সপ্তম প্রবাহ–১ : অ্যান্টি–ইসলামিস্ট বাখান : বুদ্ধিবৃত্তিক সংকীর্ণতা : আলী সিনা ও অন্যান্য
নবি মোহাম্মদের বর্ণাঢ্য জীবনে সংঘটিত ঘটনার বিবরণ ও ব্যাখ্যায় ইসলামের সম্মানিত আলেম-উলামারা তাঁর আদি জীবনী লেখক, প্রামাণিক হাদিস সংকলক, তফসিরকার, শরিয়া আইন প্রণেতা ও চার মাযহাবের কাণ্ডারিদের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রদান করে থাকেন। ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, আত-তাবারি, বুখারী, মুসলিম, তিরমিজি এবং চার অগ্রগণ্য ইমাম আবু হানিফা, মালিক ইবনে আনাস, শাফিঈ ও আহমদ বিন হাম্বল প্রণীত রেফ্রেন্স সহি ও নির্ভরযোগ্য বলে সকল মহলে স্বীকৃত। ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের রচয়িতারা তাঁদের অগাধ পাণ্ডিত্য, বস্তুনিষ্ঠতা ও ইমান-আকিদার কারণে সম্মানিতও বটে! নবি মোহাম্মদ প্রচারিত ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা নির্মাণের অগ্রদূত এই ব্যাখ্যাবিজ্ঞান হাসান বান্না, মাওলানা মওদুদী, মোহাম্মদ আসাদ থেকে শুরু করে জাদ আল-হক, ইউসুফ কারজাভী, তালাল আসাদ, তারিক রামাদান কিংবা আল-আজহার ও মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ড মুফতিসহ সকলের কাছে আদরণীয় বিবেচিত হয়ে থাকে। তো এই ব্যাখ্যাবিজ্ঞানকে মোহাম্মদের চারিত্রিক স্ববিরোধিতা এবং ইসলামে বিদ্যমান বৈপরীত্যের দলিল বলে যাঁরা ভাবেন তাঁরাই হচ্ছেন বিদ্রোহী বা অ্যান্টি-ইসলামের প্রবর্তক।
অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের কারণে এই ধারায় শামিল লোকজনদের সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। একসময় কৌতূহলবশত তাঁদের কিছু খোঁজখবর নিয়েছিলাম। ইবনে ওয়াররাক, ননি দারবিশ, আলী সিনা, আবুল কাশেম, এম. এ. খান, আমর খান, সুজিৎ দাস নামগুলার সঙ্গে তখন পরিচয় ঘটেছিল। ওয়াররাকের ‘Why I am not a Muslim’, ননি দারবিশের ‘Now They Call Me Infidel’, আনোয়ার শেখ-র ‘Arab Imperialism’ বইগুলো পাঠের সুযোগ হয়েছিল সেই সময়। পরে অনলাইন সূত্রে হাতে আসে আলী সিনা-র ‘Understanding Muhammad’ ও এম. এ. খানের ‘Islamic Zihad: A legacy of forced conversion imperialism slavery’ (*খানের বইটি পরে বাংলায় অনূদিত এবং সম্ভবত নিষিদ্ধ হয়েছিল) বই দুটি। এইসব বইপত্তর প্রকৃত অর্থে বেঞ্জামিন ওয়াকারের ‘The Foundation of Islam’ (*বাংলা অনুবাদে একসময় পাঠ গিয়েছিলাম। বিএনপি জামানায় বইটি বাংলাদেশে অনূদিত হয় এবং আপত্তির মুখে কিছুদিনের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়।) গ্রন্থের একপ্রকার নতুন সম্প্রসারণ বলা যায়।
আলী সিনা ও ওয়াররাক এই ধারার লেখককুলে সবচেয়ে আগ্রাসী ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল তখন। সিনা-র বইটি একতরফা হলেও ফ্রয়েড-ভাকনিন-মাস্টারসন’র তত্ত্বের আলোকে মোহাম্মদকে সাইক্রিয়াটিক কেইস বিবেচনার ধরনটি পাঠের সময় আগ্রহ জাগিয়েছিল। মহানবির জীবনে সংঘটিত ঘটনাবলীর মনোদৈহিক বিশ্লেষণের নেপথ্যে ছিল তাঁকে মানবসমাজের জন্য অশেষ ক্ষতিকর প্রমাণ করা, তথাপি আলী সিনা-র আলোচনার ধরন সেখানে সাবলীল ছিল সে-কথা মানতেই হবে। মোহাম্মদের আল্লাহ স্বয়ং নবির মনোজগতে ক্রিয়াশীল ‘ইগো’, যা সিনা-র ভাষায় সত্য-সত্তা (True-Self) ও মিথ্যা-সত্তা (False-Self) এবং চরমসত্তা-র (Superego) দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত কি না প্রশ্নটি সিনা তাঁর বইয়ে উঠিয়েছিলেন। কোরান-হাদিস-সিরা থেকে ঘটনার নজির পেশ করে নিজ দাবির সত্যতা প্রমাণের চেষ্টাও তিনি করেছেন।
নবি মোহাম্মদের জীবনের সকল ঘটনা অর্থাৎ হেরা গুহায় তাঁর ওহি প্রাপ্তি থেকে শুরু করে মক্কা ও মদিনাপর্বে সংঘটিত খুঁটিনাটি আলী সিনা তাঁর বইয়ে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে গেছেন। ইসলামের প্রাত্যহিক আচার-বিচার যেমন নামাজ-রোজা-হজ-যাকাত থেকে শুরু করে ওজু অবধি সকল আচার-অভ্যাস, অথবা মোহাম্মদের বিশেষ কিছু আচরণ যেমন সুগন্ধি ব্যবহারের প্রতি তাঁর ঝোঁক, জিন ও অশুভ শক্তিতে বিশ্বাস, মা আমেনার প্রতি অভিমান ও বিরাগ, মাতৃহারা হওয়ার ক্ষতিপূরণ ঢাকতে ঈসা নবির জন্মদাত্রী মরিয়মের প্রতি অনুরাগ, এতিমগণের প্রতি দরদ, দলবল নিয়ে বাণিজ্য কাফেলা বা ক্যারাভান লুট, আরব গোত্রদের সঙ্গে ঘন-ঘন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, কৌশলে চুক্তিভঙ্গ, নিজের যৌনজীবন ও হারেম ঘিরে সংঘটিত জটিলতা, সর্বোপরি কবিতা-গানবাজনা-চিত্রাঙ্কন চর্চায় বিতরাগ থেকে শুরু করে সকল কাণ্ড মনঃস্তাত্ত্বিক আবেশ থেকে কেন ও কীভাবে উদ্ভূত হয়েছিল তার সপক্ষে বইয়ের পাতায়-পাতায় তিনি যুক্তি খাড়া করেছিলেন। বাদ যায়নি কাল্ট লিডার হিটলার ও ডেভিড কোরাইশসহ বিখ্যাত জিম জোনস, যার পাল্লায় পড়ে হাজারখানেক অনুসারী একদিনে একযোগে আত্মহত্যা করেছিল, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে পৃথকভাবে মোহাম্মদের মনোজাগতিক বাতিকের তির্যক পর্যালোচনা।
সিনা-র এহেন মারমুখী বিশ্লেষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা, — নবি মোহাম্মদ তাঁর অবতার জীবনে আত্মপ্রেম বৈকল্য (Narcissistic Personality Disorder), বাতিকাবেশ বৈকল্য (Obsessive Compulsive Disorder), অস্থায়ী মৃগী বা মূর্চ্ছা রোগ (Temporal Lobe Epilepsy) ইত্যাদির শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। তদুপরি শিশুমৈথুনাবেশ (Phedophilia), গায়েবি মোহ (Positive Schizophrenia) এবং অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদনজনিত বিশৃঙ্খলা-র (Acromegaly) সমস্যা নাকি তাঁকে সারাজীবন ভুগিয়েছিল। আলী সিনা-র মতে মোহাম্মদের এই আত্মপ্রেম বৈকল্য তাঁর কাল্ট লিডার হওয়ার ধারাবাহিকতায় ঘনিষ্টজন এবং অনুসারীদের মধ্যে দ্রুত সংক্রমিত হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী খাদিজা সহচরী আত্মপ্রেম বৈকল্য (Co-Dependent Narcissistic Personality Disorder) দ্বারা সেই সময় আক্রান্ত ছিলেন। আর, সাহাবা থেকে শুরু করে মোহাম্মদী দ্বীনের ভক্ত ও অনুসারী ব্যক্তিগণ সকলে কমবেশি আত্মপ্রেম বৈকল্য ও সহচরী আত্মপ্রেম বৈকল্যর শিকার ছিলেন। ধর্মীয় অনুভূতির বিচারে মানহানিকর হলেও (*সিনা তাঁর লেখনী ও অ্যাক্টিভিজমের জন্য ডেলি পাবলিকের গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি-ধামকি হজম করেন) আমার জানামতে এই প্রথম ইসলামের নবিকে কেউ কমপ্লিট সাইক্রিয়াটিক কেইস রূপে কুশলতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল। সিনা-র বই নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রয়েছে এবং হয়তো কোনও একদিন লিখতেও পারি।
জন্মসূত্রে ইরানি এবং বর্তমানে কানাডা প্রবাসী আলী সিনা এই ধরায় যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে সক্রিয় ও আক্রমণাত্মক। প্রতিপক্ষের সঙ্গে লিখিত বিতর্কে তাঁর কুশলতার ছাপ চোখে পড়ে। আয়াতুল্লা খোমেনির সহচর ও পরে গৃহবন্দি আয়াতুল্লা মুনতাজেরি, জঙ্গি ইসলামিস্টদের সমর্থক বলে নিন্দিত ইয়ামিন জাকারিয়া, পাকিস্তানের ধীমান বুদ্ধিজীবী ও ইসলাম-বিশেষজ্ঞ জাভেদ আহমেদ গামিদি অথবা বাংলাদেশী কবি ও স্যাকুলারিস্ট ফরিদা মজিদের সঙ্গে বিতর্কে তাঁর যুক্তি নির্মাণের ধরন একসময় বেশ লাগসই ও উপভোগ্য মনে হয়েছিল। আলী সিনা পারতপক্ষে কারও সঙ্গে মৌখিক বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তর্ক-বিতর্কের জন্য নিজের ব্লগ আর ফেসবুক-টুইটারকে মাধ্যম রূপে ব্যবহার করেন বলে জানি। জাকির নায়েকের সঙ্গে বাহাসে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছায় নায়েকের সেক্রেটারি মারফত লিখিত বিতর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলেন একবার। বিশ্ব জুড়ে বিরাট খ্যাতির অধিকারী বিতার্কিক নায়েক সেই প্রস্তাবে পাত্তাটাত্তা দেননি। কয়েক দফা মেইল চালাচালির পর এই শর্তে রাজি হয়েছিলেন, — বিতর্ক হতে পারে তবে সেটা লিখিত না হয়ে মুখোমুখি হওয়া উত্তম এবং কমপক্ষে হাজার পাঁচেক শ্রোতা-দর্শক ও গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া তর্কে নামতে তাঁর আপত্তি আছে।
আমার ধারণা সম্মুখ বিতর্কে আলী সিনা যদি সম্মত হতেন তবে জাকির নায়েকের কাছে তিনি গো-হারা হারতেন। নায়েকের অডিয়েন্স বাছাই করার ধারা প্রতিপক্ষ তার্কিকের মনে প্রথমত চাপ তৈরি করে এবং সেটা বিশেষ সুখকর নয়। উপরন্তু ওয়াহাবি মতের প্রচারক নায়েক বিতর্কে যেসব গুলাবারুদ ব্যবহার করেন এবং তাঁর বাকপটুতা ইত্যাদি ট্যাকল দেওয়া সিনা-র পক্ষে সম্ভব বলে প্রত্যয় জাগে না। সিনা লেখায় যুক্তি ভালোই ঠুকতে পারেন এ-কথা ঠিক, তবে তাঁর যুক্তির মধ্যে রেফ্রেন্সজনিত বিস্তর ফাঁকফোকর থাকে, যা জাকির নায়েকের মতো চালাক তার্কিকের পক্ষে ধরতে না পারার কারণ দেখি না। উপমহাদেশে কওমি ধারায় স্বীকৃত আলেমরা অবশ্য তাঁর একাডেমিক যোগ্যতা নিয়ে বহুদিন ধরে প্রশ্ন তুলছেন, যদিও বাকযুদ্ধে তাঁরা তাঁকে কতটা কী কুপোকাত করতে পারবেন জানি না! কওমিরা জাকির নায়েককে মাওলানা মওদুদীর থেকে পৃথক ভাবেন না। তিনি হচ্ছেন ‘গাইরে মুকাল্লিদীন’ বা ফিতনাবাজ, যে-ব্যক্তি কিনা কোরানের আয়াতের শব্দ বা বাক্যাংশকে নিজের বক্তব্য যৌক্তিক প্রমাণের খাতিরে সূক্ষ্ম চাতুরীর সঙ্গে এদিক-সেদিক করতে দ্বিধা করে না! জাকিরের এহেন কোরানকাণ্ড নিয়ে কওমিরা দু-চারখানা নজির পেশ করে থাকেন বটে এবং অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা সেগুলো নিয়ে হল্লা মাচান। তবে জাকির নায়েকের এই খাসলত যে রয়েছে তার ইশারা পাঠক প্রবাহের শেষ পর্বে হুর সংক্রান্ত প্রসঙ্গের আলোচনায় আশা করি ধরতে পারবেন।
সিনা-কে তর্কে জয়লাভ করতে হলে অগত্যা জাকিরের রেফ্রেন্স ব্যবহারের সুনিপুণ কৌশল, কোরানের আয়াত ও হাদিসকে মোলায়েম কৌশলে ভিন্ন অর্থে ব্যাথ্যা করা, তাঁর বাক-কুশলতা এবং তর্কে উত্থাপিত প্রসঙ্গকে রেটোরিকে পরিণত করার দক্ষতা ইত্যাদি দিমাগে বুঝে নিতে হবে, অন্যথায় নাকাল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। উপরন্তু বিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণ মোহাম্মদ আসাদ যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে কোরানকে ডিফেন্ড করে গিয়েছেন সেখান থেকে সিনা-র বিরুদ্ধে যদি কেউ অস্ত্রে শান দেয় মনে হয় না তিনি বেশিক্ষণ টিকতে পারবেন। কোরান হচ্ছে দুধারী তলোয়ার! যে-আয়াত আলী সিনা কোরান ও ইসলামকে অসার প্রতিপন্ন করার জন্য বেছে নেবেন সেই আয়াতকে কোরান বা ইসলামের যৌক্তিকতা প্রমাণে অনায়াসে ব্যবহার যাওয়া সম্ভব। কেন সম্ভব সেটা টেক্সট হিসেবে কোরানের আপাত অগভীরতা কেমন করে তার ভরকেন্দ্রে পরিণত হয় সে-আলোচনায় বিস্তারিত বলার চেষ্টা করছি এবং এখানে তার পুনরাবৃত্তির কারণ দেখি না।
বড় কথা হলো সাংঘাতিক বাককুশলতা ও নিমিষে পালটা আক্রমণের ক্ষমতায় দক্ষ না হলে নায়েকের সঙ্গে বিতর্কে পেরে ওঠা দুরূহ! কথাটা কেন বলছি সেটা খ্রিস্টধর্মে বিশেষ পাণ্ডিত্যের অধিকারী চিকিৎসক ও গবেষক ড. উইলিয়াম ক্যাম্পবেল-এর সঙ্গে তাঁর ক্যারিয়ার সেরা বিতর্কটি যারা ইউটিউব বা ‘পিস টিভি’তে দেখেছেন তারা উপলব্ধি করতে পারবেন। জাকির নায়েক কুতর্ক করেন না তবে যুক্তি উপস্থাপনে প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গাটি পিন পয়েন্ট করা ও তাকে ঘিরে রেটোরিক তৈরির ক্ষমতা রাখেন এবং প্রতিপক্ষ একবার সেখানে পা ঢোকানোর পর বেরিয়ে আসা কঠিন হয়। ক্যাম্পবেল যেমন ফাঁদে পা দেওয়ার পর আর বের হতে পারেননি। নায়েকের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে এমন ব্যক্তি যেমন খ্রিস্টান তার্কিক স্যাম শামাউন বা এরকম দু-চারজনের নাম হয়তো নেওয়া যায়, কারণ তাঁরা নায়েকের মতোই প্রম্পট এবং রেফ্রেন্স নিয়ে কী করে খেলতে হয় সে-বিদ্যায় পারদর্শী।
শামাউন ও উড বহুবার নায়েককে তর্কে আহ্বান জানিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর রেফ্রেন্স খণ্ডনের চেষ্টা করেন বলে জানি। যদিও জাকির নায়েককে তা প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয়নি। তাঁদের সঙ্গে তিনি তর্কে জড়িয়েছেন এমন খবর আমার জানা নেই। মামলা যদি হয় কোরান ও ইসলামে কী কী কেলেঙ্কারি ঘটেছে ইত্যাদির লিস্টি তবে সেই কেলেঙ্কারির ফিরিস্তি টেনে সিনা অডিয়েন্স গরম করতে পারবেন এবং সেটা করতে গিয়ে যুক্তি ও রেফ্রেন্সে ফাঁক রেখে যাবেন এটা একপ্রকার নিশ্চিত, অতঃপর সেই ফাঁক ধরে রেটোরিকের বিস্তার ও তাঁকে কুপোকাত করা জাকির নায়েকের জন্য কঠিন কিছু বলে মনে হয় না। আবারও বলি, সিনা-র লেখনীশক্তি চটকদার হতে পারে কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণ, রেফ্রেন্স ব্যবহার ও যুক্তি বিরচনে বিস্তর গোঁজামিল ও শর্ট টেম্পার্ড হওয়ার প্রবণতা থাকায় পালটা যুক্তিবাণে তাঁকে বাতিল করার সুযোগ সেখানে থাকেই।
একটি উদাহরণ ও তার বিস্তারিত আলোচনা দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। আলী সিনা তাঁর সাইটে পাঠকের প্রশ্নের জবাব দিতে ও তাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করতে বেশ পছন্দ করেন বলেই জানি। তো পাঠকের সঙ্গে সওয়াল-জবাব সংক্রান্ত এরকম একটি রচনা কন্টেন্টের গুরুত্ব এবং সিনা-র যুক্তিপ্রণালীর ধারা বোঝার খাতিরে উল্লেখ প্রয়োজন মনে করি। প্রবাদ আছে হাড়ির একটি ভাত পরখ করলে আস্ত হাড়ির খবর পাওয়া যায়। সিনা একাধিক বইসহ প্রচুর লিখেছেন, তথাপি ‘Understanding Muhammad’ একবার পাঠ গেলে তাঁর লেখার ধারা, রেফ্রেন্স ব্যবহার ও যুক্তি বিরচন তথা মনমর্জির একটা আন্দাজ কিন্তু হয়ে যায়, যা পাঠক যদি তাঁর পরবর্তী লেখাপত্তর ঘাঁটেন, আমার মনে হয় না ব্যাপক কোনও রদবদল সেখানে তিনি নজর করতে পারবেন। আমরা এখানে অ্যান্টি-ইসলামিক টেক্সটের জগতে সিনা-র ম্যাগনাম ওপাস বিদিত বইটিতে যাব না, তবে যে-রচনাটি বেছে নেবো তার থেকে তাঁর হাড়িতে অবশিষ্ট বিষয় সম্পর্কে পাঠক আন্দাজ করে নিতে পারবেন আশা করি। সর্বোপরি, ইচ্ছে হলে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। তো যা হোক, ভণিতা ছেড়ে সিনা-র নাতিদীর্ঘ সেই রচনাটি এবার স্মরণ করা যাক।
সময় ২০১৫, আলী সিনা-র সাইটে জনৈক পাঠক তার বন্ধুর কাহিনি শুনিয়ে তাঁকে লিখেছিল, প্রথম কিছুদিন সিনা-র বইপত্তর পড়ে বন্ধুটি ইসলাম ও মোহাম্মদকে একপ্রকার ঘৃণা করতে শুরু করে, তারপর হঠাৎ কী খেয়ালে NDE-র (Near Death Experience) শিকার ধর্মান্তরিত মার্কিন বিদ্বান ও বর্তমানে সুন্নি ঘরানায় অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ হামজা ইউসুফ তার ঘাড়ে চেপে বসেন। সতেরো বছর বয়সে মারাত্মক কার এক্সিডেন্টে মরতে-মরতে বেঁচে ফেরা হামজার দু-চারখানা বইপত্তর পাঠ ও ইউটিউব লেকচারে গমনের পর তার কী হয়েছে কে জানে, বন্ধুটি এখন মোহাম্মদ হেটার থেকে তাঁর লাভারে পরিণত হয়েছে! পাঠক এই ধাঁধার খেই না পেয়ে অগত্যা সিনা-র কাছে প্রশ্নটি রেখেছে, NDE কি এতই ভয়ানক ঘটনা যার খপ্পরে পড়ে একজন হামজা ইউসুফ খ্রিস্টান থেকে মুসলমান হয় এবং তার বন্ধুও মনে হচ্ছে গোল্লায় গেল বলে!
পাঠকের প্রশ্নের জবাবে আলী সিনা যথারীতি গৎবাঁধা যুক্তি সঙ্গী করে লম্বা আলাপে নামেন। লেখনীতে চটক থাকায় পাঠে মন্দ লাগে না, যদিও যুক্তি খণ্ডনে হামজা ইউসুফ মানের বিদ্বান অথবা জাকির নায়েকের মতো রেফ্রেন্স হাজির করা ও রেটোরিক তৈরিতে কুশল বিতার্কিক অবধি যাওয়ার দরকার হয় না, তাঁদের তুলনায় খাটো ব্যক্তি সেখানে যথেষ্ট মনে হতে থাকে। কারণ, তাঁর চোখা বাক্যবাণে এমন কোনও অভিনব ও ধারালো যুক্তি তিনি হাজির করতে পারেন না যার সামনে লা-জবাব বসে থাকতে হয়।
NDE সংক্রান্ত শয়ে-শয়ে অভিজ্ঞতার বিবরণ ইন্টারনেটে ঘেঁটেছেন এই ঘোষণা দিয়ে সিনা তাঁর যুক্তি ফাঁদতে বসে অচিরে বিষোদগারের জগতে গমন করেন ও মোহাম্মদকে গাল পাড়তে থাকেন! তাঁর বক্তব্য সেখানে বাঁধা ছক ধরে অগ্রসর হয়। পাঠকের সুবিধা হবে ভেবে সিনা-র মূল বক্তব্যের সারসংক্ষেপ শুরুতে বলে নিচ্ছি। NDE সূত্রে পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সিনা তাঁর চিরশত্রু মোহাম্মদ ও কোরান সম্পর্কে বহুদিন ধরে যা বলে আসছেন সেখানে ফেরত যান। মোহাম্মদ ও কোরান নাকি NDE থেকে শুরু করে মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে নতুন কিছু বলেননি, বরং প্লেটো বহু আগে এসব বাত তামাদি করে গেছেন ইত্যাদি। সিনা-র মতে দেহ ও আত্মা কী বস্তু সে-বিষয়ে তাঁর কোনও ধারণা ছিল না এবং তিনি যা বলেছেন তা শতভাগ ভুল এবং অন্যের থেকে ধার করা (*এক্ষেত্রে আদি একেশ্বরবাদী জায়েদ ইবনে আমর ছিলেন মোহাম্মদের অন্যতম সোর্স, যাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তিনি ব্যবহার করেছেন ও পরে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছেন।) অথবা চৌর্যবৃত্তির ছাড়া অন্য কিছু নয়। নকলি ও চুরিটা যেখানে করতে পারেননি সেগুলো হচ্ছে তাঁর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল এবং যুক্তি দিয়ে ভাবার অযোগ্য। জান্নাত সম্পর্কে তাঁর বিবরণ বানোয়াট এবং ইহজগতে মানুষের যে-সকল অভিজ্ঞতা ঘটে থাকে সেগুলোকে খানিক এদিক-সেদিক করে তিনি সেখানে চালান করেছেন; এতে প্রমাণ হয় মোহাম্মদের এ-সম্পর্কে বিশেষ কোনও জ্ঞান ছিল না। নরক বিষয়ক হুমকি-ধামকি মোটের ওপর সঠিক বলতে হয়, কারণ তাঁর জন্য ওটা ছিল উপযুক্ত স্থান এবং হামজা সহ সকল ইসলামবিশ্বাসী আমআদমি মরণের পরে সেখানে ঠাঁই হবে এ-ব্যাপারে সিনা অন্তত নিশ্চিত। তো এইসব কটুক্তি শেষে লেখার অন্তভাগে পৌঁছে NDE-র অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এমন কতিপয় ব্যক্তির লিংক ধরিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর ইসলামবিদ্বেষের চলমান ইতিহাসে আপাত ইতি টানেন!
পাঠকের প্রশ্নের জবাব লিখতে বসা সিনা অবশ্য জুড়তে ভোলেন না, হামজা ইউসুফের NDE সংক্রান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আসলে কেমন ছিল তার কোনও বিস্তারিত বিবরণ তিনি নেটে খুঁজে পাননি। তিনি কেবল এটুকু জানতে পেরেছেন, র্যামন্ড মুডির কিতাব হামজাকে একসময় প্রভাবিত করেছিল এবং খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম নিলেও খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানতেন না বা তাঁর আগ্রহ ছিল না ইত্যাদি। সেইসঙ্গে ফোড়ন কাটেন, মোহাম্মদের মতো হামজারও মৃত্যু বা মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কিত জ্ঞানে জানার সঙ্গে বুঝের ঘাটতি রয়েছে। দেহ ও আত্মা ঠিক কী বস্তু অথবা দেহের পুনরুত্থান সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ভুল ধারণায় নিমজ্জিত এবং সেসব সঙ্গী করে শোচনীয় ইসলাম প্রমোটার রূপে তিনি নেটে ঘুরে বেড়ান। হামজার NDE-র অভিজ্ঞতা এবং দেহ ও আত্মা বিষয়ক ইসলামি বিশ্বাসকে খারিজ করতে সিনা এবার বাইবেল ও বিজ্ঞান হাতে নেন। থিওলজি দিয়ে থিওলজিকে কাটতে গিয়ে তাঁর হয়তো মনে হতে থাকে বাইবেল হলো সেই কিতাব যেখানে সেন্ট পলের সূত্রে দেহ, আত্মা, পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং স্বর্গ-নরক ইত্যাদির সঠিক একখান ভাষ্য পাওয়া যায়! যদিও কেন তিনি বাইবেল হাতে নেন এবং সেন্ট পলকে তাঁর কাছে কেন প্রামাণ্য মনে হয় সে-ব্যাখ্যার তোয়াক্কা না করে এ-সংক্রান্ত ইসলামি টেক্সটকে খারিজ করতে থাকেন। আজবই বটে! বাইবেল সূত্রে আলী সিনা যে-ব্যাখ্যা লেখায় হাজির করেন তার সারার্থ বোধহয় প্রথমে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। সিনা সেখানে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন :—
ধরায় আগত দেহ ও আত্মার গতি হলো পার্থিব। ধরায় বিচরণ শেষে দেহ যখন নিথর হয় তখন তার সমাপ্তি সেখানে ঘটে যায়। আত্মা দেহ ছেড়ে যথা ইচ্ছা গমন করুক কিন্তু ভুলেও ছেড়ে যাওয়া দেহে সে আর ফেরত আসে না। ওদিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেহের অবশিষ্ট ধরায় নতুন কোনও দেহ গঠনে হয়তো অংশ নেয়! সুতরাং শেষ বিচারের দিনে বস্তুগত উপাদান (Material Elements) সহকারে সৃষ্ট দেহের পুনরুত্থান ঘটার কোনও চান্স নেই। বৈজ্ঞানিক যুক্তি বিবেচনায়ও বিষয়টি হাস্যকর। কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়ায় দেহে অবিরত নতুন কোষ জন্ম নিয়ে থাকে এবং পুরোনো কোষ সেখানে তামাদি হয়। যারপরনাই একজন মানুষ কখনও অবিকল আগের মানুষটি থাকে না। পুরোনো কোষের মৃত্যু ও নতুন কোষ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তার দেহ ক্রম পরিণতি লাভ করে। কোষ বিভাজনের গতি মন্থর হয়ে এলে সে জরা বা বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং অবশেষে মারা যায়। যে-কারণে সতেরো বছরের ব্যক্তি যখন ত্রিশ বছরে পা দেয় তারা আসলে সম্পূর্ণ পৃথক দুটি মানুষ! ত্রিশে পা দেওয়া ব্যক্তির সঙ্গে সে যখন সতেরোয় ছিল তার কোনও মিল নেই। কোষ বিভাজনের খেলায় চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটার আগে অবধি একই মানুষ অবিরত নতুন মানুষ রূপে ধরায় বিচরণ করে। এখন সেই মানুষটিকে কবরে গোর দেওয়ার পর যদি পুনর্জীবিত করতে হয় তবে প্রশ্নটি সেখানে চলে আসে, — স্রষ্টা তার কোন বয়সের দেহটিকে কবর থেকে উঠাবেন? সে যখন সতেরোয় ছিল সেটা? নাকি চব্বিশে? অথবা একাশি বছরে কবরে শায়িত বুড়োকে তিনি তুলবেন? অগত্যা ধরে নেওয়া যায়, পৃথিবীতে আগত দেহকে কবরে গোর দেওয়ার পর সেখানে তার খেল খতম হয় এবং ঈশ্বরের তাকে কবর থেকে উঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। তবে হ্যাঁ, সচেতনা (Consciousness) দেহ থেকে স্বাধীন হওয়ার কারণে মৃত্যুর পরেও জীবিত থাকে। সচেতনা অতীন্দ্রিয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণে শেষ বিচারের দিনে মৃত ব্যক্তির প্রতিনিধি রূপে পরলোকে গমন করতেও পারে। সেন্ট পল সে-জন্যই পার্থিব (terrestrial) ও অপার্থিব (celestial) এই দুই অবস্থার নিরিখে দেহের গতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। সিনা-র বক্তব্য অবধানে বুঝের ভুল হয়নি নিশ্চিত হওয়ার খাতিরে তাঁর লেখার চুম্বক অংশটি উদ্ধৃত করা উচিত মনে করি। পাঠক যদি মনে করেন বুঝে কোনও ভুল ঘটেছে তাহলে শুধরে দেবেন :—
He (*Hamza Yusuf) confuses body and spirit. What survives is our spirit. Once the body is gone, it is gone. You can never reenter in your present body. We return to earth and the elements that make us will be recycled in other bodies. As a matter of fact we defecate a piece of our body every day. In seven years not a single cell in your body is the same. It is gone, done the toilet. So which body of yours will be resurrected? Your 10 year old body, your 17 year old body, your 24 year old body, or your 81 year old body? The concept of resurrection as described by Muhammad and believed by Yusuf is a logical and scientific absurdity, something even the Meccans of his time knew. — Source: Hamza Yusuf NDE: Does near death experience prove Islam right? By Ali Sina, July 2015; alisina.org.
রোজ হাশরের দিনে মৃতদেহের পুনরুত্থান ঘটার মতো অপ্রামাণিক বিষয়ে বিজ্ঞানের দেহ ও তার পরিণতি বিষয়ক ব্যাখ্যাকে কান পাকড়ে থিওলজির মামলায় টেনে এনে সিনা কতখানি সুবিবেচনার পরিচয় রাখলেন জানি না, তবে দেহের পুনরুত্থান সম্পর্কে কোরান কী উক্তি করে সেটা প্রথমেই পাঠ যাওয়া প্রয়োজন :—
‘এবং সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলিয়া যায়। সে বলে, ‘কে অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করিবে যখন উহা পচিয়া গলিয়া যাইবে?’ — ইয়াসিন ৩৫:৭৮;
‘বলো, ‘উহার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করিবেন তিনিই যিনি ইহা প্রথমবার সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ — ইয়াসিন ৩৫:৭৯;
‘উহারা বলে, ‘আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হইলেও কি নতুন সৃষ্টিরূপে উত্থিত হইব?… বলো, ‘তোমরা হইয়া যাও পাথর অথবা লৌহ।…অথবা এমন কিছু যাহা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন’; তাহারা বলিবে, ‘কে আমাদেরকে পুনরুত্থিত করিবে?’ বলো, ‘তিনিই, যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করিয়াছেন।’ অতঃপর উহারা তোমার সম্মুখে মাথা নাড়িবে ও বলিবে, ‘উহা কবে?’ বলো, ‘হইবে সম্ভবত শীঘ্রই,…’ — বনি-ইসরাইল/আল-ইসরা ১৭:৪৯-৫১;
‘উহারা দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহর শপথ করিয়া বলে, ‘যাহার মৃত্যু হয় আল্লাহ তাহাকে পুনর্জীবিত করিবেন না। কেন নয়, তিনি তাঁহার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করিবেনই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ইহা অবগত নহে—’ — আন-নাহল ১৬:৩৯;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
সূরা ‘নাহল’-র ৩৯ নাম্বার আয়াতটি এখানে বিশেষ গুরুত্ব রাখে, কারণ প্যাগান আচারে অভ্যস্ত আরব গোত্র এবং আল্লাহ প্রেরিত বাণী যারা ইতোমধ্যে বিকৃত করেছে সেই আহলে কিতাবের অধিকারী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মোহাম্মদের বাকবিতণ্ডা ও সংঘাতের ইশারা সে দিয়ে যায়। সেকালে প্যাগান আরব গোত্রপিতারা তাদের ইহজাগতিক বোধের নিরিখে মৃত ব্যক্তির কবর থেকে পুনরায় উত্থিত হওয়ার ঘটনা গাঁজাখুরি ভাবতে অভ্যস্ত ছিল। অন্যদিকে তাওরাত ও বাইবেল দেহের পুনরুত্থান সংক্রান্ত ঘটনা পৃথক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করায় মোহাম্মদের অজ্ঞতা নিয়ে বিদ্রুপ-উপহাস নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। সুতরাং এটা বলা যাবে না মোহাম্মদ ধরা থেকে একপ্রকার বিলুপ্ত আদি ইঞ্জিল ও গ্রিক বাইবেল বর্ণিত দেহের পার্থিব ও অপার্থিব গতি বিষয়ে নিতান্ত অজ্ঞ ছিলেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই আনপড় হওয়ার কারণে তিনি কোনও কিতাব-টিতাব পড়েননি এবং খাদিজার কাজিন ও একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ধর্মযাজক ওয়ারাকা ইবনে নওফল অথবা সিরিয়ায় উটের রাখালি করার দিনগুলোয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী গোত্র এবং লোকমুখে বাইবেল বর্ণিত পুনরুত্থান বিষয়ক ভাষ্য তাঁকে মালুম করতে হয়েছিল বিধায় উলটা বুঝেছেন, সেক্ষেত্রে খেয়াল রাখা প্রয়োজন, শতেক বিদ্রুপ-উপহাস সত্ত্বেও মোহাম্মদ তাঁর ‘উলটা বুঝলি রাম’ হেন বক্তব্য থেকে একচুল সরে আসেননি। এমনকি আল্লাহ সংশোধনী পাঠিয়েছেন এই অজুহাতে মতের পরিমার্জনাও করেননি। উক্ত বিষয়ে তাঁর বক্তব্য সদা এক ও অভিন্ন ছিল। ‘বুখারী’ জানায় :—
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, বনি আদম আমাকে গালি দেয় অথচ তাদের পক্ষে আমাকে গালি দেয়া উচিত নয়। আবার তারা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে অথচ আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করাও তাদের জন্য উচিত নয়। তাদের গালি হলো তারা আমার ব্যাপারে বলে যে, আমার সন্তান আছে, আর আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হলো এটা বলা যে, তিনি (আল্লাহ) যেভাবে আমাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবেন না।’ — উৎস : সহিহ বুখারী (তাওহিদ); ৩১৯৩; সূরা ‘নাহল’-র আয়াত সম্পর্কিত হাদিস; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম।
তুর্কদেশি লেখক ও কোরান গবেষক আলী উনাল (Ali Ünal) তাঁর ইংরেজিতে সংকলিত কোরানের টীকাভাষ্যে মৃতদেহের পুনরুত্থান প্রসঙ্গে সূরা ‘আল-মুমি’নুন’-র ১০০ নাম্বার আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত ধর্মবেত্তা ও হাদিস সংগ্রাহক আত-তিরমিজির (৮২৪-৮৯২) বক্তব্য দাখিল করেছিলেন। তিরমিজির বক্তব্য অনুসারে মৃতদেহ কবরে গোর দেওয়ার পর রুহ বা আত্মা ইহজগৎ ও পরজগতের মধ্যবর্তী স্থান বারযাখে অবস্থান করে। দেহ গলেপচে মাটিতে মিশে যায় কিন্তু দেহ-গঠনকারী মূল উপাদান ‘অজব আদ-ধানাব’ (ajb adh-dhanab or the fundamental particles/gene like something) বা মৌল কণা বিনষ্ট হয় না। ইংরেজি পরিভাষায় ‘অজব আদ-ধানাব’ এখন কোকিক্স (Coccyx) বা পুঞ্জাস্থী অর্থাৎ মেরুদণ্ডের নিচের দিকে অবস্থিত ত্রিভূজের অনুরূপ ক্ষুদ্র হাড়ের অংশ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্য মোতাবেক কোকিক্স মানবদেহে সেইসব মাংসপেশীর সঙ্গে নিজের সংযুক্তি রাখে যারা মলদ্বার ও মলত্যাগে বিশেষ ভূমিকা রাখে। হাঁটাচলা ও দৌড়ঝাপের কাজে নিয়োজিত মাংসপেশীর সঙ্গেও তার সংযোগ রয়েছে। আর নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণ ও প্রসবের ক্ষণে তাদের জরায়ুর প্রসারণ ও সঙ্কোচনের কাজে নিয়োজিত মাংসপেশীর সঙ্গে কোকিক্স নিজেকে সংযুক্ত রাখে।
…
চিত্র–৭ : The coccyx is a triangular arrangement of bone that makes up the very bottom portion of the spine below the sacrum. It represents a vestigial tail, hence the common term tailbone… Source: spine-health.com;
…
ভাষার বিবর্তনে তিরমিজ সংজ্ঞায়িত ‘অজব আদ-ধানাব’-এর অধুনা প্রচলিত অর্থবিচার যা-ই হোক-না-কেন, ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞানে তিনি একে মৌল উপাদান রূপে ব্যাখ্যা করেন যেটি দেহের সঙ্গে বিনষ্ট হয় না এবং আত্মা কবরে বিলীন মৃতদেহের সঙ্গে এর সাহায্যে নিজের সংযুক্তি বজায় রাখে। তিরমিজি তাঁর সময়কার জ্ঞানের গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলেন। একালের বিচারে ‘অজব আদ-ধানাব’ আল্লাহ সৃষ্ট কোনও ‘চিপ’ হতে পারে যেটি জীবিত অবস্থায় মানবদেহে সংযোজিত থাকে এবং মরণের পর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও জেনেটিক সংকেতলিপির মতো দেহের সকল কোড সেখানে লিপিবদ্ধ থাকে; এবং এটা সেই চাবি যাকে ব্যবহার করে আত্মার প্রতিস্থাপনসহ দেহের পুনর্গঠন কোরানের বিচারে কঠিন কিছু নয়! পাঠকের বুঝের সুবিধার্থে ‘অজব আদ-ধানাব’ সংক্রান্ত আলী উনাল উদ্ধৃত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি এবং শেষ বিচারের দিনে অসৎ ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের সতর্কবার্তা সূত্রে নাজিল হওয়া সূরা ‘মুমিনু’ন’-র আয়াত এই ফাঁকে উদ্ধৃত করি :—
‘যখন উহাদের কাহারও মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় প্রেরণ করো,’…‘যাহাতে আমি সৎকর্ম করিতে পারি যাহা আমি পূর্বে করি নাই।’ না, ইহা হইবার নয়। ইহা তো উহার একটি উক্তি মাত্র। উহাদের সম্মুখে বারযাখ থাকিবে উত্থান দিবস পর্যন্ত।’ — উৎস : আল–মুমিনু’ন; ২৩:৯৯–১০০; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
আয়াতের আলী উনালকৃত টীকাভাষ্য :
After burial, the spirit waits in the intermediate world between this one and the Hereafter. Although the body decomposes, its essential particles (called ‘ajb adh-dhanab, which literally means coccyx, in a hadīth) do not rot. We do not know whether ‘ajb adh-dhanab is a person’s genes or something else. Regardless of this ambiguity, however, the spirit continues its relations with the body through it. God will make this part, which is formed of the body’s essential particles, atoms, or all its other particles already dispersed in the soil, conducive to eternal life during the final destruction and rebuilding of the universe. He also will use it to re-create us on the Day of Judgment. — Source: The QUR’AN with Annotated Interpretation in Modern English by Ali Ünal; Page 774; PDF Edition.
বুখারী, মুসলিম ও একাধিক প্রামাণ্য হাদিস গ্রন্থে এই হাড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে দেহ বিনষ্ট হওয়ার পরেও হাড়টি অক্ষত থাকবে এবং এই হাড়কে কেয়ামতের পর পুনরুত্থানের চাবি রূপে ব্যবহার করা হবে :—
‘নবিজি (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) বললেন, ‘শিঙ্গার দুই ফুঁৎকারের মাঝে চল্লিশের বিরতি থাকবে।’ তাঁরা জানতে চাইলেন, ‘হে আবু হুরায়রা! আপনি কি চল্লিশ দিনের কথা বলছেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি কিছু বলতে পারছি না।’ — ‘তাহলে চল্লিশ বৎসর?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি কিছু বলতে পারছি না।’ — ‘তার মানে চল্লিশ মাস?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি কিছু বলতে পারছি না। নবিজি বলে গিয়েছেন, ‘মানুষের দেহের সবকিছু গলেপচে যাবে, একমাত্র মেরুদণ্ডের প্রান্ত ভাগের (কোকিক্স) হাড়টি ছাড়া, আর ঐ হাড় থেকে আল্লাহ সমগ্র দেহ পুনরায় তৈরি করবেন। অতঃপর আল্লাহ আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করবেন আর লোকজন সবুজ উদ্ভিদের মতো উদগত হবে।’
The Prophet said, ‘Between the two Blowing of the Trumpet there will be an interval of forty.’ The people said, ‘O Abu Hurairah! Do you mean forty days?’ He said, ‘I cannot say anything.’ They said, ‘Do you mean forty years?’ He said, ‘I cannot say anything.’ They said, ‘Do you mean forty months?’ He said, ‘I cannot say anything. The Prophet added: ‘Everything of the human body will perish except the last coccyx bone (end part of the spinal cord), and from that bone Allah will reconstruct the whole body. Then Allah will send down water from the sky and people will grow like green vegetables. — Source: Riyad as-Salihin 1836; Book 18, Hadith 29; sunnah.com/riyadussalihin; তরজমা : লেখককৃত; সমধর্মী হাদিস: সহিহ মুসলিম; ইসলামিক ফাউন্ডেশন : ৭১৪৬–৭১৪৮; হাদিসের মান : সহি; সমধর্মী হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম।
হাদিস আর আলী উনালের টীকা ভাষ্যের সূত্রে মনে পড়ল, সিনা তাঁর লেখাপত্রে বিজ্ঞানটিজ্ঞানের রেফ্রেন্স ছাড়েন, তো ‘মেমোরি আপলোড’র খবর তাঁর অজানা থাকার কথা নয়! মানবমস্তিষ্কে সংরক্ষিত স্মৃতি এবং দেহ গঠনের প্রয়োজনীয় সংকেতলিপি কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট ‘চিপ’-এ চালান বা আপলোড করার ভাবনা বিজ্ঞানে অনেকদিন ধরে চলছে। উদ্দেশ্য হলো আপলোড করা সংকেতলিপির সাহায্যে ধরা থেকে বিদায় নেওয়া ব্যক্তির প্রতিরূপ (Simulacrum) সৃষ্টি করা, যেন দেহের বিনাশ ঘটার পরেও তাকে সৃজন করা যায়। মানে দাঁড়াচ্ছে, মৃত ব্যক্তি ইচ্ছে করলে তার এই প্রতিরূপের সাহায্যে ধরায় বিচরণ করতে পারে। কল্পবিজ্ঞান ঘরানার ছবি নির্মাণে হলিউডের জুড়ি মেলা ভার এবং ‘মেমোরি আপলোড’র ঘটনা নিয়ে একাধিক ছবি ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে সেখানে। আজ যা ফিকশন আগামীকাল সেটা বাস্তব। সুতরাং মানবের পক্ষে যদি এহেন কাণ্ড দূর ভবিষ্যতে ঘটানো সম্ভব হয়, সমগ্র জাহানের যিনি স্রষ্টা তাঁর জন্য ‘অজব আদ-ধানাব’ টাইপের কোনও ‘চিপ’ ব্যবহার করে দেহের পুনর্জীবন ঘটানো দুরূহ কিছু নয়। থিওলজির মামলায় পাঠককে নসিহত করার সময় বিষয়টি সিনা-র অন্তত একবার ভাবা উচিত ছিল। মোহাম্মদকে নিয়ে কটুক্তিতে ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি সম্ভবত সেটা ভুলে গিয়েছিলেন! তাঁর ধারায় বিদ্যমান লোকজনের মধ্যে এই সমস্যা বেশ প্রকট। উনারা কমবেশি শর্ট টেম্পার্ড এবং সে-কারণে যুক্তি বিরচনে ভারসাম্য ও গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখার চেয়ে বাগাড়ম্বর বড় হয়ে ওঠে!
সে-যা-ই হোক, কিয়ামতের পর মৃতদেহ পুনর্গঠন ও পুনরুত্থানে আল্লাহ ‘অজব আদ-ধানাব’-এর অনুরূপ ‘চিপ’ এস্তেমাল করতে পারেন বলে তিরমিজি হাদিস সূত্রে আভাস দিয়ে গেছেন। থিওলজির বিচারে তাঁর এই আভাসকে আপাত যৌক্তিক ধরে নিলে কবরে মৃতদেহের সঙ্গে মালাইক বা ফেরেশতার বাতচিত কী করে ঘটে সেটা ক্লিয়ার হয়। মনে রাখতে হবে বস্তুগত উপাদানে গঠিত দেহ মৃত্যুর পর বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টি কোরান স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানে স্বীকার করে। অন্যদিকে ‘অজব আদ-ধানাব’-এর খবরও দিয়ে যায়! জীবিত মানবদেহে সে অবস্থান করে ও দেহগঠনে ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে মানবদেহের ধ্বংসস্তূপে নিজেকে বহাল রাখে এবং আত্মাকে তার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে বাধ্য করে। অপ্রামাণিক এই ঘটনা মানব ‘আকল’র পক্ষে অ-বোধগম্য ও আজগুবি মনে হওয়া স্বাভাবিক। বিজ্ঞাননিষ্ঠ ব্যক্তি সংগতকারণে একে অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বলেই চিহ্নিত করবেন। যদিও বিশ্বাসের ওপর ভর করে বিরচিত সৃষ্টিতত্ত্ব বা এ-সংক্রান্ত থিওলজির এতে কিছু যায় আসে না। কারণ…
মামলা যখন অজ্ঞেয়-অনির্ণেয় স্রষ্টা কীরূপে বিরাজ করেন, কীভাবে সৃষ্টির সূচনা-পরিচালনা-সমাপ্তি ও পুনর্জীবন ঘটান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় সেখানে প্রচলিত যুক্তিবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা যদি বিষয়টিকে প্রামাণিক, যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য করতে পারে তো ভালো কথা, যদি না পারে সেক্ষেত্রেও মানহানি ঘটে না। ‘অজব আদ-ধানাব’ হয়তো কোনও একদিন স্বয়ং বিজ্ঞানের পটভূমিকায় বৈধ ও যুক্তিসংগত বিবেচিত হবে, আবার কুত্রাপি সেটা নাও হতে পারে। সুতরাং থিওলজির পটপ্রবাহে যে-ব্যক্তি একে বিবেচনা করতে আগ্রহী তাকে সর্বাগ্রে সেই টেক্সটগুলো এস্তেমাল করতে হবে যেগুলো এহেন ধারণার ভিত্তি। উক্ত টেক্সট সমূহের সাপেক্ষে তাকে প্রমাণ করতে হবে ‘অজব আদ-ধানাব’-এর যৌক্তিক ভিত কোরান-হাদিস ইত্যাদির সাপেক্ষে দাঁড় করানো সম্ভব। যদি সেটা করতে ব্যর্থ হন তবে বিজ্ঞান একে দূর ভবিষ্যতে সঠিক প্রমাণ করলেও থিওলজির বিচারে সেটা বৈধ হয় না।
মনে রাখা উচিত, কোনও ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানের যুক্তি বিরচন পদ্ধতি প্রামাণিক উৎস নির্ভর এবং বিশ্বাস সেখানে কোনও ভিত্তি হতে পারে না। প্রামাণিকতা যাচাইয়ে আপাত অযৌক্তিক বিষয় সেখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে আবার সরাসরি অবান্তর গণ্য হতে পারে। পক্ষান্তরে থিওলজির আধারকেন্দ্র বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এর মূল প্রতিপাদ্য তাই সরল, — স্রষ্টার সকল কার্যকারণ মানবের পক্ষে বোধগম্য নহে; মানুষ এ-নিয়ে অনুমানসম্ভব যুক্তি দাঁড় করাতে পারে এবং বিজ্ঞান ও অন্যান্য শাস্ত্রে তার সমর্থন খোঁজায় দোষের কিছু নেই, তবে তা সকল অবস্থায় স্রষ্টার কর্মপরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে রচিত টেক্সট সমূহের নিরিখে বৈধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তো এই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে সৃষ্টির এসেন্স বা সারবস্তু রূপে ‘অজব আদ-ধানাব’-এর মতো উপাদানের কথা ভাবতে পারা কৃতির পরিচায়ক।
এ-ধরনের ভাবনা থিওলজিকে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক জ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুবিধা করে দেয়। চেতনা (Consciousness) বিষয়ক বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ভাবনার বর্তমান গতিবিধির নিরিখে ‘হাইপোথিসিস’ রূপে একে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। সেইসঙ্গে মনে রাখা আবশ্যক, বিজ্ঞানে গমনের পর ‘অজব আদ-ধানাব’-এর পক্ষে সমর্থন যদি না মিলে তাহলেও এটি বাতিল হয়ে যায় না, বরং কোরান-হাদিস ও ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞান যদি এরকম কিছুর ইশারা সত্যি দিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে থিওলজির ফ্রেমে তার প্রাসঙ্গিকতা অমলিন থেকে যায়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় আলী সিনা তাঁর হামজা বিষয়ক এনকাউন্টারে এসব গোনায় ধরেননি, ফলে তাঁর আলোচনায় ফাঁকফোকর যেমন রয়েছে, যুক্তির অসারতা সহজে প্রতীয়মান সেখানে।
‘অজব আদ-ধানাব’ সূত্রে দেহের সঙ্গে আত্মার সংযোগ, সিফাত আল-কিয়ামা’হ বা রোজ কিয়ামতের লক্ষণ, শেষ বিচারের আগে অবধি জান্নাত ও জাহান্নামের সক্রিয়তা স্থগিত থাকা, বারযাখ জারি থাকাকালে মৃতের সঙ্গে মালাইকদের সওয়াল-জবাব এবং পরিশেষে রোজ হাশরের ময়দানে সকলের পুনরুত্থান, আমলনামা বা কর্মফল অনুসারে শেষ বিচার ও জান্নাত অথবা জাহান্নামে গমন ইত্যাদি মিলে পরজগতের নকশা কোরান-হাদিসের নিরিখে ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞান বয়ান করে থাকে। বাইবেল যেমন ‘ঈশ্বরের রাজ্য’র নকশা হাজির করে, কোরানও ‘মালাকুত’-এর ছবিটি আাঁকে। আলী সিনা এসব নিয়ে তিলেক ভাবিত কিংবা তুলনামূলক আলোচনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন তাঁর লেখা পাঠে এমনটি একবারও মনে হয়নি। উলটো লেখায় তিনি দাবি করেন, জান্নাত সম্পর্কে মোহাম্মদের বর্ণনা বানোয়াট। তিনি শত-হাজার জান্নাত বিবরণী পাঠ করেছেন এবং এর একটির সঙ্গেও মোহাম্মদের বিবরণের মিল খুঁজে পাননি; অতএব তাঁর জান্নাত সংক্রান্ত বয়ানকে উদ্ভট মস্তিষ্কের কল্পনা ধরে নেওয়াই সমীচীন ইত্যাদি।
হায় কী দ্বিরাচার! একদিকে লেখার-পর-লেখায় সিনা বকে যাচ্ছেন, মোহাম্মদে মৌলিকতা বলে কোনও বস্তুর বালাই নেই, জায়েদ ইবনে আমরের কবিতা আর অন্যের থেকে ধার-উধার করে নিজেকে তিনি নবি করে তুলেছেন! ঘটনা সত্য হলে মোহাম্মদের জান্নাত বিষয়ক বয়ান সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবে জায়েদ বা অন্যের নকলি হওয়ার কথা! তাই নয় কি? ওদিকে সেই সিনা মত দিচ্ছেন, জান্নাতকেন্দ্রিক অপার্থিব নকশার যেসব বিবরণ বাইবেল সহ অন্যত্র মিলে মোহাম্মদের দুনিয়াবি ছকে সাজানো জান্নাত এর বিপরীত হওয়ায় বোঝা যায় তিনি এ-সম্পর্কে কিছু জানতেন না। তাঁর জান্নাত দুনিয়ার প্রতিরূপ। নানা বয়সের লোকজন সেখানে ঘুরে বেড়ায়, তারা শরাব পান করে, হুর ও গেলমানে বিমোহিত হয় এবং সারাক্ষণ সেক্সের ধান্ধায় লিপ্ত থাকে; যা কিনা অন্যে ধর্মে বর্ণিত জান্নাতের আত্মাকেন্দ্রিক অপার্থিব পবিত্রতায় বিরাজিত নকশার সঙ্গে খাপ খায় না! আরে ভাই, মিল যদি না থাকে তাহলে তো বলতে হয় মোহাম্মদ তাঁর বিবরণে মৌলিক ছিলেন! আর যদি এই বিবরণ ইমরুল কায়েস ও জায়েদের কবিতা শুনেটুনে কোরানে তিনি পাঞ্চ করে থাকেন তাহলে দায়টা কার ঘাড়ে বর্তায়? মোহাম্মদের নাকি ভুলে ভরা তথ্যে তাঁর মগজ যিনি বোঝাই করলেন সেই জায়েদ অথবা অন্য কারওর?
…
চিত্র–৮ : Raising of Lazarus; Painter: Unknown; Source: Google Images: Internet;
…
সিনা-র সাইটে যাঁরা রোজ হুমড়ি খেয়ে পড়েন ও তর্কে লিপ্ত হন এইসব সরলসিধা প্রশ্ন কী করে তাঁদের নজর এড়িয়ে যায় আল্লাহ মালুম! ইসলামকে ইভিল প্রমাণের মিশনে নিয়োজিত তাঁর সাইটে আলটপকা সব আলোচনায় এন্তার রেফ্রেন্স খইয়ের মতো ওড়ে, যদিও সারগর্ভতা ঠনঠনে সেটা প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর পর পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। ‘ঠনঠনে’ বলায় এ-দেশে তাঁর ভক্ত-আশেকানরা রাগ করতে পারেন কিন্তু লেখক নাচার। মোহাম্মদ ও তাঁর ভক্ত হামজা ইউসুফকে একহাত নিতে গিয়ে বিজ্ঞান ও বাইবেল মিশিয়ে উদ্ধৃতি আর কটুবাক্যের তোড়ে সিনা-র স্মৃতি থেকে (হায়! হায়!) কিংবদন্তির ল্যাজারাস বেমালুম গায়েব হয়ে যায়! আহা সেই ল্যাজারাস! আলী সিনা যখন সেন্ট পলের উক্তি ঠুকে তাঁর নাদান পাঠককে জ্ঞান বিতরণে বিভোর, সেই ফাঁকে ঈসা তাকে কবর থেকে জীবিত উঠে আসতে বাধ্য করেন! চারদিন ধরে কবরে তার লাশ পড়েছিল। ধরার নিয়মে মৃতদেহ কীটদংশনে নিশ্চয় বিনষ্ট হয়েছিল। আত্মা মৃতদেহ ছেড়ে উড়াল দিয়েছিল অজানায়! তথাপি ল্যাজারাসের বোন ও প্রতিবেশী এবং অবিশ্বাসী ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকজন আর শিষ্য পরিবেষ্টিত ঈসা কবরের নিকটে গমন করেন এবং তাকে সেখান থেকে উঠে আসার ডাক দেন। বাইবেল তার স্বভাবসুলভ অপূর্বতায় সে-কাহিনি বয়ান করে যায় :—
‘যিশু যখন দেখলেন, তিনি কাঁদছেন এবং তার সঙ্গে যে-ইহুদিরা এসেছিল তারাও কাঁদছে, তখন তিনি গভীরভাবে শোকাহত হলেন এবং ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন : ‘তাকে কোথায় রেখেছ?’ তারা তাঁকে বললেন : ‘প্রভু, এসে দেখুন।’ তখন যিশু কাঁদলেন। এতে ইহুদিরা বলতে লাগল : ‘দেখো, ইনি তাকে কত ভালোবাসতেন!’ কিন্তু, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলল : ‘এই ব্যক্তি, যিনি অন্ধ ব্যক্তির চোখ খুলে দিয়েছেন, তিনি কি লাসারকে (*ল্যাজারাস) মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারতেন না?’ তখন যিশু আবারও গভীরভাবে শোকাহত হলেন এবং কবরের কাছে এলেন। আসলে এটা ছিল একটা গুহা এবং এটার মুখে একটা পাথর দেওয়া ছিল। যিশু বললেন : ‘পাথরটা সরিয়ে দাও।’ তখন সেই মৃত ব্যক্তির বোন মার্থা তাঁকে বললেন : ‘প্রভু, নিশ্চয়ই এখন সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, কারণ আজ চার দিন হলো সে মারা গিয়েছে।’ যিশু তাকে বললেন : ‘আমি কি তোমাকে বলিনি, যদি বিশ্বাস করো তা হলে ঈশ্বরের মহিমা দেখতে পাবে?’ তখন তারা পাথরটা সরিয়ে দিল। পরে যিশু স্বর্গের দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘পিতা, তোমাকে ধন্যবাদ দিই, তুমি আমার প্রার্থনা শুনেছ। আমি জানি, তুমি সবসময় আমার প্রার্থনা শুনে থাক; কিন্তু আমি চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই লোকদের জন্য এই কথা বলছি, যেন তারা বিশ্বাস করে যে, তুমি আমাকে পাঠিয়েছ।’ এই সমস্ত কথা বলার পর, তিনি উচ্চস্বরে ডেকে বললেন : ‘লাসার, বেরিয়ে এসো!’ তখন সেই ব্যক্তি, যিনি মারা গিয়েছিলেন, বেরিয়ে এলেন আর তার হাত ও পা কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল এবং তার মুখ কাপড়ে মোড়ানো ছিল। যিশু তাদের বললেন : ‘ওর বাঁধন খুলে দাও এবং ওকে যেতে দাও।’ — উৎস : যোহন : ৩৩–৪৪; পবিত্র বাইবেল; জেডাব্লিউডটওরগ।
ঘটনাবহুল বাইবেলে যোহন ওরফে জনের বিবরণে জীবন্ত দরিদ্র ভিখারি ল্যাজারাসের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা যাওয়া এবং ঈসার কল্যাণে পুনর্জীবন লাভের অত্যাশ্চর্য ঘটনা বেমালুম বিস্মৃত হওয়া অবিশ্বাস্য বটে! মথি ও লুকের বিবরণে ল্যাজারাসের খোঁজ মিলে না। মার্কে তার উল্লেখ পাওয়া গেলেও এই ল্যাজারাস যোহনের গসপেলে বর্ণিত ব্যক্তি কি না সে-নিয়ে মনে দ্বন্দ্ব জাগে। বার্নাবাসে ল্যাজারাসকে পাওয়া যায় এবং তাঁর বর্ণনা সেখানে যোহানের অনুরূপ। পৃথিবীতে জীবনের সমাপ্তি ঘটার পর ঈশ্বর কীভাবে মৃতদেহ কবর থেকে উঠিয়ে আনবেন ল্যাজারাসের পুনরুত্থান তার নমুনা ইত্যাদি কথাবার্তা সাধু বার্নার বাইবেলে মিলে বটে, যা ইসলামিক মতের সঙ্গে অভিন্ন। তবে বার্নাবার বিবরণ নিয়ে খ্রিস্টান মহলে আপত্তি থাকায় এখানে উল্লেখ নাই-বা করি। আপাতত যোহনই যথেষ্ট! তাঁর সুসমাচারে ঘটনাটি খুঁটিনাটি সহকারে বর্ণিত হওয়ার ফলে ঈসা সেই সময় এমনধারা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন সে-ব্যাপারে সকল সন্দেহ দূর হয়ে যায়। কিন্তু সিনা-র ব্যাপারে সন্দেহ প্রগাঢ় হতে থাকে। লেখার প্রসঙ্গ বিবেচনায় জরুরি রেফ্রেন্স পাশ কাটিয়ে শব্দের গুলতি ছুঁড়তে থাকায় মনে আপনা থেকে প্রশ্ন ওঠে, বাইবেল কি তিনি জীবনে পাঠ করেছেন নাকি সাহেবদের কিতাব থেকে টুকলি মেরে ঠেকা চালাচ্ছেন? সেন্ট পলকে উদ্ধৃত করে দেহের পার্থিব (terrestrial) ও অপার্থিব (celestial) পুনরুত্থান বিষয়ক তাঁর মন্তব্যটি এই সুবাদে কিঞ্চিৎ বিবেচনা করা দরকার :—
So the body that is buried is not the same that survives. One is made of matter, and remains here, in the material world. It is destroyed. It will never rise. Our consciousness is independent from our body. That consciousness survives. Note how Paul calls people who think like Muhammad fools. He continues, ‘There are also celestial bodies and bodies terrestrial: but the glory of the celestial is one, and the glory of the terrestrial is another. — Source: Hamza Yusuf NDE: Does near death experience prove Islam right? by Ali Sina; alisina.org.
সিনা-র ব্যাখ্যা ও উদ্ধৃতি ঠোকার ধরন কিছুতে পরিষ্কার করে না এখানে মোহাম্মদের বোকামিটা কোথায়? আধ্যাত্মিক রাজ্যে দেহের পুনর্গঠন, পুনর্জীবন, পুনরুত্থানের বাইবেলবর্ণিত বয়ানের সঙ্গে কোরানের বেমিল মানে এই হতে পারে না পল সঠিক আর মোহাম্মদ ভ্রান্ত অথবা মোহাম্মদ ঠিক আর পল বেঠিক। মামলা এখানে অমীমাংসিত বিষয় ধরে অগ্রসর হওয়ার কারণে মৃতদেহের পরজগতে উত্থানের বয়ানে দুজনের কাউকে সঠিক অথবা ভ্রান্ত বলার সুযোগ থাকে না। হ্যাঁ, যিনি বাইবেলে বিশ্বাস করেন তিনি সেন্ট পলের উক্তিকে সত্য মানবেন এবং সেই যুক্তিছকে কোরানের বয়ানকে বাতিল করবেন। অনুরূপভাবে কোরানবিশ্বাসী ব্যক্তি বাইবেলকে ভ্রান্ত রায় দেবেন সেটা স্বাভাবিক। সিনা এইসব তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়ে নিজের কটুক্তি জারি রাখেন এবং পাঠকের মনে হতে থাকে তিনি বাইবেল গুলে খেয়েছেন আর যারা ইসলামকে কবুল করেছে তারা সবে নাদান! বিরাট বাইবেল ও কোরান বিশেষজ্ঞ আলী সিনা তো তুল্যমূল্য যাচাইয়ে না গিয়ে রায় ঠুকে দিলেন, আমাদের অতি সীমিত জ্ঞান ব্যবহার করে নাহয় একবার যাচাই করে দেখা যাক বাইবেল ও কোরান এ-সম্বন্ধে কতটা কী বলে গিয়েছে :—
প্রথমত বাইবেল ও কোরান উভয়ে বিশ্বাস করে ধরায় কাটানো ইহজাগতিক জীবনের মেয়াদ একদিন শেষ হবে এবং পরজগতে সকলের উত্থান ঘটবে। পুনরুত্থানের এই ছকে বাইবেলের সঙ্গে কোরানের মৌল তফাত হচ্ছে কোরান অনুসারে রোজ হাশরের ময়দানে সৃষ্টির সূচনা থেকে কিয়ামত অবধি যত মানবপ্রাণ ধরায় বিচরণ করেছেন তাদের সকলকে উঠিয়ে আনা হবে। ধর্মে-অধর্মে সেখানে কোনও তফাত করা হবে না, সকলে রোজ হাশরের ময়দানে নিজের আমলনামা বা কর্মফলসহ উত্থিত হবেন এবং সেই অনুসারে প্রাপ্য অর্থাৎ জান্নাত নয়তো জাহান্নামের রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হবে। বহুলপঠিত সূরা ‘হাশর’র শেষ দিকের কয়েকটি আয়াত এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় :—
‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; প্রত্যেকেই ভাবিয়া দেখুক আগামী কল্যের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠাইয়াছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা যাহা করো আল্লাহ সে-সম্পর্কে অবহিত।… আর তোমরা তাহাদের মতো হইও না যাহারা আল্লাহকে ভুলিয়া গিয়াছে; ফলে আল্লাহ উহাদের আত্মবিস্মৃত করিয়াছেন। উহারাই তো পাপাচারী।…জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। জান্নাতবাসীরাই সফলকাম।…তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নাই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত। উহারা যাহাকে শরিক স্থির করে আল্লাহ তাহা হইতে পবিত্র ও মহান।’ — উৎস : হাশর; ৫৯:১৮–২০, ২৩; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশে; পিডিএফ সংস্করণ।
সূরা ‘হাশর’ একইসঙ্গে স্রষ্টার স্বরূপ, তাঁর সৃষ্টি, জাগতিক ও পরজাগতিক পরিকল্পনা, শুভ-অশুভর দ্বন্দ্ব এবং সৃষ্টির অন্তিম পরিণামকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে নির্ধারণ করে যায়। বঙ্গদেশে এই সূরা হরহামেশা সালাত আদায়ের ক্ষণে ইমাম সাহেবরা মসজিদে পাঠ যান। আমজনতা যেহেতু আরবি বোঝেন না তারা ইমাম সাহেবের পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে শ্রবণ করতে থাকেন এবং পাঠ অন্তে রুকুতে গমন করেন। আপাত সংক্ষিপ্ত পরিসরে সূরা ‘হাশর’ যে-ভাবব্যঞ্জনা ধারণ করে তার কিছুটা আন্দাজ হয় প্যালেস্টাইন নিবাসী ইমাম ঘাসসান আল-শোরবাজি যখন সালাতে দাঁড়িয়ে এটি পাঠ যান! একজন ফিলিস্তিনি আরবিভাষী হওয়ার সুবাদে অনায়াস সহজতায় সূরায় উচ্চারিত আয়াতের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে। তার হয়তো মনে পড়ে যায় যেখানে দাঁড়িয়ে সে সালাত আদায় করছে সেখানে ক্ষণিক পরে কাঁটাতারের প্রাচীর উঠবে দেশহীন উদ্বাস্তু হওয়ার অনুভূতিতে তাকে বিদীর্ণ করার জন্য। ‘হাশর’র প্রতিটি পঙক্তি তাই নির্মমভাবে তার জীবনে প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে। তার হয়তো মনে পড়ে যায়, কোরানের ভাষায় সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐতিহাসিক সংঘাতের ময়দানে সে এখনও বিরাজিত!
অন্যদিকে সূরা ‘হাশর’ একজন ফিলিস্তিনির জন্য অগ্নিপরীক্ষাও বটে! সে কি সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের সঙ্গে আপসরফায় যাবে এবং তার দীন, চরিত্র ও ‘আকল’ ধারণ করবে, নাকি নিজের দীনে অটল থেকে উদ্বাস্তু হওয়ার দুঃসহ দহন সইবে? দহন সইলে কি পরজগতে জান্নাত মিলবে? সকল বঞ্চনা-লাঞ্ছনার শোধবোধ ঘটে যাবে? অথবা তার হয়তো উচিত, নিজের প্রাপ্যটি এখনই বুঝে নেওয়া! অগত্যা সূরা ‘হাশর’ তার কাছে মর্মবেদনা ও সান্ত্বনার বার্তাবাহক হয়ে আসে। ইমাম নিজের আবেগ সম্বরণ করতে পারেন না। তার পেছনে সালাতে দাঁড়ানো ফিলিস্তিনি নামাজ ভুলে রুমাল দিয়ে বারবার চোখের অশ্রু মুছে। কোরান ও মোহাম্মদের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে অটল আলী সিনা-র সংবেদনহীন ‘আকল’র পক্ষে বিষয়টি ধরতে পারা সহজ নয়। কোরান কেন ফিরে-ফিরে জাগতিক ঘটনার ভিতর দিয়ে ভাষা পায় এবং জাগতিক চিহ্নের অনুরূপতায় জান্নাত ও জাহান্নামের নকশা করে?—জিজ্ঞাসার হদিশ পেতে ঐশীবাণীর সঙ্গে আমজনতা কীভাবে নিজেকে সংযুক্ত রাখে সেই বিষয়গুলো সুবেদী মন নিয়ে অনুভব করা প্রয়োজন। অন্যথায় মনে হবে, কোরান নিছক সেকালের ঘটনা, হয়তো-বা উচ্চাভিলাষী এক ব্যক্তির ভুলচুকে ভরা দীন প্রণেতা হওয়ার ইতিহাসগাথা! সত্য বৈকি, কাউকে বাতিল করা সহজ কিন্তু সংবেদনশীল ‘আকল’ সহযোগে বাতিল ও গ্রহণের ভেদবিচার যথেষ্টই কঠিন! দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আলী সিনা সেই পরীক্ষায় ডাহা ফেল!
তো প্রসঙ্গে ফিরে যাই আবার, হাশরে সংঘটিত বিচারিক যজ্ঞ কীভাবে সম্পন্ন হবে সে-নিয়ে বিচিত্র ব্যাখ্যা রয়েছে, তবে মোদ্দা কথাটি সরল, — মোহাম্মদী দীনকে পরিপূর্ণতা দানের উদ্দেশে ধরায় ঈসা-র পুনরাগমন ঘটবে ও নিজেকে মসীহ বা ঈসা রূপে উপস্থাপনকারী অশুভ শক্তি দাজ্জালকে তিনি পরাভূত করবেন। ঈসা-র এই আগমনের ফলে পৃথিবী ফিতরাতে অটল হওয়ায় শান্তি ও স্থিতি বিরাজিত থাকবে কিছুদিন; অতঃপর ঈসা দেহ রাখার পরবর্তী মেয়াদ পূর্ণ হলে ইবলিশের ‘আকল’ সক্রিয় হতে থাকবে এবং রোজ কিয়ামত ঘটে যাবে। কিয়ামত ঘটে যাওয়ার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাঁর পরিকল্পনা মোতাবেক পরজগতে বিদ্যমান সকল প্রক্রিয়াকে সক্রিয় (Operational) করবেন এবং সেটাকে যদি কর্মপরিকল্পনার ফিনিশিং টাচ ভাবি তাহলে এই অবস্থা শাশ্বতকাল জারি থাকবে।
বাইবেলের ঘোষণা এখানে ভিন্ন। সেন্ট পল যেমন মত দিয়েছেন, কবর খালি হয়ে যাবে এবং ধার্মিক-অর্ধামিক সকলে উঠে আসবে তবে তাদের গতি ভিন্ন হবে। অর্থাৎ যারা ঈশ্বর ও ঈসায় ইমান রেখেছেন এবং সেই অনুসারে জীবন যাপন করেছেন তারা পরলোকে পুনরুত্থিত হবেন, আর যারা এর বাইরে রয়ে গেলেন তাদের গতি কী হবে সে-ব্যাপারে তিনি ঝেড়ে কাশেননি। ধর্মবেত্তারা ধারণা করেন তাদের গতি হবে ‘গিহেন্না’ (*কোরানে সিজ্জিন) বা পুঁতিগন্ধময় নরকে। নরকটি কোথায় তার ব্যাখ্যায় বাইবেল জানায় :—
গিহেন্না কী এবং কারা সেখানে যায়?
‘এর অর্থ কি এই যে, এক সময়ে বেঁচে ছিলেন এমন প্রত্যেক মানুষ পুনরুত্থিত হবে? না! বাইবেল বলে যে, মৃতদের কেউ কেউ গিহেন্নায় রয়েছে, যা বাংলা বাইবেলে ‘নরক’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। (লূক ১২:৫); প্রাচীন যিরূশালেমের (*জেরুজালেম) বাইরে অবস্থিত জঞ্জাল ফেলার এক স্থান থেকে গিহেন্না শব্দটা এসেছে। সেখানে মৃতদেহ ও জঞ্জাল পোড়ানো হতো। যে-মৃত ব্যক্তিদের দেহ সেখানে ফেলা হতো, তাদেরকে ইহুদিরা কবর দেওয়ার ও পুনরুত্থানের অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করত। তাই, গিহেন্না হচ্ছে চিরধ্বংসের এক উপযুক্ত প্রতীক। যদিও জীবিত ও মৃতদের বিচার করার ক্ষেত্রে যিশুর একটা ভূমিকা থাকবে, কিন্তু যিহোবাই হলেন চূড়ান্ত বিচারক।(প্রেরিত ১০:৪২) তিনি সেই ব্যক্তিদের কখনওই পুনরুত্থিত করবেন না, যাদের তিনি দুষ্ট এবং পরিবর্তিত হতে অনিচ্ছুক বলে বিচার করেন।’ — উৎস : বাইবেল ব্যাখ্যা; অধ্যায় সাত, আপনার মৃত প্রিয়জনদের জন্য প্রকৃত আশা; জেডাব্লিউডটওরগ।
এই বাছাইকরণের পাশাপাশি বাইবেল নিশ্চিত করে যেসব ব্যক্তি কুত্রাপি ঈশ্বর ও ঈসাকে জানতে পারেনি তাদেরকে পুনরুত্থিত করা ও সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে। এখানে প্রশ্ন হলো উত্থানের স্বরূপ নিয়ে। পরলোকের জন্য যারা পুনরায় উত্থিত হবেন তাদের স্বরূপ সেখানে কেমন হবে? তারা কি কবরে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেহ নিয়ে পুনরুত্থিত হবেন? নাকি যে-সচেতনা মৃত্যুর পরে জারি থাকে বলে সিনা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন তার ওপর ভর করে পরজগতে মৃতদের উত্থান ঘটানো হবে? অথবা আত্মা বা রুহের (গ্রিক পরিভাষায় ‘রুয়াখ্’ বা ‘প্নেভ্মা’) মাধ্যমে ঘটনাটি ঘটবে? বাইবেল এক্ষেত্রে কোরানের ন্যায় সুস্পষ্টভাষী নয়। বিষয়টি নিয়ে মতভেদ খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব বা থিওলজিতে বিদ্যমান এবং তার প্রকরণ এত ব্যাপক যে এ-সম্পর্কিত আলোচনার জন্য লেখক নিজেকে যোগ্য মনে করেন না। বিচিত্র ফেরকার উপস্থিতি ঘটায় সিনা যেমন বিশেষ ভাবাভাবির ধার-না-ধেরে ডিরেক্ট মত ঠুকে দিয়েছেন, বাস্তবে সেরকম মত ঠোকা আত্মহননের শামিল।
বিচিত্র ফেরকার বাইরে গিয়ে জনৈক জোশুয়া হেহে (Joshua Hehe) নামধারী ভদ্রলোকের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘টুইটার’ প্রণীত মুক্ত লেখালেখির অনলাইন সাইট Medium-এ বহুবিষয়ে আগ্রহী স্বশিক্ষিত (An Autodidact Polymath) ব্যক্তি রূপে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন। বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মে পুনরুত্থান সংক্রান্ত বিবরণ আর বাস্তবে সংঘটিত এরকম কিছু ঘটনার নজির জোড়া দিয়ে পরজগতে মৃতদেহের উত্থানকে তিনটি সম্ভাব্য স্তরে ভাগ করে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে মৃতদেহের পুনর্জীবন ও জীবিত দেহ ছেড়ে আত্মার চলে যাওয়া এবং পরে ফেরত আসার প্রহেলিকা ইঙ্গিত করে মৃত অথবা চেতনহীন দেহের পুনর্জীবন ত্রিবিধ উপায়ে সাধিত হতে পারে। স্থবির অথবা মৃত দেহে প্রাণসঞ্চারকে পুনর্গঠন (reanimation), পুনরুত্থান (resurrection) ও পুনর্জন্ম (reincarnation) এই তিন অবস্থার নিরিখে অনুমান করা সম্ভব। Medium-এ প্রকাশিত নিজের লেখায় সম্ভাব্যতার ছকটি তিনি এঁকেছেন নিচের মতো করে :—
…
চিত্র–৯ : Return of the Dead by Joshua Hehe; medium.com;
…
অর্থাৎ মৃতদেহ রিঅ্যানিমেশন বা পুনর্গঠিত অবস্থায় প্রাক্তন দেহ নিয়ে উত্থিত হলেও আত্মা সেখানে ভিন্ন হয়ে থাকে। রেজার্যাকশন বা পুনরুত্থানের বেলায় দেহ ও আত্মা দুটোই প্রাক্তন স্বরূপে উত্থিত হয়। এবং, মৃতদেহের রিইনকারন্যাশন বা পুনর্জন্ম যদি ঘটে তাহলে দেহ ভিন্ন হলেও প্রাক্তন আত্মা সেখানে বিরাজিত থাকে। জোশোয়ার এই ছককে যদি পলক বিবেচনায় নেওয়া যায় তবে কোরান সেখানে ছকের দ্বিতীয় সারি অর্থাৎ রেজার্যাকশন বা পুনরুত্থানের স্তরে অবস্থান করে। এটি সেই স্তর যেখানে প্রাক্তন দেহ ও আত্মাসহ হাশরের ময়দানে মৃতদেহের উত্থান ঘটবে। কোরান অনুসারে দেহ ধরায় অগমনের সঙ্গে রুহ সচল হয়। পুনরুত্থানের বেলায় বিধি সমান। কবরে বিনষ্ট দুনিয়াবি কায়া হয়তো ‘অজব আদ-ধানাব’ টাইপের ‘চিপ’র মাধ্যমে পুনর্গঠিত হবে; সেইসঙ্গে বারযাখকালীন অবস্থায় ‘ইল্লিন’ অথবা ‘সিজ্জিন’-এ বিশ্রামরত হলেও তিরমিজি বর্ণিত ‘চিপ’-এর মাধ্যমে সম্পৃক্ত আত্মাসহ হাশরের ময়দানে সে হাজির হবে।
মনে রাখতে হচ্ছে, ইসলামে ভিন্ন আত্মা দিয়ে দেহের পুনর্গঠন অথবা ভিন্ন দেহে প্রাক্তন আত্মা নিয়ে পুনর্জন্ম স্বীকৃত নয়। সিনা তাঁর লেখায় প্রশ্ন রেখেছিলেন, দেহকে যদি পুনরায় উত্থিত হতে হয় সেক্ষেত্রে আল্লাহ কোন দেহকে উঠাবেন, যেহেতু দেহকোষের জন্মমৃত্যুর ছকে একই মানব ভিন্ন বয়সে ভিন্ন অবস্থা ধারণ করে? এর উত্তর কোরানের বিচারে সহজ। মানব যে-অবস্থায় কবরে ঢোকে সেই অবস্থায় তার পুনরুত্থান ঘটতে পারে আবার তার জীবনকালের যুবক বয়সকে হয়তো তিনি বেছে নিতে পারেন। শুধু ফিতরাত অর্থাৎ জন্মসূত্রে তাওহিদে অটল যেসব শিশু ধরায় আসার পরে অবুঝ থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তারা মুমিন বা কাফির যার ঘরে জন্ম নিক-না-কেন, পুনরুত্থানের পর এইসব শিশু সোজা জান্নাতে গমন করবে।
এখন, জোশোয়ার এই ছকে বাইবেলের স্থান নির্ধারণ বেশ কঠিন। পুনরুত্থান সংক্রান্ত ব্যাখ্যাটি সেখানে স্ববিরোধী ও গোলমেলে। বাইবেলে সেন্ট পল দেহের পার্থিব বা টেরেস্ট্রিয়াল এবং অপার্থিব অর্থাৎ সেলেস্টিয়াল গতি লাভের খবর শোনান। দেহকে আত্মাসহ অবিকল পুনর্গঠনের সূত্র বা ইঙ্গিত সেখানে রয়েছে কি না এ-ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। যদিও হিব্রু শব্দ ‘রুয়াখ্’কে প্রাণীদেহে সক্রিয় আত্মা রূপে বিবেচনা করা নিয়ে অনেকে সন্দেহ ব্যক্ত করেন। তাঁদের মতে শব্দটির দ্বারা ভিন্ন কিছু হয়তো বোঝানো হয়েছিল! হিব্রু ‘রুয়াখ্’ বা গ্রিক ‘প্নেভ্মা’ সম্ভবত এমনকিছু ছিল যা প্রাণ অথবা প্রাণী বোঝাতে ব্যবহৃত হিব্রু শব্দ ‘নেফিশ’ ও গ্রিক ‘সিখি’র থেকে পৃথক কিছুর ইঙ্গিতদান করে :—
‘রুয়াখ্ বা প্নেভ্মা ছাড়া দেহ মৃত। তাই, বাইবেলে রুয়াখ্ শব্দটাকে কেবল আত্মা হিসেবে নয়, সেইসঙ্গে ‘প্রাণবায়ু’ বা জীবনীশক্তি হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, নোহের দিনে জলপ্লাবন সম্বন্ধে আদি পুস্তক ৬:১৭ পদ বলে: ‘আকাশের নীচে প্রাণবায়ুবিশিষ্ট [রুয়াখ্বিশিষ্ট] যত জীবজন্তু আছে, সকলকে বিনষ্ট করণার্থে আমি পৃথিবীর উপরে জলপ্লাবন আনিব।’ (আদি পুস্তক ৭:১৫, ২২) অতএব, রুয়াখ্ বলতে এক অদৃশ্য শক্তিকে (জীবনের স্ফুলিঙ্গকে) বোঝায়, যা সমস্ত জীবিত প্রাণীকে সজীব রাখে।’ — উৎস : বাইবেল ব্যাখ্যা; পরিশিষ্ট : রুয়াখ্ ও প্নেভ্মা শব্দগুলো বাইবেলে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে; জেডাব্লিউডটওরগ।
বাইবেল যেহেতু বিনষ্ট দেহের অবিকল পুনরুত্থান স্বীকার করে না সেক্ষেত্রে ‘রুয়াখ্’-কে ইসলামি ছকে ‘অজব আদ-ধানাব’ হেন কিছু ভাবা মুশকিল হয়ে পড়ে। ওদিকে ‘জীবনের স্ফুলিঙ্গ রুয়াখ্’ স্রষ্টার মৌল গুণাবলীর অপার্থিব অংশ অথবা অন্যকিছু, এই বিষয়টি সেখানে পরিষ্কার নয়। এহেন বিভ্রাটের কারণে পুনরুত্থানের প্রসঙ্গটি সিনা যেভাবে চুটকি বাজিয়ে বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করেন, বাস্তবে ঘটনা অনেক বেশি ঘোলোটে ও জটিল এবং তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হলে পুনরুত্থানকে আত্মিক ঊর্ধ্বারোহন ধরে নিতে হয়। ঈসাসহ জগতে আবিভূর্ত ও বাইবেল স্বীকৃত অনধিক দেড় লক্ষ ব্যক্তি সরাসরি অপার্থিব গতি প্রাপ্ত অবস্থায় পরজগতে অবস্থান করবেন বলে বাইবেল ব্যাখ্যা করে। এর মধ্যে যিশু ইতোমধ্যে অপার্থিব আত্মা রূপে সেখানে অবস্থান করছেন :—
‘এ ছাড়া, বাইবেলে আরেক ধরনের পুনরুত্থান সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে, যেটা হচ্ছে এক আত্মিক প্রাণী হিসেবে স্বর্গে জীবন লাভ। এই ধরনের পুনরুত্থানের শুধুমাত্র একটা উদাহরণই বাইবেলে লিপিবদ্ধ রয়েছে আর তা হচ্ছে যিশু খ্রিষ্টের উদাহরণ।…যিশুকে মানুষ হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে দেওয়ার পর, যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত পুত্রকে কবরে থাকতে দেননি। (গীতসংহিতা ১৬:১০; প্রেরিত ১৩:৩৪, ৩৫) ঈশ্বর যিশুকে পুনরুত্থিত করেছিলেন কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়। প্রেরিত পিতর ব্যাখ্যা করেন যে, খ্রিস্ট ‘মাংসে হত, কিন্তু আত্মায় জীবিত হইলেন।’ (১ পিতর ৩:১৮) এটা সত্যিই এক বিরাট অলৌকিক বিষয় ছিল। যিশু একজন শক্তিমান আত্মিক ব্যক্তি হিসেবে আবার জীবিত হয়েছিলেন! (পড়ুন, ১ করিন্থীয় ১৫:৩-৬.) সর্বকালের মধ্যে যিশুই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই ধরনের গৌরবান্বিত পুনরুত্থান লাভ করেছিলেন। তবে, এই ক্ষেত্রে তিনিই শেষ ব্যক্তি হবেন না। — যোহন ৩:১৩’ — উৎস : বাইবেল ব্যাখ্যা; অধ্যায় সাত : আপনার মৃত প্রিয়জনদের জন্য প্রকৃত আশা; জেডাব্লিউডটওরগ।
অপার্থিবের বিষয়টি মোটের ওপর বোঝা গেল কিন্তু বাকি যারা রইলেন অর্থাৎ পার্থিব, যাদেরকে ধার্মিক ও অধার্মিক বিবেচনায় পরলোকে গমনের সুযোগ দান করা হবে তাঁরা সম্ভবত পার্থিব আত্মা রূপেই পরলোকে পুনরুত্থিত হবেন। সিনা-র সঙ্গে তালিয়া বাজিয়ে আপাতত ধরে নিতে হচ্ছে বাইবেলে আত্মিক পুনরুত্থান আছে, দৈহিক পুনরুত্থান নেই। সমস্যা হলো, যোহন বর্ণিত ল্যাজারাস সেখানে ফের ঝামেলা পাকায়! ঈসা তাকে ধরায় গলাপচা দেহ থেকে পুনর্জীবিত করেন। ল্যাজারাস ছাড়াও মৃতের জীবন ফেরানোর একাধিক ঘটনা বাইবেল বর্ণনা দিয়ে যায়। সেন্ট পল ও একালের বিজ্ঞান মাথায় নিয়ে সিনা মৃত বা বিনষ্ট দেহের অবিকল পুনর্জীবন লাভের ঘটনা খারিজ করেছেন এবং সেটা কোনও ভুল নয়। আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার যাক বা না-যাক ব্যক্তির সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও মৃত্যুর পর দেহের বিনষ্টিকে অনিবার্য বলে স্বীকার করে। প্রশ্ন হলো, ল্যাজারাস ছাড়াও যেসব মৃতদের প্রাক্তন দেহসহ ঈসা জীবনে ফেরান তাদের বিষয়ে সিনা-র ব্যাখ্যা কী? তারা কি পার্থিব আত্মার সাহায্যে প্রাক্তন দেহে ফেরত যায় ও বেঁচে ওঠে? নাকি সচেতনা (Consciousness) ব্যবহার করে ঈসা তাদের প্রাক্তন দেহের পুনর্জন্ম ঘটান? জগতে ফাজিল লোকের অভাব নেই। এই সুযোগে সেরকম ফাজিল কেউ যদি তাঁকে প্রশ্ন ঠুকে বসে, ঈশ্বর যিহোবার কল্যাণে ঈসা যে-কর্মটি ধরায় অনায়াসে করতে পারলেন, পরলোকে সেটা করা স্রষ্টার জন্য কী এমন কঠিন কাজ শুনি? জানি না সিনা তার উত্তরে কী বলবেন! অবশ্য তাঁর কাছে উত্তর আশা করা বৃথা! মোহাম্মদের নাম শুনলেই তাঁর গায়ে চুলকানির যে-বিগার ওঠে সেটা আর থামতে চায় না। অগত্যা শাপশাপান্তের চোটে সকল বিচারিক কাণ্ডজ্ঞান সেখানে লোপ পায়। মোহাম্মদ যদি আলী সিনা-র বিবেচনায় বাতিকাবেশ বৈকল্যের শিকার হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে তাঁকে মোহাম্মদবিরাগ বৈকল্যয় (Muhammad Allergy Syndrome Disorder) আক্রান্ত ভাবা যেতে পারে!
এই বিমারে ভোগার কারণে পাঠককে জবাব দিতে বসে ঈসা-র মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বিষয় সিনা-র লেখায় বাদ পড়ে যায়। অথচ যে-পরিসর নিয়ে তিনি জবাব লিখেছেন সেখানে এটি আসতে পারত। তিনি হয়তো অন্যত্র এসব নিয়ে লিখেছেন, লিখে থাকলে তথ্যসূত্র ধরিয়ে দিতে সমস্যা তো ছিল না। এর কিছুই তিনি করেননি! হামজা ইউসুফের মৃত্যুর নিটকবর্তী অভিজ্ঞতা (NDE) এবং মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে কোরানের বক্তব্য বিচারের মামলায় পূর্ব সিদ্ধান্তে (*তাঁর লিখিত বইপত্র ও অন্যান্য লেখালেখিকে যদি বিবেচনায় রাখি।) স্থির হয়ে লিখতে বসায় নিজেকে প্রশ্ন ও যাচাইয়ের তাগিদ তিনি বোধ করেননি, যা এরকম একটি প্রসঙ্গের আলোচনায় জরুরি ছিল।
বাইবেল জানায় ঈসা ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং পরে কবর থেকে উঠে আসেন ও ধরায় কিছুদিন বিচরণের পর সম্ভবত স্বর্গে আরোহন করেন। মথি, মার্ক, লূক ও যোহনের বয়ান ঈসার পুনরুত্থান আর অচেনা বেশে ধরায় বিচরণের খবর দিয়েই শেষ হয়েছে। বাইবেলের সম্প্রসারণ ‘প্রেরিত’ ও সেন্ট পলের বাখানি ‘করিন্থীয়’ অংশও ঈসা পবিত্র আত্মিক শক্তিতে জীবিত দেহ ধারণ করে ফিরে এসেছিলেন এবং করণীয় সম্পর্কে শিষ্যদের দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন ইত্যাদি বলে মামলা খতম করে। এর থেকে অনুমান হয় বাইবেলের এই প্রাণপুরুষ কার্যত যেশোয়া হেহে-র ছকে তৃতীয় অর্থাৎ রিইনকারন্যাশন বা পুনর্জন্মের স্তরে ভিন্ন দেহে প্রাক্তন আত্মা নিয়ে কবর থেকে উঠে আসেন ও শিষ্যদের দেখা দিয়ে অপার্থিব আত্মা রূপে স্বর্গে ফেরত যান। ঈসার আমআদমিকে প্রাক্তন দেহসহ জীবিত করে তোলা এবং তাঁর নিজের কবর থেকে উঠে আসা ও ধরায় বিচরণ উভয় ক্ষেত্রে বিষয়টি ক্লিয়ার নয়, কীসের সাহায্যে দেহ ধারণের কর্ম সেখানে সাধিত হয়েছিল! পার্থিব ও আপার্থিব আত্মিক শক্তির জোরে নাকি সচেতনাকে (Consciousness) ব্যবহার করে? সিনা তাঁর রচনায় দুটোকে উল্লেখ করেছেন দায়সারা রেফ্রেন্সের মতো, যা দেখে সন্দেহ হয় জটিল এই বিষয় সম্পর্কে তাঁর নিজের ধারণা স্বচ্ছ নয়। যদি ভুল বলে থাকি সিনাভক্ত পাঠকরা শুধরে দেবেন আশা করি।
সন্দেহ নেই, দেহ-আত্মা-সচেতনার ভজকট সত্ত্বেও পার্থিব দেহের অবিকল পুনরুত্থানের ঘটনা নাকচ করায় বাইবেল এখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে বেশ মিলেঝুলে গেছে; অতএব কেউ তাকে বৈজ্ঞানিক এবং কোরানকে অবৈজ্ঞানিক আখ্যা দিলে বলার কিছু নেই। সমস্যা হলো পুনরুত্থানের যে-ছক কোরান রেখে যায় সেটা যে একদিন বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলঝুল ঘটাবে না তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? সেরকম যদি ঘটে যায় তখন সিনা কি তাঁর মত প্রত্যাহার করে নেবেন? ক্যাম্পবেলের সঙ্গে বিতর্কে জাকির নায়েকের এই মতটি তাই প্রনিধানযোগ্য, — কোরান কোনও Science নয় বরং Sign. আর Sign মানে হচ্ছে আয়াত। কোরানে অনধিক পাঁচ হাজার আয়াত রয়েছে যার মধ্যে হাজারখানেক Science-র সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। থিওলজির মামলায় বিজ্ঞান নিয়ে দড়ি টানাটানি বিশেষ কাজে আসে না। এই টানাটানি কোরানপন্থীর জন্য যেমন আপদ বাড়ায়, বাইবেল কিংবা অন্যপন্থীর ক্ষেত্রেও কথা সমান। আলী সিনা কথাটি মনে রেখে অগ্রসর হলে তাঁর টেক্সট অন্যমাত্রায় উপনীত হতো সন্দেহ নেই। তাহলে তিনি দেখতে পেতেন বাইবেলের চেয়ে বরং কোরান অধিক স্বচ্ছতার সঙ্গে জটিল মামলাটি সমাধা করেছে। সিনা-র ভাষায় নাদান ও প্রতারক মোহাম্মদ কোরান সূত্রে বাইবেলর তিনটি জায়গা খারিজ করে গেছেন এবং বাদবাকি বিষয় যেমন হারাম-হালাল ও উপাসনারীতি ইত্যাদি টুকিটাকি বাদ দিলে মোটের ওপর তাঁকে একাত্ম হতেই দেখা যায় :—
প্রথমত আল্লাহর একত্বে এমনকি তাঁর নূরস্বরূপ সিফাতের প্রতিভাস (*সূরা ‘নূর’ দ্রষ্টব্য) থেকে জাত নবির একাত্ম হওয়ার সুযোগ নেই এবং এহেন তুলনা শিরকের সমতুল। আল্লাহ সৃষ্টির মাঝে তাঁর গুণ সঞ্চারিত করেন কিন্তু আত্মিক কিংবা অন্য কোনও উপায়ে নিজে সেই সৃষ্টির আকৃতি ধারণ করেন না। যে-কারণে ঈশ্বর একজনই, তবে নিজের পবিত্র শক্তিবলে তিনি তাঁর বার্তাবাহক ও পবিত্র আত্মা অর্থাৎ দিশারী সৃষ্টি করে থাকেন ইত্যাদি ইসলাম স্বীকার করে না। যা ত্রিত্ববাদকে খারিজ করার উদ্দেশে আল্লাহর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নেই ইত্যাদি সূত্রে একাধিক সূরায় উল্লেখিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত ঈসার মৃত্যু ঘটেনি বরং ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ক্ষণে আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন পরে আবার প্রেরণ করবেন বলে। রোমান ও ইহুদিরা মিলে ঈসা ভেবে যাঁকে হত্যা করে তিনি ছিলেন তাঁর নকল প্রতিরূপ। যদিও এই প্রতিরূপ কী করে সৃষ্টি হয় কোরান সেটা ক্লিয়ার করেনি। থিওলজির শরণ নিয়ে অবশ্য ভাবা যায়, আদম ও হাওয়াকে যদি অ-যৌন পন্থায় সৃজন করা সম্ভব হয়, যদি ঈসা বন্ধ্যা মরিয়মের গর্ভের তিন স্তর বিশিষ্ট অন্ধকার (*দ্রষ্টব্য : সূরা ‘আয-জুমার’ ৩৯:৬) পেরিয়ে ধরায় জন্ম নিতে পারেন, সেক্ষেত্রে তাঁর নকল প্রতিরূপ প্রেরণ স্রষ্টার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। তবে মোদ্দা কথাটি হলো মৃত ব্যক্তিকে ধরায় তিনি পুনরায় জীবন দান করেন না। একবার মৃত হলে তার দেহের সঙ্গে আত্মার সংযুক্তি ‘অজব আদ-ধানাব’ সূত্রে তিনি বারযাখে বজায় রাখেন। তাকে উত্থান করা হবে রোজ কিয়ামত ঘটার পর। ততদিন অবধি জান্নাত-জাহান্নামের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, তবে বারযাখ অবস্থায় মালাইকের মাধ্যমে মৃতের সঙ্গে সাওয়াল-জওয়াব ও এহেন কার্যক্রম চলমান থাকবে। তৃতীয়ত কেউ উঠবে আর কেউ উঠবে না এমনধারা কারবার আল্লাহর অপছন্দ ও তাঁর পরিকল্পনায় নেই। তিনি সকলের স্রষ্টা, সুতরাং সকলেই উঠবে এবং সকলের আমলনামা পাঠ ও সেই অনুসারে পুরস্কার ও শাস্তি এবং শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে অপরাধীরা জান্নাতে দাখিল হবে। এটা বাইবেল বর্ণিত সেই ‘অমররাজ্য’ যা শাশ্বত, যদি না আল্লাহ এমন কোনও পরিকল্পনা করে থাকেন যা মোহাম্মদেরও অজানা ছিল।
কোরান ও মোহাম্মদ প্রণীত পরজাগতিক এই বয়ানকে স্বীকার যাওয়া বা না-যাওয়া ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। তিনি এটা বাতিল অথবা গ্রহণ করতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে জবরদস্তি না-করার বিধান কোরানে স্বীকৃত। এখন কথা হচ্ছে গ্রহণ অথবা বাতিল দুটোই সুস্পষ্ট যুক্তি ও রেফ্রেন্সের সাহায্যে সম্পন্ন হওয়া উচিত, কেননা পরজগৎ সংক্রান্ত সকল ভাষ্য অমীমাংসিত এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত যুক্তি দিয়ে বোনা। যুক্তির সারবত্তা নিয়ে ধুন্ধুমার তর্ক চলতে পারে এবং সেটা হওয়া উচিত। আলী সিনা এই রীতি উপেক্ষা করায় তাঁর টেক্সটের সঙ্গে কট্টরপন্থী ইসলামিস্টের কোনও ফারাক থাকেনি! তার মতো তিনিও একপেশে, একদেশদর্শী এবং পিউরিটান। একজন বিদ্বেষীর পক্ষে আর যা-ই হোক সংবেদনশীলতা আশা করা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার নামান্তর। নাস্তিক্যের পয়লা শর্ত সংবেদনশীল সুবেদী বিচক্ষণতা। প্রাসঙ্গিক যুক্তি সহকারে কঠিন কথা বলতে বাধা নেই, নিকট অতীতে ভলতেয়ার ও বার্ট্রান্ড রাসেল জগতে সে-নজির রেখে গেছেন এবং সে-তালিকায় এ-রকম আরও অনেকের নাম নেওয়া যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য এইসব মণীষাকে যাঁরা অনুসরণ ও উদ্ধৃত করেন তাঁদের মধ্যে এর অভাব থাকায় মাঝেমধ্যে মনে হয় শব্দচাকু হাতে ভয়ংকর খুনিরা অনলাইনে ঘুরছে এবং সুযোগ পেলে ‘জয় বজরং বলি’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে!
সিনা-র ‘বজরং বলি’-সুলভ অবিমৃষ্যকারিতা এতদূর উৎকট যে ইসলামে মালাকুত বলতে কী বোঝায়, দেহের সঙ্গে রুহের ধরায় গমনের পর কী ঘটে, রুহের সংজ্ঞা সে কীভাবে নির্ধারণ করে, দেহ কবরস্থ হওয়ার পর রোজ হাশরে তার উত্থান সম্পর্কে কোরান ও ইসলামি টেক্সটের ব্যাখ্যা কী এসবের পরোয়া না করে তাঁর চাকুবাজি চলতে থাকে। চিরাচরিত বদ খাসলতের দোষে তিনি বারবার ফেরত যান বিষোদগারে জগতে এবং উক্তি ঠোকেন, হামজা ইউসুফ ভ্রান্ত মতের চক্করে পড়ায় মোহাম্মদের মতো তাঁরও নরকে গমন ছাড়া গতি নাই! চাকুবাজির তোড়ে আলী সিনা আহাম্মকের মতো মতো এখানে যে ভুলটি করে বসেন সেটা হলো অন্যের বক্তব্যের ভিত্তি ও যুক্তি বিরচনের ধারা-প্রবণতা কোনও কিছুর তোয়াক্কা না-করে ডিরেক্ট মত ঠুকতে থাকেন! তাঁর এই হালত দেখে ‘বাহুবলী’-র অনন্য সেই থ্রিডি অ্যানিমেশন, শিংয়ে লকলকে আগুনের শিখা নিয়ে মাটি কাঁপিয়ে ধাবমান খ্যাপা ষাঁড়ের ছবি চোখে ভাসে।
বিষয়টি দুঃখজনক! ‘Understanding Muhammad’ গ্রন্থে রেফ্রেন্স সূত্রে যুক্তি প্রদানে তাঁর যাও-বা কুশলতা ছিল সময়ের সঙ্গে তিনি সেটা হারিয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ইসলামি চরমপন্থী মনোভাবের সঙ্গে তাঁর জঙ্গিপনার পার্থক্য খুঁজতে যাওয়া দুরাশার নামান্তর! কন্টেন্টের বিচারে সমৃদ্ধ হামজার বই ও ইউটিউব লেকচার ঘেঁটে দেখার কথা লেখায় উল্লেখ করলেও কাজটি তিনি করেছেন বলে একিন হয় না। কেন হয় না সে-আলাপ পরবর্তী পর্বে বলা সংগত মনে করি। এমনিতে এই আলাপ যথেষ্ট লম্বা সময় ধরে চলেছে। খানিক জিরান দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে!
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৯
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৮
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS