ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ৩ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ৩ || আহমদ মিনহাজ

পরিশিষ্ট / ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা


মধ্যযুগের অনেক দিগগজ বিদ্বানকে দেখতে পাচ্ছি ইসলামের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যায় হাদিসশাস্ত্রকে সকল সময় অমোঘ করে না-তুলতে, যদিও এর জন্য কোরান থেকে মোহাম্মদকে নিষ্কাশন করে নিতে তাদেরকে গাড্ডায় পড়তে হয়নি। ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ বা ইবনে আরাবির কথা বাদই দিচ্ছি; আল্লাহর স্বরূপ ও সৃষ্টিরহস্যের কিনারা সন্ধানে গাজ্জালির মতো কট্টরপন্থী বিদ্বান কোরানের আয়াতকে প্রাধিকার দিয়ে নিজের ভাবনা ও উপলব্ধি ব্যাখ্যা করছেন দেখতে পাই। তাহাফুত আল-ফালাসিফায় (Incoherence of the Philosophers) গ্রিক দর্শন বিশেষ করে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দার্শনিক মতবাদকে ভাগাড়ে নিক্ষেপের সপক্ষে কটু যুক্তিবাণ হানলেও ইসলামি বিদ্যাচর্চার ইতিহাসে গাজ্জালিকে অ্যারিস্টটল ও সেন্ট অগাস্টিনের সমগোত্র মানতে হয়। জগৎসংসারের সকল বিষয় নিয়ে অ্যারিস্টটলের মতো তিনিও ভেবেছেন এবং বক্তব্য বা অভিমত প্রদানের সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাঁকে তাড়িত করেনি! গাজ্জালি যেখানে যাচাই-বাছাই না করে হাদিসের ব্যবহারে ব্যাপক হয়েছেন (*যেমন ইসলামি জীবনাচারে পালনীয় বিধি-বিধান ইত্যাদি) সেখানে তিনি নিরস ধর্মবেত্তা। এই গাজ্জালি হলেন ইমাম  যাঁকে ইসলামি জীবনবিধান সম্পর্কে ফতোয়া দানের জন্য রাজন্যরা খাটিয়ে মারছে আর তিনি অকাতরে সেই দায়িত্বের বোঝা বহন করে চলেছেন! তাঁর বহুল পঠিত কিতাবগুলোয় কোরানের ব্যবহার ঘটলেও সেই কোরান এক প্রেতপুরী, যেটি মধ্যযুগের সংকীর্ণ খোপে দমবন্ধ আর প্রায়শ হাস্যকর সংস্কারে আচ্ছন্ন।

অন্যদিকে সংস্কারাচ্ছন্ন গাজ্জালি আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন যখন স্রষ্টার প্রকৃতি সম্পর্কিত দার্শনিক ঘরানায় বিদ্যমান মতবাদ খণ্ডনে পাঠক তাঁকে ‘মাকসুদুল ফালাসিফা’ কিংবা তাহাফুত আল-ফালাসিফায় গমন করতে দেখে। নিজের বক্তব্য ও অভিমতকে সঠিক প্রমাণে আগ্রাসী হলেও বিপক্ষমত খণ্ডনে তাঁর যুক্তির সারবত্তা পাঠককে ভাবায়। ‘তাহাফুত আল-ফালাসিফা’ কিতাবখানা তিনি লিখেছিলেন বলে হয়তো তাঁর অভিমত খণ্ডনের অভিপ্রায়ে প্রায় এক শতাব্দী পর ইবনে রুশদ-এর আবির্ভাব ঘটেছিল। অ্যারিস্টটলের ওপর খড়গহস্ত গাজ্জালির বক্তব্যকে যুক্তির ছুরি দিয়ে ব্যবচ্ছেদের খেলায় রুশদের ‘তাহাফুত আল-তাহাফুত’ (The Incoherence of the Incoherence) যেন শাণিত তরবারি! মোল্লাদের দু-চোখের বিষ হলেও সেকালের অনেক বিদ্বান এই কিতাবকে কট্টরপন্থী মনোভাবের বিপরীতে তাজা হাওয়া গণ্য করতে অভ্যস্ত ছিলেন। ইতিহাসে লেখে কর্দোবার খালিফ ইবনে রুশদকে প্রীতিকর ভাবলেও মোল্লাদের চাপ ও প্ররোচনায় তাঁর পাণ্ডুলিপি ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রুশদের ভেনিসনিবাসী খ্রিস্টান শিষ্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই পাণ্ডুলিপি কর্দোবা থেকে ইউরোপে পাচার করেছিল। ঘটনাটি না-ঘটলে মুক্তচিন্তার ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরকালের জন্য মুছে যেতেও পারত, আর সেক্ষেত্রে তাঁকে নিয়ে রাফায়েল বা বোর্হেসের পক্ষে স্মরণীয় চিত্র (*The School of Athens) ও কাহিনি (*Averroes’s Search) ফাঁদা বরাতে জুটত বলে মনে হয় না। প্রতিকূল যুগবিশ্বে অ্যারিস্টটলের দার্শনিক ভাবনার তদন্ত ও ব্যাখ্যায় নিবেদিত রুশদের পাণ্ডুলিপির ইউরোপ গমন নিয়ে মিশরদেশি চলচ্চিত্রকার ইউসুফ চাহিন-এর Destiny সিনেমাখানা পাঠক এই ফাঁকে দেখে নিতে পারেন।



চিত্র
: দ্য স্কুল অব এথেন্স (ফ্রেস্কো) : পাগড়ি পরিহিত ইবন রুশদ পিথাগোরাসের কাঁধ বরাবর উঁকি দিচ্ছেন, যেখানে পিথাগোরাস বই লিখছেন মূল চিত্রকর্ম : রাফায়েল; উৎস : wikipedia

গাজ্জালির প্রসঙ্গে ছিলাম, আরেকবার সেখানে ফিরি। কট্টরপন্থী ভাবনাকে প্রতিহত করার বাসনায় ইবনে রুশদ তাহাফুত আল-ফালাসিফার পাল্টি ‘তাহাফুত আল-তাহাফুত’ রচনায় হাত দিলেও অধমের পাঠ-অভিজ্ঞতায় গাজ্জালির যুক্তি-বিরচন পদ্ধতিকে অপ্রাসঙ্গিক প্রলাপ মনে হয়নি। দেরিদীয় পন্থায় দুই যুগন্ধর যুক্তিবেত্তার দার্শনিক ভাবনার নতুন পাঠ ও ব্যাখ্যা হতেই পারে। ইসলামের ইতিহাসে হাজার বছর ধরে সচল কট্টর ও মুক্তমনার সাংঘর্ষিক বয়ানে নিহিত ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের পুনর্পাঠ ব্যতীত একালের বিদ্যাচর্চায় বিরাজমান শিবির-বিভাজনের তল পাওয়া মুশকিল হয়। হাস্যকর বৈকি, ঐতিহ্যপন্থীদের অনুকূলে ওকালতি করলেও তাহাফুত আল-ফালাসিফার গাজ্জালিকে মুসলমান সম্প্রদায় পারলে এড়িয়ে চলে। ‘এহিয়া উল উলুমুদ্দিন’-এর রচয়িতা গাজ্জালির পাঠক মুসলিম বিশ্বে বেশুমার। কিতাবটির সংক্ষেপিত ফার্সি ভাষ্য ‘কিমিয়ায়ে সাদাত ওরফে সুখের রসায়ন’ বিদ্বান থেকে আমজনতার নিকট হাজার বছর ধরে আদরণীয় গণ্য হয়ে আসছে। ঐতিহ্যপন্থী ব্যক্তির নিকট ‘সুখের রসায়ন’ সুখপাঠ্য কিতাব হলেও একুশ শতকে জ্ঞানের গতিধারা বিবেচনায় বিশেষ মূল্যবান নয়। তুলনায় ‘তাহাফুত আল-ফালাসিফা’, ‘মাশকাতুল আনওয়ার’ বা ‘হকিকতে রুহ’-এর রচয়িতা গাজ্জালির কদর পাঠক কতটা করেন সেই প্রশ্ন মনে উঁকি দিয়ে যায়!

কট্টরপন্থী ইসলামিস্টরা গাজ্জালির হাদিসপ্রভাবিত ও আচারবিচারসর্বস্ব কিতাবগুলোয় মজে থাকে বা সেগুলোকে প্রমোট করে যায়, অথচ যেখানে তিনি ভাবনার স্বকীয়তায় দীপ্ত সেই গাজ্জালির প্রমোটার একালেও মেলা ভার! গাজ্জালিভক্ত হামজা ইউসুফের পক্ষে কাজটি দুরূহ ছিল না, যদিও ভদ্রলোক কোরানের আধ্যাত্মিক উপলব্ধির চর্চায় তাসাউফের যে-পরিধিতে গমন করেছেন সেখানে প্রবেশের পর তাসাউফ শরিয়তের ছকে বাঁধাই নিরস পাঠ্যবস্তুতে পরিণত হয়! গাজ্জালির একনিষ্ঠ পাঠক মার্কিনদেশি বিদ্বানের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নমনীয়তাকে ভালোবাসার কারণ থাকলেও ইসলামি থিওসফি ও কোরানের সুবেদি সম্প্রসারণের কাজকে তিনি এগিয়ে নিতে পারেননি। অতিরিক্ত ‘বুখারী’ আর ‘কিমিয়ায়ে সাদাত’ প্রীতি হামজাকে আত্মিকভাবে নিঃস্ব করে দিয়েছে এবং এই ফাঁদ কেটে তাঁর বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ!

তাসাউফের অনুশীলনে মর্মরিত সুফিবাদকে শরিয়তনিষ্ঠ ছকে জনপ্রিয় করে তোলার ইতিহাসে গাজ্জালির ভূমিকা ও প্রভাবকে পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে এবং কাজটি হওয়া প্রয়োজন। কালের ধারায় ইসলামে জন্ম নেওয়া উগ্রতাকে নমনীয় করার লক্ষ্যে মুসলিম বিশ্বে সুবেদি এক তাসাউফের জন্ম হয়েছিল, যদিও পরে সেটি গাজ্জালির চিন্তাধারার প্রভাবে মরুসাহারায় পথ হারিয়েছিল কি-না সেটি যাচাইয়ের সময় বোধহয় তামাদি হয়ে যায়নি। একালে তাসাউফ চর্চায় নিবেদিত বিদ্বানকুলের বৃহৎ অংশের মধ্যে সেই আধ্যাত্মিক দ্যুতির আভাস কী মিলে যে-কারণে এর অনুশীলনকে একসময় অনুধ্যান ও উদারতার স্মারক গণ্য করা হতো? ইসলামের রাজনৈতিক সম্প্রসারণ ঘটিয়ে আল্লাহর রাজ্য প্রতিষ্ঠা আর বিদআত নিকাশের খোয়াবে বিভোর সালাফি ও ওয়াহাবি পন্থীদের চক্করে দিশেহারা বিদ্বানরা ‘মুসলমান’ শব্দের সারবত্তা অন্বেষণে কথিত রাজনৈতিক ছক ধরেই অগ্রসর হয়ে থাকেন, যেখানে এই শব্দের নেপথ্যে সক্রিয় ‘ফিতরাত’-এর মৌল আবেদন তাদেরকে বিচলিত করে বলে মনে হয় না! কোরানের আধ্যাত্মিক সারবত্তা উপলব্ধি ও অনুশীলনে একদেশদর্শিতা তাসাউফের আদি চরিত্রের সঙ্গে মানায় কী? প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান হয়তো জরুরি!

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ত্রিনিদাদ-টোবাগোর নাগরিক ইমরান নজর হোসেনকে অগত্যা কোরানের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার দিশারী রূপে তাসাউফপন্থী বিদ্বানদের গুরুত্ব প্রদানের জন্য সালাফিদের নিকট আবেদন পেশ করতে দেখি! গাজ্জালি ঘরানায় তাসাউফচর্চায় নিবেদিত ইমরান ইসলামি পরকালবিদ্যার (Islamic Eschatology) রাজনৈতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় নিয়োজিত রয়েছেন হয়ে গেল বহু বছর। পৃথিবীর গোপন প্রান্তে অবরুদ্ধ ও কোরানে উল্লেখিত বৈনাশিক শক্তি ইয়াজুজ-মাজুজের (*বাইবেল বর্ণিত Gog and Magog) অবমুক্ত হওয়ার সঙ্গে রোজ কিয়ামতের দিনক্ষণ গণনা ও তার রাজনৈতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় পারদর্শী সুবক্তা ইমরান নজর হোসেনের তাসাউফচর্চা যথারীতি ভীতিপ্রদ বয়ানের জগতে বিচরণ করতে স্বস্তি বোধ করে! নিজ মতের সপক্ষে যুক্তি বিরচনে পারঙ্গম ইমরান কিয়ামতের লক্ষণ ব্যাখ্যার আদি উৎস রূপে কোরানের আয়াতে গমন করলেও এর ভাবিক সম্প্রসারণ ঘটানোর কাজে তাঁর অবধানশক্তি হাদিসের বৃত্তেই ঘুরপাক খায়। বুখারী শরীফ-এ সংকলিত কতিপয় হাদিস সম্পর্কে সন্দিহান হলেও স্বরচিত কিতাব ও বক্তিমায় সম্পূরক পাঠ্যবস্তুর সাহায্য নেওয়ার ক্ষণে হাদিসশাস্ত্রকে যে-পন্থায় তিনি এস্তেমাল করেন সেটি কোরানের আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে সহায়তা করে কি-না সেই প্রশ্ন কিন্তু ওঠে!

পরকাল সম্পর্কিত কোরানের আয়াতকে সম্পূরকের সাহায্যে ব্যাখ্যায় নিবেদিত ইমরানের পাঠ্যবস্তু অগত্যা মানব সমাজে শয়তানের রাজত্ব ও প্লটিংয়ের বিবরণ প্রদানের নামে ব্যক্তির মনোজগতে ভয়, ত্রাস, আতংক, ঘৃণা, উগ্রতা, জাতি-বৈরিতা ও সম্প্রদায় বিদ্বেষ থেকে শুরু করে নৈরাশ্যকে ঘনীভূত করে! এহেন পরকলাবিদ্যা চর্চায় কি লাভ যেটি কোরান ও হাদিস সূত্রে মানবজাতিকে সতর্ক করতে গিয়ে Terror and Fear ছড়ানোর পুরাতন খেলায় ফেরত যায়? অথবা মধ্যযুগে উপদ্রবে পরিণত ক্যাথলিক রক্ষণশীলতার ধাঁচে মুসলমানের করণীয় সম্পর্কে সূক্ষ্মতার ‘সহিত’ উস্কানিমূলক বার্তা প্রচারের নজিরকে পুনর্জীবিত করে?

ইমরান নজর হোসেনের কিয়ামত কেন্দ্রিক তত্ত্বছকে যারপরনাই পুতিন শাসিত রাশিয়াকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখি। ইয়াজুজ-মাজুজের অবরুদ্ধ ও অবমুক্ত হওয়ার সংযোগসূত্র খুঁজতে নেমে ইমরান কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী দাগিস্তান ওরফে ডারবেন্ট অঞ্চলকে (*বর্তমানের রাশিয়া ও উজবেবিকস্তানের মাঝে বিদ্যমান সীমান্ত এলাকা) তাদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেন। সাগর-উপত্যকা পরিবেষ্টিত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জুলকারনাইন নির্মিত প্রাচীরের অবশেষ (*খ্রিস্টান বিশ্বে যেটি সম্রাট আলেকজান্ডার কর্তৃক নির্মিত প্রাচীর নামে খ্যাত। ইসলামি ইতিহাস অবশ্য জুলকারনাইনকে সিকান্দার ওরফে আলেকজান্ডার বলে মানতে নারাজ, কেননা সম্রাট আলেকজান্ডার একেশ্বরবাদী ছিলেন না) শনাক্ত করা গেলেও তাঁর মত অনুসারে ইয়াজুজ-মাজুজ এখন আর সেখানে অবরুদ্ধ নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপ থেকে ব্যাপক সংখ্যক ইহুদি জনগোষ্ঠীর ইসরায়েল রাষ্ট্রে গমনের ক্ষণে কাস্পিয়ান তীরবর্তী একটি জনগোষ্ঠী নিজেকে সেখানে স্থানান্তরিত করেছিল, উক্ত জনগোষ্ঠীকে কোরানবর্ণিত ইয়াজুজ-মাজুজের উত্তরসূরি ভাবার শক্ত যুক্তি রয়েছে বলে ইমরান দাবি করে থাকেন।

ইসরায়েল রাষ্ট্রে সমবেত ইহুদিস্রোতে ক্রমশ প্রভাববিস্তারী জনগোষ্ঠী পরবর্তী গণহত্যার বিভীষিকা থেকে ইহুদি সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য জায়োনিস্ট আন্দোলনে (Zionist Movement) নিজেকে সক্রিয় রেখেছে। বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পাশাপাশি আশু পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটনে জায়োনিস্ট তৎপরতার ব্যাখ্যা ইমরান নিজের কিতাব (*দ্রষ্টব্য : Jerusalem In Quran এবং Islamic Views on Gog and Magog) ও বক্তিমায় অহরহ দিয়ে থাকেন। পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাব্যতা বিষয়ে এই পরকালবিদের আধ্যাত্মিক অনুমানের আভাস সূরা ‘দুখান’-এর (Smoke) ১০ ও ১১ নাম্বার আয়াতে খানিক মিলে বৈকি :—

অতএব তুমি অপেক্ষা করো সেই দিনের যেদিন স্পষ্ট ধূম্রাচ্ছন্ন হইবে আকাশ,…/এবং উহা আবৃত করিয়া ফেলিবে মানব জাতিকে। ইহা হইবে মর্মন্তুদ শাস্তি। — দুখান; ৪৪:১০১১; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

কিয়ামতের লক্ষণ বর্ণনায় সূরা ‘দুখান’-এ উল্লেখিত বিদুখানিন (bidukhanin) ও দুখানুন (dukhanun) শব্দের আধ্যাত্মিক মর্ম অনুসন্ধানে কোনো-কোনো পরকালবিদ শব্দ দুটিকে পারমাণবিক ধ্বংসলীলায় জাগতিক সৃষ্টির লয় ঘটার ইঙ্গিত রূপে বিবেচনা করে থাকেন! পদার্থবিদ হেইঞ্জ প্যাগেলসের নাম এ-প্রসঙ্গে আরেকবার স্মরণ করতে হয়। সুমেরীয় পুরাণে লিপিবদ্ধ সাহিত্যের পাঠোদ্ধারে নেমে মার্কিন পদার্থবিদ বলেছিলেন পারমাণবিক বিস্ফোরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম ঘটেছিল এই ধারণাটি সম্ভবত সত্য নয়। সুমেরবাসীর নিকট ঈশ্বর ও নৃপতির মহিমায় অভিষিক্ত মারদুক (Marduk) আর সেমিটিক উৎসে (তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরান) লিপিবদ্ধ ইব্রাহিম নবির (*আদি হিব্রু নাম ব্রাম) যুগে সংঘটিত ঘটনাকে একসুতোয় গেঁথে নিলে সুদূর অতীতে পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আভাস মেলে। বর্তমান ইরাকে অবস্থিত প্রাচীন নগরী ‘হরান’ (Harran) ও পাশ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের যেসব বিবরণ সুমেরীয় পুরাণ ও সেমিটিক উৎসে পাওয়া যায় তার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসলীলার সাদৃশ্য রয়েছে। ‘হরান’ সহ বিস্তৃত জনপদে সংঘটিত বিপর্যয়ে নাগরিক স্থাপনা অক্ষত থাকলেও অত্র এলাকার জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তি হয়ে গিয়েছিল। কেবল তা-ই নয়, লোহিত সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত মৃত সাগর (Dead Sea) এই বিপর্যয়ের ফলে প্রাণবৈচিত্র্য হারায়, যেটি শক্তিশালী পারমাণবিক বিস্ফোরণকে ইঙ্গিত করে। ‘হরান’ থেকে ব্যাবিলন অবধি ছড়ানো-ছিটানো নিদর্শন ও খননকার্যে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর রসায়নিক পরীক্ষায় উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণের উপস্থিতি প্যাগেলস তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন, যেটি উক্ত কালপর্বে পারমাণবিক বিস্ফোরণ জাতীয় ঘটনার সম্ভাবনাকে জোরদার করে তোলে।



চিত্র-৪ : ইয়াজুজ-মাজুজ (Gog and Magog) সম্পর্কিত কোরান-বাখান :—

উহারা তোমাকে জুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে| বলো, ‘আমি তোমাদের নিকট তাহার বিষয় বর্ণনা করিব৮৩; আমি তো তাহাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়াছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়উপকরণ দান করিয়াছিলাম৮৪; অতঃপর সে এক পথ অবলম্বন করিল৮৫; চলিতেচলিতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থানে পৌঁছিল তখন সে সূর্যকে এক পঙ্কিল জলাশয়ে অস্তগমন করিতে দেখিল এবং সে সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখিতে পাইল আমি বলিলাম, ‘হে জুলকারনাইন! তুমি ইহাদেরকে শাস্তি দিতে পারো অথবা ইহাদের ব্যাপার সদয়ভাবে গ্রহণ করিতে পারো৮৬;… আবার সে এক পথ ধরিল,৮৯; চলিতেচলিতে যখন সে সূর্যোদয়স্থলে পৌঁছিল তখন সে দেখিল উহা এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদয় হইতেছে যাহাদের জন্য সূর্যতাপ হইতে কোনো অন্তরাল আমি সৃষ্টি করি নাই৯০; চলিতেচলিতে সে যখন দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছিল তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পাইল যাহারা কোনো কথা বুঝিবার মত ছিল না৯৩; উহারা বলিল, ‘হে জুলকারনাইন! ইয়াজুজ মাজুজ তো পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করিতেছে আমরা কি আপনাকে খরচ দিব যে, আপনি আমাদের উহাদের মধ্যে এক প্রাচীর গড়িয়া দিবেন?’৯৪; সে বলিল, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে এই বিষয়ে যে ক্ষমতা দিয়াছেন তাহাই উৎকৃষ্ট সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য করো, আমি তোমাদের উহাদের মধ্যস্থলে এক মজবুত প্রাচীর গড়িয়া দিব৯৫; ‘তোমরা আমার নিকট লৌহপিণ্ড সমূহ আনয়ন করো’, অতঃপর মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হইয়া যখন লৌহস্তূপ দুই পর্বতের সমান হইল তখন সে বলিল, ‘তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাকোযখন উহা অগ্নিবৎ উত্তপ্ত হইল তখন সে বলিল, ‘তোমরা গলিত তাম্র আনয়ন করো, আমি উহা ঢালিয়া দেই ইহার উপর৯৬; ইহার পর তাহারা উহা অতিক্রম করিতে পারিল না এবং উহা ভেদও করিতে পারিল না৯৭; সে বলিল, ‘ইহা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হইবে তখন তিনি উহাকে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দিবেন এবং আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য৯৮; সেই দিন আমি উহাদেরকে ছাড়িয়া দিব এই অবস্থায় যে, একদল আর একদলের উপর তরঙ্গের ন্যায় পতিত হইবে এবং শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হইবে অতঃপর আমি উহাদের সকলকেই একত্র করিব৯৯আলকাহফ; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; চিত্র বিবরণী : I. Building a wall against Yajuj and Majuj, painting by Qasim, 16th century; British Library; II. Devil, Gog and Magog attack the Holy City: 17th-century Russian manuscript; Source: Wikiwand;

নির্বাসিত ও রাজ্যহারা মারদুকের ব্যাবিলন নগরী পুনরুদ্ধারের ক্ষণে সংঘটিত যুদ্ধের সঙ্গে সেমিটিক ধর্মে বর্ণিত ইব্রাহিম নবির একেশ্বরবাদী প্রচারণার সংযোগ রয়েছে বলে প্যাগেলস ধারণা করেন। সুমেরীয় ঈশ্বর ও নৃপতি মারদুক হৃত রাজ্য ব্যাবিলন পুনরুদ্ধারের সংকল্পে ‘হরান’-এ প্রবেশ করে; ওদিকে এক ঈশ্বরের বাণী প্রচারে নিবেদিত ইব্রাহিম প্রতিপক্ষের বাধার মুখে সাময়িকভাবে ‘হরান’ নগরী ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সুমেরীয় অতিকাহিনি অনুসারে পৃথিবী থেকে দূরবর্তী গ্রহ নিবিরু-র (*Nibiru; আমাদের পরিচিত সৌরজগৎ ছায়াপথের বাইরের গ্যালাক্সিতে অবস্থিত দ্রুত ঘূর্ণনশীল একটি গ্রহ, যে তার প্রতি ঘূর্ণনে পৃথিবীর হিসাব অনুসারে সাড়ে তিন হাজার বছরের অধিক সময় অতিক্রম করে থাকে) অতি-অগ্রসর সভ্যতা কার্যকারণ ফেরে পৃথিবীকে তাদের কলোনি রূপে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে যায়। উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানের অধিকারী নিবিরু-র প্রতিনিধিরা (*সুমেরীয় পুরাণে আনুনাকি (Anunaki/Anununnaki/Ananaki) বা ঈশ্বর/দেবতা/অবতার নামে খ্যাত) জিন প্রকৌশল কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে নতুন একটি মানব প্রজাতির (*দ্রষ্টব্য : সূরা আনআম ১৩৩ নাম্বার আয়াত : ‘তোমার প্রতিপালক অভাবমুক্ত, দয়াশীল তিনি ইচ্ছা করিলে তোমাদেরকে অপসারিত করিতে এবং তোমাদের পরে যাহাকে ইচ্ছা তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করিতে পারেনযেমন তোমাদেরকে তিনি অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশ হইতে সৃষ্টি করিয়াছেনআনআম; :১৩৩) জন্ম দেয়। গ্রহটিকে নিজের অনুকূলে ব্যবহারের জন্য সৌরজগৎ কেন্দ্রিক গ্রহ-ব্যবস্থাপনায় তারা পরিবর্তন ঘটায়। পৃথিবী ও মানব প্রজাতির নিয়তি নির্ধারণে তাদের ভূমিকা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব বা জটিলতা ‘হরান’ নগরীতে পারমাণবিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল বলে প্যাগেলস তাঁর কিতাবে মত দিয়েছেন। সমগ্র সৃষ্টিজগতের রূপকার হিসেবে বহু ঈশ্বরের ক্রমবিন্যাস ভেঙে এক ঈশ্বরের আবির্ভাব ঘটার কারণ বিশ্লেষণে যেসব প্রসঙ্গ তিনি কিতাবে টেনেছেন তার থেকে অনুমান হয় সেমিটিক উৎসে বর্ণিত হিব্রু ঈশ্বর ইয়াওয়ে-র রাজ্য (*আরবি আল্লাহর আরশ) নিবিরু-র সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও হতে পারে।

প্যাগেলসের কিতাবে ব্যক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে মারদুকের ‘হরান’ নগরীতে প্রবেশ আর ইব্রাহিমের নগর পরিত্যাগের কাহিনি পাশাপাশি পাঠ করলে বোঝা যায় তিনি এই পারমাণবিক ধ্বংসযযেজ্ঞর চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন, যদিও মারদুকের সঙ্গে তাঁর দেখাসাক্ষাতের প্রমাণ প্রচলিত ইতিহাসে মিলে না। সুমেরীয় পুরাণ জানায় পৃথিবীর অধীশ্বর হতে সংকল্পবদ্ধ মারদুক ব্যাবিলন পুনরুদ্ধারে মরিয়া ছিল। তার পুত্র এ-ব্যাপারে পিতার সহায় হয়। বিরোধী বা প্রতিপক্ষ প্রতিনিধিগণের কারণে রাজ্যচ্যুত ও নিবিরুতে নির্বাসিত মারদুক নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হলে পৃথিবীতে গমন ও ‘হরান’ নগরে প্রবেশ করে। ব্যাবিলন পুনরুদ্ধারে সৈন্যসামন্ত নিয়ে ‘হরান’-এ সমবেত হওয়ার ঘটনাটি প্রতিপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সকলে মিলে পৃথিবীর আদি অধীশ্বর ও বিলুপ্ত মানব প্রজাতির স্থলে নুতন প্রজাতির রূপকার ইএ/এনকি’র সঙ্গে বৈঠকে (God’s Council) বসে। মারদুককে শায়েস্তা করার নিমিত্তে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রস্তাব পেশ করা হয় এবং পরিষদের সকলে সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। ‘হরান’ সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য সিনাই উপত্যকায় অবস্থিত মানমন্দির ও নভোযান অবতরণে ব্যবহৃত স্পেস স্টেশনকে (*হিব্রু ঈশ্বর ইয়াওয়ে যেখানে প্রথমে নবি মূসা পরে তাঁর অনুসারী গোত্রদের মধ্য থেকে কিছু প্রতিনিধিকে দর্শন দিকনিদের্শনা দিয়েছিলেন) সেই সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। ওদিকে মারদুক যবে ‘হরান’-এ প্রবেশ করছে সেমিটিক উৎসে লিপিবদ্ধ বিবরণ জানায় ইব্রাহিম তখন শহর ছেড়ে মিশর গমনের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, যেটি প্যাগেলসের মতে আদি ঈশ্বর এনকি’র হিব্রু সংস্করণ ইয়াওয়েহ-র (*আরবি সংস্করণ আল্লাহ) পরিকল্পনা অনুসারেই ঘটছিল।

দূরাতীত ইতিহাসে লিপিবদ্ধ এইসব হেঁয়ালির পারস্পরিক ও তুলনামূলক পাঠ ব্যতীত কোরানে ব্যক্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর যোগসূত্র ও কার্যকারণ ব্যাখ্যা দুষ্কর বলেই মনে হয়। যাই হোক, তাসাউফের ছকে ইমরান নজর হোসেনের ইসলামি পুরাণ-ব্যাখ্যা প্যাগেলস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও পারমাণবিক যুদ্ধের অশনিসংকেত সম্পর্কে বক্তব্য রাখার ক্ষণে পুতিন জামানার রাশিয়া তাঁর কাছে তুরুপের তাস গণ্য হতে থাকে। কিয়ামতের আলামত ব্যাখ্যায় ইমরান তাই অভিমত রাখেন, ইয়াজুজ-মাজুজের অপ্রতিরোধ্য উত্থানের রাশ টানতে বিজাতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলমান বিশ্বের মৈত্রী স্থাপন অনিবার্য এবং একাধিক কারণে রাশিয়ার সঙ্গে সেটি ঘটার সম্ভাবনা অধিক :—

প্রথম কারণ, সমাজতন্ত্রের পতন ঘটার পর থেকে রাশিয়ায় ক্যাথলিক শাসিত রক্ষণশীল ধর্মচর্চার ধারা পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিপথগামী খ্রিস্টান বিশ্বে রাশিয়ার খ্রিস্টানদের কোরানকথিত আহলে কিতাবের প্রতিনিধি গণ্য করতে হয় এবং এক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের মিত্র রূপে তাদেরকে ভাবা যেতে পারে। ওদিকে মুসলমানরা রাশিয়ায় দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এবং দীনচর্চার স্বাধীনতা ও সংখ্যার বিচারে ক্রমবর্ধনশীল। যারপরনাই ইসলামের সম্প্রসারণ ও শক্তিসঞ্চয়ে রাশিয়াকে অনুকূল ক্ষেত্র রূপে ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এবং তৃতীয়ত রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী হাদিসে ব্যক্ত ইমানদার খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মিলনে সেই শক্তির জন্ম দিতে সক্ষম যেটি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সন্ধিযোগে ইসরায়েলের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলার সামর্থ্য রাখে। ঈসার আগমন ও দাজ্জালের (Antichrist) পতনকে ত্বরান্বিত করতে হলে সাম্প্রতিক বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক পটপ্রবাহ অনুসরণ ও সেই নিরিখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনৈতিক মিত্র বা জোট তৈরির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটি এখন থেকে ছকে রাখা জরুরি।

কোরানের পরকাল সংক্রান্ত বার্তার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় ইমরান নজর হোসেন প্রণীত ভবিষ্যপুরাণকে দেরিদীয় পাঠ-পদ্ধতিতে ‘স্থানান্তর’ (Replacement) গণ্য করা যেতে পারে, যেখানে মূল পাঠ্যবস্তুকে (*এক্ষেত্রে যেমন কোরান) স্থানচ্যুত করার লক্ষ্যে কল্পনাপ্রতিভা (Imagination) ও সম্পূরকের (Supplement) মিলনে নতুন পাঠ্যবস্তু জন্ম নিতে থাকে। দেরিদীয় পন্থায় ইমরানের পাঠ্যবস্তুকে অধিবিদ্যার সম্প্রসারণ ভাবতে অসুবিধা না থাকলেও এই অধিবিদ্যা ‘বাহানা’ কি-না সেই সন্দেহ মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন হয়। কোরানে সংকলিত ‘মুতাশাবিহাত’ আয়াতের আধ্যাত্মিক মর্ম অন্বেষণে নজর প্রণীত ব্যাখ্যাকে অধিবিদ্যক মনে হলেও এটি সম্ভবত সেই অধিবিদ্যা নয় যাকে অমিমাংসিত পার্থক্যে স্থগিত অর্থমালার সম্প্রসারণ রূপে দেরিদা পাঠ করে থাকেন। তাঁর পরকালবিদ্যা চর্চার ধরন দেখে বরং এই বিশ্বাস প্রবল হয়, —ইসলামি উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান কেমন করে ঘটানো যায় তার তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপত্র সালাফিদের হাতে ধরিয়ে দিতে তাসাউফকে তিনি খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন! বিদ্যাচর্চার নাম করে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের দাসত্ব কোরানের বিচারে বিধিসংগত না হলেও ইসলামের ইতিহাসে ঘটনাটি বারবার ঘটেছে এবং ইমরানের ভূমিকা সেখানে ব্যতিক্রম কিছু নয়।

ইমরান নজর হোসেনের মতো তাসাউফপন্থীদের হালত দেখে বোঝা যায় ইসলামে ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর সংকট তীব্র হয়েছে এবং ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল-ফারাবি বা ইবনে আরাবির মতো উচ্চমানের চিন্তকরা আর দেখা না দিতেও পারেন। আরাবিকে সেন্ট থমাস একুইনাসের সমতুল মানতে হয়। তাঁর ‘ফুসুস আল-হিকাম’ (The Bezels of Wisdom) সাম্প্রতিক পাঠ-অভিজ্ঞতায় বিস্ময় হয়ে থাকবে। কোরানে বর্ণিত নবিদের মধ্য থেকে সাতাশজনকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। নবিগণের মধ্যে কীভাবে আন্তঃসংযোগ ঘটে থাকে, কী কারণে তাঁদেরকে স্রষ্টার মৌল প্রকৃতির নির্যাস ভাবা যায়, স্রষ্টার সারবত্তা থেকে পৃথক হওয়া সত্ত্বেও সৃষ্টির গতি কেন অন্তিমে স্রষ্টায় বিরাম খুঁজে ফিরে, কী হেন কারণে স্রষ্টার পক্ষে ক্ষমাশীল হওয়া ব্যতীত অন্য রূপে অবস্থান করা সম্ভব নয়, সোজাকথা ওয়াদাত আলওজুদকে (Unity of Being) কোরানের মৌল সত্য প্রমাণের ধারা বিবেচনায় তাঁকে থমাস একুইনাসের সহগামী মানতে হয়। আরাবির ভাবুকতা ক্ষেত্রবিশেষে কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হলেও তাঁর মতো সুবেদি, মানবিক, উদার ও মুক্তমনা বিদ্বান ইসলামের ইতিহাসে অল্পই এসেছেন।

আচারসর্বস্ব ঐতিহ্যের চাপে নিঃস্ব হয়ে পড়া উগ্র ইসলামিস্টদের বাড়বাড়ন্তের যুগে প্রকৃত দিব্যজ্ঞান বিরল ঘটনায় পরিণত হলেও আলোর রেখা অস্তমিত এমনটি বলা যাবে না। পারস্পরিক মতবিরোধ সত্ত্বেও আলোকরশ্মি বহনকারী বিদ্বানের সংখ্যা একেবারে নগণ্য নয়। তাঁদের কয়েকজনের পরিচিত পরিশিষ্টে সংযুক্ত রাখা প্রয়োজনীয় মনে করি, যেহেতু পরবর্তী গ্রন্থনায় তালিকাটি কাজে লাগতেও পারে :—

প্রথমে এল লেখা-বক্তৃতা ও ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা, তারপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া, অতঃপর আদালতে সওয়াল-জওয়াব শেষে মুক্ত এবং নিজ দেশ ও গোত্র ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে অনিচ্ছুক সৌদি নাগরিক শেখ হাসান ফারহান আল-মালিকি। মিশরের প্রয়াত সংস্কারবাদী শেখ মোহাম্মদ আব্দুহ। ঐতিহ্যপন্থী আলেমদের সমালোচক ও ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর রূপকার হাসান আল-বান্না ও তাঁর ভ্রাতা উদারপন্থী গামাল আল-বান্না। মেধাবী গণিতজ্ঞ, ইসলামি চিন্তাবিদ ও কোরানের বৈজ্ঞানিক ভাষ্য তাজকিরাহ প্রণেতা পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী এনায়েত উল্লাহ খান মাশরিকি। উল্লেখ প্রয়োজন, উর্দু থেকে অন্তত একটি ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদের শর্তে সেই সময় (*১৯২৫ সাল) তাজকিরাহকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। ইংরেজ শাসন বিরোধী খাকসার আন্দোলনের জনক মাশরিকি ইউরোপীয় ভাষায় তাজকিরাহ-র ভাষান্তরে রাজি হননি। নোবেল কমিটিকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন শোষণ ও বৈষ্যম্যমূলক বিশ্বব্যবস্থায় যেখানে কোরান বর্ণিত ইনসাফের প্রতিফলন চোখে পড়ে না সেই ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকদের নিকট থেকে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের বাসনা তাঁর নেই।

ভারতে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর মাশরিকি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিতর্কিত হলেও বিজ্ঞান ও ধর্মে বিদ্যমান সংঘাত নিরসনে তাঁর দার্শনিক ভাবনায় দ্যুতিভাস্বর কিতাবটি সম্ভবত এখনো ইউরোপীয় বা অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়নি। নেটে তাঁকে নিয়ে চর্চা ব্যাপক নয়। ছড়ানো-ছিটানো দু-একখানা প্রচার পুস্তিকা ও লেকচার ছাড়া বইপত্র বলতে গেলে দুর্লভ! আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্মরণীয় ঘটনা ছিল। পারমাণবিক গবেষণায় বিজ্ঞানীদের রাজনীতির খপ্পরে পড়ার বিপদ সম্পর্কে তাঁকে তিনি আগাম সতর্ক করেছিলেন। মাশরিকির মনে হয়েছিল প্রকৃতির ভাষাকে বিজ্ঞানীরা পড়তে ভুল করছেন। প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রয়োগ বিষয়ক পুস্তিকাটি (Human problem: A message to the knowers of nature) পাঠ করলে তাঁর অন্তর্দৃষ্টির খানিক আভাস টের পাওয়া যায়।

ক্ষুদ্র পুস্তিকায় মাশরিকি আধ্যাত্মিক অনুধ্যানকে বিবেচনায় রেখে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রণয়ন ও আবিষ্কারের প্রায়োগিক তাৎপর্য উপলব্ধির দিকে জোর দিয়েছেন; সর্বোপরি আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিকতা’ বিষয়ক তত্ত্ব কী কারণে নিশ্চয়তাবাদী গণিতছকে আবদ্ধ জ্ঞানের প্রকৃতিকে আগামীতে মিথ্যা প্রমাণ করবে সেই আভাস দিতেও ত্রুটি করেননি। প্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রজাতির মিথস্ক্রিয়ার ইতিহাস ও তার পরিণাম অনুধাবনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধারা ও প্রবণতাকে নিজের পুস্তিকায় মাশরিকি প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। ‘গাইয়া তত্ত্ব’-প্রণেতা পরিবেশবিজ্ঞানী জেমস লাভলক, গণিতবিদ ডেভিড বার্লনিস্কি কিংবা পদার্থবিদ রজার পেনরোজ গত তিন দশক ধরে যে-কথাগুলো বলে যাচ্ছেন মাশরিকির বক্তব্যে এর আদি অনুরণন চকিত কানে এসে লাগে :—

…the knowledge of Man, in whatever form it exists, is the result of his direct observation of Nature, his calculations and measurements, his ‘formulae’ and ‘equations,’ his ‘mathematics’ and ‘geometry’ in fact in whatever manner he deals with or interpolates with lifeless matter for the purpose of utilising it, are the product of his own conventions and conveniences. Nature has nothing to do with or learn from these products of his intelligence, nor it is that the Design of Nature has been built on these instruments of information. On the other hand, it is obvious that Nature must possess ‘geometry’ and ‘mathematics’ of its own, also ‘formulae’ and ‘equations’ of its own for the purpose of perfecting its own design. Nature’s Units of Measurement and Methods of Calculation must thus be radically different from these man-made devices, besides being much more comprehensive, more accurate and more applicable to the ‘nature of matter.’ — Human problem: A message to the knowers of nature by Allama Inayatullah Khan Al-Mashriqi, 1951; Source: PDF Version

মনে রাখতেই হচ্ছে কোরানকে নিজস্ব ধীশক্তির সাহায্যে পাঠ ও ব্যাখ্যার অপরাধে সেকালের মোল্লারা ধীমান এই চিন্তককে ‘কাফের’ ফতোয়া দিতে কালবিলম্ব করেনি। তো এই ফতোয়ার ঝুঁকি নিয়ে একালে কোরানচর্চায় মগ্ন বিদ্বানদের মধ্য থেকে আরো কিছু নাম বোধহয় টুকে রাখা প্রয়োজন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন হাদিসশাস্ত্রের ভিত্তি ও যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দিহান মালয়ী সমাজে কোরানপন্থী আন্দোলনের জনক কাসিম আহমদ; পাকিস্তানের প্রয়াত স্মরণীয় বিদ্বান গোলাম আহমেদ পারভেজ থেকে শুরু করে জাভেদ আহমদ গামিদি, শেহজাদ সেলিম এবং গুলিবিদ্ধ হয়েও কোরানের বাইরে দ্বিতীয় ইসলামিশাস্ত্রে যাঁর আস্থা নেই সেই মোহাম্মদ শেখ; কোরান পাঠ, ব্যাখ্যা ও ভাষান্তরে যৌক্তিক সংস্কারের প্রণেতা তুরস্কের এদিপ ইউকসেল ও প্রয়াত বিদ্বান ইয়াসির নূরি ওজটার্ক; কোরানের নিরিখে হানাফি ফিকাহর প্রাসঙ্গিকতা অন্বেষণ, প্রশ্নবিদ্ধ হাদিস আর রিবা ওরফে সুদ সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যার প্রণেতা আতাবেক শুখরভ; ঐতিহ্যে পরিণত আচার-বিচারের বৃহৎ অংশকে কোরানের আলোয় প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশনে তৎপর মার্কিনদেশি কৃষ্ণাঙ্গ হামজা আব্দুল মালিক; কোরানের শব্দার্থ ও ব্যাকরণগত উৎস ব্যাখ্যায় পটু যুবা (*খুব সম্ভবত) ইরাকের নাগরিক ইউসুফ প্রমুখ।

অ-মুসলিম গবেষকদের বিরাট তালিকায় ব্যতিক্রম গ্যারি উইলস এবং কোরানপন্থী ভাষান্তরের প্রণেতা স্যাম গেরানস প্রাসঙ্গিক হওয়ার যৌক্তিকতা রাখেন। যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও সংস্কারন্ধ ঐতিহ্যপন্থীদের নিয়ে মকারিতে ওস্তাদ পাকিস্তানি মুফতি আবু লেইথকে ইসলামি ঘরানায় সক্রিয় বিদ্বানদের সঙ্গে ইউটিউবে ‘Mindtrap’ নামক বুদ্ধিদীপ্ত সরস বাতচিতের জন্য তালিকায় সংযুক্ত রাখা প্রয়োজন। এবং, মোহাম্মদের মধুর ও যৌক্তিক জীবনকাহিনি যিনি শেষাবধি রচনা করতে পেরেছেন সেই ল্যাজলি হ্যাজিলটন তাঁর বক্তব্যের প্রসাদগুণে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেন। সেইসঙ্গে ‘কিবলা’ কেন্দ্রিক বিতর্কে নবতরঙ্গের প্রণেতা ড্যান গিবসন, যিনি তাঁর তিরিশ বছরের গবেষণার অন্তে এসে ইসলামের জন্ম মক্কার পরিবর্তে সভ্যতার অতীত নিদর্শন জর্ডানের পেট্রায় বলে দাবি করছেন, অভিমত খণ্ডনের জন্য হলেও তাঁকে বিবেচনায় রাখা জরুরি।

এঁনারা সকলে মিলে সেই গুচ্ছ যাঁরা বিবিধ জটিলতার ফেরে অসহিষ্ণু ও যুগের সাপেক্ষে অচল দীনীচেতনার গা থেকে অতিরঞ্জনের আবর্জনা সরিয়ে তাকে সরল-সুগম রূপ প্রদানের জন্য কোরানে ফেরত যাওয়ার কথা বলে চলেছেন। তাঁরা সকলে অভ্রান্ত বা শেষকথা এমনটি নয়। মানবজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় তাঁদের বক্তব্য ও লেখাপত্রে ভ্রান্তি, স্ববিরোধিতা থাকাটাই স্বাভাবিক এবং সেটি রয়েছেও। কারো-কারো কথাবার্তায় এমনকি উগ্রতাও চোখে পড়ে। তথাপি ইসলামকে নিয়ে মনখোলা আলাপে গমনে সহায়ক হওয়ার কারণে এইসব ব্যক্তির বক্তব্য পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ‘ইসলামবীক্ষণ’র ফিরতি পুনর্বিবেচনায় ঐতিহ্যপন্থী বিদ্বানকুলের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের জায়গাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আশা করি পাঠককে নতুন ভাবনার খোরাক যোগাবে।

ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এ গরিব হওয়ার কারণে ঝাঁকের কইয়ের মতো জাকির নায়েকরা মঞ্চ দখলে নিলেও সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে সৃজনী-প্রতিভার অধিকারী বিদ্বানদের আকাল চোখে লাগে। এ-কথা ঠিক, সময়ের সঙ্গে ইসলামের উপস্থাপনে নতুনত্ব যোগ হলেও কোরান সেখানে যথারীতি গৌণ প্রসঙ্গ! একটা মরা টেক্সট যাকে হাদিস নামের অক্সিজেন চেম্বারে ঢুকিয়ে কায়ক্লেশে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কী নিঠুর এই দৈন্য যার কবলে পড়ে মোহাম্মদ নিজের স্বরূপ হারিয়েছেন! মানব-ইতিহাসে গৌতম বুদ্ধ, ঈসা ও মোহাম্মদের মতো ব্যক্তিত্ব একাধিক কারণে যুগ-নির্ধারক হলেও ত্রয়ীর একজনেরও বিকৃতির কবল থেকে রেহাই মিলেনি। হযরত মোহাম্মদকে তাঁর দীনের সম্প্রসারকরা আল্লাহর স্বকীয়তার সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে দিয়েছেন যে বোঝা মুশকিল হয় মোহাম্মদ কে আর আল্লাহ কোন জনা! এই মোহাম্মদ শকাব্দ ধরে চলমান সম্পূরক তথা সাবটেক্সটের হাতে তৈরি এক বার্তাবাহক, কোরানে গমনের পর যাঁর দেখা পাই তাঁর সঙ্গে মিলঝুল চোখে পড়ে না!

প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টান ধর্মের কড়া সমালোচক নিটশে ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ ছকে ইসলামি কালচার ও তার সেমিটিক হয়ে ওঠার পন্থাকে বাহবা দিলেও মোহাম্মদকে ইমপোস্টার বা বুজরুক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। উবারম্যানশ (Superhuman) ভাবা দূরে থাক, শেষনবিকে ঘিরে পল্লবিত ইতিহাসের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের তিলেক ইচ্ছে জার্মান দার্শনিকের মনে জাগেনি। স্বাভাবিক! আমির মুয়াবিয়ার যুগ থেকে সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে সংঘটিত রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘনঘটায় মোহাম্মদকে নিয়ে সৃষ্ট সন্দেহজনক কিচ্ছা-কাহিনি আর তার ওপর ভর করে বিরচিত ইতিহাস থেকে ইসলাম সম্পর্কে যৎসামান্য খবরাখবর নিটশে ধার করেছিলেন। গির্জাশাসিত খ্রিস্টধর্মের মূলে কুঠার হানতে ব্যগ্র দার্শনিকের কাছে সেটাকে কাফি  মনে হয়েছিল। ইসলামিশাস্ত্রের গভীরে ঢুকে এর অন্ধিসন্ধি তলিয়ে দেখার ভাবনা তাঁর মনে দানা বাঁধেনি; যারপরনাই নিটশের নিকট থেকে ‘ইমপোস্টার’র অধিক শংসা মোহাম্মদের প্রাপ্য ছিল না। ইসলাম নামক দীনের সর্বনাশ ঘটানোর যজ্ঞে সায়েবরা অবশ্য ফুটনোট মাত্র! এই দীনের অনুসারী যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হাজার বছর ধরে একে ব্যাখ্যা করে গেলেন, এর প্রচার-প্রসারে ঘাম ঝরালেন, দেশবিদেশে দীন প্রতিষ্ঠায় সচল থাকলেন…সিংহভাগ অপকর্ম তাঁদের কল্যাণেই সাধিত হয়েছে!

একুশ শতকে বিজ্ঞানের গতি-প্রকৃতি ও ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিরচিত ধীমান গণিতবিদ ডেভিড বার্লনিস্কির বহি (Devil’s Delusion) যখন পাঠ যাই তখন বুঝতে পারি সমস্যা কত গভীর! বিজ্ঞানকে একপেশে ছকে অকাট্য প্রমাণের চেষ্টা দেখে বিরক্ত বার্লনিস্কি মনে করেন ধর্মের মৌল বাণী বা তার ব্যাখ্যায় নিহিত অধিবিদ্যাকে খারিজ করার আগে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বস্তুতান্ত্রিক ভাবনাছকে মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তৎপর বিজ্ঞানের জগতে অবভাস বা মিথ্যাজ্ঞান প্রীতির প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধর্ম প্রসূত অধিবিদ্যার বৈজ্ঞানিক পাঠে একরৈখিক ধ্যানধারণা ও পূর্বসিদ্ধান্তে অটল থেকে রায় প্রদানকে ফ্যাশনে পরিণত করা হয়েছে! সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে আরো বহু বিষয়ে গণিতাশ্রয়ী বিজ্ঞানীরা যেসব তত্ত্ব দিয়ে চলেছেন সেগুলোকে অধিবিদ্যা ভাবতে দোষ কোথায়? — প্রশ্নটি বার্লনিস্কি নিজের কিতাবে উঠিয়েছেন। বিজ্ঞানের ছকে প্রণীত অধিবিদ্যারা সঠিক এবং বাকিগুলো ভ্রান্ত; — মিথ্যাজ্ঞানের এহেন বৃত্তে বসে অন্যান্য শাস্ত্র সম্পর্কে মতামত দেওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাঠমোল্লার ফারাক ঘুচতে বসেছে! ধর্মীয় বলয়ে মিথ্যাজ্ঞান উৎপাদনের পরিণাম যে ভালো হয় না সেটি অতীত বা সাম্প্রতিক ইতিহাসে গমন করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হালজামানার মানুষের কাছে এ-কারণে হয়তো ধর্ম ব্যাপারখানা সেরদরে বিকানোর সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানকে উক্ত পন্থায় মাপার পাঁয়তারা বার্লনিস্কির উদ্বেগের কারণ আর তাঁর ক্ষোভটা সেখানেই!

অংশের সাহায্যে বস্তুজগতের সামগ্রিক প্রণালী অর্থাৎ তার কার্যকারণ অবধানের প্রক্রিয়া (Reductionism) থেকে তত্ত্ব প্রণয়ন, পক্ষান্তরে সামগ্রিক প্রণালীতে বিদ্যমান প্রতিটি অংশের পারস্পরিক সংযোগ উপলব্ধির (Holistic) সাহায্যে তত্ত্ব হাজির করা, — জ্ঞানতত্ত্বের দুটি ধারার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জগৎকে Reductionism-এর পৃষ্ঠপোষক করে তুলেছে। অন্য শাস্ত্র থেকে আগত প্রস্তাবনা/প্রতিপাদ্য নিয়ে ভাবনা বা তাকে পুনর্বিবেচনার পরিসর বিজ্ঞানে কেন থাকা প্রয়োজন সেই বক্তব্য রিচার্ড ডকিন্সের God Delusion-এর জবাব হয়ে ওঠা Devil’s Delusion কিতাবের মূল সুর; বলাবাহুল্য সুরের এই গ্রন্থনায় কিতাবটি সফল! খণ্ডবাদী ধ্যানধারণা থেকে প্রণীত বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তত্ত্বগুলো নিজেই অধিবিদ্যা কি-না তার সরস আলোচনায় এই গণিতবিদকে সাহসী, অকপট আর ভাবনা উদ্রেককারী মানতেই হয়।

বার্লনিস্কির বহি পাঠের পর বুঝতে বাকি থাকে না কেবল ধর্মীয় গণ্ডিতে নয় বরং একালের জ্ঞানচর্চার সকল শাখা-প্রশাখায় ঝাঁকে-ঝাঁকে ধার্মিকরা জন্ম নিচ্ছেন, যদিও ঘটনাটি সেখানে ধর্মকে বাদ দিয়ে ঘটছে বলে একিন হয়। বকধার্মিকতা এখন তাই সার্বত্রিক ব্যাপার! ইসলামে কোরানের পাঠ ও অর্থ ব্যাখ্যায় বকধার্মিকতার অনুশীলন ধর্ম বির্সজনের ঘটনা হয়ে মনে কৌতুক বহায়! ভ্রান্ত সংজ্ঞার চাপে কোরানের মৌল সুর নিখোঁজ হওয়ার ইতিহাসকে তাই সামনে আনা প্রয়োজন; বলাবাহুল্য সেখানে বার্লনিস্কির পথ ধরে খোলা মনে অগ্রসর হওয়া সমীচীন।

মিথ্যে নয়, ইসলামে শিরকের ধরন নিয়ে তীব্রতা কোরানে না থাকলে এতদিনে যুগাবতার যিশু ও বুদ্ধের সঙ্গে মোহাম্মদের তফাত করা মুশকিল হতো। বুখারী ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থকে সতর্কতা সহকারে যাচাই না করে বিভ্রান্ত কল্পপ্রতিমা তৈরির চেষ্টা প্রমাণ করে ধর্মকে তার মৌল স্বরূপ থেকে বিপথগামী করার আয়োজন জোরেশোরে চলছে। ইসলামবীক্ষণ তাই শুরু মাত্র। সময়ের ধারায় সেই রচনাটি লিখতে চাই যেটি হৃদয়সংবেদি স্পিরিচুয়াল অনুভবে ভাস্বর হওয়ার শক্তি রাখে। যেখানে গৌতম থেকে মোহাম্মদ অবধি নবিত্বের পরম্পরা কী কারণে একই স্রষ্টার পরিকল্পনার অংশ ছিল সে-নিয়ে আলাপ জোড়া হয়তো সম্ভব হবে। সেইসঙ্গে মনে-মনে ভাবি, বুখারীর হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্যে যারা পরিকল্পিত বানোয়াট জিনিসপত্র ঢুকিয়েছেন অথবা সেগুলোর সাহায্যে দীনচর্চার নাম করে বিভীষক কল্পপ্রতিমা দাঁড়া করিয়ে রমরমা দুনিয়াবি হাসিল করছেন, রোজ হাশরের ময়দানে তাদের জন্য স্বয়ং শেষনবি আল্লাহর নিকট শাফায়েত চাওয়ার অনুমতি পাবেন তো?

মানুষের জীবনে শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্বটি এমন যে অশুভের অধিপত্য প্রবল না হওয়া পর্যন্ত শুভর মূল্য বুঝে আসে না! ঈশ্বর কেন শুভর অধিশ্বর সেটি ধরিয়ে দিতে ফিওদর দস্তয়েভস্কি ব্রাদার কারমাজভ-এ হাঁক পেড়েছিলেন If God doesn’t exist, everything is permitted. ভুবনবিখ্যাত আখ্যানে রুশ লেখক উক্তিটি সত্যি করেছিলেন কি-না সে-নিয়ে গুণীজনে মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলার চেষ্টা করেন রুশ থেকে ভাষান্তরিত হওয়ার সময় অনুবাদক মূল বাক্যে হানি ঘটিয়েছেন। বিবেকবৈরাগ্যের শিকার দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে কারমাজভের মুখ দিয়ে হুবহু এই উক্তিটি যে বেরিয়ে আসেনি তার প্রমাণ ইন্টারনেট ঘাঁটলে মিলে, যদিও ঘোরপ্যাঁচে যে-কথা বলার চেষ্টা করেছেন সেটি আবার অনূদিত বাক্য থেকে বিশেষ দূরের নয়। সুতরাং মূল বাক্যের ভাবানুবাদের জন্য অনুবাদককে দায়ী করা সমীচীন হয় না; তবে কথাটি যার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসুক এর অন্তর্নিহিত ইশারা সুগভীর! ঈশ্বর ‘নেই’ ধরে নিলে ভালো-মন্দ বলে কিছু থাকে না। যার-তার ওষ্ঠে আবেগবিহ্বল চুম্বনকে সেখানে যেমন স্বীকৃতি দিতে হয়, রিপুতাড়নায় যাকে-তাকে যখন-তখন বলাৎকারকে সেক্ষেত্রে অবৈধ বলি কি করে? আবার এহেন আচরণকে শুভ-অশুভ ইত্যাদির বাইরে সহজাত বলতেও মনে বাঁধে। প্রাকৃতিক জীবকুলের অংশ হলেও অন্যান্য জীব সহজাত অভ্যাসের বশে যেসব আচরণ করে থাকে মানুষের মধ্যে সেই আচরণগুলো আর সহজাত নেই। সমাজ-বিবর্তনের ধারায় নিজেকে পৃথক জাহির করতে গিয়ে সহজাত আচরণে জারি থাকার অভ্যাস তাকে পরিত্যাগ করতে হয়েছিল।

জগতে কোনো প্রাণী নিজেকে সংজ্ঞায়তি করেছে এমন প্রমাণ বিজ্ঞান আজো দিতে পারেনি। মানুষ সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম যে কিনা সহজাত আচরণের তালাশে নেমে নিজের ওপর সেই অর্থগুলো আরোপ করতে বাধ্য হয়েছিল যেটি তাকে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট জীবকুল থেকে পৃথক করতে সক্ষম। সহজাত প্রবৃত্তি থেকে নৈতিক প্রবৃত্তির জগতে উত্তরণের কারণে মানুষ কেন্দ্রিক সকল আলোচনা সেই স্বাতেন্ত্র্যের পরিপোষক যেখানে স্বেচ্ছায় নিজেকে সে বন্দি করেছিল। এখন মনোরম এই বিশ্বপ্রকৃতিকে যদি স্বপ্রণোদিত সংজ্ঞায় বন্দি মানবের সুকাম-কুকামের আধার ভাবি তাহলেও ঝামেলা বিস্তর! সহজাত প্রাকৃতিকতায় ফেরত যাওয়ার বাসনা নিজের ওপর সংজ্ঞা আরোপণের দিন থেকে মানুষের মধ্যে সমানে সক্রিয় হতে দেখা যায়। যদিও খোলা চোখে নজর করলে দেখি বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার মাঝে সচল বস্তুজগৎ কার্যকারণের চক্করে শেষাবধি কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধা। স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছাচারিতার মতো উপাদেয় বাসনাকে অগত্যা পরাধীনতার খোলসবন্দি স্বমেহন ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কঠিন হয়। মানুষের মেধা-মননের মধু দিয়ে রচিত সভ্যতাকে পরাধীন বৃক্ষশাখায় চাকবাঁধা মৌচাক বলে মেনে নিতে হয়। মধু চারধার থেকে উপচে পড়লেও মিষ্টতার অনুপাতে তেতো স্বাদের প্রাবল্য সেখানে কম নেই!

নিউটনের পৃথিবীতে মানুষের বসবাস বলে বিজ্ঞান প্রচার করে। বস্তুপুঞ্জে ঘেরা জগৎ কী শর্ত মেনে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় থাকে সেই সূত্র বিরচনে ইংরেজ বিজ্ঞানী বিলক্ষণ মেধাবী ছিলেন। যদিও বস্তুমধ্যে সঞ্চারিত সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রয়তা নামধারী গুণের নেপথ্যে কোনো কারিগরের হাত রয়েছে কি-না সে-প্রশ্নের উত্তরে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা (*বার্ট্রান্ড রাসেল ও হোয়াইটহেড রচিত কিতাবটি নয়) মৌন প্রস্তর! নিউটন অবশ্য ইশারা দিতে ভোলেননি, — নিগূঢ় অতিন্দ্রীয় শক্তি হয়তো ব্যাখ্যাতীত জটিল উপায়ে সেখানে বিরাজ করে। বিজ্ঞানের গণিতছকে তাকে আঁটানো সম্ভব নয় বুঝে মৌনতা অবলম্বনকে ইংরেজ বিজ্ঞানী সর্বোত্তম ভেবেছিলেন। নিগূঢ় এই শক্তিকে যদি বস্তুর সারনির্যাস ভাবি তাহলে বস্তুবাদী ভাবধারায় বিদ্যমান স্বতঃসিদ্ধ যুক্তিছকের সাহায্যে তার নামসাকিন তালাশ ঝকমারি বটে!

বিজ্ঞানের জন্য ঝকমারি হলেও ধর্মের জন্য কাজটি পানির মতো সহজ! সৃষ্টির সারবত্তা রূপে অদেখা সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস ও তার উপাসনা মানব-সংসারে প্রচারিত সকল ধর্মের বনেদ। সেখানে হিদু কে আর কেই-বা মুছলমান! ইসলাম মনে করে আদ্যশক্তি রূপে সক্রিয় এই সারবত্তার (Primordial Substance) অভিবাজ্য থাকাটা অপরিহার্য, অন্যথায় তাকে যৌগিক ও বিভাজক হতে হবে, আর যৌগ ও বিভাজক কিছুর পক্ষে সৃষ্টির সারবত্তা বা মূলীভূত কারণ রূপে বিরাজিত থাকা সম্ভব নয়। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে জাত এই প্রতিপাদ্যকে বস্তুবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তির প্রতিপাদ্য দিয়ে যৌক্তিক বা স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ করা যায় না। সৃষ্ট জগতের নেপথ্যে মৌল/অবিভাজ্য শক্তির কারসাজি থাকে কি-না তার অন্বেষণে নেমে বস্তুবাদ যেখানে এসে থমকে দাঁড়ায় সেখান থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসে নিহিত যুক্তিরা নিজেকে সক্রিয় করে তোলে। অনুমানসিদ্ধ হলেও এই অধিবিদ্যায় নিহিত আদ্যশক্তির ভাবনাকে এক কথায় নাকচ করা শক্ত কাজ! কোরানের বক্তব্য অনুসারে আদ্যশক্তি হচ্ছে মৌল বা আদি কারণ যার গুণের নির্যাস একদা জগৎকে অস্তিত্বে আনয়ন করেছিল :—

পরমাণু যারা ছত্রভঙ্গ হয়।; বহন করে বৈদ্যুতিক আধান।; মসৃণভাবে প্রবাহমান।; আদেশ অনুসারে যারা বিভাজিত।; তোমাদেরকে যে-প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সেটি সত্য।আদযারিয়াত; ৫১:; উৎস : I. The Quran: A Reformist Translation by Edip Yüksel, PDF Version, 2007; II. The Quran A Complete Revelation: Sam Gerrans; Al Quran in translation: Talal Itani; ভাষান্তর : লেখককৃত

দ্রষ্টব্য : সূরা  আদ-যারিয়াতএর প্রথম চারটি আয়াতের ভাষান্তরে শব্দচয়নের প্রচলিত প্রবণতা মূল বক্তব্যকে অস্বচ্ছ বা দূরবর্তী করার সঙ্গে অর্থ উপলব্ধির পন্থাকে হ্যাস্যকর প্রশ্নবিদ্ধ করে যায়! নাম্বার আয়াত ওয়াযযারিয়াতি যারওয়ান’- দাল, রা, ওয়াধাতুমূল থেকে নিষ্পন্ন যারিয়াতশব্দটি বিক্ষিপ্ত বা ছত্রভঙ্গ (Scattered/Dispersing) অর্থে কোরানে তিনবার প্রযুক্ত হয়েছে, যদিও প্রচলিত ভাষান্তরে ছত্রভঙ্গ বোঝাতে ধূলিঝঞ্ঝা/ঝড়/ঘূর্ণিপ্রবাহইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ চোখে পড়ে অনুরূপভাবে নাম্বার আয়াতে ফাল্ হামিলা করান’- ক্ষেত্রে করানশব্দটিমেঘপুঞ্জ বা বোঝা বহনকারী মেঘহিসেবে সচরাচর অনূদিত হয়ে থাকে, যেটি আয়াতের অর্থ বিবেচনায় বিভ্রান্তিকর Corpus Quran- তথ্য মোতাবেক ওয়াও, কাফ, রাধাতুমূল থেকে নিষ্পন্ন করানশব্দ বধির অথবা বোঝা বহনকারীশক্তির উদাহরণ রূপে কোরানে নয়বার ব্যবহৃত হয়েছে ওদিকে নাম্বার আয়াতে ফালজারিয়াতি ইউছরা’-কে প্রবহমান নৌযানঅর্থে ভাষান্তর ভুল না হলেও সেটি কিন্তু শব্দটির একমাত্র অর্থ নয়জিম, রা, ইয়াধাতুমূল থেকে উৎপন্ন তাজরিফ/ইয়াজরি/জারিয়াতি/জারিয়াতিনআয়াতের প্রকারভেদেম্বচ্ছন্দে প্রবহমানবস্তু বা ঘটনার স্মারক রূপে ৬৪ বার কোরানে প্রযুক্ত হয়েছে আর নাম্বার আয়াতে ফাল্ মুকাছ্ছিমাতি আমরা’- ব্যবহৃত আমরাশব্দটিকে অনেক অনুবাদক ফেরেশতাদের মধ্যে কর্ম বা দায়িত্ব বণ্টনহিসেবে অনুবাদ করে থাকেন হামযা মিম রাধাতুমূল সহযোগে নিষ্পন্ন বিচিত্র প্রকারভেদে (আমরা/আমরা/ওয়ামরু ইত্যাদি) ২৪৮ বার প্রযুক্ত শব্দটির প্রয়োগ অনুসরণ করলে দেখা যায় আল্লাহ কর্তৃক প্রাপ্ত অথবা তাঁর থেকে নির্ধারিতআদেশ, নির্দেশ, নির্দেশনাইত্যাদি অর্থে কোরানের আয়াত সমূহে এর পৌনঃপুনিক ব্যবহার ঘটেছে

প্রচলিত ভাষান্তর (*যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশন কৃত বঙ্গানুবাদ,শপথ ধূলিঝঞ্ঝার, / শপথ বোঝা বহনকারী মেঘপুঞ্জের, / শপথ স্বচ্ছন্দগতি নৌযানের, / শপথ কর্মবণ্টনকারী ফিরিশতাগণের’…) এখানে উদ্ধৃত আয়াতসমূহের পারস্পরিক সংযোগ উপলব্ধির ক্ষেত্রে ভ্রান্তি অস্পষ্টতা রেখে যায় এদিপ উইকসেল, স্যাম গেরানস তালাল ইটানির ভাষান্তরকে তাই অধিক সুবেদি যৌক্তিক মানতে হয় নিজেদের অনুবাদে মূল আরবি শব্দের ব্যাকরণগত উৎস, ধাতুমূল এবং হালফিল বৈজ্ঞানিক তথ্যের নিরিখে কোরানে লিপিবদ্ধ সৃষ্টিজগৎ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোর প্রাসঙ্গিকতাকে তাঁরা বিবেচনায় নিয়েছেন জগৎ সৃষ্টির কাণ্ডারি পরমাণুর একীভবন বিদারণ, তার অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল ইলেকট্রনের ঘূর্ণন বিচলনকে নিয়মের অধীন রাখার নেপথ্যে অবিভাজ্য মৌল শক্তির ভূমিকা রয়েছে কিনা সেনিয়ে বাকবিতণ্ডা অনুসন্ধানে আজো ইতি ঘটেনি ঘটনাটি মাথায় রেখে কোরান বর্ণিত রব বা স্রষ্টাকে আদি, আদ্য অবিভাজ্য উৎস হিসেবে বিবেচনা সেই অনুসারে আয়াতগুলোর অনুবাদকর্ম তাঁরা সমাধা করেছেন অর্থাৎ স্রষ্টা এখানে পরমাণুর অভ্যন্তরে সঞ্চালিত মৌল গুণের নিরূপক নির্দেশনার (আমারা) প্রণেতাআমারাহচ্ছে স্রষ্টা কর্তৃক সেইসব নির্দেশনার সমষ্টি যাদের মাধ্যমে সৃষ্টিজগৎ বিদ্যমান, সচল বহমান রয়েছে আদ-যারিয়াতএর আয়াতচতুষ্টয়ের এহেন অনুবাদ নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে, তবে প্রচলিত অনুবাদে যেসব আজগুবি প্রবণতা দৃষ্ট হয় তার সঙ্গে তুলনা করলে নবীন এই ভাষান্তরকে যুগপ্রাসঙ্গিক মানতে ইচ্ছে করে সার্বিক বিবেচনায় অগত্যা প্রচলিতের পরিবর্তে নবীন ভাষান্তরকে উৎস রূপে ব্যবহার যৌক্তিক মনে করেছি

সূরা আদযারিয়াত-এর আয়াতনিচয় পাঠে বোঝা যায় সৃষ্টি যৌগিক ও বিভাজক গুণ সম্বলিত ঘটনা হলেও নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং আদ্যশক্তি বা আদিকারণ (First Cause) রূপে বিদ্যমান স্রষ্টার অ-যৌগিক/অ-বিভাজক গুণের মাঝে নিহিত একীভবন (Fusion) ও বিদারণের (Fission) ফলাফল থেকে তার উদ্ভব ঘটেছিল। একীভবন ও বিদারণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ ঘটলেও আদ্যশক্তির মৌল গুণে কোনো বিকার বা পরিবর্তন কিন্তু ঘটে না। যৌগিক বা বিভাজক গুণের সাহায্যে বিরচিত বস্তুপুঞ্জের জগৎ আত্মপ্রকাশ ও অবক্ষয়ের যুগল বৈশিষ্ট্য ধারণ করেই পরিণতি লভে। পক্ষান্তরে অবক্ষয়ের কারণে সৃষ্টি সসীম ও বিধিবদ্ধ ঘটনা হওয়ার ফেরে আদ্যশক্তির নিকটেই তাকে ফেরত যেতে হয়। সসীমতায় নিয়ন্ত্রিত সৃষ্টি তাই স্রষ্টা নামক আদ্যশক্তিতে সক্রিয় মৌল গুণের বিচ্ছুরণ, যার সঠিক প্রকৃতি উপলব্ধি ও অনুসরণের আহবান কোরান রেখে যায় :—

তুমি একনিষ্ঠ হইয়া নিজেকে দীনে প্রতিষ্ঠিত করো। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ করো, যে-প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নাই। ইহাই সরল দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। — রুম; ৩০:৩০

ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল জীব এবং নিজ ডানার সাহায্যে উড়ন্ত পাখি — তাহারা সকলে তোমাদের মতোই এক-একটি জাতি। কিতাবে কোনোকিছুই আমি বাদ দেই নাই; অতঃপর স্বীয় প্রতিপালকের দিকে তাহাদেরকে একত্র করা হইবে।

আল্লাহ শস্যবীজ ও আঁটি অঙ্কুরিত করেন, তিনিই প্রাণহীন হইতে জীবন্তকে বাহির করেন এবং জীবন্ত হইতে প্রাণহীনকে বাহির করেন। তিনিই তো আল্লাহ, সুতরাং তোমরা কোথায় ফিরিয়া যাইবে?

      • আনআম; :৩৮; :৯৫; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

‘হানিফাং ফিতরাতাল্লাহি আল্লাতি ফাতারান্নাসা’ — সূরা রুম-এর ৩০ নাম্বার আয়াতাংশে ব্যক্ত ইশারা থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না সৃষ্টি স্বয়ং মৌল গুণের আধার না হলেও মৌল উৎস থেকে জাত; সে-কারণে সৃষ্টির প্রকৃতি অবধান অর্থাৎ অস্তিত্ব, বিকাশ ও পরিণতি বিষয়ে সম্যক ধারণা ব্যতীত স্রষ্টার প্রকৃতি সম্পর্কে উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কোরানে প্রকৃতিজগৎ সম্পর্কিত আয়াত প্রবাহে চক্রাকার পুনরাবৃত্তির মতো নভোমণ্ডলি, আকাশ ও বায়ু প্রবাহ, মেঘ-বৃষ্টি-বজ্রপাত, উষর-বন্ধ্যা মাটির বৃষ্টির পরশে নবজীবন লাভ ও শস্যের উদগম, সবুজ বৃক্ষ ও ফলমূল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে পথ চিনে নৌ-যানের গন্তব্যে ফেরা, বন্য ও গৃহপালিত জীবজন্তু, পতঙ্গ আর বিহঙ্গকুলের উল্লেখ ইত্যাদি বার্তা দিয়ে যায়, — সমগ্র প্রকৃতি নিয়ম ও পরিকল্পনার অধীনে বিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং মানুষ সেখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বিবর্তনের ধারায় ইহজগৎ হচ্ছে বিদারণের ফসল আর অবক্ষয়ের অন্তে ইহজাগতিক বস্তুপুঞ্জের পরজগতে গমনের মানে হচ্ছে পুনরায় একীভবনের বৃত্তে প্রবেশ যেখান থেকে একদা জীবনের সূচনা ঘটেছিল। এদিক দিয়ে বিদারণ কোরান বর্ণিত ফিতনা  বা বিশৃঙ্খলার প্রতীক, পক্ষান্তরে একীভবনকে স্থিতি ও সংহতির উপমান বলা যায়।

ইহজাগতিক বস্তুনিচয় আপাতভাবে স্থিতিশীল দশায় অবস্থান করলেও মৃত্যুশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার দরুন শেষাবধি বিশৃঙ্খলায় তার অন্ত ঘটে, যার চূড়ান্ত সমাপণকে কোরান ‘কিয়ামত’ নামে দাগায়। সূর্যের নাক্ষত্রিক আয়ুর সঙ্গে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ সৃষ্টি যতক্ষণ অবিচ্ছেদ্য রয়েছে ততক্ষণ সৃষ্টির বিলোপ ঘটে না, আর এই কালপর্বের সীমায় শৃঙ্খলিত মেয়াদ হয়তো-বা স্রষ্টা ঘোষিত ‘অবকাশকাল’! সূর্যের আয়ু ফুরিয়ে এলে তাপমৃত্যুর দশায় উপনীত পৃথিবীর জন্য বিশৃঙ্খল বিদারণ অমোঘ হবে, যাকে শিঙ্গা বা মহানাদ নামে কোরান ঘোষণা দিয়ে যায়। যে-বিদারণ দিয়ে সৃষ্টির সূচনা ঘটেছিল অন্তিমে সেই বিদারণের মাধ্যমে স্রষ্টা সেখানে যতি টানবেন আর নতুন একীভবনের পানে সবকছিুর প্রত্যাবর্তন ঘটবে। সুতরাং স্রষ্টার প্রকৃতি উপলব্ধিতে ফিতনার ভূমিকা অবধান জরুরি বৈকি!



চিত্র-৫: আল্লামা মাশরিকি : কোরানের নিরিখে মৃত্যু ও জীবন

Again, it must have been that lifeless matter at some stage of its internal “evolution” or owing to the incidence of suitable “external” circumstances to it sprang into initial life on Earth, but Man has been unable so far to subject this phenomenon to his rules of mathematics or units of measurement, nor has he been able to discover so far the process that can lead lifeless matter to life.Life: A Continuation of Dead Matter: Allama Inayatullah Khan Al-Mashriqi; Image Source: Internet

কোরানবর্ণিত ফিতনা তাই মানুষ কর্তৃক রচিত বা সভ্যতা প্রসূত সামাজিক ঘটনা পরম্পরার ফসল মাত্র নয়; সে হচ্ছে জগৎ সৃষ্টির আদি কারণ। সৃষ্টি যার কল্যাণে গতি লাভ করেছিল বলে বিজ্ঞান হাঁক পাড়ে সেই বৃহৎ বহ্বাস্ফোট (Bing bang) আদতে পুঞ্জিভূত শক্তির সমাবেশে বিরাজিত ফিতনার বহিঃপ্রকাশ। একীভবন ও বিদারণ ঘটানোর ক্ষমতা যার রয়েছে সে যদি একে দমিয়ে রাখে তাহলে সৃষ্টি বলে কিছু থাকে না। সৃষ্টি যদি না থাকে তবে আদ্যশক্তি বা স্রষ্টার থাকা কিংবা না থাকায় কিছু যায় আসে কি? ফিতনার ঘূর্ণিতরঙ্গে জগৎ যদি দিশেহারা না হলো তবে বস্তুরাজি কি করে বিকাশের পথ পাবে? অতএব, ফিতনার হাত ধরে সৃষ্টির সূচনা, তার সঙ্গে মিলন, বিরহ ও বিবাদে সে বিকশিত, আর নাটকের আপাত পরিশেষ যদি সত্যি ঘটে কোনোদিন তাহলে সেটি ওই ফিতনাকে বাদ দিয়ে হওয়ার জো নেই। চতুর ইবলিশের সঙ্গে আদম ও হাওয়ার ধরায় নেমে আসার ক্ষণে বিষয়টি গোপন ছিল না যে তাদের এই মর্ত্যবাস ফিতনাকে বাদ দিয়ে শেষ হওয়ার নয়।

ফিতনার তাই দুটো দিক, — একীভবন ও বিদারণ; একীভবন শুভর প্রতীক হলে বিদারণকে অশুভর দ্যোতক বলতে হয়, যদিও অশুভ বিনে শুভয় অটল থাকার মানে দাঁড়ায় না! ফিতনায় সচল সৃষ্টি একদিন পরিণতির দিকে হেলে যাবে। অতিকায় সূর্য তার লোহিত উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে শীতল হওয়ার ক্ষণে দুম করে ফেটে যাবে অবসন্ন প্রহরে! নক্ষত্রের ছাই থেকে ধুলা ও মাটির জন্ম হয়। মাটির গুণ থেকে জল জন্ম নিয়ে থাকে আর জলের গুণ শোষণ করে মানুষ প্রতিমারা ভবে জন্মায়। প্রতিমায় কে যেন জীবন ফুঁকে দিলে সে রক্তে-মাংসে জৈবিক হয়ে ওঠে। অতঃপর শক্তি ফুরিয়ে এলে ফেরত যায় মাটি ও ধুলায়; — কেউ একদিন পুনরায় তাকে জাগিয়ে তুলবে সেই অপেক্ষায় তার দিন কাটে! কোরানের আয়াত প্রবাহে গুঞ্জরিত পরকাল-বাখান চিরন্তন মৃত্যুকে তাই নাকচ করে যায় :—

আমি মৃত্তিকা হইতে তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছি, উহাতেই তোমাদেরকে ফিরাইয়া দিব এবং উহা হইতে পুনর্বার তোমাদেরকে বাহির করিব| — তাহা; ২০:৫৫

হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্বন্ধে যদি তোমরা সন্দিগ্ধ হও তবে অবধান করো — আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছি মৃত্তিকা হইতে, তাহার পর শুক্র হইতে, তাহার পর ‘আলাকা’ হইতে, তাহার পর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি গোশতপিণ্ড হইতে — তোমাদের নিকট ব্যক্ত করিবার জন্য, আমি যাহা ইচ্ছা করি তাহা এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি, তাহার পর আমি তোমাদেরকে শিশুরূপে বাহির করি, পরে যাহাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও।…তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক, অতঃপর উহাতে আমি বারি বর্ষণ করিলে উহা শস্য-শ্যামলা হইয়া আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ।

ইহা এইজন্য যে, আল্লাহ সত্য এবং তিনিই মৃতকে জীবন দান করেন এবং তিনি সর্ববিষয়ে শক্তিমান; — হাজ; ২২:; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

উদ্ধৃত সরল উপমাগুলো থেকে বোঝা যায় মানুষের জন্য মৃত্যু কোনো পরিশেষ নয় বরং পুনরায় জেগে ওঠার মহড়া! সৃষ্টিজগতে বিদ্যমান অশুভের দাপট নিয়ে আদিকারণ স্রষ্টাকে যে-কারণে উদ্বিগ্ন ভাবা সমীচীন হয় না। নাটকের প্লট তিনি সাজিয়ে রেখেছেন এবং সময় হলে সেখানে যতি টানবেন। অতঃপর তার দিকে পুনরায় উত্থিত মানুষ জানবে কী হেন কারণে ফিতনা দিয়ে জগৎটি রচিত হয়েছিল। কোরানে বর্ণিত কিয়ামত, পুলসিরাত, হাশর ও শেষ বিচারের একটাই মৌল সুর, — অবশেষে ঈশ্বরের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলার মওকা পাবে মানুষ। প্রভু তাকে হয়তো বলবেন, ‘সকলই জানি বাহে, এইবার চলো আমলনামা উল্টে দেখি কী ছিল মোর মনে আর কী ছিল তোমার।’ পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর ধারে বসে সংলাপটি জনে-জনে চলতে থাকবে। সংলাপ জারি থাকবে আগুনে লেলিহান কুণ্ডের ধার ঘেষে। তারপর নুতন ছকে এমন এক বিশ্ব তিনি সাজিয়ে তুলবেন যেটি আগে কেউ দেখেনি! বিশ্বটি হয়তো নিযুত বছর জারি থাকবে, যদি না তিনি অন্য কিছু ভেবে থাকেন :—

যখন সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে, আর যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে, আর পর্বতসমূহকে যখন সঞ্চালিত করা হবে, আর যখন পূর্ণগর্ভা মাদী উট উপেক্ষিত হবে, আর যখন বন্য পশুগুলো একত্র করা হবে, আর যখন সাগরকে অগ্নি-উত্তাল করা হবে, যখন দেহের সঙ্গে আত্মাগুলোকে আবার জুড়ে দেয়া হবে, যখন জীবন্ত পুঁতে-ফেলা কন্যাশিশুকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে? আর যখন আমলনামাগুলো প্রকাশ করে দেয়া হবে, আর যখন আসমানকে আবরণমুক্ত করা হবে, আর জাহান্নামকে যখন প্রজ্জ্বলিত করা হবে, আর জান্নাতকে যখন নিকটবর্তী করা হবে, তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে সে কি উপস্থিত করেছে, — আমি কসম করছি পশ্চাদপসারী নক্ষত্রের, যা চলমান, অদৃশ্য,—আর কসম রাতের, যখন তা বিদায় নেয়,—আর কসম প্রভাতের, যখন তা আগমন করে, — আর এটা কোনো অভিশপ্ত শয়তানের বাক্য নয়, — এ তো শুধু সৃষ্টিকুলের জন্য উপদেশ, — তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্য। — আততাকভীর; ৮১:১৮, ২৫, ২৭২৮; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

আপাত ভয়ংকর কাব্যিক নিষ্ঠুরতার অন্তরালে কোরানের বার্তা চির-পুরাতন। ধরার বুকে মানবের ঘরকন্না সার্ত্রে বা কামুর বাখান মেনে দুর্বোধ্য দুর্ঘটনা কিংবা উদ্দেশ্যহীন নিরথকর্তায় নিঃস্ব নয়। ইবনে আরাবি হয়তো সঠিক সেখানে, — বোধের অগম্য উপায়ে ‘পবিত্র’ এক সত্তা নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। তাঁর নিজেকে সচল রাখার যজ্ঞে ‘পবিত্র ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা’ (Divine Will and Wish) থেকে রূপময় জগৎ সৃজনে তিনি নিমগ্ন হয়েছিলেন। জগতের সক্রিয়তার ওপর স্রষ্টার সক্রিয়তা নির্ভর করায় জগৎ বিনে তাঁর অস্তিত্ব যেন থেকেও নেই। ওদিকে স্বরচিত ‘ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা’র অধিকারী স্রষ্টার অস্তিত্ব যদি নাই থাকল তাহলে জগতের থাকা বা না-থাকায় কি যায় আসে! স্রষ্টা ‘না থাকা’ তাই নিখিল নাস্তির পরিচায়ক, অনস্তিত্বের ভুতূড়ে স্রোত ছাড়া যেখানে কোনও শব্দ নেই। তাঁর বিদ্যমানতা এ-কারণে অবশ্যম্ভাবী। দৃশ্য ও অদৃশ্যর মিলনে মহাবিশ্বে অস্তিত্বের স্রোত বয়ে চলেছে। দৃশ্য যেদিন অদৃশ্যে বিলীন হবে তখন স্রষ্টা তাকে পুনরায় নতুন দৃশ্যে গতিশীল করবেন আর সেটাই পরকাল! জীবন এভাবে চিরজীবী হওয়ায় ধর্ম অনুসরণ করায় ইহজাগতিক সৃষ্টির বিনাশ ঘটলেও পরজগতে সে নতুন জীবনে পাবে। সৃষ্টি তাই চিরজীবী, যার সংরক্ষণ ও সংস্থাপনায় স্রষ্টার ক্লান্তি নেই!

ইহজগৎ হচ্ছে দৃশ্যমান রূপের সচল খনি আর পরজগৎটি আপাত অদৃশ্য স্বরূপে বিরাজিত রূপসায়র। দুই জগতের মধ্যিখানে রয়েছে আড়াল বা বারযাখ। দুটি বিশ্ব এবং তারা তৃতীয় এক বিশ্ব থেকে জাত! তৃতীয়কে কেউ সৃষ্টি করেনি কিন্তু নিজেকে সচল রাখার প্রয়োজনে সে সৃজনমত্ত! ইনি হলেন কোরানের আল্লাহ! অন্যভাবে তিনি হয়তো ‘গীতা’র ভগবান :— ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিভর্বতি ভারত/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্/পরিত্রাণায় সাধুনাম বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম/ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’ ধর্মের সংস্থাপনার্থে যুগে-যুগে দূত প্রেরণ ব্যতীত তাঁর পক্ষে সৃষ্টিকে সুরক্ষিত রাখা কঠিন। সুতরাং নিজের সারবান সচল সত্তা থেকে ক্ষয়িষ্ণু জগৎ বিরচন ও বিচিত্র উপায়ে এর পরিণাম নির্ধারণে তিনি বাধ্য। এছাড়া তাঁর নিজের অস্তিত্বের মহিমা লোকের কাছে চিরতরে আধুরা থেকে যায়।

জগতের সকল ধর্মের সারকথা বলতে এটুকু। বাকি যা রইল যেমন আচার-উপাসনা ইত্যাদি, এর সমস্তটাই ধ্যানযোগ, মনকে একীভূত করা পরম সক্রিয় অস্তিত্বের পানে, যার স্বরূপ স্বয়ং ‘দেব না জনন্তি’। হিদুর কাছে তিনি নিরাকারে সাকার, মুছলমানের মনে স্বরূপে অরূপ অরশের অধিপতি, যদিও সেই আরশ আসলে কেমন সে এক তিনি জানেন! হিন্দু পুরাণ বলে ব্রহ্ম পানির সায়রে অণ্ড রূপে ভাসমান ছিলেন। কোরান বলে আল্লাহর আরশ পানির সায়রে সচল; — রয়েছে সপ্ত আকাশ, তার ঊর্ধ্বে খোদার সিংহাসন আর সেই সিংহাসন ঘিরে বিদ্যমান তাঁর রাজ্য বা আরশ। একালের বিজ্ঞানে ব্যক্ত মাল্টাইভার্সের অনুরণন সূরা বাকারাহর ২৫৫ নাম্বার আয়াত। ‘আয়াতুল কুরসি’ নামে ঘরে-ঘরে লোকে এর নিত্য পাঠ যায়। আয়াতখানা ফেনোমেনাল এবং তার পরিচয় সালাফিপন্থী নেটিজেন Merciful Servant নির্মিত The Throne of Allah-য় একপাক ঘুরান দিয়ে আসলে খোলাসা হয়। ভিডিওটি নিয়ে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষ জনতার ক্রেজ দেখে বোঝা যায় মানুষ মজ্জাগতভাবে অনতিক্রম্য ঈশ্বরের স্বপ্ন দেখেই চলেছে, যাঁর কাছে সমর্পণের ক্ষুধা ভোগলিপ্সু মানবের মনে আজো অমলিন।

বস্তুবাদের নিরস বাখান দিয়ে জনতার এই বাসনাকে আটকানো মুশকিল। ধর্মের শক্তি হলো তাকে বাতিল করা সহজ হলেও অতিক্রম দুঃসাধ্য। অতিক্রম করার মতো অকাট্য প্রমাণ না কেউ দিতে পেরেছে, না ভবিষ্যতে পারবে। সৃষ্টির উদ্দেশ্য দুর্বোধ্য প্রহেলিকার মেঘে আজো ঢাকা। হালজামানার বিজ্ঞান যখন এর অতলে ঢোকে সেখানে বস্তুগুণ দিয়ে রচিত ব্যাখ্যাগুলো কেন যেন খাপ খেতে চায় না! অগত্যা মরমি অধিবিদ্যায় নিজের অনুমান ও সিদ্ধান্ত প্রকাশের ঝুঁকি তাকে হয়রান করে ছাড়ে। হয়তো সে-কারণে রক্তেমাংসে সেক্যুলার ও র‍্যাশনাল ডেভিড বার্লনিস্কি বিজ্ঞান বিরচিত সৃষ্টিতত্ত্বকে অতিকায় Mathematical Metaphysics আখ্যা দিতে পিছপা হননি। ওদিকে কবি লাবিদ এই চক্করে পড়ে পদ রচনা করেছিলেন, ‘কিছুই যখন দাঁড়াবে না ঠিক তবে বিনাশহীন সত্যে অবনত থাক এই মন।’ অথবা বুদ্ধ! কিমাশ্চর্যম! ঈশ্বর সম্পর্কে নির্বাক তথাগত শত রূপে ধরায় যেন ফিরে আসতে না হয় সেজন্য অষ্টমার্গে সুকর্মের নিদান হেঁকে গেলেন! নিজের পরাধীন দশা তাঁকে উৎপীড়িত করেছিল আর এর থেকে মুক্তি লাভে আকাঙ্ক্ষাশূন্য সমাধিতে নিজের অবক্ষয় ঘটালেন গৌতম!

এইসব অমিয় ও গরলের স্রোতে নিজের যৌক্তিকতা প্রমাণে মুখর ইসলামকে ঘিরে যেসব পাঠ্যবস্তু ও প্রতি-পাঠ্যবস্তু তৈরি হয়েছে তাদের সতর্ক পাঠ ছাড়া মুসলমানি দীনে প্রবাহিত পঙ্কিলতার অপসারণ সম্ভব নয়। ‘ইসলামবীক্ষণ’র দ্বিতীয় দফায় গমনের আগে স্বীকারোক্তি প্রয়োজনীয় বটে :—

কোরান কী করে পাঠ করা উচিত সেটি আসলে জানা ছিল না! এখনো সম্যক জানি ও বুঝি এই দাবি নিজের কানে হাস্যকর শোনায়! বড়োজোর এ-কথা বলা যেতে পারে, কোরানের পুনর্পাঠে গমনের পর থেকে মনে হচ্ছে স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে কিতাবে লিপিবদ্ধ সংকেত সাম্প্রতিক বা আগামীর জন্য অপ্রাসঙ্গিক নয়। কোরান যদি অপ্রাসঙ্গিক না হয় সেক্ষেত্রে তার বার্তাবাহক নবি ও মানবজাতির সঙ্গে তাঁর মিথস্ক্রিয়ার ইতিহাসকে অপ্রাসঙ্গিক ভাবা অবিচার হয়।

ধারণা ও অভিমত খণ্ডনের উত্তেজনায় ঠাসা ‘ইসলামবীক্ষণ’-এ ভাবনাটি তুলে ধরার সুযোগ হয়নি। ওটা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ দীন সম্পর্কে নাদান রচয়িতার কৌতূহল মিটানোর প্রথম ধাপ। ইসলামের পক্ষে-বিপক্ষে বিদ্যমান প্রশ্ন, সংশয় আর বাদানুবাদে ভর দিয়ে মন সেখানে তর্ক করেছে। তর্কটা কখনো নিজের সঙ্গে অথবা আলী সিনাদের ঘরানায় সচল ইসলাম বিদ্বেষী তার্কিকদের সঙ্গে ছিল। তর্কের সুরে চোখা বিদ্রুপ ও বিরূপতা ঠিকরে উঠেছে, কখনো-বা গোপন পক্ষপাত চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। ওই ‘ইসলামবীক্ষণ’ ছিল নিজের সঙ্গে অন্যের ভ্রান্তি ও বিক্ষোভের সংঘাতে দীর্ণ এক রচনা, যেটি থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়তো হয়েছে। পাঠক কথাগুলো স্মরণ রাখলে অধমের উপকার হয়।

‘ইসলামবীক্ষণ’ যদি প্রকাশের মুখ দেখে অথবা বন্ধুচক্রে পাঠের সুযোগ ঘটে আর সেই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় রচয়িতাকে তাঁরা পক্ষপাতদুষ্ট, সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক বিশেষণে চিহ্নিত করেন, সেক্ষেত্রে তাঁদের এইসব অভিধা সে মাথা পেতে নিতে রাজি আছে। ওদিকে কেউ যদি সেখানে ইসলামের অবমাননা ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা খুঁজে পান, বিনয়ের সঙ্গে বলছি, তাঁদের সঙ্গে বিবাদে জড়ানোর ইচ্ছে রচয়িতার নেই। যেহেতু, পরস্পরবিরোধী ভাবনাগুলোকে একত্রে হাজির করার বাসনা থেকে ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর উৎপত্তি ঘটেছিল। সুতরাং রচনাটিকে উস্কানিমূলক ও কুতর্কের যোগানদাতা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়! না, এর জন্য রচয়িতার মনে অনুতাপ নেই। ভুলচুক, ভালোমন্দ, ঠিকবেঠিক যেমন হোক, তার কাছে এভাবে নিজের বক্তব্য হাজির করা যথাযথ মনে হয়েছিল। এছাড়া দ্বিতীয় স্রোতে নাও বাওয়ার ঘটনায় গমন সম্ভব ছিল না। পরিশিষ্টের অন্তে এসে কথাটি তাই জানিয়ে রাখলাম।


ইসলামবীক্ষণ পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১-১৫
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you