ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭ || আহমদ মিনহাজ

পঞ্চম প্রবাহ : কোরান পাঠ তরজমা : হারামহালালের দ্বন্দ্ব মুমিন মুসলমানের দিগদারি


আরব অঞ্চলের গোত্রশাসিত জীবনধারায় ‘ইলাহ’র বিগ্রহধারী উপাসনা ‘বাতিল’ ঘোষণার ক্ষণ থেকে মূর্তিপূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক নিদর্শন মোহাম্মদের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়। কোরানের ভাষায় ইবলিশের ‘আকল’ দ্বারা প্রভাবিত আরব গোত্রপিতারা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল কী হেন কারণে গায়েবি থেকে আগত মোহাম্মদের বার্তা কাবাঘরে লটকানো মুয়াল্লাকা অথবা দেবদেবতার ভাস্কর্য কিংবা বাদ্যযন্ত্রের সুর-মূর্ছনায় যে-জগৎ চমকায় তাদের থেকে উৎকৃষ্ট ভাবতে তারা বাধ্য? তাঁর বার্তায় ভাষা ও ভাবব্যঞ্জনার এমন কোনও অভিব্যক্তি কি আছে যা মক্কার গোত্রীয় জীবনধারায় নতুন বা অপরিচিত? খ্রিস্টান ও ইহুদি প্রচারকদের মাধ্যমে এমতো বার্তা কি আগে থেকে আরবে প্রচারিত হয়নি? যদি হয়ে থাকে এবং তারা যদি সেটা প্রত্যাখ্যান করে নিজের বিশ্বাসে স্থির থাকতে পারে তাহলে মোহাম্মদের দাবির মাঝে এমন কী গভীর নিহিতার্থ রয়েছে যা গ্রহণ না-করলে তারা অভিশপ্ত হবে? এইসব প্রশ্ন ও সংশয় হচ্ছে সেই ঘূর্ণি ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নে মোহাম্মদকে যেটি মোকাবিলা করতে হয় এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তাঁকে সেখানে কৌশল ও ধৈর্য অবলম্বন করতে হয়েছিল। মানব চর্চিত আচার-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির জগতে কোরানের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণের প্রয়োজনে অগত্যা কবিতা-গানবাজনা ও ছবি আঁকার অনুশীলন থেকে সৃষ্ট টেক্সট ‘বাতিল’ করা ছাড়া তাঁর উপায় থাকে না।

এর অর্থ হচ্ছে ইসলামে কবিতা, গানবাজনা ও চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ আবার নিষিদ্ধ নহে। মোহাম্মদ যেসব পরিস্থিতির চক্করে সুকুমার চর্চার বিরোধিতা করেছিলেন সেগুলো বিবেচনা করলে কবিতা ইত্যাদির চর্চা ইসলামে নিষিদ্ধ বলে মেনে নিতে হয়। উক্ত পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এলে অথবা কারও জীবনে অনুরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব যদি না ঘটে সেক্ষেত্রে কবিতা, গানবাজনা ও ছবি আঁকায় সমস্যার কারণ থাকে না। আরব তথা বিশ্ব জুড়ে মুসলমান সমাজে কলাশাস্ত্রের চর্চাকে কেন্দ্র করে রক্ষণশীল যেসব ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান অথবা ফরবিডেন জিনিস নড়াচড়া করার অস্বস্তি তার যৌক্তিক ভিত্তি যে-কারণে সবল মনে হয় না। কোরান তার আপাত কঠোর বাহ্য অবয়বের অন্তরালে ফরবিডেন এইসব জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির স্পেস রেখে যায় বলে কবিতা, গানবাজনা ও চিত্রাঙ্কনের মতো অনুভূতিসঞ্চারী বিষয়ের প্রতি মোহাম্মদ বিদ্বিষ্ট ছিলেন এমনটা বিশ্বাস করতে মন ওঠে না। আল্লাহর একত্ব বা তাওহিদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে এবং ইসলামের মৌল বিধানের বিপক্ষে যায় এহেন কাব্যচর্চায় তাঁর আক্রোশ যেমন সংযমের তোয়াক্কা করেনি, বিপরীতে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন কাব্য রচয়িতাদের প্রতি প্রশ্রয়ের মনোভাব হাদিসে দলিল হয়েছে বৈকি :—

‘কুতায়বা ইবনু সাঈদ সাকাফী (রহঃ)…আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-র সাথে ‘আরজ’ এলাকায় সফর করছিলাম। তখন এক কবি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আসতে লাগল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : শয়তানটাকে ধরে ফেল কিংবা (বর্ণনা ভেদে, তিনি বললেন) ‘শয়তানটাকে রুখে দাও’। কোনও লোকের পেট পুঁজে ভর্তি হয়ে যাওয়া কবিতায় ভর্তি হওয়া থেকে উত্তম।’ — সহিহ মুসলিম; কবিতা : ৫৬৯৮; সমধর্মী হাদিস : ৫৬৯৬-৫৬৯৭;

‘আমর আন-নাকিদ ও ইবনু আবু উমার (রহঃ)…আমর ইবনু শারীদ (রহঃ) সূত্রে তার পিতা শারীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন একদিন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-র বাহনে আরোহী হলাম। তিনি বললেন, তোমার স্মৃতিতে কবি উমাইয়া ইবনু আবুস-সালত-র কবিতার কোনও কিছু আছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, চালাও (শুনাও)। আমি তখন তাঁকে একটি পঙক্তি আবৃত্তি করে শোনালাম। তিনি বললেন, চালাও। তখন আমি তাঁকে আরেকটি শ্লোক আবৃত্তি করে শোনালাম। তিনি বললেন, চালাও। শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে একশোটি পঙক্তি আবৃত্তি করে শোনালাম।…যুহায়র ইবনু হারব ও আহমদ ইবনু আবদা (রহঃ)…শারীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর (বাহনে) পিছনে সহ-আরোহী বানালেন। এরপর তারা পূর্বোক্ত হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।’ — সহিহ মুসলিম; কবিতা : ৫৬৮৯;

‘মুহাম্মাদ ইবনু হাতিম ইবনু মায়মুন (রহঃ)…আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কবিকুলের কাব্যের মধ্যে সর্বাধিক সত্য লাবিদের কথা (أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مَا خَلاَ اللَّهَ بَاطِلٌ), ‘মনে রাখো আল্লাহ ছাড়া যা আছে সব বাতিল’। আর উমাইয়া ইবনু আবুস সালত তো প্রায় মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।’ — সহিহ মুসলিম; কবিতা : ৫৬৯২; সমধর্মী হাদিস: ৫৬৯০-৫৬৯১, ৫৬৯৩-৫৬৯৫;

বি. দ্র. সহিহ মুসলিম শরীফের ফাউন্ডেশন কৃত বঙ্গানুবাদে উদ্ধৃত সমধর্মী হাদিসে  ‘…আল্লাহ ছাড়া যা আছে সব বাতিলকবি লাবিদের এই উক্তির বর্ণনায় প্রকারেভেদ বোঝাতে প্রতিটি হাদিসের ভাষান্তরে অনুবাদক মূল আরবি সংযুক্ত রেখেছেন

উৎস : সহিহ মুসলিম; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম

ওপরে উদ্ধৃত হাদিস থেকে বোঝা যায় কবিতাসহ কলাশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত যে-কোনও মাধ্যমের চর্চায় শান দেওয়া তখনই ফরবিডেন যেখানে তারা কোরান ও মোহাম্মদকে উপহাস যায়, ইসলাম স্বীকৃত বিশ্বাস ও প্রথাচারকে ‘বাতিল’ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে অথবা শিরক ও প্রতিমা উপাসনার অনুভূতি মনে তীব্র করে এমন কাণ্ড ঘটায়। মামলাগুলা যেখানে নেই সেখানে এমনকি কোরান ও মোহাম্মদের গাঠনিক সমালোচনার অপরাধে হাজার বছর ধরে চর্চিত এইসব মাধ্যমকে নিষিদ্ধ করার ভাবনা ইসলামের ভিত্তি কোরানে সত্যি কি মিলে? প্রশ্ন উঠানো যায়, — মহানবির ওফাত লাভের অনধিক কয়েকশো বছরে সংকলিত হাদিস, সিরা ও তফসির অথবা ফিকাহশাস্ত্রে কলাশাস্ত্রের চর্চা নিষিদ্ধ করার আওয়াজ কি সাংঘাতিক তীব্র ছিল তখন? কোরানে বর্ণিত ঘটনার ব্যাখ্যা হচ্ছে তফসির এবং সেক্ষেত্রে ঘটনা যখন ঘটেছিল ব্যাখ্যা সেই সময়ের নিরিখে হওয়া প্রয়োজন। অতীতে সংঘটিত ঘটনার ব্যাখ্যা পুনর্বিবেচনা করতে যেয়ে যেসব তফসির ও ফিকাহশাস্ত্রবিদ তাকে পরিবর্তিত যুগের জন্যও প্রযোজ্য বলে রায় দিলেন উনাদের সেই রায় কতটা যৌক্তিক? যেখানে, কোনও বিষয়ে জটিলতা দেখা দিলে সেটা নিরসন ও রায় প্রদানের ক্ষেত্রে ফয়সালাকারীর করণীয় সম্পর্কে হাদিসে নবি স্বয়ং ইশারা দিয়েছেন :—

কোনও ঘটনার সালিশ নির্ভর করে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে কোরান কোনও সম্পর্ক রাখে কি না, যদি না রাখে তাহলে হাদিসে এ-সম্পর্কে কোনও দলিল রয়েছে কি না, যদি হাদিসে না মিলে তাহলে পরবর্তী সময়ে এরকম ঘটনা নিষ্পত্তির নজির পাওয়া যায় কি না যার সাহায্যে মামলাটি ডিসমিস করা যায়; সেরকম কিছু না থাকলে নিজের বোধবুদ্ধি অনুসারে সালিশের নিষ্পত্তি ঘটানো ব্যক্তির জন্য উত্তম বিবেচনা করা যেতে পারে। এখানে খেয়াল রাখা প্রয়োজন, সালিশের ফয়সালা অবশ্যই ন্যায়বিচার অনুসারে সংঘটিত হতে হবে, যেন একপেশে বলে কারও পক্ষে তাকে মার্কিং করার অবকাশ না জোটে।

বহুরৈখিক বিচার-বিবেচনার সাপেক্ষে কবিতা ইত্যাদি চর্চার ব্যাপারে সাম্প্রতিক ইসলামি চিন্তাবিদরা কতটা কী ভেবেছেন? বতর্মান চিন্তকদের মধ্যে অগ্রগণ্য আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শেখ জাদ আল হক অথবা ইউসুফ আল-কারযাভীর মতো দু-চার জন ছাড়া কোরান-হাদিস-তফসিরে উল্লেখিত রেফ্রেন্সকে জাহিরি অর্থে পাঠ করে নিষিদ্ধের মামলা ঠুকতে তৎপর চিন্তকরা আজও দলে ভারী বলে মনে হয়। গেল শতকের ষাটের দশকে প্রকাশিত ‘The Lawful and The Prohibited in Islam’ কিতাবে ইউসুফ আল-কারযাভী হারাম-হালাল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সময় মদ্যপান থেকে শুরু করে কবিতা-গানবাজনা-চিত্রাঙ্কন তথা সকল প্রসঙ্গ ধরেই আলোচনা করেছিলেন। ফরবিডেন বা নিষিদ্ধ বিষয় সম্পর্কে অভিমত প্রদানে কোরান-হাদিস-সিরা-তফসির-ফিকাহ ছাড়াও গাজ্জালির মতো ধীমান চিন্তকদের রেফ্রেন্সে বর্ণিত ইসলামি সংস্কৃতির স্বরূপকে কারযাভী তাঁর বইয়ে মৌল ভিত্তি রূপে গ্রহণ করেছিলেন। কাজটি সম্পন্ন করতে যেয়ে পশ্চিম গোলার্ধে সক্রিয় বিদ্বান ও ইতিহাসকার এবং মাযহাবচর্চিত ইসলামি আইনবেত্তাদের ব্যাখ্যা ও রায়কে নিজের অভিমত প্রদানের জায়গা থেকে গৌণ বিবেচনা করতেও ইতস্তত বোধ করেননি।

কেন করেননি তার ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে কারযাভী জানাচ্ছেন ইসলামে ফরবিডেন বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত রাখার সময় মুসলমান লেখক-গবেষক-চিন্তাবিদরা দুটি ধারায় নিজেকে প্রভাবিত করেন, একটি ধারায় পশ্চিমের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ইসলাম সম্পর্কিত ব্যাখ্যাকে তাঁরা অন্ধভাবে অনুসরণ করেন, এবং অন্য ধারায় মাযহাবসূত্রে প্রণীত ইসলামি আইনশাস্ত্র অথবা এরকম নির্দিষ্ট কোনও ঘরানায় বন্দি হয়ে রায় হাঁকেন। যদিও মাযহাবের জনক ও শরিয়া আইন প্রণেতারা তাঁদের রচনায় ভুলেও নিজের মতামতকে স্বতঃসিদ্ধ বলে দাবি করেননি। ইসলামের বিধি-বিধান চর্চায় বিদ্যমান এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে কারযাভী কোরান ও হাদিসে বর্ণিত ইসলামি সংস্কৃতি ও স্থানিক সংস্কৃতির নিরিখে ফরবিডেন সম্পর্কিত বিষয়ের যৌক্তিকতা অনুসন্ধান করেছেন। নিজের কিতাবের ভূমিকায় তিনি তাই মন্তব্য করেছেন :—

I have endeavored not to be in either of these two groups. I cannot compromise my religion by taking the West as my god after accepting Allâh as the Rabb, Islâm as the religion, and Muhammad (s.a.w.s.) as the Messenger. At the same time, I cannot compromise my intellect by following one particular school of jurisprudence in all its judgments, whether right or wrong, suspending my own faculty of reasoning and discernment. — Source: The Lawful and The Prohibited in Islam by Seikh Yusuf Al-Qaradawi, Al-Falah Foundation, 1960; PDF Edition.    

কোনও একটি মত বা ঘরানার অন্ধ অনুসারী রূপে সত্য সন্ধানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন কারযাভী তাঁর বইয়ে ইবনে আল-জাওজি’র উদাহরণ টেনেছেন। জাওজি অন্ধ অনুসারীকে সেই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন যাকে নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে বাতি প্রদান করা হয়েছে কিন্তু বাতিটা জ্বালানোর পরিবর্তে সেই লোক নির্বোধের মতো অন্ধকারে পথের সন্ধান করে। জাওজি মনে করেন বুদ্ধিবৃত্তির জন্ম হয়েছে চিন্তা ও যুক্তিশীলতা চর্চায় শান দেওয়ার জন্য, সেখানে অন্ধ অনুসারী বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা স্থগিত রেখে নির্দিষ্ট কোনও মতবাদ বা ঘরানায় আটক থাকতেই ভালোবাসে। ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জনে মাযহাব অথবা সুনির্দিষ্ট চিন্তনপদ্ধতির অন্ধ অনুসরণ কারযাভীর কাছে অগত্যা যুক্তিসংগত মনে হয়নি, কেননা ‘সত্য’ কারও একচেটিয়া সম্পত্তি হতে পারে না। নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু সম্পর্কে ইসলামি চিন্তাবিদরা যেসব মতামত রেখেছেন সেগুলো ব্যক্তি ভেদে সত্য সন্ধানের পন্থা ও গবেষণা বিবেচিত হতে পারে কিন্তু তাঁরা কেউ নিজের রায় ও মতামতকে শেষকথা ঘোষণা করেননি এটা মাথায় রাখা প্রয়োজন।

খোলা মনে হারাম-হালাল বিষয়ক তদন্ত শেষে কারযাভী কবিতা-গানবাজনা ও ছবি আঁকার ঘটনায় ইসলামের মারাত্মক কোনও লঙ্ঘন খুঁজে পাননি। কলাশাস্ত্রের চর্চা যদি ব্যক্তিকে স্থূলতা, অশ্লীল কামবাসনা, এবং উচ্ছৃংখল ও বেহেড মাতাল হতে প্ররোচিত করে সেগুলো সাফ হারাম। অন্যদিকে কলাশাস্ত্রে চর্চিত কবিতা-গানবাজনা-চিত্রকলা যদি ব্যক্তির মনে আনন্দ ও প্রশান্তি বহায়, জীবনকে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি সহকারে ব্যাখ্যা ও গভীর জীবনবোধে উপনীত হতে সাহায্য করে এবং তার আত্ম-উপলব্ধি ও আত্ম-জাগরণ ঘটায় সেক্ষেত্রে এসবের চর্চায় ইসলামে বাধা নেই। সুতরাং ব্যক্তির মনে উপাসনা ও শিরকের মনোবৃত্তি জাগ্রত করে না এরকম কবিতা, গানবাজনা, চিত্রকলা, আলোকচিত্র অথবা নাটক ও চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ ভাবা আপন মনের নির্বুদ্ধিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। কারযাভী ছবি আঁকার সূত্রে উদাহরণ দিয়েছেন। ইসলামের প্রথম যুগের তফসিরকার আত-তাবারি চিত্রকরদের বিরুদ্ধে নবি মোহাম্মদের সাবধানবাণী সম্পর্কে ‘সহিহ মুসলিম শরীফ’-এ বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় যে-মত ব্যক্ত করেছিলেন নিজের বইয়ে তিনি সেটা পেশ করেছেন :—

Al-Tabari, explaining the meaning of this hadith, says, “What is meant here by makers of figures are those who make figures in order that they may be worshipped besides Allâh, and this is unbelief (kufr). As for those who do not make them for this purpose, they will be guilty only of making a representation (suar).” Similarly, if someone hangs such pictures on the wall in order to venerate them, his act is not that of a Muslim, for Islâm has departed from his heart. — Source: The Lawful and The Prohibited in Islam by Seikh Yusuf Al-Qaradawi, Al-Falah Foundation, 1960; PDF Edition.

তাবারিকৃত বক্তব্যের মোদ্দা কথা হচ্ছে, প্রাণহীন বস্তুর ছবি অঙ্কন বা ভাস্কর্য নির্মাণে বিশেষ বাধা নেই; অন্যদিকে জানদার জীবের ছবি শিল্পী যদি আঁকেন এবং সেই ছবি চিত্তে কুফরি অর্থাৎ প্রতিমা-উপাসনা ও শিরকের মনোভাব সঞ্চারিত না করে তবে এরকম চিত্রাঙ্কন মাকরুহ বা অপেক্ষাকৃত লঘু অপরাধ রূপে গণ্য হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিল্পীর এই ‘সুয়ার’ (suar) বা প্রতিরূপতা সৃষ্টির অপরাধকে উপেক্ষণীয় ভাবা যেতে পারে। দেয়ালে লটকানো ছবি বা চিত্রাঙ্কনের বেলায় ব্যক্তি যদি সেই ছবিকে উপাসনার উদ্দেশ্যে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখে তবে সেটা কোরানের বিচারে বৈধ হবে না এবং সেই ব্যক্তির হৃদয় থেকে ইসলাম বিদায় নিয়েছে ধরে নেওয়াটা যুক্তিসংগত; অন্যথায় এহেন প্রদর্শনে ‘ইসলাম গেল গেল’ রব তোলা বা এতে দোষ ধরার কিছু নেই। কবিতা ও গানবাজনার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারযাভী যেমন নিজের বইয়ে গানবাজনাকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রবণতার সাপেক্ষে ইসলামে হারাম বলে অভিমত রেখেছেন :—

প্রথমত গানের বিষয়বস্তু যদি মদ্যপানকে গ্লোরিফাই ও মানুষকে মদ্যপ হতে উৎসাহী করে তখন সেটা হারাম। দ্বিতীয়ত গীতকলিতে অন্তর্নিহিত বার্তা কোরান ও হাদিসে ব্যক্ত জীবনাচারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কিন্তু গায়কী বা পরিবেশন রীতির কারণে মনে যৌনতাড়না ও সুড়সুড়ি জাগ্রত করায়, সেক্ষেত্রে ইসলামে গানবাজনা চর্চায় কঠোর নিষেধ আছে। তৃতীয়, গানবাজনায় বুঁদ হওয়ার কারণে ইসলামের মৌল বিষয় ও দায়িত্বে যে-ব্যক্তি অবহেলা করে তাকে টলারেট করা বিধিসংগত নয়। ইসলাম যেহেতু মানব-সংসারে সংঘটিত সকল ঘটনায় সংযত আচরণের পক্ষপাতি সেহেতু গানবাজনার প্রতি অত্যধিক আসক্তি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা নিজের দায়িত্ব গণ্য করে। চতুর্থ, গানবাজনা চর্চার যেসব ধারা ও ঐতিহ্য ব্যক্তির নফসে সক্রিয় অপরাধ ও পশু-প্রবৃত্তি দমনের পরিবর্তে তীব্র করে তোলে, ইসলামের বিচারে সেটা হারাম। এবং পঞ্চম, মদ্যপানের আসর বসিয়ে গানবাজনা করা কিংবা এর সঙ্গে নির্লজ্জ দেহ-প্রদর্শন ও অশ্লীলতার ভিয়েন মিশানো গানবাজনার আসর ইসলাম অনুমোদন করে না এবং মারাত্মক পাপ বলে মনে করে।

এখন এই পঞ্চবিধির সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেনি এমন গানবাজনার চর্চা ইসলামি অনুভূতি ও জীবনবোধ ক্ষুণ্নকারী বলে কারযাভীর মনে হয়নি। কবিতা, আলোকচিত্র, অভিনয় বা ছবি আঁকা সম্পর্কে মোদ্দা কথাটা তাঁর গান সম্পর্কিত বক্তব্যের রকমফের এবং কারযাভী সেখানে সোজাসাপটা মত রেখেছেন :—

Among the entertainments which may comfort the soul, please the heart, and refresh the ear is singing. Islâm permits singing under the condition that it not be in any way obscene or harmful to Islâmic morals. There is no harm in its being accompanied by music which is not exciting.

In order to create an atmosphere of joy and happiness, singing is recommended on festive occasions such as the days of ‘Eid, weddings and wedding feasts, births, ‘aqiqat (the celebration of the birth of a baby by the slaughter of sheep), and on the return of a traveler. — Source: The Lawful and The Prohibited in Islam by Seikh Yusuf Al-Qaradawi, Al-Falah Foundation, 1960; PDF Edition.

সংগীতকে আল্লাহনিষ্ঠ হওয়ার উপায় ঠাউরে যেসব সুফি-মরমি-বাউল শরিয়তের বিধি-বিধান প্রায়শ উপেক্ষা করেন, কারযাভীর শর্তাধীন সংগীতচর্চা সে-বিষয়ে পৃথক কোনও আলোচনা করেনি। সুফি-মরমি ও বাউল ধারায় চর্চিত সংগীত যে পদ্ধতির আশ্রয়ে কোরান, মোহাম্মদ তথা সমগ্র ইসলামকে পাঠ যায় তা কারযাভীর শর্তছকে আঁটে বলে মনে হয়নি। যদিও Islamic Extremist অর্থাৎ চরমপন্থীদের প্রতি বিরক্ত এই বিদ্বান সুফি-মরমিধারায় চর্চিত ইসলামের বিরোধী শিবিরের লোক নন। লেখা ও বক্তৃতায় সুফিবাদের প্রতি তাঁর মমত্ব ও সহিষ্ণু মনোভাব অতীতে প্রকাশ পেয়েছে। কারযাভী সুফি ও মরমিবাদকে সেই ছকে এলাউ করেন যা আল্লাহর সঙ্গে তাঁর রসুলের সম্পর্ক উপলব্ধির ক্ষেত্রে কোনও গোলযোগ ঘটায় না এবং সন্ন্যাসবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিয়েও আত্মিক ঊর্ধ্বারোহণে নিজেকে ব্রত রাখে। তাঁর কাছে মুসলমান যথারীতি ফিতরাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বাবস্থায় সংযত আচরণের প্রতীক মানব সম্প্রদায়। নিজের স্বাধীনতার মাত্রা সম্পর্কে সম্প্রদায়টি সচেতন এবং শরিয়তের মৌল শর্তে যুক্তিশীল ও মানবিক বলেই তিনি মনে করেন। এহেন মনোভাব তাঁকে ক্ষেত্রবিশেষে সাংঘর্ষিক ও বিতর্কিত মন্তব্যের দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে জামায়াতে ইসলামীর লবিস্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি যেমন গোলাম আযমের পক্ষে সাফাই গান, তদ্রুপ হিটলার কর্তৃক ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে অক্লেশে সেই ঘটনাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত শাস্তি (A punishment was coming from God) বলে মন্তব্য ঠুকতে দু’বার ভাবেন না। তাঁর যুক্তি ছিল :—

ফিতরাতের বিচারে বনি ইসরায়েলসহ বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত ইহুদি গোত্ররা ভিন্ন পরিচয়ে মুসলমানই ছিল। কিন্তু ফিতরাতে তারা কখনও অটল থাকেনি। তারা তো সেই সম্প্রদায় যারা ইউজারি বা সুদকে শিল্পে পরিণত করেছিল এবং তাওরাতের আদি ভাষ্যে পরিবর্তন ঘটাতে পিছপা হয়নি। সুদ প্রথাকে বৈধ করার জন্য ‘ডিউটেরনমি’র বাণী তারা পালটে দিয়েছিল। নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে সুদের লেনদেন তারা নিষিদ্ধ গণ্য করে অথচ অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সুদভিত্তিক লেনদেনের ধারা বজায় রাখায় ধর্মের লঙ্ঘন খুঁজে পায় না। এই দ্বৈত নীতি (Double Standard) স্ববিরোধিতা ও ঐশী গ্রন্থের বিকৃতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাদের স্মরণ রাখা উচিত ছিল…

সুদকে ইন্টারেস্ট বলে ডাকলে যেমন তার চরিত্রে বদল ঘটে না, মহাজনি প্রথার ওপর ভর করে ব্যবসায় লিপ্ত কুসিদজীবী নিজেকে উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও ক্যাপিটালিস্ট রূপে হাজির করলেও সুদ ও সুদখোরের স্বভাব পালটায় না। আল্লাহ মানুষের জন্য ব্যবসা থেকে লাভের বিধান রেখেছেন, সুদ বা ইন্টারেস্ট নয়। সুতরাং ফিতরাতের ওপর যে-ব্যক্তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত মনে করে তার জন্য সুদ ভিত্তিক লেনদেন সকল অবস্থায় হারাম। ইহুদিকুলের এই বারবার ভ্রান্ত ও অবাধ্য পথে গমনের কর্মফল হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত ঘটনা। শাস্তিটি তাদের প্রাপ্য ছিল, যেহেতু সুদীর্ঘ কাল ধরে ইউরোপে উদ্বাস্তু জীবন অতিবাহিত করা সত্ত্বেও তারা তাদের স্বভাব পালটায়নি। হিটলারের ঘটনা একদিক থেকে বরং তাদের জন্য ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’-তে ফেরত যাওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছিল; যদিও সুযোগটি পাওয়ার পর তারা যথারীতি অন্যকে অরক্ষিত করে হলেও নিজেকে সুরক্ষিত ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ভাবার পুরাতন বিমারে ফেরত গেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের Final Solution বা ‘অন্তিম ফয়সালা’-র নাম করে সংঘটিত ইহুদি নির্যাতনের মর্মান্তিক ইতিহাস যারা পাঠ করেছেন কারযাভীর এহেন বক্তব্যে তাদের ক্ষুব্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে যাঁরা সেই সময় বেঁচে ফিরেছিলেন তাঁদের সাক্ষ্য ঘিরে নির্মিত ফরাসি চলচ্চিত্রকার ক্লদ ল্যাণ্জম্যানের নয় ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের ‘সোহা’ (Shoah) তথ্যচিত্রটি দেখার অভিজ্ঞতা যেসব দর্শকের হয়েছে তাদের হৃদয়ে এই বক্তব্য শেল হয়ে বিঁধে। উক্ত তথ্যচিত্রে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা পরিকল্পিত এই নিধনযজ্ঞের যেসব বিবরণ তুলে ধরেন তা এককথায় হৃদয়বিদারক। সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে ধারাবিবরণীর এই চাপ সহ্য করা কঠিন। ইহুদি নিধনযজ্ঞ নিয়ে দালিলিক যেসব কাজ সম্পন্ন হয়েছে অথবা সাহিত্য-চলচ্চিত্র-আলোকচিত্র থেকে শুরু করে বিচিত্র প্রকাশমাধ্যমে নিধনযজ্ঞের ভয়াবহতা পাঠ যাওয়ার পর ইহুদিকে ঘৃণা করেন এমন ব্যক্তি ছাড়া কারও পক্ষে একে পানিশমেন্ট বলে দাগানো সম্ভব নয়! সুতরাং কারযাভীকে পাষাণদিল ইহুদি বিদ্বেষী ব্যক্তি রূপে কেউ যদি চিহ্নিত করেন তাতে অবাক হওয়ার কারণ থাকে না।

অন্তিম ফয়সালার নামে সেই সময়ে সংঘটিত নিধনযজ্ঞকে যেমন বৈধ ও ন্যায়সংগত ভাবার সুযোগ নেই, বিপরীতে এও সত্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জের ধরে ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ ফেরত পাওয়ার পর থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘিরে ইহুদি শাসকদের তৎপরতা আরববিশ্বের জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা হয়ে আসেনি। ইহুদি জনগোষ্ঠীকে সকলের থেকে স্বতন্ত্র ও অনিরাপদ ভাবার মনোভাব থেকে ইসরায়েল আজও সরে আসেনি। কাঁটাতারের পরিধি বাড়িয়ে হতভাগা ফিলিস্তিনিদের ক্রমশ দেশহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত করার মর্মান্তিক ঘটনা তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ জুড়ে সক্রিয় ইহুদি লবির নিজেকে নিরাপদ করার পন্থা নিয়েও সমালোচনার অন্ত নেই। অগত্যা নরম্যান ফিঙ্কেলস্টেইনকে স্মরণ করতে হয়। জন্মসূত্রে ইহুদি ফিঙ্কেলস্টেইনের বাবা-মা সেই সময় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর কোনওমতে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন। পারিবারিক সূত্রে ভয়াবহ এই অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়ালেও ফিঙ্কেলস্টেইন ইসরায়েল রাষ্ট্র ও ইহুদি লবির কড়া সমালোচক রূপেই বিশ্বে পরিচিত। নিধনযজ্ঞের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং প্যালেস্টাইন সমস্যা নিয়ে সোচ্চার থাকার কারণে ইসরায়েল ও ইহুদি লবি তাঁকে সুনজরে দেখে না এবং ‘গাদ্দার’ বলেই ভাবে।

ফিঙ্কেলস্টেইন কিন্তু কথাটি বহুদিন যাবত প্রকাশ্যে বলে আসছেন, ইহুদি লবিস্টদের কারণে নিধনযজ্ঞ তার আদি তাৎপর্য হারিয়ে ‘Holocaust Industry’ হয়ে উঠেছে! নিজের কুকর্মকে ইহুদি সম্প্রদায় ও বিশ্বের কাছে ন্যায্য প্রমাণের কাজে ইসরায়েল যাকে এখন ব্যবহার করে। মিথ্যে নয়, বিশ্ব জুড়ে সক্রিয় ইহুদি লবিস্টরা নিধনযজ্ঞের স্মৃতিকে ইহুদির মনোজগতে সেই অবিশ্বাস জারি রাখার প্রয়োজনে ব্যবহার করে যার জের ধরে একজন ইহুদি সম্ভবত তার নিজ সম্প্রদায় ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে বিশ্বাস যায় না! সে হয়তো ভাবে, ইসরায়েল হচ্ছে শেষ প্রান্ত যেটি পরবর্তী কোনও নিধনযজ্ঞ নেমে এলে তাকে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে সক্ষম। ইসরায়েলের অনায্য আচরণ এভাবে ইহুদির মনোজগতে ন্যায়সংগত হয়ে ওঠে। মার্কিন মদতপুষ্ট এই ইসরায়েলকে ফিঙ্কেলস্টেইন বা তাঁর মতো আরও অনেকে তাই বিষবৃক্ষ গণ্য করতে সঙ্কোচ বোধ করেন না। এই বিষবৃক্ষ ইহুদি সম্প্রদায়কে ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত ও সে-কারণে শত্রুপরিবেষ্টিত ভাবার দ্বৈত জগতে বহাল থাকতে বাধ্য করে। পরিণাম স্বরূপ ঐতিহাসিক এই সম্প্রদায়ের যে-অবশেষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজের অতুলনীয় মেধার জোরে এখনও করে খাচ্ছে, যাঁরা কিনা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সভ্যতার উৎকর্ষে সদা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, এহেন মেধাবী সম্প্রদায়টি খুব কম ক্ষেত্রে তার নিজেকে পৃথক ও সঙ্কুচিত ক্লান ভাবার বাতিক পরিহার করে সহজ বিনিময়ের জগতে নিজেকে শামিল করাতে পেরেছে। ইহুদি মনস্তত্ত্বের জটিল এই সমস্যার তল পেতে পাঠক যোয়াভ শামির (Yoav Shamir) নির্মিত ‘Defamation’ বা মানহানি নামের সংবেদনশীল ও সুবেদী তথ্যচিত্রে একপাক ঘুরে আসতে পারেন।

এহেন পটভূমিতে বিরাজিত থাকার কারণে ‘ইসরায়েল এবং ইহুদি’ হচ্ছে সেমিটিক সাম্রাজ্যবাদের ছকে সেই সমীকরণ যার সঙ্গে ছকের বাকি দুই প্রতিনিধি মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ক্রুসেড প্রকারান্তরে আজও বহমান। ফিঙ্কেলস্টেইন হয়তো সে-কারণে সেমিটিক বিবাদের সামগ্রিক ধারাটিকে অপছন্দ করেন এবং এর বিপক্ষে বিষোদগার করতে পিছপা হন না। ইউসুফ কারযাভীর মন্তব্য অনুচিত ও মানহানিকর হলেও সে-বিবাদের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। উপরন্তু কোরানে এমন কিছু বিধান রয়েছে যা কোনও অজুহাতে (*এমনকি মুসলমান বলে যে নিজেকে দাবি করে তার জন্যও) বৈধ ভাবার সুযোগ নেই এবং স্রষ্টার একত্বকে বিকৃত করা কিংবা সুদের প্রচলন ঘটানো তাদের মধ্যে অন্যতম। ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলমানের বিরোধ-সংঘাতের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এই বিষয়গুলো ফিরে-ফিরে অমোঘ হয়েছিল বৈকি! যে-কারণে কারযাভী ‘অন্তিম ফয়সালা’কে কেন শাস্তি বলে চিহ্নিত করেন সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

ইসলামে তাগুত অর্থাৎ সীমা লঙ্ঘন করে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনা অথবা তাঁর সঙ্গে সৃষ্ট কিছু শরিক করার সুযোগ নেই। কোরানের মৌল বিধান শরিয়তকে সুবিধামতো ব্যাখ্যা ও পালটানোর সুযোগ সেখানে সীমিত এবং নিজের কিতাবে কারযাভী বিষয়টি স্পষ্ট করেই ব্যাখ্যা করেন। শূকরের মাংস কেন হারাম তার আলোচনায় তিনি যেমন অভিমত রেখেছেন, — ময়লা ঘাঁটার কারণে শূকরকে মুসলমানদের জন্য হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এখন বিজ্ঞান যদি ক্ষতিকর অণুজীবের বাহক হওয়ার কারণে শূকরের মাংসকে মানুষের জন্য বিপজ্জনক বলে রায় প্রদান করে তবে সেই রায় শুনে একজন মুসলমানের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। অনুরূপভাবে বিজ্ঞান যদি আগামীকাল সম্পূর্ণ বিপরীত মতে উপনীত হয় সেক্ষেত্রেও উক্ত ব্যক্তির নিরাশ বোধ করার কারণ নেই। তার বরং এই কথাটি স্মরণ রাখা উচিত শূকরকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণের বিষয় স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অতএব এটা হারাম। মুসলমানরা তাই ধারণা করেন তাগুতের ফাঁদে বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে গ্রিক বাইবেলে পাক-নাপাক সম্পর্কে ঈসার মুখে এই কথাটি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল :—

‘মানুষের বাইরে এমন কিছু নেই যা ভিতরে গিয়ে তাকে কলুষিত করতে পারে কিন্তু যা যা মানুষের ভেতর থেকে বের হয় সেটাই মানুষকে কলুষিত করে।…বাইরে থেকে যা কিছু মানুষের ভেতরে যায় তা তাকে কলুষিত করতে পারে না। কারণ এটা তার অন্তরে যেতে পারে না, পাকস্থলীতে যায় এবং তারপর দেহের বাইরে গিয়ে পড়ে। এই কথার মাধ্যমে তিনি সমস্ত খাবারকে শুদ্ধ বললেন।’ — উৎস : মার্ক :১৯; মথি ১৫:১৮১৯; পবিত্র বাইবেল; বঙ্গানুবাদ; পিডিএফ সংস্করণ

মথি ও মার্ক বিরচিত সুসমাচারে হাত না ধুয়ে খাদ্য গ্রহণের ঘটনা ঘিরে আবর্তিত যিশুর বাণী মূলত অন্তর-শুদ্ধির ইঙ্গিত দানের মাধ্যমে সকল খাদ্যকে মানুষের জন্য বৈধ বলে মত দিয়েছিল। যদিও তাওরাত ও কোরান এক্ষেত্রে বাইবেলের বিপরীত মনোভাব পোষণ করে। ইহুদি ও মুসলমান সম্প্রদায় খাদ্যে বাছবিচার মেনে চলাকে সরাসরি আল্লাহর অভিপ্রায় ও পরিকল্পনা থেকে আগত নির্দেশ এবং অবশ্য পালনীয় বলে মানে। প্রতিটি বিষয়কে মাত্রাভেদ অনুসারে আল্লাহ কেন হালাল ও হারামে ভাগ করেছেন তার কারণ মানুষের পক্ষে সম্যক জানা সম্ভব নয়। অগত্যা ইসলামে এটা একজন মুসলমানের ইমান পরীক্ষার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কারযাভীর ভাষায় :—

The Muslim is not required to know exactly what is unclean or harmful in what Allâh has prohibited; it may be hidden from him but be apparent to someone else, or its harm may not have been discovered during his lifetime but may be understood at a later period. What is required of a Muslim is simply to say, ‘We have heard and we shall obey. — Source: The Lawful and The Prohibited in Islam by Seikh Yusuf Al-Qaradawi, Al-Falah Foundation, 1960; PDF Edition.  

এ-রকম কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কট্টর ও Straightforward এবং আরও বহু বিষয়ে নমনীয় কারযাভী হারাম-হালালের মামলাকে Degree of differences-এর আলোকে নিজের কিতাবে বিবেচনা করেছেন। ইহুদি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য রূঢ় হলেও একে সেই আলোকে মনে হয় বিবেচনা করা উচিত। তাঁর হারাম-হালাল বিষয়ক আলোচনায় নিষেধের মাত্রা তাই সমান নয়। এই যেমন মদ্যপান যথারীতি হারাম তবে চিকিৎসা বা জীবন-সংশয়ের মতো পরিস্থিতিতে এর উপকারিতা থেকে থাকলে প্রয়োগে দোষ নেই। নির্দোষ বিনোদনের জন্য বাজি ধরায় গুরুতর অপরাধ ঘটে না কিন্তু তা-বলে অর্থের বিনিময়ে বেটিং বৈধ নয়। এইসব হচ্ছে মাত্রা ও গুণগত প্রভেদ যেখানে দাঁড়িয়ে কারযাভী কলাশাস্ত্রে চর্চিত বিষয় সম্পর্কে নিজের অভিমত রেখেছিলেন। কারযাভী কী অভিমত দিয়েছেন আর ওদিকে আমজনতা মূল আরবি অথবা অনূদিত কোরান-হাদিস কতটা কী জেনেবুঝে পড়ি সে-আলোচনা আপাতত পরের পর্বেই করি।


ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১

COMMENTS