তৃতীয় প্রবাহ–৩ : জ্ঞানবৃক্ষ ও নূরতত্ত্ব : সুফিভাবে নূরের সুরত–বিচার
আলোচনার শুরুতে বলে রাখা প্রয়োজন, প্রখ্যাত সুফিসাধক আবু আল-নাজিব সোহরাওয়ার্দী (১০৯৭-১১৬৮) প্রবর্তিত এবং তাঁর ভাইপো আবু হাফস উমর সোহরাওয়ার্দী (১১৪৫-১২৩৪) কর্তৃক পরিণতি প্রাপ্ত সুফি মতবাদ যেটি উপমহাদেশের অগ্রগণ্য সুফিসাধক বাহাউদ্দিন জাকারিয়ার (১১৭০-১২৬২) হাত ধরে সোহরাওয়ার্দী সিলসিলা নামে এখানে প্রসার লাভ করে, তার সঙ্গে নূরতত্ত্বের অন্যতম রূপকার ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দীর (১১৫৪-১১৯১) কোনও প্রকার সাক্ষাৎ সংযোগ ছিল না। নিকটবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণ এবং পদবীতে মিল থাকার কারণে ইয়াহিয়া সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর নূরতত্ত্বকে অনেকে নাজিব, উমর কিংবা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া চর্চিত সুফি তরিকার সঙ্গে গুলিয়ে বসেন! সুফি ভাবে মাথা মোড়ানোর কারণে তাঁরা একে অন্যের পরিপূরক হলেও প্রত্যেকে পৃথক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক এবং বিষয়টি মাথায় রেখে আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যুক্তিসংগত। এই কথার মানে অবশ্য এটা নয় তাঁদের মধ্যে ভাবগত কোনও ঐক্য ছিল না! মনে রাখা চাই আল্লাহর প্রকৃতি অনুধাবনে তাঁদের তরিকা আলাদা হলেও পারস্পরিক মিল বা সাযুজ্যও রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী সিলসিলায় শামিল না হলেও ইয়াহিয়া যে-দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে আহাদ-আহমদের মামলা তামাদি করেন তার সঙ্গে নাজিব, উমর ও জাকারিয়ার সুফিপন্থা ক্ষেত্রবিশেষে সাংঘর্ষিক হলেও মোটের ওপর তাঁরা একে অন্যের ভাবনার প্রলম্বিত প্রতিধ্বনি বটে! আলোচনার ধারাবাহিকতায় বিষয়টি পাঠকের কাছে খোলাসা হবে আশা করছি। ইয়াহিয়ার নূরবিচার যেহেতু দার্শনিক ভিত্তিকে উপজীব্য করে আবর্তিত হয়েছে আলোচনার পটপ্রবাহ বিবেচনায় তাঁকে অনুসরণ করে অগ্রসর হওয়া এবং প্রাসঙ্গিকতা অনুসারে সোহরাওয়ার্দি সিলসিলা বিষয়ক আলাপন মনে হচ্ছে উত্তম ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
সর্বাগ্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দীর নূর ভেদবিচার সুফি ধারায় স্বস্তি বোধ করলেও আত্মিক ঊর্ধ্বারোহনের চূড়ায় উপনীত হওয়ার পর আল্লাহর মৌল প্রকৃতি ও মানবাত্মায় বিরাজিত নূরের প্রতিভাসকে তিনি কখনও অভিন্ন ভাবেননি। তাঁর কাছে যিনি আহাদ তিনি ‘এক বিনে দুই নহে’ এবং তাঁর একত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য অ্যারিস্টটলের প্রথম কারণ (First Cause) বা আদি চালকের (Prime Mover) ভাবনাটি নিজের কিতাবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর ভাষ্য অনুসারে সৃষ্টিতত্ত্বের বিচারে আল্লাহ হচ্ছেন ওয়াজিব বা অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন (Absolute Necessity)। এই ‘প্রয়োজন’ সকল অবস্থায় এক ও চিরসচেতন। নির্দিষ্ট স্থান-কাল-আয়তনে তাঁর মৌল প্রকৃতি সীমায়িত না থাকায় তিনি সকল প্রকার ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং সে-কারণে মৌলিক।
‘আল-‘আকল আল-আওয়াল’ বা আদি প্রজ্ঞা (First Intellect) হচ্ছে আল্লাহর মৌল প্রকৃতির অংশ। আদি প্রজ্ঞা অ-সৃষ্ট রূপে মৌল প্রকৃতির মাঝে বিরাজ করায় নিজেও মৌলিক। নবিগণ বিশেষ করে মোহাম্মদ মৌল এই প্রজ্ঞা বা ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন বিধায় তাঁকে নূর-ই-মোহাম্মদ বা আল্লাহর আলোয় আলোকিত গণ্য করা হয়; তথাপি মোহাম্মদ স্বয়ং আল্লাহ অথবা আল্লাহ নিজে মোহাম্মদ নন। সূরা ‘নূর’-এ উল্লেখিত দীপাধার আর প্রদীপ যেমন এক বস্তু নয় আল্লাহর মৌল প্রকৃতি থেকে বিকীর্ণ জ্যোতি ও প্রজ্ঞার প্রতিভাস মোহাম্মদ ও মোহাম্মদের প্রতিভাসে চমকিত বস্তুজগৎ পরস্পর অভিন্ন নয়। গুণ ও মাত্রাগত ভিন্নতার কারণে তাঁদেরকে এক ভাবা কোরানে বর্ণিত আল্লাহর মৌল স্বরূপ সংশ্লিষ্ট তাওহিদের পরিপন্থী। অগত্যা তাওহিদের পরিচয়সূচক ছবিকে উইকিপিডিয়া ‘multiple connotations’ বা একাধিক নিহিতার্থের দ্যোতক উল্লেখ করলেও কোনও যুক্তিতে স্রষ্টার একত্বে কাউকে শরিক করার সুযোগ ইসলামে নেই। আল্লাহর একত্ব ও স্বকীয়তাকে সর্বাগ্রে স্বীকার গিয়ে তাঁর সঙ্গে সৃজিত বস্তুরাজির পার্থক্যকে সোহরাওয়ার্দী বিবেচনায় নেওয়ার পাশাপাশি এই পার্থক্যকে Degree of Capacity বলে নিজের কিতাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
…
চিত্র–৫ : A single raised index finger has multiple connotations. Many Muslims view it as a symbol of Tawhid; — Source: Wikipedia;
…
আদি প্রজ্ঞার অধিকারী আল্লাহকে তাই গ্রিক লোগোস বা জ্ঞানের প্রতীক ভাবা যায়। এহেন কারণে তিনি আবার ‘আকল আল-কুল্লি’ বা অজ্ঞেয় উপায়ে বিরাজিত পরম মনের (Absolute Mind) উপমানও বটে! আল্লাহর পরম মন থেকে সৃষ্ট প্রজ্ঞার দুটি স্তর সোহরাওয়ার্দী বর্ণনা করেন। একটি স্তরে বিরাজিত প্রজ্ঞাকে তিনি তাঁর কিতাবে ‘আকল আল-মাঅ‘আশ’ বা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান নামে অভিহিত করেছেন। বস্তুজগতের কার্যকারণ উপলব্ধি করতে লোকে সচরাচর এই প্রজ্ঞা ব্যবহার করে। অন্য স্তরটি হচ্ছে ‘আকল আল-মাঅ’আদ’ বা আধ্যাত্মিক ধীশক্তি। গুণবিচারে এটি উচ্চতর। পরম মনের প্রতীক আল্লাহর এই প্রকৃত স্বরূপ যাঁরা উপলব্ধি করতে চায় তাঁদের জন্য আত্মতত্ত্বে গমনের পর আধ্যাত্মিক ধীশক্তির শরণ নেওয়া তাই ফরজ হয়ে ওঠে। সুফি তরিকায় আত্মতত্ত্ব হলো আল্লাহর চির-অপরিবর্তনীয় প্রকৃতি থেকে উৎসারিত আলোয় জায়মান রুহ বা বিবেচক আত্মার (Rational Soul) গতিপ্রকৃতি উপলব্ধির উপায়। বিবেচক আত্মা হচ্ছে মহাজাগতিক কারণ (Cosmic Reason), বস্তুজগৎ সৃজনে ভূমিকা রাখায় তাকে সৃষ্টির নির্যাস মনে করা হয়। বিবেচক আত্মার গুণ ধারণের মধ্য দিয়ে মানবাত্মা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে ওঠে।
এখন যে-ব্যক্তি আত্মতত্ত্বে গমনে আগ্রহী তার জন্য মানবদেহে সক্রিয় রুহ বা নফস অর্থাৎ আত্মার স্বরূপ আল্লাহ কীভাবে কোডিং করেছেন সেই বিষয়টি উপলব্ধির বিকল্প নেই। আত্মতত্ত্বে নিমগ্ন ব্যক্তির স্মরণে রাখা প্রয়োজন, — পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সমষ্টি মানুষের দেহ ও দেহস্থিত অহং জীবাত্মায় (Animal Soul) নিহিত জৈবিক বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করায় গুণবিচারে তার অবস্থান নিম্নস্তরে। অন্যদিকে মানবাত্মা (Human Soul) আল্লাহর মৌল প্রকৃতি থেকে উৎসারিত আলো দ্বারা গঠিত হওয়ায় ডিভাইন বা স্বর্গীয় এবং গুণবিচারে উচ্চস্তরে অবস্থান করে। সোহরাওয়ার্দীর ভাষায় মানবাত্মা গুণবিচারে উচ্চস্তরে অবস্থান করলেও ধরায় আগমনের পর দেহে বিরাজিত ইন্দ্রিয় সমূহের আশ্রয়ে জগতে তাকে সক্রিয় হতে হয় :—
পঞ্চ ইন্দ্রিয় যেমন স্পর্শ-স্বাদ-গন্ধ-শ্রবণ ও বীক্ষণ ইত্যাদিকে মাধ্যম রূপে ব্যবহার করে আত্মার জগতে সংযুক্ত থাকার এই ক্ষমতাকে সোহরাওয়ার্দী যৌথ সচেতনা (collective consciousness) নামে চিহ্নিত করেছেন। সচেতনা অ-ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা হলেও জীবের ‘আকল’ যেখানে সৃষ্ট ও সংরক্ষিত থাকে অর্থাৎ মস্তিষ্ককে এর আধারকেন্দ্র রূপে নিজের কিতাবে তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি। তাঁর মতে বস্তুরাজি ও ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত পঞ্চ ইন্দ্রিয় যেসব সাড়া ও উদ্দীপনা নশ্বর মানবদেহে পাচার করে তার ভাষান্তর বা অর্থ-নির্মাণের কাজটি দেহে বিদ্যমান ‘আকল’ দ্বারা সংঘটিত হয়। যৌথ সচেতনা তাই মানুষসহ সকল জীবের কল্পনা-চিন্তা-অনুমান ও মস্তিষ্কের কোষে সংরক্ষিত স্মৃতির সমষ্টিও বটে!
উল্লেখ্য যে সুফি মতবাদে ব্যবহৃত নফসের বিখ্যাত বর্গীকরণকে সোহরাওয়ার্দী রুহ বা আত্মার বিবিধ প্রকারভেদ ব্যাখ্যায় নিজের কিতাবে ব্যবহার করেছেন। এই বর্গীকরণ অনুসারে ‘আল-নফস আল-তাবিই‘ই’ প্রাকৃতিক স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। প্রকৃতির অংশ রূপে সৃষ্ট জীবকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে এটা বাধা দেয় এবং তাদের মাঝে সংহতি বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। জীবের ধরায় আগমন, পরিবর্ধন ও বিবর্তনের পরিচয় ‘আল-নফস আল-নাবাতি’র মধ্যে মিলে। অন্যদিকে ‘আল-নফস আল-হাওয়ানি’ জীবে বিদ্যমান জৈবিক প্রবৃত্তির (Animal Instinct) স্মারক এবং জীবের স্নায়বিক সংবেদন (যেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিবিধ গুণ) ও স্বভাবকে সে প্রতিফলিত করে। সৃষ্ট জীবে বিদ্যমান নফসের এই প্রকারভেদের রাজ্যে ‘আল-নফস আল-নাতিকাহ্’ বা মানবাত্মার অবস্থান! এই নফসধারী আত্মা স্বয়ং আল্লাহর নূরস্বরূপ প্রতিভাসের ঝলক ধারণ করে ধরায় আগমন করে এবং মানুষকে চিন্তা, বিবেচনা, পর্যবেক্ষণ ও বিচারবোধের সাহায্যে স্রষ্টা ও জগতের মধ্যে বিরাজিত সম্পর্ক অনুধাবনে তাড়িত করে। সোহরাওয়ার্দী তাঁর কিতাবে কোরান অনুসারে মানবাত্মা যে-সাতটি স্তরে উদ্ভূত ও বিবর্তিত হয় তার ব্যাখ্যাটি হাজির করেছেন :—
মন্দ তাড়না দ্বারা পরিচালিত মানবাত্মা নফসের প্রথম স্তর ‘আল-নফস আল-আমারাহ’য় অবস্থান করে। দ্বিতীয় স্তরে ‘আল-নফস আল-লাওওয়ামাহ্’ বা বিবেকবোধের সাহায্যে ভালোমন্দ বিচারে সক্ষম মানবাত্মার অবস্থান। তৃতীয় স্তর ‘আল-নফস আল-মুলহিমাহ্’ সঠিক ও ভ্রান্ত সম্পর্কে সচেতন মানবাত্মাকে নজর করায়। চতুর্থ স্তরে আশীর্বাদধন্য ও মোক্ষ লাভে ব্যাকুল মানবাত্মা ‘আল-নফস আল মুতমা‘ইন্নাহ্’-র দেখা মিলে। পঞ্চম স্তর ‘আল-নফস আল-রাদিয়াহ্’ আল্লাহর নিকট নিজেকে সমর্পণে ব্যগ্র মানবাত্মাকে প্রকটিত করে। ষষ্ঠ স্তরে স্থিত মানবাত্মা ‘আল-নফস আল-মারদিয়াহ্’ আল্লাহর অতি নিকটবর্তী হওয়ার আবেশ জাগ্রত করায়। এই স্তরে অবস্থিত আত্মিক গুণের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছায় সৃষ্ট জগতের কার্যকারণ অনুভব করতে পারে এবং নিজের ইচ্ছা ও স্বকীয়তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে ফানা ফিল্লাহ্ বা আল্লাহয় নিজেকে সমর্পণ করে। সপ্তম বা চূড়ান্ত স্তরে ‘আল-নফস আল-জাকিয়াহ্’ মতান্তরে ‘আল-নফস আল-কামিলিয়াহ্’র অবস্থান। আত্মতত্ত্বের গমনের মাধ্যমে উক্ত স্তরে উন্নীত মানবাত্মা শুদ্ধ সত্তারূপে নিজেকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের সারনির্যাস বলে অনুভব যায় এবং নিজের মধ্যে সৃষ্টিকে লীলা করতে দেখে। বঙ্গে লালন প্রভাবিত ভাবসাধনার জগৎ মূলত সোহরাওয়ার্দী বর্ণিত ষষ্ঠ ও সপ্তম স্তরে নিজেকে উপনীত করতে দেহসাধনায় লিপ্ত হয়। বাউল ও ফকিরি ধারায় ‘যা নাই ভাণ্ডে তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে’ নামক প্রবচন কার্যত নিজেকে মহাজাগতিক কারণ (Cosmic Reason) ভাবার ফেরে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
ইয়াহিয়া হাবাশ সোহরাওয়ার্দীর নফস-বিচারের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী সিলসিলার পুরোধা কাণ্ডারি আবু হাফস উমর আল-সোহরাওয়ার্দীর সবিশেষ অমিল না থাকলেও তাঁর মারফতি ও সুফি সাধনমার্গ বিষয়ে বিরচিত কিতাব ‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’ (Awarif-ul Maarif) নফস ও রুহের মধ্যে গুণগত পার্থক্য দেখতে পায়। মূলধারার ইসলাম আত্মা-স্বরূপ রুহ ও নফসকে পৃথক ভাবে না। দেহের সঙ্গে নফস বা রুহ জগতে আগমন করে এবং দেহ গত হলে পরে ইহজগতে দেহধারী মানবের আমল অনুসারে ‘ইল্লিন’ ও ‘সিজ্জিন’-এ অবস্থান করতে থাকে। ‘ইল্লিন’ হচ্ছে পরলোকের সর্বোচ্চ স্তর বা জান্নাত মতান্তরে আল্লাহর বিদ্যমানতার অতি-নিকটবর্তী স্থানে রুহের অবস্থান গ্রহণ; পক্ষান্তরে ‘সিজ্জিন’ হলো পরলোকের নিকৃষ্ট স্তর দোজখ বা জাহান্নামে রুহের গমন। সূরা ‘আল-মুতাফফিফিন’-এ যারা মাপে বা ওজনে কম দেয় তাদের পরিণতি সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণের ছলে আয়াত আসে :—
‘দুর্ভোগ তাহাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। উহারা কি চিন্তা করে না যে উহারা পুনরুত্থিত হইবে? মহদিবসে? কখনও না, পাপাচারীদের আমলনামা তো সিজ্জিনে আছে। সিজ্জিন সম্পর্কে তুমি কী জানো? উহা চিহ্নিত আমলনামা।… অবশ্যই পুণ্যবানদের আমলনামা ইল্লিনে। ইল্লিন সম্পর্কে তুমি কী জানো? উহা চিহ্নিত আমলনামা।’ — উৎস : আল–মুতাফফিফিন ৮৩:১, ৪, ৭–৯; ১৮–২০; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
উমর সোহরাওয়ার্দী সুফি তরিকায় সাধনমার্গে স্বচ্ছতা আনয়নের প্রয়োজনে সম্ভবত মূলধারা থেকে পৃথক স্রোতে গমন করেন এবং নফস ও রুহে প্রভেদ ঘটান। তাঁর মতে নফস মূলত ব্যক্তির মন্দ ও নিন্দনীয় গুণকে ধারণ করে, পক্ষান্তরে রুহ প্রশংসনীয় গুণের ধারক; — ‘The source of the blameable qualities in man is nafs : the source of the laudable qualities is ruh (the soul).’ ইমাম গাজ্জালি ও জুনায়েদ বাগদাদী প্রভাবিত উমর সোহরাওয়ার্দীর মারফতি সিলসিলা মন্দ গুণের ধারক নফসে মানুষের বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে মন্দ বা নিন্দনীয় দশটি গুণের প্রকাশ লক্ষ করে। নিজের কিতাবে দ্বিরুক্তিসূচক এই গুণ সমূহের ব্যাখ্যা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন :—
নফসে বিদ্যমান প্রথম গুণটি ‘হাওয়া’ (Hawa) বা বাসনাকে বক্ষে নিয়ে অগ্রসর হয়। বাসনার কটিবন্ধে নিজেকে বাঁধতে ইচ্ছুক ব্যক্তি স্বয়ং স্রষ্টাকে তার মনোবাসনা পূরণের সঙ্গী রূপে সেখানে আঁকড়ে ধরে, ‘…to bind on its waist the girdle of its consent with desire and to hold God in partnership.’। তার এই বাসনা নফসের প্রকৃত গুণাবলী অর্থাৎ কঠোর সংযম ও স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার দ্বারা সংরক্ষিত নয়। নফসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় লক্ষণ হচ্ছে ‘নিফাক ও রিয়া’ (Nifak and Riya); উক্ত লক্ষণ সমূহ যার মধ্যে প্রকটিত সেই ব্যক্তি শঠতাকে আশ্রয় করে স্রষ্টার প্রতি আন্তরিক সাজার ভান করে। নিফাক ও রিয়ায় বশীভূত ব্যক্তি লোকের সম্মুখে নিজেকে ঐকান্তিক প্রমাণে সচেষ্ট থাকে এবং অনুপস্থিতিতে তার স্বভাবে বিপরীত আচরণ দৃষ্ট হয়। মূলধারার ইসলামে এই ব্যক্তি মুনাফিক নামে বিদিত। স্রষ্টার বিবেচনায় প্রশংসনীয় গুণাবলী যেমন মর্যাদা, দীনতা, সমর্পণ ও অনুতপ্ত বোধ করা ইত্যাদিকে প্রশংসার ছলে প্রকারান্তরে হিংসা-হানাহানি ও স্বেচ্ছাচারিতাকে নিজের জীবনে সে অমোঘ করে তোলে। এহেন ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টির অধিকারী ব্যক্তিকে নফসের মৌল গুণ যা মন্দ ও কুৎসিতকে আড়াল করে উত্তম ও সুন্দরের প্রকাশ ঘটায় এরূপ গুণাবলীর দ্বারা সুরক্ষিত নয়।
জোরজবরদস্তির মাধ্যমে মানুষকে স্রষ্টার উপাসনায় বাধ্য করে যে-লোক সে নফসের চতুর্থ গুণ ধারণ করেছে বলা যায়। এই ব্যক্তি স্রষ্টাকে মহান জাহির করার নামে কার্যত নিজের অভিলাষ পূরণের দাসত্ব করে এবং মহান স্রষ্টাকে খাটো করার আকাম সারে; যা স্রষ্টার প্রকৃত গৌরববাচক গুণাবলীর দ্বারা সংরক্ষিত নয়। ব্যক্তির স্বভাবে বিদ্যমান নফসের পঞ্চম গুণ তাকে অহংকারী হতে ও আত্ম-প্রচারের দিকে ধাবিত করে। মোহাম্মদের পরিভাষায় এটা মারাত্মক পাপ সমূহের একটি। নফসের এই দশা নিজেকে তুচ্ছ ও সামান্য ভাবার বিনয় দ্বারা সুরক্ষিত নয়। উমর সোহরাওয়ার্দীর কিতাবে ষষ্ঠ অর্থাৎ নফসের অন্যতম মন্দ দিক সেই ব্যক্তির মধ্যে দৃষ্ট হয় যে কিনা অর্থলিপ্সা ও কৃপণতাকে জীবনে আঁকড়ে ধরে বাঁচে। দারিদ্র্যভীতি থেকে রক্ষা পাওয়ার অজুহাতে অর্থলিপ্সু ও অর্থগৃধ্নু ব্যক্তিটি প্রাচুর্যের দ্বারা সুরক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও হিংসা বা দ্বেষমুক্ত হতে পারে না। ক্ষমতা হাতে পেলে ধ্বংসাত্মক রূপে সে আত্মপ্রকাশ করে। তার এই বিপথগামীতা স্রষ্টার সুনিশ্চিত আলোকের অধীন নয় :— ‘This departeth not save under the power of the light of yakin.’
মাত্রাতিরিক্তি লোভী ব্যক্তি নফসের সপ্তম গুণ ধারণ করে। নিয়ন্ত্রহীন লোভ মনের শান্তি চিরতরে বিনষ্ট করে এবং তার এই লোভ সংযমের কঠোরতা অথবা স্রষ্টার প্রতি ভয় ও আনুগত্যের দ্বারা সুরক্ষিত নয় :— ‘This departeth not save by wara’ (austerity) and by takva (piety).’ লঘুতা, চপলতা ও অস্থিরচিত্ত ব্যক্তি নফসের অষ্টম গুণটি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই গুণ ব্যক্তিকে বোধশূন্য ও কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের দিকে ধাবিত করায় এটা স্থৈর্যর দ্বারা সংরক্ষিত নয়। নফসের নয় নাম্বার খারাপ লক্ষণ হলো ক্লান্তি ও বিবমিষা। যে-ব্যক্তি এহেন গুণের খপ্পরে পড়েছে তার নফস মিথ্যা কল্পনার রাজ্যে ডুব দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টিকে নৈরাশ্যে সুবাসিত করে। নিজের অর্জন তার কাছে তখন ঘৃণ্য মনে হতে থাকে। উক্ত দশায় যাকে পায় সে স্রষ্টা কর্তৃক সৃজিত প্রকৃতির নিয়মানুগ শৃঙ্খলার দ্বারা সুরক্ষিত নয়। অবহেলা ও অমনোযোগ হচ্ছে নফসের দশম বা শেষ গুণ। এই গুণের ওপর ভর করে জীবন নির্বাহকারী ব্যক্তি স্রষ্টার আনুগত্য থেকে শুরু করে সকল ভালো কাজে অলস ও অমনোযোগী থাকায় অকর্মণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং তার প্রতি সংযমের কঠোরতা বিশেষ ফলদায়ক হয় না। — *দ্রষ্টব্য : The Awarifu-l-Ma’arif by Shihab al-Din ‘Umar al-Suhrawardi; Translation : Mahmud Ibn Ali Kashani; 1891; PDF Edition.
মারফতি ছকে বর্ণিত উমর সোহরাওয়ার্দীর নফস-বাখান কোরানের সেইসব সূরার সমীকরণ থেকে প্রাপ্ত যেখানে এইসব গুণধারী ব্যক্তির স্বরূপ সম্পর্কে আয়াতের-পর-আয়াতে তীব্র ভাষায় আল্লাহ তাঁর প্রেরিত নবিকে সাবধান থাকার সিগন্যাল প্রেরণ করেছিলেন। সুফিভাবে আল্লাহর সিফাত অর্থাৎ গুণাবলীর অনুধ্যানে মুর্শিদ বা দীক্ষাগুরুর শরণ নেওয়ার পর থেকে যেসব ধাপ একে-একে অনুসরণ করতে হয় উমর সোহরাওয়ার্দীর কিতাব তার বিস্তারিত বয়ান রেখে যায়। সুফি সাধনতরিকায় খানকা, সফর, সামা গান ও জিকির, খিরকা বা সুফি লেবাস পরিধান, খিলাওয়াত বা জাগতিকতা থেকে নিজেকে ক্রমশ প্রত্যাহার এবং মারফত, হাল ও মকাম সম্পর্কিত জ্ঞান, সর্বোপরি তাওহিদ বা স্রষ্টার একত্ব উপলব্ধি শেষকথা নয়, সুফিভাবে মাথা মোড়ানো ব্যক্তির জন্য রুহ ও নফসের প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন অতিব জরুরি। অন্যথায় তার পক্ষে ওয়াজিদ বা পরমানন্দ লাভের সড়ক ধরে গমনের ক্ষণে তাজরিদ বা বাহ্যিক বিচ্ছিন্নতার অনুভবে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাজরিদ অনুভূত না হলে তাফরিদ অর্থাৎ মানসিক প্রশান্তি আসে না। মন শান্ত না হলে রিজা বা সন্তুষ্টি বোধ চিত্তে জাগ্রত করা কঠিন হয়। সন্তুষ্টি ছাড়া মুহাব্বত বা ভালোবাসার অনুভবে নিজেকে সিক্ত বোধ করা এবং শাউক বা স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সমর্পণের মকামে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। উপরন্তু আত্মিক মুক্তি অর্জনের পথে স্রষ্টার প্রতি নবির আদাব বা মান্যতা, সালাত, জিকির ও ভাবাবেশ সহযোগে সামা এইসব আচারে অভ্যস্ত হওয়া সুফির জন্য ফরজ বলে গণ্য হয়ে থাকে। তবে রুহ ও নফস বিষয়ে উত্তম-অধম বিবেচনাজ্ঞান যদি ব্যক্তির চিত্তে দৃঢ় না হয় তবে এসব আচারিক প্রক্রিয়ার কোনও মূল্যই আর থাকে না!
উমরের সঙ্গে ইয়াহিয়া সোহরাওয়ার্দীর তফাত বলতে এটুকু, মানবাত্মায় সক্রিয় নফসের নৈতিক প্রকৃতি নিয়ে উমর বিস্তারিত হয়েছেন সুফি সিলসিলার প্রয়োজনে, অন্যদিকে নফসের প্রকৃতি ব্যাখ্যায় ইয়াহিয়া নৈতিক প্রকারভেদে গমন না করলেও দুজনের বক্তব্যের সারকথা অভিন্ন, — মানবাত্মা আল্লাহর জ্যোতিতে আলোকিত হওয়ার ফলে স্বর্গীয় বা পবিত্র, কিন্তু মানবদেহে তার অবস্থান নফসের নানাবিধ লক্ষণ আমল করার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। নেক আমল মানুষকে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি ও তাকে আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করে আর বিপরীত আমল আত্মাকে হীন দশায় উপনীত করায়। এখন ইয়াহিয়া প্লেটোর সঙ্গে অ্যারিস্টটলকে সঙ্গী করেন বিধায় নফসকে মানুষের ‘আকল’ বা মস্তিষ্কের গতিবিধির সঙ্গে জুড়ে তাঁকে ব্যাখ্যায় গমন করতে হয়েছিল। দুজনের বক্তব্য ক্লিয়ার করে, নফসে কোডিং করা উত্তম ও অধম বৈশিষ্ট্য সমূহ আমলের মাধ্যমে মানুষ জীবাত্মা বা পশুসুলভ জৈবিক প্রবৃত্তির অধিকারী আত্মিক অবস্থানে নিজের অবনতি ঘটায় নতুবা মানবাত্মা বা স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত হয় এবং আল্লাহর জ্যোতির নিকটবর্তী হতে থাকে। সুফিভাবে এটা ঊর্ধ্বারোহন বা স্রষ্টার জ্যোতিতে নিজেকে তরঙ্গিত বোধ করা নামে চিহ্নিত হয়েছে। এহেন মানবাত্মার অধিকারী মানুষটি হচ্ছে মহাবিশ্ব তথা সৃষ্ট জগতের সার এবং মোহাম্মদ সেখানে প্রাণবিন্দু স্বরূপ। তিনি হচ্ছেন সেই বিন্দু যিনি স্বয়ং আল্লাহর মৌল প্রকৃতিতে নিহিত ‘আল-‘আকল আল-আওয়াল’র আলোক-প্রতিভাস ধারণপূর্বক ধরায় আগমন করেছিলেন। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর নূর থেকে জাত মানবাত্মাকে সোহরাওয়ার্দী বর্ণিত সতর্কবাণীর আলোকে চিরন্তন ভাবা যায় :—
কিছু লোক যখন উপলব্ধি করতে পারল মানবাত্মা কায়াধারী বা বস্তুর অনুরূপ নয় তখন তারা প্রতারিত হয়ে ভাবল এটা নিশ্চয় আল্লাহ হবে এবং ধর্মদ্রোহিতার গহ্বরে নিজেরা পতিত হলো। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। জায়েদ ও ‘আমরের আত্মা যদি এক এবং অভিন্ন হয়ে থাকে তাহলে একজন যা উপলব্ধি করে অন্যজন সেটাই উপলব্ধি করার কথা। এবং একজন যদি জ্ঞাত থাকে তবে সমগ্র মানবজাতির তা জ্ঞাত হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটনা সেরকম হয় না। অধিকন্তু, কায়াধারী দেহ যেসব শক্তি ও ক্ষমতা ধারণ করে তা কী করে সর্বোচ্চ মহান আল্লাহকে প্রভাবিত করতে পারে?
অন্যরা মানবাত্মাকে (যদি আল্লাহ স্বয়ং সেরকম না হয়ে থাকেন) আল্লাহ মনে করে ভ্রমে পতিত হয়। আল্লাহ কায়াধারী বা বস্তু সদৃশ নন, তাহলে কী করে তিনি বিভাজনযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন, আর কে অথবা কোন শক্তিই-বা তাঁকে পৃথক করতে পারে?
আবার অনেকে ভাবে মানবাত্মা আল্লাহর ন্যায় চিরন্তন এবং সে-কারণে স্বাধীন। ঘটনা যদি সেরকম হয়ে থাকে তবে পবিত্র স্থান থেকে আত্মাকে কে পৃথক করে, তাকে জীবনের রাজপাটে কে আনিত করে, অতঃপর পার্থিব জগৎ থেকে তাকে উঠিয়ে নেয় এবং মৃত্যু ও অন্ধকারের রাজ্যে উপনীত করায়? — উৎস : ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দী বিরচিত হায়াকাল আল–নূর বা The Shape of Light; ভাষান্তর : শায়েখ তোসুন বায়রাক আল–জেরিহ্ আল–হালভেতি, ১৯৯৮; বাংলা তরজমা : লেখককৃত; পিডিএফ সংস্করণ।
এই সতর্কবাণী আবারও বার্তা প্রদান করে স্রষ্টা রূপে আল্লাহর অবস্থান সর্বোচ্চ, এমনকি যা-কিছু চিরন্তন তিনি সেই চিরন্তনেরও ঊর্ধ্বে বিরাজ করেন। এই আল্লাহর কোনও সৃষ্টি-বিনাশ ও রূপান্তর নেই। তিনি হলেন ডট বা বিট রূপী মৌল জ্ঞানের আধার যার থেকে সমুদয় জগতের উৎপত্তি ঘটলেও Dgree of Capacity-র কারণে সৃষ্টি থেকে তিনি সর্বদা পৃথক থাকেন। আল্লাহর এই পৃথকত্বের নেপথ্য যুক্তি হলো যা-কিছু সৃষ্ট তা মৌলিক নয়, একমাত্র অ-সৃষ্ট কিছু মৌলিক হতে পারে, যেমন আল্লাহ। মোদ্দা কথা, আল্লাহ প্রথম কারণ রূপে যেমন মৌলিক, আদি প্রজ্ঞার অধিকারী রূপেও সমান মৌলিক এবং এ-জন্য তাঁর নিরাকার হওয়ার প্রয়োজন নেই, বরং কোনও এক স্বরূপে তিনি সক্রিয় ও বিদ্যমান। মোহাম্মদের ধীশক্তি আল্লাহর আদি প্রজ্ঞার নিকটবর্তী এবং যে-কারণে আল্লাহর মৌল স্বরূপ অনুধাবনে তিনি অধিক অগ্রবর্তী। সুতরাং তাঁর ‘আকল’ যারা বিবেচনায় নিতে পারে তারা আল্লাহর চির সক্রিয় ‘আকল’র হদিশ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেরা অগ্রবর্তী হয়। তারা তখন আল্লাহ প্রদীপের আলোয় আলোকিত বোধ করে এবং সুফিভাবে এটা হচ্ছে ফানা। আল্লাহয় বিলীন হওয়ার অর্থ এই নয় মানবাত্মা (*এমনকি নূর মোহাম্মদ) তাঁর সঙ্গে অভিন্ন! আল্লাহর মৌল প্রকৃতির এসেন্স বা সারনির্যাস উপলব্ধির পর নিজেকে সূরা ‘নূর’-এ ব্যক্ত আলোকিত দীপাধার অনুভব করার যে-অবস্থা চিত্তে জাগরুক থাকে সেরকম অবস্থায় উপনীত হওয়ার নাম হলো ফানা এবং নূরতত্ত্বের সারকথা সেখানে নিহিত।
মোহাম্মদ তাই আল্লাহ নামক বাতির আলোয় আলোকিত কিন্তু নিজে সেই আলোর জনক নন। মৌল নূর তাঁর মধ্যে সক্রিয় থাকায় আত্মিক পরিশুদ্ধি ও স্রষ্টাকে উপলব্ধি করতে তিনি সক্ষম এবং সেই জায়গা থেকে মুর্শিদ বা স্পিরিচুয়্যাল গাইড রূপে তাঁকে মেনে নিতে সোহরাওয়ার্দী অধীর থাকেন। তাঁর কিতাবের তরজমাকার তোসুন বায়রাকের ভাষ্য মোতাবেক মাত্র আটত্রিশ বছরের আয়ুষ্কালে সোহরাওয়ার্দী পঞ্চাশটি কিতাব রচনা করেছিলেন এবং একাধিক কিতাবে নবি মোহাম্মদের জ্যোতির্ময় প্রকৃতিকে বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন; — হিকমাত আল–ইশরাক কিতাবে মোহাম্মদকে আল্লাহর অমলিন জ্যোতির নিকটবর্তী জ্যোতি বা ‘আল-নূর আল-আকরাব’ বলে তিনি বন্দনা করেন। তালউইহাত কিতাবে সমগ্র মন বা আল-‘আকল আল-কুল্লি’ রূপে নবি তাঁর চেতনায় ধরা দেন। এভাবে অন্যান্য কিতাবে প্রথম আলো বা ‘আল-নূর আল-আওয়াল’, ‘আল-শায়েখ’ বা শিক্ষক, ‘আল-জামাল’ অর্থাৎ সুন্দর ইত্যাদি বিশেষণে নবি মোহাম্মদকে তিনি বিশিষ্টতা দান করেছেন।
এই বিশেষণগুলা ইশারা ওঠায়, কোরানে নবিকে আল্লাহর নূরে নূরানি আখ্যায়িত করার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানব সম্প্রদায়কে স্রষ্টার মৌল প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান, যা কোনওভাবে এটা বোঝাতে চায়নি যে নবি স্বয়ং আল্লাহর কায়া হয়ে ধরায় নেমেছিলেন অথবা তিনি স্বয়ং আল্লাহর নূরস্বরূপ সিফাতের অধিকারী ইত্যাদি। কোরানে সূরা ‘নূর’-এ বর্ণিত ‘নূরুন আলা নূরিন’ বা ‘জ্যোতির ঊর্ধ্বে জ্যোতি’-র মধ্যে নিহিত মেটাফরের ভ্রান্ত পাঠ সুফি থেকে মরমি সকল ধারায় কমবেশি প্রচলতা পাওয়ায় আহাদ-আহমদ অভিন্ন এমতো ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়! এর অর্থ হলো যে-ত্রিত্ববাদকে কোরান একাধিক সূরায় খারিজ করে তার নতুন সংস্করণ ‘দ্বৈততার মধ্য দিয়ে তিনি অদ্বৈত’ এমনধারা মতবাদকে আশ্রয় করে ‘যিনি আহাদ তিনি আহমদ’ তত্ত্বে মোড় নিতে থাকে। বুল্লে শাহ যেসব কার্যকারণ সূত্রে দ্বৈততা স্বীকার করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং লালন সাঁইজি আল্লাহ-নবি অভিন্ন আওয়াজ তোলার আবেশে বৈদিক অদ্বৈতবাদ ও ইসলামি সুফিবাদকে একসূত্রে গাঁথেন তার নেপথ্যে এই মতের প্রভাব একটি গণ্য কারণ।
অতএব, উপমহাদেশে সুফি, মরমি ও বাউল ধারায় ব্যক্ত নূরতত্ত্ব এই জ্ঞানপ্রকল্পের স্মারক নয় যার আভাস আবদুল কাদের জিলানী, বায়েজিদ বোস্তামি, ইমাম গাজ্জালি, ইবনে রুশদ, ফারাবি থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী সিলসিলার প্রবক্তা আবু আল-নাজিব সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর মতবাদকে যিনি পূর্ণতা দান করেছেন সেই উমর সোহরাওয়ার্দী এবং এই সিলসিলায় শরিক না হলেও সংলগ্ন ইয়াহিয়া সোহরাওয়ার্দী প্রমুখরা নিজস্ব বাহাস সৃষ্টিকারী প্রস্তাবনায় রেখে গেছেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, তাঁরা কেউ শরিয়তকে অস্বীকার যাননি, তবে শরিয়তের মসলা-মাসায়ালা নিয়ে নিজস্ব পন্থায় বাহাসে লিপ্ত ছিলেন, যার জের ধরে সুফি, মরমি এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অজ্ঞেয় ধারণা ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেননি। ইতিহাসে লেখে, ইয়াহিয়া সোহরাওয়ার্দীর পরিণতি মনসুর হাল্লাজ থেকে ভিন্ন ছিল না। তাঁর শিরশ্ছেদ ঘটানো হয়নি কিন্তু তৎকালীন শাসকের কানে কোরান ও ইসলাম সম্পর্কিত তাঁর ব্যাখ্যাকে অপব্যাখ্যা ও শরিয়তের পরিপন্থী ইত্যাদি মন্ত্রণা দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। এর জের ধরে মানসিক চাপ ও গৃহবন্দিত্ব তাঁকে সইতে হয়েছিল, যা প্রকারান্তরে তাঁর অকালমৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।
শরিয়ত বা কোরানে বর্ণিত আল্লাহ উপাসনার বিধিবিধানের সমষ্টি হচ্ছে ইসলাম, যা সোহরাওয়ার্দীর বচনে ‘ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি’; এখন সেই ভিত্তির ওপর যে-ঘরটি খাড়া রয়েছে সেটা হচ্ছে সুফিবাদ। দ্বিতীয়ত সোহরাওয়ার্দী বিরচিত ‘হায়াকাল আল-নূর’ কিতাবের অনুবাদক তোসুন বায়রাকের ভূমিকা এটা আবারও ক্লিয়ার করে আল্লাহর মৌল গুণাবলী উপলব্ধির প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দী প্লেটোর ভাববাদী যুক্তিছক বা ইশরাকিয়াহ যেমন গ্রহণ করেছিলেন, অ্যারিস্টটল প্রভাবিত মাশশিয়াহ বা রেশনালিটিকে ঈশ্বর-উপলব্ধির নিরিখে বিবেচনা করেছেন। তৃতীয়ত তিনি সর্বাধিক প্রভাবিত হয়েছেন শরিয়ানিষ্ঠ ইমাম গাজ্জালির সুফিবাদী বাখান ‘মিশকাত আল-নূর’ বা দীপাধার-এ বর্ণিত ভাষ্য দ্বারা; যার মোদ্দা কথাটা হচ্ছে আল্লাহর বস্তুজগৎ সৃজন প্রক্রিয়ায় আলোর ভূমিকা অশেষ। আহমদরূপী মোহাম্মদ সেখানে আহাদের মৌল নূরের ছটায় চমকিত, সূর্যের আলোয় যেমন চমকিত হয় পৃথিবী কিন্তু তা বলে পৃথিবী ও সূর্য এক বস্তু নয়। মৌল নূর হলেন সূরা ‘নূর’-এ বর্ণিত প্রদীপ আর প্রদীপের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় মোহাম্মদ সেখানে দীপাধার। দীপাধার কখনও প্রদীপের সঙ্গে একীভূত হতে পারে না, আবার দীপাধার যখন অপসারিত হয় প্রদীপ তখনও অবিকল প্রদীপই থাকে। অর্থাৎ সৃষ্ট জগৎ আল্লাহর জ্যোতির বিচিত্র তরঙ্গ থেকে সৃষ্টি হলেও সেই তরঙ্গ শেষাবধি তাঁর মৌল গুণাবলীকে প্রভাবিত করতে পারে না। এছাড়া মৌল বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার যাওয়া মুশকিল হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিজ্ঞানের একটি ধারা সমগ্র মহাবিশ্ব অভিবাজ্য কোনও স্বরূপ থেকে সৃষ্ট হয়েছিল কিনা এই অনুসন্ধানে নিজেকে সক্রিয় রেখেছে। বিপরীত ধারায় সক্রিয় বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব সৃষ্টির নেপথ্যে মৌল ও অভিবাজ্য কিছুর অস্তিত্ব এখন আর স্বীকার যেতে চান না। তাঁরা মনে করেন বিগ ব্যাং পূর্ববর্তী মহাবিশ্ব Out of nothing অর্থাৎ বিজ্ঞানে চর্চিত সৃষ্টিতত্ত্বের সকল শর্তের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বৃহৎ বিস্ফোরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পেরেছিল। বস্তুগঠনকারী পরমাণুকণা, স্থান-কাল-মাত্রাসহ তাপগতিবিদ্যার সূত্র এবং বিজ্ঞান নির্ধারিত শর্তের কোনওটা সেখানে হাজির ছিল না, তথাপি বিদারণ (Fission) ও একীভবন (Fusion) ঘটানোর মতো পরিবেশ নিরাকার সদৃশ অবস্থায় তৈরি হয়েছিল বলে বৃহৎ বিস্ফোরণ সম্ভব হয়েছে। এরূপ শর্তবিহীন নিখিল ‘নেই’ থেকে জগতের উদ্ভব বিষয়ক তত্ত্বের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর লেনদেন না থাকলেও যে-দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি আল্লাহকে অনিবার্য জ্ঞান করেন সেখানে ‘ওয়াজিব’ বা অবশ্যম্ভাবীর উপিস্থিতি কিন্তু নাস্তি বা Out of nothing-হেন পরিবেশেও বজায় থাকে। এছাড়া নিখিল নাস্তির জগৎ থেকে নিখিল আস্তি বা অস্তিত্বের সূচনা ঘটার কোনও যুক্তি অবশিষ্ট থাকে না। নিজের কিতাবে তিনি তাই যুক্তি দিয়েছিলেন :—
কোনও কিছু বিদ্যমান থাকার ক্ষেত্রে তার সেই বিদ্যমানতা ইচ্ছা, সময়, স্থান, সংযুক্তি, সম্ভাবনা ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং তার অস্তিত্বের কারণ হয়ে ওঠে। কারণ সম্পর্কে যদি সম্যক উপলব্ধি না হয় তবে কার্য বা ফলাফল সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধ হতে পারে না। বস্তুর বিদ্যমান থাকার সকল কারণ ও শর্ত যদি সেখানে থাকে এবং উক্ত বস্তুর সাপেক্ষে সকল অনাবশ্যক কারণ ও শর্ত বিদূরিত হয়, তখন সেই বস্তুর অস্তিত্ব ওয়াজিব বা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
যাঁর অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী সেই এক ও অদ্বিতীয় নিজ গুণাবলী নিজ থেকে ধারণ করে না; না এটা ভাবা বিধিসংগত হয়, নিজের গুণাবলী সে নিজে উদ্ভাবন করেছে। যে-বস্তু স্বয়ং বিদ্যমান সে কারও দ্বারা প্রভাবিত হয় না, এমনকি তার নিজের দ্বারাও।
বস্তুগত উপাদান সমূহকে আলোকপ্রাপ্ত জ্ঞান বিতরণের সাহায্যে উচ্চতর মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি একক আলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আলো হচ্ছে অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তা, আদি বা প্রথম কারণ, আল-হায়া, চিরজীবী; আল-কাইয়ুম, নিজ থেকে বিদ্যমান। সুতরাং…আল্লাহ সৃষ্টির কারণ কিন্তু তাঁর নিজেকে ব্যতীত অন্য কিছুর প্রয়োজন তাঁর নেই। যে-কারণে সৃষ্টির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও তিনি সৃষ্টি থেকে পৃথক থাকেন। — উৎস : ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দী বিরচিত হায়াকাল আল–নূর বা The Shape of Light; ভাষান্তর : শায়েখ তোসুন বায়রাক আল–জেরিহ্ আল–হালভেতি, ১৯৯৮; বাংলা তরজমা : লেখককৃত; পিডিএফ সংস্করণ।
জগতের অস্তিত্ব অথবা অনস্তিত্ব অর্থাৎ সকল অবস্থায় ‘মৌল কারণ’-এ বিদ্যমান গুণাবলীর হেরফের বা বিকার ঘটে না। নিখিল নাস্তি ও নিখিল আস্তি উভয় অবস্থায় চলক বা ভ্যারিয়েবল রূপে সে তার বিদ্যমানতা জারি রাখায় তাকে স্রষ্টা মানতেই হয়। প্রচলিত মত অনুসারে মৌলর অকৃত্রিম শর্ত এমনকি বিজ্ঞানেও অনুরূপ, — মৌল প্রকৃতির অধিকারী কোনও কিছু সৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে বিকারগ্রস্ত হয় না। সৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে তার সম্পৃক্তি অথবা সেখানে ক্রিয়াশীল হওয়ার ক্ষণেও তার মৌল বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটা সম্ভব নয়।
আল্লাহর সর্বাবস্থায় জারি থাকা, তাঁর স্বরূপ ও সৃষ্ট জগতের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা মূলধারার ইসলামের সঙ্গে সুফি ও মরমিধারার বিরোধের গণ্য কারণ, যা গাজ্জালির মধ্যস্থতা সত্ত্বেও আজও দূর হয়নি। মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ হয়তো সে-কারণে তখন সমস্যার জন্ম দিয়েছিল। সৃষ্ট জীব রূপে আল্লাহ তাঁকে ধরায় প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর ‘আকল’-এ নফসের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে বোধ অর্জনের ক্ষমতা বা সেইসব কোডিং জানার উপায় বলে দিয়েছেন; এখন হাল্লাজ সে-উপায় ব্যবহার করতে গিয়ে যদি খোদ স্রষ্টার একত্বকে অস্বীকার করে বসেন অথবা আল্লাহর মৌল গুণের সঙ্গে নিজেকে শরিক ভাবার আবেশে ‘তিনি ও আল্লাহ অভিন্ন’ আওয়াজ উঠান, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে সৃষ্টির কারণ রূপে সক্রিয় মৌলগুণের সর্বাবস্থায় অবিকার থাকার সিক্রেট তিনি ধরতে পারেননি এবং নিজের অজান্তে শিরকে পা দিয়ে বসেছেন।
ইসলামে বহুদিন ধরে ফরবিডেন গণ্য মুতাজিলা, যুক্তিছকে মোহাম্মদকে বিতর্কিত করে তোলার কারণে ফিতনা সৃষ্টিকারী এই অভিযোগে যাঁদেরকে সেই সময় দমন করা হয়, আল্লাহর মৌল প্রকৃতির সর্বাবস্থায় ‘এক ও অবিকার’ থাকার কোডিং তাঁরা সম্ভবত ধরতে পেরেছিলেন। লওহে মাহফুজে কোরানের আগে থেকে বিদ্যমান থাকা কিংবা নূর রূপে আল্লাহর আরশে মোহাম্মদের বিরাজ করার ঘটনা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলছিলেন, কেননা মৌল প্রকৃতির সঙ্গে সৃষ্ট বস্তুর সহাবস্থানকে তাঁরা শিরকের দ্যোতক মনে করতেন। মুতাজিলারা অবশ্য এটা খেয়াল করেননি, কোরান কিংবা নূর রূপী মোহাম্মদের সহাবস্থান আল্লাহর সঙ্গে মোটেও ঘটেনি! জ্ঞানবৃক্ষ ও সেখানে ঝুলন্ত ফলগুলো ছিল সেই সিক্রেট যা ইবলিশ হ্যাক ও স্প্যামে পরিণত করার আগে অবধি স্রষ্টা কীভাবে নিজের মৌল প্রকৃতিতে অটল থেকে সৃষ্টিকে নূরতেজল্লির সাহায্যে বিকশিত করার কাজটি সমাধা করতেন সেই আভাস দিতে সক্ষম ছিল। সূরা ‘নূর’-র আয়াতাংশ পুনরায় স্মরণযোগ্য, ‘আল্লাহ আসমান ও পৃথিবীর জ্যোতি/তাঁহার সে-জ্যোতি যেন দীপাধার/যেখানে রহিয়াছে কাচপাত্রে ঢাকা প্রদীপ,/কাচপাত্রটি যেন-বা জ্যোতির্ময় নক্ষত্র/পবিত্র জলপাই বৃক্ষের আলোক দ্বারা প্রজ্বলিত;’ ইত্যাদি।
এইসব হচ্ছে অভিজ্ঞতা যা নবিগণকে ধরায় প্রেরণের সময় ‘সিনা চাক’-এর মতো ঘটনার মাধ্যমে তাঁদের ‘আকল’-এ নির্দিষ্ট কোড সংযোজনে ‘সর্বজ্ঞ’ আল্লাহকে প্রণোদিত করেছিল। ড্যামন বা অশুভ জ্ঞানের প্রতীক ইবলিশ তার নিজেকে স্বয়ংক্রিয় সত্তায় পরিণত করার পর তাকে দমনের জন্য নবিগণকে তাঁদের নিজস্ব আকল’ ব্যবহারের সুযোগ দিতে আল্লাহ কার্পণ্য করেননি, তবে নবিকুলের ‘আকল’ যেন ইবলিশের পালটি কোডিং প্রতিহত করতে পারে সে-জন্য নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত সত্তা রূপে তিনি তাঁদেরকে ধরায় পাঠান। নবিরা হলেন কম্পিউটারের পরিভাষায় ফায়ারওয়াল বা অগ্নিপ্রাচীর; ভাইরাস ও স্প্যাম সৃষ্টিকারী কোডিং এবং ম্যালওয়্যার বা ক্ষতিকারক প্রোগ্রামের সাহায্যে সিস্টেমকে বিগড়ে দেয়ার আকাম ঠেকানো সে-প্রাচীরের কাম। সেক্রেড বা পবিত্র কেডিংয়ের দ্বারা সুরক্ষিত এই ফায়ারওয়াল হ্যাক কিংবা বিকৃত করা ইবলিশ নামক হ্যাকারের ‘আকল’ দ্বারা চালিত কোনও মানবের পক্ষে তাই সম্ভব হয় না।
ইবলিশ কর্তৃক জ্ঞানবৃক্ষের সিক্রেট ফাঁস ও সিস্টেম হ্যাক করার ক্ষমতা সর্বজ্ঞ আল্লাহ কেন তখন বিনষ্ট করেননি? এই প্রশ্নের জবাব কোরান সহ অন্যান্য ঐশী গ্রন্থে পাওয়া যায় না এমন নয়। সেখানে লিপিবদ্ধ উত্তরের সারকথাটি হলো, অবাধ্য ইবলিশ ও তার প্ররোচনায় বিপথগামী জিন ও মানুষের সিস্টেম হ্যাক করার কোডিংকে পালটা কোডিংয়ের সাহায্যে বিনষ্ট করা আল্লাহর জন্য কঠিন ছিল না কিন্তু তিনি তা করেননি; বরং ইবলিশ প্রভাবিত ‘আকল’ দ্বারা চালিত মানুষ সৃষ্টিকে কতদূর বিকৃত ও জ্ঞানবৃক্ষে সঞ্চিত গোপন জ্ঞানকে বিতর্কিত করতে পারে আল্লাহ সেটা পরখ করতে আগ্রহী ছিলেন; অগত্যা তাদের কর্মকাণ্ড চূড়ান্ত ক্ষতিকর অবস্থায় উপনীত না হলে তিনি সেখানে হস্তক্ষেপ সমীচীন মনে করেন না। সৃষ্টিকে আল্লাহ কেন ভালো ও মন্দ তাড়নায় তাড়িত আত্মিক গুণাবলী দিয়ে সৃজন করেন তার কারণ মানবীয় জ্ঞানের পক্ষে তাই বোধগম্য নয়। যেমন বোধগম্য নয় জরা-মৃত্যু ও ক্লেশবিহীন জান্নাতের সরল একরৈখিক কাঠামো থেকে কী হেন কারণে জটিল ও বহুরৈখিক ইহজাগতিক জীবনধারার সূচনা তিনি ঘটান!
জটিল এই ধাঁধার সমাধানে স্রষ্টার পক্ষে-বিপক্ষে মুনিগণ বিচিত্র অভিমত যুগে-যুগে ব্যক্ত করেছেন বা এখনও করে থাকেন। এইসব মতামতের সিংহভাগ স্রষ্টার সর্বজ্ঞতাকে অনির্ণেয় ও সে-কারণে বৈধ অথবা তাঁর সৃষ্টি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে তিনি অবৈধ ইত্যাদি প্রমাণে নিজের শক্তি খরচ করে থাকে। গৎবাঁধা ছকের বাইরে ভাবতে পারেন তেমন মানুর দেখা পাওয়া ভার হলেও পর্তুগাল নিবাসী লেখক ফার্নান্দো পেসোয়াকে সম্ভবত ব্যতিক্রম মানতে হয়। নিজের স্বকীয় আত্ম-যাপনের দিনলিপি ‘The Book of Disquiet’-এ ব্যক্ত ভাবনা আগ্রহ-উদ্দীপক মনে হওয়ায় তার সারকথাটি এখানে উল্লেখ করা আশা করি অসংগত হবে না :—
রেনে দেকার্তের মতো ফার্নান্দো পেসোয়াও বস্তুজগতকে ঘড়ির উপমায় চিন্তা করেছেন এবং সেই ঘড়ির নির্মাতা সৃষ্ট বস্তুর প্রাণ রূপে তাঁর চেতনায় ধরা দিয়েছিল। সৃষ্ট জগতে ইভিল ফোর্স বা অশুভশক্তির সক্রিয় উপস্থিতির কারণে পীড়াদায়ক ঘটনার অন্ত নেই বলে তাঁকে সদাশয়, করুণাময় ও বিবেচক বলে বিশ্বাস যাওয়া অনেকের কাছে দুরূহ ঠেকে। বহু মুনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন ত্রুটিপূর্ণ ঘড়ি নির্মাণের কারণে স্রষ্টাকে নিখুঁত ও স্বয়ংস্বসম্পূর্ণ ভাবার চান্স নেই, সুতরাং স্রষ্টা রূপে তাঁর অনন্যতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে বিবেচিত হতে পারে না। পেসোয়া এখানে আপত্তি ঠুকেছেন। তাঁর মতে জগৎ-সংসারে মন্দ বা অশুভ ঘটনার উপস্থিতি এক কথা আর কী হেন পরিকল্পনার ফলে মানবজীবনে অশুভ ঘটনা সংঘটনে পারঙ্গম শক্তির ভূমিকা প্রবল হয় সেটা পৃথক বিষয়। ঘড়িনির্মাতা স্রষ্টা যদি মানুষের জীবনে শুভ ও ভালো ফলাফল বহন করে এমন ঘটনার পরিকল্পনা করে থাকেন সেক্ষেত্রে মন্দ বা অশুভ ফলাফল বহনকারী ঘটনা তাঁর পরিকল্পনা বহিভূর্ত ছিল এমনটি ভাবা যুক্তিসংগত হয় না।
জগতে সকল ঘটনার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ ও যুক্তির অস্তিত্ব যদি থেকেই থাকে সেক্ষেত্রে অশুভর উপস্থিতিকে অনুমোদন দানের পেছনে স্রষ্টার নিজস্ব কারণ বা যুক্তি থাকতে পারে। মানুষের বোধ ও উপলব্ধিতে সে-যুক্তি দুর্বোধ্য হওয়ার অর্থ এই হতে পারে না ঘড়িনির্মাতা স্রষ্টা কোনও প্রকার সচেতন পরিকল্পনা ছাড়া অশুভকে ধরায় পারমিট করেছিলেন। ‘স্রষ্টা বা ইশ্বর হলেন পশুসুলভ জান্তব প্রবৃত্তির আত্মা স্বরূপ’ — ফরাসি এই প্রবাদবাক্য যদি সত্যি হয় তবে এটাও মিথ্যা নয়, ‘সমুদয় সৃষ্টির আত্মা স্বয়ং ঈশ্বর’ ব্যতীত অন্য কেউ হতে পারে না!
এমন হওয়া অসম্ভব নয় স্রষ্টা মানুষকে ত্রুটিপূর্ণ করে ধরায় প্রেরণ করেছিলেন যেন বহুরৈখিক ছকে সংগঠিত পার্থিব জীবনের জটিলতা ও ভ্রান্তি উপলব্ধির পর সরলরৈখিক কাঠামোয় গঠিত জান্নাতের মহার্ঘতা সে তার চেতনায় উপলব্ধি করতে পারে। মানুষকে ত্রুটিপূর্ণ ও সারল্যের পরিপন্থী গণ্যকারী পেসোয়া তাই উক্তি করতে দ্বিধা রাখেননি, ‘The existence of evil cannot be denied, but one can deny that the existence of evil is evil. I admit that the problem persists, but only because our imperfection persists.’ — Source: Fragments of an Autobiography: The Book of Disquiet by Fernando Pessoa, Edited and translated by Richard Zenith, Penguin Books, 2001; PDF Edition.
মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতার কারণে স্রষ্টার পরিকল্পনা সম্পর্কে শেষকথা বলা অথবা মানুষ রূপে ধরায় পাঠানোর পর নবিগণের ‘আকল’ সংশোধনীর ঘটনা তিনি কেন ঘটান সে-প্রহেলিকার কিনারা করা তাই কঠিন হয়। এর একটি কারণ এই হতে পারে, নফসের স্তর বিবেচনায় নবিগণ কী কারণে সর্বোচ্চ স্তরে বিরাজ করেন মানবজাতির সম্মুখে তার উদাহরণ পেশ করার প্রয়োজনে তিনি তাঁদের ‘আকল’-এ সংশোধনী ঘটান। জীবদ্দশায় যেমন একাধিকবার মোহাম্মদের ‘আকল’-এ সঞ্চিত কোডিং আপডেট করা হয়েছিল! ইসলামের ইতিহাসে এই ঘটনা ‘সিনা চাক’ বা বক্ষ বিদারণ নামে পরে সমাদৃত হয়। সৌভাগ্যের রজনীতে আল্লাহর সঙ্গে মোহাম্মদের সাক্ষাৎ অথবা সুফি মত অনুসারে মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহর আরশে ঊর্ধ্বারোহনের ক্ষণে ঘটনাটি চূড়ান্ত পরিণতি পায়। মূলধারার ইসলামতাত্ত্বিকরা অধুনা এই ঘটনাকে মোহাম্মদের ‘আকল’ বা ‘বোধি’র সম্প্রসারণ আখ্যা দিয়ে থাকেন। যদিও নবির আদি জীবনী লেখকদের একজন ইবনে হিশামের বিবরণে ‘সিনা চাক’ মুজেযা বা অলৌকিক ঘটনার স্মারক হয়েই আসে! ব্যাখ্যার এই পরিবর্তন ইঙ্গিত করে সময়ের সঙ্গে মানুষের বোধ যেমন পরিণত হয় আল্লাহর নেপথ্য পরিকল্পনা সম্পর্কিত অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যায় রদবদল ঘটে। ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞান যে-কারণে ‘সিনা চাক’র বস্তুগত ভিত্তিকে নবির ‘আকল’ বা বোধের সম্প্রসারণ এবং আমজনতার জন্য আল্লাহ উপাসনার বিধি-বিধান সুনির্দিষ্ট করার ঘটনা রূপে ব্যাখ্যা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যদিও সত্যিকার কারণ কী ছিল সে-বিষয়ে খোদ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষে নিশ্চিত হওয়া দুরূহ।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় নবি মোহাম্মদের ‘আকল’ যাতে সালাত কায়েম সহ আল্লাহর একত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এবং ইবলিশ যেন কোনওভাবে সেখানে তাঁকে বিভ্রান্ত না করে সে-জন্য ‘সিনা চাক’ প্রোগ্রামিংয়ের সাহায্যে তাঁর ‘আকল’-এ নতুন কোডিং সংযোজন করা হয়েছিল এবং ‘মিরাজ’র রজনীতে আল্লাহ সেই কোডিংয়ে ফিনিশিং টানেন। অতঃপর ‘মিরাজ’ থেকে প্রাপ্ত কোডিং ইসলামের মৌল ভিত্তি রূপে জগতে প্রচার লাভ করতে থাকে :—
‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁহার বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করাইয়াছিলেন আল-মসজিদুল হারাম হইতে আল-মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যাহার পরিবেশ আমি করিয়াছিলাম বরকতময়, তাহাকে আমার নিদর্শন দেখাইবার জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ — বনি ইসরাইল/ইসরা ১৭:১;
‘তাহাকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী,
প্রজ্ঞাসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে স্থির হইয়াছিল,
তখন সে ঊর্ধ্বদিগন্তে,
অতঃপর সে তাহার নিকটবর্তী হইল, অতি নিকটবর্তী,
ফলে তাহাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রহিল অথবা উহারও কম।
তখন আল্লাহ তাঁহার বান্দার প্রতি যাহা ওহি করিবার তাহা ওহি করিলেন।’ — আন-নাজম ৫৩:৫-১০;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
কোডিংয়ে সংশোধনী আনয়নের মাধ্যমে আল্লাহ হয়তো নবিকে তাঁর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি রূপে ধরায় প্রেরণ করেন যে কিনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গমনকারী ইবলিশের সিস্টেম হ্যাকের ক্ষমতা প্রতিহত করার শক্তি রাখে এবং বিভ্রান্ত মানব সম্প্রদায়কে গাইড করতে পারে। সে-কারণে কোরানে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে বিচ্ছুরিত বাক্যবাণ সেইসব স্লেজিংয়ের অংশ হয়ে আসে যার মাধ্যমে তাদের ‘আকল’কে মোহাম্মদ Garbled বা বিকৃত করেন। সমর-প্রস্তুতির ক্ষণে ইসলামের নবি নিজেকে তাই স্লেজিংয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। কোরানে ‘চুক্তি, বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী’ অভিধার পৌনঃপুনিক প্রয়োগের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ‘কাফের, মুশরিক, মুনাফিক’ শিরোনামে দাগানোর প্রবণতা অন্য ধর্মাবলম্বী ও কট্টরপন্থী ইসলাম-সমালোচকের কাছে পীড়াদায়ক গণ্য হলেও মোহাম্মদের জীবনে স্লেজিংগুলোর প্রাসঙ্গিকতা অশেষ ছিল। সেইসঙ্গে প্রতি পদে নিজেকে আল্লাহর মুখাপেক্ষী দাবি করায় লোকের মনে এই বিশ্বাস তিনি জাগিয়ে তুলতে সফলকাম হয়েছিলেন, তাঁর কাছে প্রেরিত ওহির সর্বস্বত্ব স্বয়ং সেই প্রোগ্রামারের নিকট সংরক্ষিত যিনি চিরকাল ধরে বিদ্যমান রয়েছেন এবং কেয়ামতের পর তাঁর অভিমুখে সকলের পুনরুত্থান ঘটানো হবে।
‘পুনরুত্থান’ ও ‘শেষবিচার’ ইঙ্গিত করে আল্লাহর সিম্যুলেশন বা অনুরূপতা সম্ভব নয়। তিনি সৃষ্টির অতীত এক স্বয়ংক্রিয়তায় বিরাজমান। তাঁর এই স্বয়ংক্রিয়তার সঙ্গে ‘দুজাহান’ বলতে লোকে যেমন বুঝে অর্থাৎ ইহজাগতিক ও পরজাগতিক ঘটনাপ্রবাহে নিহিত স্বয়ংক্রিয়তার মৌল পার্থক্য রয়েছে। ইহজাগতিক ঘটনার অংশ হয়ে জীবের ধরায় আগমন, সেখানে যাপন ও প্রস্থান অথবা মৃত্যুর পর অজানা পরজগতে তার আত্মার অবস্থান ইত্যাদি ঘটনায় দৃষ্ট স্বয়ংক্রিয়তা আর আল্লাহর অটোম্যাটন বা স্বয়ংক্রিয়তা এক বস্তু নয়। দুজাহানের স্রষ্টা হওয়ার ফলে তাঁর স্বয়ংক্রিয়তা অ-সৃষ্ট ও মৌলিক, পক্ষান্তরে দুজাহানে জন্ম-মৃত্যু-পুনরুত্থানের মতো ঘটনা স্বয়ংক্রিয় মনে হলেও স্বয়ং স্রষ্টা কর্তৃক পরিকল্পিত ও সৃষ্ট হওয়ার কারণে তারা মৌলিক নয়। সোজা কথা আল্লার অটোম্যাটন অ-সৃষ্ট ও অজ্ঞাত, এর বিপরীতে জাহান কেন্দ্রিক বিন্যাসে অটোম্যাটনের লক্ষণযুক্ত সকল ঘটনা পরিকল্পিত ও সৃষ্ট।
বিশ্বাস বা অবিশ্বাস পৃথক আলোচনার বিষয় তবে ইসলামি থিওলজির বিচারে এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন, স্রষ্টার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশেষ গুণের অধিকারী নবি, সমগ্র মানব সম্প্রদায় ও অন্যান্য প্রজাতি ইহজগতে গমন করে এবং মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। অনুরূপ পরিকল্পনার ছকে ফেরেশতা-জিন-হুর-গেলমান থেকে শুরু করে রোজ কেয়ামত, পুলসিরাত, রুহের পুনরুত্থান, শেষবিচার এবং বেহেশত ও দোজখে আত্মার অবস্থান গ্রহণ ইত্যকায় ঘটনাবলী দিয়ে পরজগৎটি সাজানো। ইহজগৎ অর্থাৎ ধরায় গমনের পর মানব প্রজাতি ও অন্যান্য জীবের জৈবিক গঠনকাঠামোয় বিন্যস্ত কলকব্জাসহ তাদের ‘আকল’ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়, যেন তারা অভিযোজনের সাহায্যে সেখানকার পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। ধরায় সক্রিয় প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে না পেরে অনেক সময় প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে এবং নতুন প্রজাতির আর্বিভাব কিংবা পুরোনো প্রজাতির নানান প্রকারভেদ সেখানে অবশ্যম্ভাবী হয় ইত্যাদি। ইহজাগতিক এইসব ঘটনাছকের বিন্যাস এবং স্বয়ংক্রিয়তার ধরন থেকে বোঝা যায় দুজাহান সৃষ্টিতে আল্লাহ মৌল কোনও উপাদান এমন কৌশলে ব্যবহার করেন যেন ইহজগৎ ও পরজগতে সৃষ্ট প্রজাতির মধ্যে বহু ব্যাপারে সাদৃশ্য থাকলেও পরস্পর থেকে তারা শেষ পর্যন্ত পৃথকই থাকে।
জিন, ফেরেশতা ও হুর সৃজনে ব্যবহৃত উপাদানের সঙ্গে ‘আদম’সহ অন্যান্য প্রজাতি সৃষ্টিতে ব্যবহৃত উপাদানের গুণগত ফারাক থাকলেও তারা মৌল কোনও উপাদানের অংশ ছিল বলেই মনে হয়। মানব প্রজাতি সৃজনে আদি মানব আদমকে অ-যৌন পদ্ধতিতে আকার দান করা হয়েছিল। আদমের দেহে সক্রিয় স্বয়ংক্রিয়তার উপকরণ ব্যবহার করে আল্লাহ অতঃপর হাওয়ার জন্ম দান করেন। সৃষ্টির ধারাকে স্বয়ংক্রিয়তা দানের প্রয়োজনে অ-যৌন পদ্ধতিতে সৃষ্ট আদি মানবজোড়ে ‘আকল’র সংযুক্তি (*যদিও সে-আকল ঘটনার রঙ্গমঞ্চে ইবলিশের প্রবেশ ঘটার আগে অবধি সচেতনাবিহীন ছিল।) ও যৌনকর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাটি রাখা হয়েছিল। মানব জাতির সৃষ্টি-প্রক্রিয়া এবং তাকে সুনির্দিষ্ট জৈবিক ঘটনাছকে (আহার-শয়ন-রেচন ও যৌনমিলন) স্বয়ংক্রিয়তা প্রদানে আল্লাহ তাঁর প্রয়োজন অনুসারে অন্যান্য প্রজাতিতে সক্রিয় নানা উপাদান সীমারেখা বজায় রেখে ব্যবহার করেছিলেন। এই সীমারেখার কারণে বিজ্ঞানের বিচারে মানুষ পশু প্রজাতির অংশ স্বীকৃত হলেও ইসলামের বিবেচনায় পশুসুলভ বৈশিষ্ট্য ধারণ সত্ত্বেও মানুষ ‘হায়াওয়ান’ নয় বরং সে হচ্ছে ‘ইনসান’। সম্পূর্ণ পৃথক এক প্রজাতি, যাকে সৃষ্টির সেরা জীব বলে সকলে স্বীকার যান।
প্রজাতি হিসেবে মানুষের এই পৃথকত্ব নিয়ে মতান্তরের অন্ত নেই। মানুষ ভিনগ্রহ থেকে আগত কোনও জীব কি না এ-নিয়ে পশ্চিমে কিছু দিন পরপর শোরগোল ওঠে। ড. এ্যালিস সিলভার যেমন সম্প্রতি তোলপাড় তুলেছেন এই মত ঠুকে দিয়ে, মানুষ আদৌ পৃথিবীর জীব নয় বরং ভিন্ন গ্রহ থেকে উন্নত প্রজাতি রূপে তাকে এখানে নির্বাসিত করা হয়েছিল। এ্যালিসের বই বাজারে দেদার কাটছে বিধায় দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তাঁর মতামত নিয়ে প্রতিবেদন সহজেই চোখে পড়ে। মূল বইয়ে যে-দাবিগুলো তিনি করেছেন তার সারকথা ব্রিটেনের ‘ডেইলি মেইল’ সহ অনেকেই প্রতিবেদন আকারে ছেপেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে মোটামুটি একে অন্যের প্রতিধ্বনি বলা চলে, যার মোদ্দা কথা হচ্ছে এ্যালিস নাকি মনে করেন মানুষের পৃথিবীতে আগমন ও বসতি স্থাপন সম্ভবত তাদের নিজ ইচ্ছায় ঘটেনি। তাদের জন্য এটা ছিল কারাগার (Galactic Jail), যেখানে শাস্তি ভোগ করার জন্য কয়েক লক্ষ বছর আগে তাদেরকে নির্বাসিত হতে হয়। কে বা কারা নির্বাসিত করে সেটা অস্পষ্ট। হতে পারে মানুষের নির্বাসিত প্রজাতির আদি বাসস্থান সূর্যের নিকটবর্তী উজ্জ্বল তারকামণ্ডলি বা ‘আলফা সেন্টরাই’র আশেপাশের কোনও গ্রহে ছিল এবং সেখান থেকে তাদেরকে পৃথিবীতে ট্রান্সমিট করা হয়। এই অদ্ভুত দাবির সপক্ষে এ্যালিস কিছু যুক্তিও তাঁর বইয়ে তুলে ধরেছেন, ‘ডেইলি মেইল’ প্রতিবেদক যুক্তিগুলোকে যেভাবে তুলে এনেছেন তা এই সুযোগে স্মরণ করা যেতে পারে :—
মানুষকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব ভাবা হলেও এখানে তার বিবর্তন বিবেচনায় নিলে তাকে বরং খাপছাড়া ও অদ্ভুত মানতে হয়! পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশের সঙ্গে তার অভিযোজনের ইতিহাস সুখকর নয়। ওটা সবসময় ক্লেশদায়ক ছিল, যা অন্য প্রজাতির ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
ব্যাকপেইন ছাড়াও একাধিক ক্রনিক ডিজিজ মানুষকে ভোগায়। অন্যান্য প্রজাতিতে এই বিমারগুলো দৃষ্ট হয় না। নিম্ন-মাধ্যাকর্ষণে (Lower Gravitation) বিবর্তিত প্রাণী ছাড়া এহেন দৈহিক সমস্যা কারও থাকার কথাও নয়। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, মাধ্যাকর্ষণ কম এরকম কোনও গ্রহে থেকে আগত হওয়ার ফলে মানুষ তার হাঁটাচলা ও দৈহিক কাজকর্ম দ্রুততা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সম্পাদনের সুবিধা ভোগ করে না, যা অন্য প্রজাতির ক্ষেত্রে সহজাত, কারণ তারা সকলে পৃথিবীর উচ্চ মাধ্যাকর্ষণে জন্মের পর থেকে অভিযোজিত ও অভ্যস্ত।
মানুষের সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া বাকি প্রজাতির সঙ্গে খাপ খায় না। গর্ভে সন্তান ধারণের পরিসর শিশুর দৈহিক আয়তন ও মাথার গঠন বিবেচনায় সংকীর্ণ, যার ফলে সন্তান প্রসবে মাকে অশেষ কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এই অদ্ভুত পরিসর-বিন্যাস পৃথিবীর অন্য কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীর গঠনে দেখা যায় না।
সূর্যের কড়া আলোয় অন্য প্রাণীরা ইচ্ছেমতো হুটোপুটি খেয়ে বেড়ায়। মানুষ এটা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না অথবা দীর্ঘসময় রোদ পোহানোর ক্ষমতা তার নেই। এর থেকে সন্দেহ প্রবল হয় মানুষ অপেক্ষাকৃত মৃদু সূর্যালোক বিদ্যমান এরকম পরিবেশে জন্ম নিয়েছিল ও সেখানে বিবর্তিত হয়েছিল।
নিদ্রা নিয়ে যারা মাথা ঘামান তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে মানুষের জৈব বা দেহঘড়ি (Biology Clock) পঁচিশ ঘণ্টার ছকে দেহে কাজ করে যায়, সেখানে আমরা দিনের দৈর্ঘ্য মাপি চব্বিশ ঘণ্টায়। দেহঘড়ির সঙ্গে এই ভিন্নতা নানা রোগব্যাধির অন্যতম কারণ; পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার যে শতভাগ সুস্থ বলে নিজেকে দাবি করতে পারে।
ড. এ্যালিস সিলভার আরও কী কী বলেছেন সেটা মূল বই পাঠ না যাওয়া অবধি বলা মুশকিল। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন আর ইউটিউবে এ-সম্পর্কিত বাতচিত ঘাঁটলে বোঝা যায় তাঁর বাজারকাটতি বইটি এ্যালিয়েন তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন বটে। বিজ্ঞানীমহল এ্যালিসের যুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে সরগরম হলেও তাঁর যুক্তিবিন্যাস নিছক ফেলনা নয় সেটা মানতে হয়। পশু প্রজাতির সদস্য হলেও পৃথিবীতে মানুষের ‘আকল’-এর বিকাশ ও অগ্রগতি অন্য প্রজাতির সাপেক্ষে খাপছাড়া ঘটনাই বটে। জিনগত সাদৃশ্যের বিচারে মানুষের সঙ্গে বানরসহ একাধিক প্রজাতির নিবিড় মিল চোখে পড়ে, যদিও উভয়ের ‘আকল’গত তফাত যে-পার্থক্য সেখানে সৃষ্টি করেছে তার ছাপ তাদের বেঁচে থাকার পরতে-পরতে ধরা পড়ে। ‘আকল’র উৎকর্ষ ও অগ্রগতির আকাশ-পাতাল তফাত কেন ঘটে তার বিবর্তন সম্মত ব্যাখ্যা যদিও বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন তথাপি ঘটনাটিকে স্বাভাবিক বলে একিন যাওয়া দুরূহ ঠেকে। সূত্র যেনে মিলেও মিলতে চায় না! অন্যদিকে দৈহিক সক্ষমতা যেমন স্পর্শ-গন্ধ-শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির বিচারে অন্য প্রজাতির তুলনায় মানুষ শুরু থেকে হাজার মাইল পেছনে পড়ে রয়েছে। শারীরিক ক্ষিপ্রতার দিক দিয়েও বাকিদের তুলনায় সে পিছিয়ে। আবার তার হিংস্র ও নৃশংস কাণ্ডগুলো পৃথিবীতে বিদ্যমান পরিবেশের সাপেক্ষে অস্বাভাবিক বলে স্বীকার যেতে হয়। ফলে কেউ যদি বিজ্ঞানের প্রচল স্বীকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে মানব প্রজাতিকে পৃথক সৃষ্টি বলে ভাবেন তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
সে যা হোক, কোরানে অ-যৌন প্রক্রিয়ায় আদম ও হাওয়ার সৃজন-প্রক্রিয়া অন্যভাবে এককোষী প্রাণীর গঠন ও বিবর্তনকে স্মরণ করায়। আদি মানবজোড় সৃষ্টির উৎস হয়তো এককোষী জীবের জন্মগ্রহণ ও বিবর্তনে সংগুপ্ত ছিল! এককোষী থেকে বহুকোষী জীবের বিকাশ ধরায় প্রাণবৈচিত্র্য ঘটালেও স্মরণ রাখতে হচ্ছে এতে সৃষ্টির মৌল নিয়মে পরিবর্তন ঘটেনি, One to many বা এককোষী থেকে বহুকোষীর ছকে বৈচিত্র্য সাধিত হয়েছে কেবল! থিওলজির পরিভাষায় উদ্ভিদ ও জীবদেহে বিদ্যমান জিনের গঠন তাদের অভিযোজনের প্রকৃতি অনুসারে বিচিত্রগামী হলেও সরল এককোষীকে আদ্য বা চিরজীবী মানতে হয়, যাকে ছাড়া বহুকোষীর বিকাশ সম্ভব ছিল না! এককোষীকে তাই স্রষ্টা নামক অটোম্যাটন কর্তৃক সৃষ্ট আদি রূপ বলা চলে। স্বয়ংক্রিয়তার গুণ দিয়ে তাকে সৃজন করা হয়েছে, যেন সে এক থেকে একাধিকে নিজেকে বিবর্তিত করতে পারে। মাটির আদম থেকে হাওয়ার জন্ম আদতে হয়তো কোষ বিভাজনের সেরকম কোনও খেলা হলেও হতে পারে! জীবনের এই জৈবিক বিকাশ বিখ্যাত ইংরেজ গণিতবিদ জন হর্টন কনওয়ে’র কম্পিউটারে সৃষ্ট সেলুলার অটোম্যাটন বা জীবনখেলার স্মৃতি মনে জাগ্রত করে বৈকি!
ধীমান এই গণিতবিদ কিছুদিন আগে দেহ রেখেছেন। কোভিডঝড়ে যুক্তরাজ্য লণ্ডভণ্ড হওয়ার দিনগুলোয় তিনি এর কবলে পড়েন এবং পরে আর বেঁচে ফিরতে পারেননি। বিজ্ঞানে কনওয়ের আবদান নিয়ে ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর প্রতিবেদনের কথা স্মরণ করতে হয়! মৃত্যুর কয়েক বছর আগে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে ‘গার্ডিয়ান’ তাঁকে সমকালের অন্যতম অগ্রগণ্য ‘কবি, বোদ্ধা, শিল্পী ও চিন্তক’ রূপে কুর্নিশ জানাতে দ্বিধা করেনি। কনওয়ে জীবনে কবিতা লিখেছেন বলে জানা নেই তবে তাঁর উদ্ভাবিত সেলুলার অটোম্যাটন অর্থাৎ দেহে কোষ তৈরি ও ধ্বংস হওয়ার খেলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কম্পিউটার প্রোগ্রাম ‘জীবনখেলা’ (Game of life) এই কবিতার খেই ধরতে সাহায্য করে, যেখানে তিনি প্রমাণ করেছিলেন মহাজগতে প্রাণের খেলা কীভাবে কোনও খেলোয়াড় ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় নিয়মে ঘটতে থাকে। তাঁর উদ্ভাবিত খেলার গণিতছকে দেহে সক্রিয় কোষ নিজের প্রতিবেশী কোষের সঙ্গে মিলিত হয়ে বেঁচে থাকে অথবা প্রতিবেশীর সংস্পর্শে আসার কারণে মারা যায় কিংবা নতুন জীবন খুঁজে নিতে অসীমে হারায়। সে-খেলায় একটি জীবিত কোষের বাঁচামরা নির্ভর করে তার প্রতিবেশী জীবিত কোষের ওপর, কনওয়ের ব্যাখ্যায় যা ছিল এ-রকম :—
নিঃসঙ্গ জীবিত কোষ যদি দুই থেকে তিনটি জীবিত কোষকে প্রতিবেশী রূপে কাছে পায় তবে তাদের মিলন থেকে নতুন কোষ দেহে জন্ম নেয়। জীবিত কোষ যদি দুইয়ের কম (১ অথবা ০) কোষকে প্রতিবেশী হিসেবে পায় তবে জনসংখ্যায় ঘাটতি (Under Population) থাকার কারণে তাকে মরতে হয়। প্রতিবেশীর সংখ্যা তিনের বেশি হলে অধিক জনসংখ্যার (Over Population) চাপে সে মারা যায়। এবং, মৃত কোনও কোষ যদি তিনটি জীবিত কোষকে নিকটে পায় তবে মৃতসঞ্জীবনীর পরশে সে বেঁচে ওঠে ও নতুন জীবন ফিরে পায়।
বাঁচামরার এই খেলা কে নির্ধারণ করে সে-প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা কনওয়ে করেননি। খেলাটি তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন এটা প্রমাণ করতে, ধরায় সচল জীবদেহে প্রতিটি কোষ একইসঙ্গে নিঃসঙ্গ ও সঙ্গলিপ্সু। তারা স্বতন্ত্র হলেও সমবায়ী বটে! নিঃসঙ্গ অবস্থায় যেসব মৌল গুণ একটি কোষ তার নিজের ভিতরে বহন করে অন্য আরেকটি নিঃসঙ্গ কোষের সঙ্গে সংযোগ ঘটার কারণে তারা তখন যৌগিক হয় এবং নতুন প্রজাতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। দেহকোষের পারস্পরিক সম্পর্কের এই সুতো বিবর্তনের ধারায় স্বয়ংক্রিয়তা লাভ করায় জগৎকে কম্পিউটারে লিখিত প্রোগ্রামের ন্যায় ছকবাঁধা মনে হয়। এ যেন স্রষ্টা-বহিভূর্ত তথাপি স্বয়ংক্রিয় নিয়মে সচল যন্ত্র যে কিনা তার নিজেকে পরিচালনার শর্ত নিজেই ঠিক করে নিতে সক্ষম। কম্পিউটার সিম্যুলেশন তত্ত্বে জগৎ তাই অটোম্যাটন বা নিজ থেকে সক্রিয় ও প্রোগ্রামড্। এই তত্ত্ব-প্রণেতারা সিম্যুলেশনের পরিকল্পনাকারী বা সিম্যুলেটরকে স্বয়ংক্রিয়তার উপমায় ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা মনে করেন কম্পিউটারে সৃষ্ট প্রোগ্রাম যেভাবে কাজ করে যায় বস্তুজগতে জন্ম-মৃত্যুর খেলাও সেভাবে স্রষ্টার প্রয়োজন ব্যতীত ক্রিয়াশীল থাকে।
…
চিত্র–৬ : Digesting Duck by Jacques de Vaucanson; Replica of the original; Image Source: I. Wikipedia; II. Watches, Automatons, ‘Soul,’ And The Digesting Duck Of Jacques de Vaucanson by Jack Forster; hodinkee.com;
…
জগৎ হচ্ছে অষ্টাদশ শতকের ফরাসি উদ্ভাবক ও চিত্রশিল্পী জ্যাকুয়াস ডি ভোক্যানসনের ডিজাইন করা (Digesting Duck) যান্ত্রিক হংসের অনুরূপ। যান্ত্রিক উপায়ে সৃষ্ট সেই হংস শস্যদানা ভক্ষণ, পরিপাক ও রেচনে সক্ষম ছিল। কোনও কারণে খাদ্য পরিপাক না হলে তার দেহের ভিতরে একটি চেম্বারে গিয়ে সেটা জমা হতো। হংসটি অবশ্য সতি-সত্যি খাদ্য পরিপাক করতে পারঙ্গম ছিল বলে মনে হয় না। উইকিপিডিয়ার তথ্য মোতাবেক এটা ছিল ভোক্যানসনের চালাকি। তিনি দুটি চেম্বার তৈরি করেছিলেন, প্রথমটিতে খাদ্য মাড়াই হতো আর দ্বিতীয়টিতে আগে থেকে তৈরি মল তিনি রেখে দিতেন। চালাকি হলেও এহেন অটোম্যাটন সৃষ্টির ভাবনাটি মৌলিক ছিল। ভোক্যানসনের উদ্ভাবন প্রাণ ও আত্মা সম্পন্ন হংস সৃষ্টি করতে না পারলেও তাঁকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সংবেদনের অধিকারী যন্ত্র (Artificially Intelligent Machine) তৈরি নিয়ে যাঁরা এখন ভাবছেন তাঁদের আদি প্রতিধ্বনি বলা চলে। সেকালে এহেন হংসের কথা তিনি ভেবেছিলেন এটা বোঝানোর জন্য যে দূর ভবিষ্যতে মানুষ তার নিজ উদ্ভাবনী শক্তির সাহায্যে জগতে বিদ্যমান সকল প্রাণকে যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি করে নিতে সক্ষম হবে এবং প্রাকৃতিক বা জৈবিক উপায়ে সৃষ্ট প্রাণের ওপর তাকে আর নির্ভর করতে হবে না। ভোলতেয়ার সে-কারণে উক্তি করেছিলে, ‘ভ্যোক্যানসনের এই হংস ব্যতীত আমাদের আর কিছুই থাকবে না যা ফ্রান্সের গৌরবগাথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।’
থিওলজির সঙ্গে এহেন ভাবনার তফাত হলো ভোক্যানসনের স্বয়ংক্রিয় হংসের ন্যায় পরিপাক ও রেচনে সক্ষম জাহানের নিজ থেকে সক্রিয় থাকার ঘটনায় একজন সিম্যুলেটর বা পরিকল্পনাকারীর কথা ভাবা হয়েছে। এই সিম্যুলেটর গ্রোগ্রামের ছক ঠিক করে দিয়েছেন এবং সেটা যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে যেতে পারে সেই ব্যবস্থাটি সেখানে রাখা হয়েছে। অগত্যা সিম্যুলেটরকে উপলব্ধি করতে না পারলে জগৎ কী করে অনুরূপতার মধ্য দিয় স্বয়ংক্রিয় থাকে সেটা ঠাহর হয় না। দেকার্তে যেমন ডাচ দেশের রানিকে তামাম জাহান কেমন করে যান্ত্রিক নিয়মে কাজ করে যায় সেটা বোঝানোর খাতিরে ঘড়ির উপমা টেনেছিলেন এবং ঘড়ির নিয়ন্ত্রক কে এই প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হেসে ‘হলি স্পিরিট’ বলে মামলা সেখানেই ডিসমিস করেছিলেন। দেকার্তের সঙ্গে এখানে কোরানের বিশেষ ভিন্নতা নেই। সিম্যুলেটরের মামলা তামাদি করতে কোরান বায়বীয়তায় বিদ্যমান অটোম্যাটনের দিকে ইশারা উঠায়। তাঁর স্বরূপ অজানা হলেও তিনি হচ্ছেন সেই প্রোগ্রামার যিনি নিজের প্রতিবন্ধকতাহীন স্বয়ংক্রিয়তার (Uninterrupted automaton) অনুপাতে জগৎকে নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয়তায় (Controlled Automaton) বেঁধে রেখেছেন। সাত আসমানের ওপরে বিচরণের ক্ষণে দুজাহানকে তিনি অবিরত নতুন কোডিংয়ে সচল রাখেন :—
‘ভূপৃষ্ঠে যাহা কিছু আছে সমস্তই নশ্বর,’…‘অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের সত্তা, যিনি মহিমাময়, মহানুভব;’ — রহমান ৫৫:২৬-২৭;
‘এবং সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলিয়া যায়। সে বলে, ‘কে অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করিবে যখন উহা পচিয়া গলিয়া যাইবে?’
‘বলো, ‘উহার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করিবেন তিনিই যিনি ইহা প্রথমবার সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’
‘যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন তিনি কি তাহাদের অনুরূপ সৃষ্টি করিতে সমর্থ নন? হাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ।’…
‘তাঁহার ব্যাপার শুধু এই, তিনি যখন কোনও কিছুর ইচ্ছা করেন, তিনি উহাকে বলেন, ‘হও’, ফলে উহা হইয়া যায়।’ — ইয়াসিন ৩৬:৭৮-৭৯, ৮১-৮২;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
কোরান এভাবে ব্যাখ্যা ব্যতিরেক সেই জ্ঞানের জনক হয় যা দৃশ্যত অগভীর, কিন্তু অগভীর এই জ্ঞান যখন ‘কুন ফাইয়া কুন’-এ বন্দি স্বয়ংক্রিয়তায় জগৎ সৃষ্টির সিগন্যাল দিতে থাকে তখন শাব্দিক এইসব চিহ্ন নিছক মেটাফর বা কিসসা-কাহিনির অংশ থাকে না, তারা জ্ঞানের অংশে পরিণত হয় এবং কোরানকে প্রাসঙ্গিক টেক্সট করে তোলে। যে-কারণে কোরানে সঞ্চিত শাব্দিক চিহ্ন সমূহের গভীরতা সম্পর্কে মোহাম্মদের কাছে উত্তর জানতে চেয়ে লাভ নেই, যেহেতু জ্ঞানার্জনের যত উৎস সেখানে সংকলিত হয়েছে সেটার মালিকানা দৃশ্যত তাঁর নিজের নয়; এই মালিকানা সেই পরম অজ্ঞেয় সত্তার যিনি তাঁর নিজেকে ব্যক্ত করার অসমাপ্ত কর্মটি নবিত্বের কুলুজিতে অপাঙক্তেয় আরবকে দিয়ে সমাধা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
মোহাম্মদের ‘অজ্ঞতা’ বা তাঁর ঘটনাবহুল জীবন কোরানের ভিত্তি হলেও প্রকৃতপক্ষে কোরান সেই গ্রন্থ যা জ্ঞানবাহক নবি বা উত্তম মানবাত্মার অধিকারী মানবের পরিবর্তে জ্ঞানের অজ্ঞেয় উৎসের দিকে ফিরে তাকাতে বলে। অজ্ঞেয় সেই উৎস নিজের স্বয়ংক্রিয়ভাবে জারি থাকার চাবি গন্দমবৃক্ষের ডালে ঝুলন্ত ফলে গচ্ছিত রেখেছিলেন এবং দুর্ঘটনাবশত তাঁর খেয়াল থেকে সৃষ্ট বিপথগামী সত্তা ইবলিশ সেটা হ্যাক করতে সক্ষম হয়েছিল। সিক্রেট নলেজ যেটা সেদিন চুরি হয় তার অপব্যবহার ঠেকানোর ঠেকায় আল্লাহ যুগ-যুগে ধরায় যত নবি প্রেরণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ নবি মোহাম্মদের মানবিক বৈশিষ্ট্য এতক্ষণের আলোচনায় উপেক্ষিত হয়েছে বলা যায়। আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্বের বার্তাবাহক নবি কোরান নামক ডিপ্লোম্যাটিক আসমানি কিতাবকে কীভাবে নিজের ‘আকল’-এ ধারণ ও ব্যবহার করেছিলেন সেটা তাই বিবেচনা করা প্রয়োজন। সময় হয়েছে বাতেনি বাতচিত ছেড়ে জাহিরি অবয়বে আরব অঞ্চলে বিচরণরত মোহাম্মদের দিকে এবার ফিরে তাকানোর।
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS