলিয়ে নেয়ার একটা বাধা সামনে আসতে পারে স্টারডম্ ইত্যাদির অভ্যস্ততার কারণে, ফান্টিকে একবার ইন্-ডিটেইল্ড ইন্টার্ভিয়্যু করতে পারলে একটা কাজের কাজ হয়। ফান্টি নিশ্চয় দেশে থাকেন না, বাংলাদেশের ফার্স্ট-জেনারেশন ব্যান্ডম্যুভের অ্যাক্টর গুটিকয়রেই দেশে অ্যাভেইল করা যায়, তাদের বেশিরভাগই বিদেশবিভূঁইয়ে একটু উন্নত রোজগারের আশায় পাড়ি দিয়েছেন ম্যালা দিন হয়।

এইভাবে একটা আন্দাজ করা যেতে পারে হয়তো যে, আমাদের দেশে ব্যান্ডগুলো অচিরে অটোক্র্যাটিক প্র্যাক্টিসের দিকেই যায় এবং আমরাও মিউজিক/ডাইভ্যার্সিটি না-খুঁজে তড়িঘড়ি আইকন খুঁজতে ব্যস্ত হই। ফলে ব্যান্ডে ফান্টি/পাবলো ঠিকঠাক নিজেদের ড্রিম্ ইনভেস্ট করতে না-পেরেই চিরবিচ্ছেদ বেছে নেন হয়তো। শুধু ‘ফিলিংস’ নয়, এই ইতিহাস অবলা হলেও পুরোটুকু অসত্য হবে না মনে হয় আটঘাঁট বেঁধে খুঁজতে নামলে, এইটা বাংলাদেশের ব্যান্ডের স্পন্টেনিটি স্তিমিত হয়ে যাবার পেছনেও ক্রিয়া করেছে। ব্যান্ড ভেঙে তেরোটুকরো হবার ইতিহাস খালি বাংলাতেই নয়, এইটা আবিশ্বভূমণ্ডলেই বিরাজিত। অনেকটা নিয়তিরই ন্যায় মানুষ যেমন যূথবদ্ধ সংসার ছেড়ে একদিন পুনরায় যাত্রা করে একলাটি অমোঘ অজানায়।

‘স্টেশন রোড’ সংকলনে এক-ডজন গানের আটটায় জেমস্ কণ্ঠ দিয়েছেন; এর মধ্যে পাঁচটার স্যংরাইটারও জেমস্ নিজে। ব্যস্ত নক্ষত্র হয়ে উঠবার আগে জেমসের স্যংরাইটিং ক্যাপাবিলিটি আমরা দেখেছি, প্রায় প্রতিটা অ্যালবামে জেমসের একাধিক স্বরচিত গীতের কথাভাগ পাওয়া যেত, নগরবাউলের সর্বশেষ স্টুডিয়োসংকলন ‘দুষ্টু ছেলের দল’-এর প্রত্যেকটা গানে জেমস্ তার সেই অ্যালবামের কো-অথার বিশু শিকদারের সঙ্গে মিলে লিরিক্স লিখেছেন। এখন, জেমসের স্যংরাইটিঙের সামর্থ্য ও কোয়ালিটি নিয়া আলাদা আলাপ জুড়তে হবে। এই নিবন্ধে সেইটা আবশ্যক নয়। স্টেশন রোডে জেমসের লেখা গানপঞ্চক হচ্ছে একে একে ‘স্টেশন রোড’, ‘আর নয় যুদ্ধ’, ‘আগের জনমে’, ‘ঝর্ণা থেকে নদী’ এবং ‘আমায় যেতে দাও’; অন্য তিনটা গান ‘একদিন ছিল’, ‘যদি এমন হতো’ ও ‘সত্যের সুন্দর’ লিখেছেন যথাক্রমে মুসা, সজল ও বাবু দেওয়ান। অন্য দুই ভোক্যাল্সের মধ্যে পাবলোর গানদুইটা তার নিজেরই রিটেন এবং ফান্টির গানদ্বয়ের একটা ‘দুঃখ কেন কর’ লিখেছেন শাকিল এবং অন্যটা ‘রূপসাগর’ সংগৃহীত। পুনর্প্রকাশিত সংকলনের কাভার ডিজাইন করেছেন সজল সমাদ্দার এবং কম্পিউটার গ্র্যাফিক্সের কাজটা কায়েস নামে কেউ-একজন করেছেন লেখা আছে। সেলিম খান নিবেদিত ‘স্টেশন রোড’ দ্বিতীয় প্রকাশ পরিবেশিত হয়েছে সংগীতা কমপ্লেক্স, ৩৭ পটুয়াটুলী এবং সংগীতা প্লাস, ১৬০ নবাবপুর রোড, ঢাকা থেকে একযোগে।

এইখানে ‘স্টেশন রোড’ অ্যালবামের দ্বিতীয় প্রকাশের একটা ক্যাসেটখাপ থেকে ফ্ল্যাপ/ইনলে-কার্ড স্ক্যানপূর্বক আদি ফিলিংসের ব্যান্ডমেইটদের মুখচ্ছবিগুলো গৃহীত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এটি রিপাব্লিশ্ করা হয় ‘সংগীতা’-র প্রযোজনায়। ফার্স্ট লঞ্চ হয়েছিল ‘বেঙ্গল মিউজিক’ থেকে, ক্যাসেটকাভারটা পাওয়া যায় নাই যথাসাধ্য খুঁজেও। ওইটাও, ওই-রকম পুরনো অনেক আর্কাইভ্যাল্ চিহ্ন, খুঁজে বের করা আবশ্যক। এইজন্যেই ‘ফিলিংস’ ও অন্যান্য ব্যান্ডপুরোধাদের ইন্টার্ভিয়্যু সংগ্রহের একটা ভালো প্রোজেক্ট দরকার অচিরে।

Station Roadঅ্যানিওয়ে, পাঠক, আপনাকে থ্যাঙ্কস্ জানাই ইন-অ্যাডভ্যান্স এজন্যে যে ব্যান্ডসংগীতের গ্লোরিয়াস পাস্ট নিয়া আপনি জিজ্ঞাসাপ্রসূ ক্রমশ এবং খুঁজতে নেমেছেন ব্যান্ডম্যুভের আর্লি দিনগুলোয় কারা ছিল কী ছিল কেমন ছিল। খোঁজাটাই জীবনের আনন্দ, খুঁজিয়া পাওয়া বা না-পাওয়া আলাদা বাৎ। সবাই মিলে এইভাবে একটু-একটু অনুমানজাত মন্তব্য লিখলেও বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকের বড় সময়টাকে একভাবে-না-আরভাবে ক্যাপ্চার করা যাবে। এই নিবন্ধের একটা সার্চ ছিল পাবলো লইয়া, আরেকটা ফিলিংসের আদি দিনরাত্রি, ফান্টি ইন্সট্রুমেন্টপ্লেয়ার নন শুধু ছিলেন কণ্ঠশিল্পীও যেইটা আজকের অনেকেই অবাক হয় জেনে, ফিলিংসের পয়লা অ্যালবামে ইংরেজি একজোড়া গান ছিল মৌলিক যেগুলো কম্পোজ করেন পাবলো, পাবলোর হোয়ারঅ্যাবাউটস্ সম্পর্কে প্রাচীন তালপাতাপুঁথি ঘেঁটে কিছু পাই কি না দেখতে নেমেছিলাম আমরা, তালপাতাপুঁথিপত্রে ব্যান্ড/রক নিয়া আঁকিবুকি বিশেষ নাই, লিরিসিস্ট লতিফুল ইসলাম শিবলীর রচনায় কিতাব একখানা বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়েছিল বহুকাল আগে ব্যান্ডসংগীত নিয়ে, যেইটা হারাম নজরে হেরি নাই, রিসেন্টলি কিতাবখানা পাব্লিশার পাল্টে ফের নতুন মোড়কে এসেছে মার্কেটে, ফেব্রুয়ারি বিদায় নিলেই বাংলাদেশে বইয়ের মার্কেট হয়ে যায় তাজমহলের গোল্লাধাঁধা, একটা-কোনো বই দরকারের সময় হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার উপায় নেহাতই সীমিত মেলাশেষে একলা, পাবলোকে পেলে ‘নিম্নঠিকানায়’ নিশ্চয় জানাব। এবং ভাইস্-ভ্যার্সা। আপনিও সংগীতে থাকুন, হে পাঠক নমস্য, নতুন দিনের সংগীত যত অনভ্যস্ত-অস্বস্তিকর ঠেকুক তাতে মদত দিন, সমর্থন অব্যাহত রাখুন সাংগীতিক সমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রতি। নিশ্চয় এইভাবে সুলুকসন্ধানের মাধ্যমে একদিন শুরুর হিস্ট্রি রিস্টোর করা যাবে।

[ক্যাসেটের খাপ/ইনলে-কার্ড থেকে স্ক্যানপূর্বক ছবিগুলো ফোটোশপে অ্যামপ্লিফাই করে ব্যানার ও  অন্যান্য ছবি বানিয়ে দিয়েছেন উসমান গনি। ক্যাসেট কালেক্ট করা হয়েছে ফাহিম  ইনানের সংগ্রহশালা থেকে।]

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you