পঞ্চম প্রবাহ–২ : কোরান পাঠ ও তরজমা : হারাম–হালালের দ্বন্দ্ব ও মুমিন মুসলমানের দিগদারি
এখন Degree of differences সূত্রে যাচাই করা হারাম-হালালের মামলায় শরিয়তনিষ্ঠ মিশরদেশি আলেম কারযাভী এটা অবশ্য ক্লিয়ার করতে পেরেছেন মোল্লাদের ওয়াজে কবিতা-গানবাজনা ও ছবি আঁকা সম্পর্কে অহরহ যেসব বিষোদগার ধ্বনিত হয় তার কোনও মৌল ভিত্তি নেই; উনারা যে-সমস্ত আয়াত ও হাদিস কপচান কারযাভীর অনুসন্ধানে সেটা হয় কোরান অথবা নির্দিষ্ট হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা অথবা যয়িফ নয়তো জাল হাদিসকে সহি বলে দাগানোর আকাম ছাড়া অন্য কিছু নয়। উপমহাদেশে আমজনতা কোরান-শিক্ষক হুজুর মারফত ঘরে-ঘরে এই গ্রন্থ পাঠ যায়, যদিও হুজুরদের শেখানো পদ্ধতিতে কোরান পাঠ আরবি ভাষার উচ্চারণবিধি থেকে শুরু করে শব্দার্থ ও ভাবব্যঞ্জনা উপলব্ধিতে আদৌ সহায়ক কি না কারযাভীর কিতাব পাঠের সুবাদে প্রশ্নটি তীব্র হয়ে ওঠে!
বাল্যবয়সে সকলে কমবেশি হুজুরদের কাছে কোরানশিক্ষা গ্রহণ করলেও চর্চার অভাবে অনেকে সেটা বিস্মৃত হই। সালাত সারার জন্য দশ-পনেরোটা সূরা আর কিছু দোয়াকুনুত হয়তো স্মৃতিতে সঞ্চিত থাকে এবং তার ওপর ভর করে ইসলামের সঙ্গে নিজের কারবার সারি। এর বিষম ফল হচ্ছে বঙ্গে যে-ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণায় পৌঁছাতে আগ্রহী তার পক্ষে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত ইসলামি টেক্সট ব্যতীত এক-পা অগ্রসর হওয়া মুশকিল! সেখানে তখন এই প্রশ্ন মনে জাগে, — আরবি ভাষায় রচিত কোরান-হাদিস-সিরা-তফসির ও ইসলামের ব্যাখ্যা-ব্যাখ্যান সমৃদ্ধ টেক্সট একজন আরব যে-সহজতায় পাঠ যায় তার সঙ্গে উপমহাদেশে ফারসি, উর্দু, ইংরেজি ও বাংলা সূত্রে চর্চিত টেক্সটের পঠনপাঠনের মাঝখানে কোনও স্পেস থেকে যায় কি না যেটি কোরানের মর্মার্থ উপলব্ধিতে অনেকসময় ভ্রান্তি ও স্ববিরোধিতা সৃষ্টি করে?
প্রশ্নটি বিশেষ কারণে তুলতে হচ্ছে। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ হলেও বক্ষ্যমাণ আলোচনার সাপেক্ষে অপ্রাসঙ্গিক নয় বলে উল্লেখ প্রয়োজন মনে করছি, সম্প্রতি ইন্টারনেটের সুবাদে জনৈক মিশরবাসী হুজুর সপ্তাহে দুই দিন এক ঘণ্টা করে আমার ছেলেকে কোরানশিক্ষা দিয়ে থাকেন। দেশি হুজুরের কাছে কোরান পাঠের ধরন সে আগে রপ্ত করেছিল। সে যখন চব্বিশ পারায় তখন হুজুর এন্তেকাল করেন। অগত্যা বাকি ছয় পারা সে নিজে খতম দিয়েছিল। এখন ফিরতি পাঠে মিশরী হুজুরের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটেছে। তো উনার পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে দেশি হুজুরের তফাত টের পাই। এমন নয় দেশি হুজুর তাকে ভুলভাবে কোরান পাঠ করতে শিখিয়েছিলেন, বরং আমাদের দেশজ রীতিতে কোরান পাঠের যে-ঐতিহ্য বিদ্যমান ছেলেকে তা লবজ করাতে তিনি ত্রুটি রাখেননি। হুজুর যেটি ছেড়ে গিয়েছিলেন সেটা হলো কোরান পাঠের ক্ষেত্রে শব্দের গভীরে নিহিত ব্যঞ্জনা, রূপমূল, রূপকার্থ ও উচ্চারণরীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আরবি ভাষার সেমিওটিক্স কণ্ঠস্বরে কীভাবে তুলতে হয় ছেলের সেই অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। সে কেবল তোতাপাখির মতো আরবি বর্ণ রপ্ত করেছে এবং জের-জবর-পেশ-নুক্তা অর্থাৎ হরকতের উপমহাদেশে প্রচলিত ধাঁচ অনুসারে কোরান পাঠ করতে শিখেছে। মিশরী হুজুর দেখলাম শুরু করেছেন অর্থ ব্যঞ্জনার সাপেক্ষে আরবি শব্দের ধ্বনি ও রূপমূল কেমন করে উচ্চারণে আয়ত্ত করতে হয় সেটা দিয়ে। ছেলে স্কাইপের মাধ্যমে কানেক্টেড হুজুরের কাছে কোরানের প্রাচীন ও ধ্রুপদি ভাষায় নিহিত ধ্বনি, রূপমূল ইত্যাদি একঘণ্টা ধরে কণ্ঠে লবজ করে এবং আমি মাঝেমধ্যে বসে অবোধ হয়ে শুনি। চর্চার অভাবে আরবি এখন আর সেভাবে বুঝি না, অগত্যা অবোধ হয়ে শ্রবণ ছাড়া উপায়ও নেই। তবে এটা টের পাই মিশরী হুজুরের কাছে তার কোরান পাঠ সম্পন্ন হওয়ার পর আমাদের ফারসি ও উর্দু প্রভাবিত পাঠের ধারায় সে আর কখনও ফেরত যেতে পারবে না!
এই ফিরতে না-পারাটা আরবি ভাষার ভাব-ব্যঞ্জনার সঙ্গে তার অতীত সংযোগে বিচ্ছেদ তৈরি করে। সে এখন সেই পাঠের ভিতর দিয়ে গমন করছে একজন আরব যেটি জন্মসূত্রে সহজাতভাবে নিজের রক্তে বহন করে এবং প্রাচীন এক ভাষিক ঐতিহ্যে গমনের মধ্য দিয়ে কোরানে নিজেকে রিলেট করায়। এখন বুঝি আরবদেশের গানের পাখি উম্মে কুলসুম (*বব ডিলান তাঁর গানের বিশেষ ভক্ত ছিলেন এবং ‘কুইন অব প্যারাডাইস’ নামে তাঁকে অভিহিত করেছিলেন।) যখন তাঁর গানে ভালোবাসা ও বিরহে বিদীর্ণ হন তখন মিশর বা আরব অঞ্চলের শ্রোতাদের মনে কেন কোরান পাঠের স্মৃতি জাগ্রত হয়! অথবা তারা এমতো ভাবতে থাকে, — এটা নিছক সংগীত নয় বরং আরবি শব্দের উচ্চারণরীতি অতুল রূপময়তায় ঝর্ণাছন্দে ‘এনতা ওমরি’ (*তুমিই আমার জীবন) বা ‘আলিফ লায়লা’ হয়ে কুলসুমের কণ্ঠ দিয়ে নামে! ছেলেবেলায় সুর করে কোরান পাঠের ফলে কুলসুমের কণ্ঠস্বরে আরবি ভাষার ধ্রুপদিছন্দ স্থায়িত্ব লাভ করে, যা তিনি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি ধরে রেখেছিলেন। আমাদের আরবি ভাষাশিক্ষায় উক্ত ভাষার ধ্বনি, রূপমূল ও শাব্দিক রূপকার্থ বা মেটাফর অনুভবে বিচিত্র ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতা থাকায় সময়ের সঙ্গে আমরা তা বিস্মৃত হই এবং পরবর্তীতে উর্দু নিদেনপক্ষে বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদ ছাড়া কোরানের কাছে যাওয়া অসম্ভব ঠেকে।
ব্যক্তিগত প্র্রসঙ্গ হলেও কথাগুলা এ-জন্য বলা, একজন আরবিভাষী হওয়ার কারণে ভাবব্যঞ্জনার যেসব পাঠসূত্রে সম্পৃক্ত থাকার দরুন ইউসুফ কারযাভী কোরানের আয়াত ও হাদিসকে ‘বোঝার ভুল’ বলে মার্কিং করতে পারেন সেটা ফারসি ও উর্দু প্রভাবিত ইসলাম চর্চায় মিসিং লিংকের সম্ভাবনা রেখে যায়। বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ মোহাম্মদ আসাদ নিজের অনূদিত কোরানের ভূমিকায় সমস্যাটি নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন। পারিবারিক সূত্রে অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি লেখক-সাংবাদিক-গবেষক ও কূটনীতিবিদ লিওপোল্ড উইজের মোহাম্মদ আসাদ নাম ধারণ করে ইসলাম গ্রহণ সেই সময় আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। কোরানের অনুবাদ ও ‘রোড টু মক্কা’ সহ (*‘জিবরাইলের ডানা’ গল্পের লেখক শাহেদ আলী সম্ভবত বইটি বাংলায় তরজমা করেছিলেন এবং যতদূর মনে পড়ছে বইটি সেই সময় পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছিল) ইসলাম বিষয়ক লেখনীর জন্য প্রশংসিত আসাদ ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে তাঁর সময়েই ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।
আল্লামা ইকবালের সঙ্গে আসাদের সখ্য বেশ নিবিড় ছিল এবং ইকবালের চিন্তাধারা তাঁকে সেই সময় প্রভাবিত করে বলেই জানি। মোহাম্মদ আসাদের সুযোগ্য পুত্র নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ স্যাকুলার চিন্তাচেতনায় অভ্যস্ত হলেও পিতার উত্তরাধিকার তাঁর রক্তেও প্রবাহিত। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে থেকে আরব অঞ্চলের জনগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষা-কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ট মোহাম্মদ আসাদ কোরান অনুবাদে হাত দেওয়ার পর কোরানের মর্মবাণী উপলব্ধির ক্ষেত্রে ইউরোপ মহাদেশের কোনও বাসিন্দার সঙ্গে একজন আরবের মানসিকতার পার্থক্য কী কারণে ঘটে সে-প্রশ্ন দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন। কোরান অনুবাদের ভূমিকায় প্রশ্নটি তিনি উত্থাপন করেছিলেন, যার সারার্থ অনুধাবন সম্ভবত জরুরি :—
প্রথমত, কোনও বিশ্বাসী মুসলমান যখন আরবিতে কোরান পাঠ যায় সে তখন এর মধ্যে ‘সৌন্দর্য’ ও সংহতি টের পায়, অথচ অবিশ্বাসী বা অন্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির কাছে কোরান ‘কর্কশ ও বিশৃঙ্খল’ মনে হতে থাকে! আসাদ মনে করেন এর মূল কারণ আরবি ভাষা রপ্ত করা অথবা না-করায় নিহিত নয়। আরবিতে পটু ব্যক্তির কাছে কোরানকে কর্কশ মনে হতে পারে, কারণ এর ভাষিক অনুষঙ্গ যেসব ঐতিহাসিক স্মারকের সাহায্যে সেকালের আরব গোত্রের সঙ্গে নিজের সংযুক্তি তৈরি করে তার সঙ্গে সর্বাগ্রে সংযুক্ত হওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে আরবিতে অবিরত কোরান পাঠ ও শ্রবণ ছাড়া নিজের কানে এর সাংগীতিক ব্যাঞ্জনা ও সুরধারা অনুভব করা সম্ভব নয়। ধ্রুপদি আরবি ভাষা রপ্ত করলে কাজ ফুরিয়ে যায় না। আধুনিক আরবি ভাষার সঙ্গে প্রাচীন ভাষারীতির দূরত্ব ও ব্যবধান উপলব্ধি করা, আরব-অঞ্চলে লম্বা সময় ধরে অবস্থান, এবং মরুর বুকে এখনও সচল বেদুইন গোত্রের সঙ্গে নিবিড় উঠবস ছাড়া কোনও ব্যক্তির পক্ষে কোরানে ব্যবহৃত ভাষাকাঠামোর সৌন্দর্য, তার অর্থগত সুসামঞ্জস্য ও শাব্দিক রূপকার্থের মর্ম নিজের ‘আকল’-এ ধারণ করা সম্ভব নয়। অন্যথায় আরবি ভাষা রপ্ত করা সত্ত্বেও কোরান তার কাছে নিছক আক্ষরিক অর্থে পঠিত হতে থাকবে এবং সেভাবে ব্যাখ্যায় লিপ্ত হতে তাকে প্ররোচনা দিয়ে যাবে।
*আসাদের বক্তব্যের সঙ্গে সংযোজক কিছু কথা এখানে যোগ করা প্রয়োজন, সমকালে এই অভিজ্ঞতাটি ঘটে সালাত আদায়ের ক্ষণে ইরাকদেশি রাদ আল–কুর্দির কোরান তেলাওয়াত শ্রবণে। ভয়েস কোয়ালিটি বা স্বরগ্রাম ব্যবহারের মুন্সিয়ানা তো রয়েছে তবে বড়ো ঘটনা হচ্ছে কোরান পাঠের সময় রাদের স্বতঃস্ফূর্ত নির্লিপ্ত প্রবহমানতা শ্রোতাকে কোরানের সাংগীতিক মাধুর্যে বশীভূত করে ফেলে। পাঠ শেষ হয় কিন্তু শ্রোতার কানে জলতরঙ্গের মতো তিনি বইতে থাকেন! কোরান রিসাইটার হিসেবে রাদের বিশেষত্ব হলো অন্য ক্বারীদের মতো তিনি কায়দা–কসরতের ধার ধারেন না; অবিশ্বাস্য এক সহজতায় তাঁর কণ্ঠ সূরাগুলো পাঠ যায়! কিশোর কুমার যে–সহজতায় গানের কথা ও সুর গলায় তুলতেন, অনেকটা সেরকম ঘটনা রাদের কোরান রিসাইটেশনে ঘটে; এবং জাদু বা সম্মোহনটা সেই অব্যক্ত সহজতায় লুকিয়ে থাকে, যার ইঙ্গিত আসাদ তাঁর বক্তব্যে রেখে গেছেন। আগ্রহী পাঠক যাঁরা এখনও হয়তো শ্রবণ করেননি, তাঁরা রাদের রিসাইটেশন ইউটিউবে সহজেই শুনতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে বিশেষভাবে মূসার জীবনকাহিনি সূরা ‘আল–কাসাস’ শ্রবণের অনুরোধ রইল।
দ্বিতীয়ত, কোরানে আল্লাহর ‘আমি ও আমরা’ উভয় বচনে ব্যক্ত হওয়ার ঘটনায় পশ্চিমের লোকজন তাঁর ‘একত্ব’ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বা নানান প্রশ্ন উঠায়, সেখানে একজন আরবকে ভাষার এমনধারা প্রয়োগ নিয়ে তিলেক বিচলিত হতে দেখা যায় না! সে বিচলিত হয় না কারণ কোরানে আল্লাহ ম্যাসেজটা দিতেই থাকেন, একজন ব্যক্তির বেলায় ‘আমি’ ও ‘আমরা’ সংখ্যাগত ব্যবধান ঘটায় কিন্তু আল্লাহর বেলায় সেটা প্রযোজ্য নয়। ‘আমি’ বাচ্যে সম্বোধনের ক্ষণে তিনি যেমন এক ও অদ্বিতীয় থাকেন, ‘আমরা’ সম্বোধনে সেই একত্বে হানি ঘটে না। কোরান তাই ক্লিয়ার করে আল্লাহর অজ্ঞেয় সত্তার ভাষিক বিবরণ প্রদানে আরবি ভাষার রীতি অনুসারে ‘আমি বা আমরা’ শব্দের প্রয়োগে তাঁর মৌল প্রকৃতিতে বিকার সৃষ্টি করতে পারে না। ব্যক্তি বা সমষ্টির প্রতিরূপ না হওয়ার কারণে তিনি সর্বাবস্থায় ‘মৌল কারণ’ হয়ে বিরাজ করেন। তিনি সৃষ্টি করেন কিন্তু নিজেকে সৃষ্টির সঙ্গে লীন বা একীভূত করেন না এবং তাঁকে সেখানে একীভূত ভাবাও যায় না। আল্লাহর একত্ব যৌগিক নয় বরং অবিভাজ্য সংখ্যার উপমা এবং সে-জন্য তাঁকে ভাগ করা সম্ভব নয়। অবিভাজ্য হওয়ার কারণে তিনি সকল দশায় ‘এক’ রূপে বিদ্যমান থাকেন এবং এটা হচ্ছে ইসলামে তাওহিদের সারার্থ। একজন ইসলামবিশ্বাসী আরবিভাষীর হৃদয়ে ‘তাওহিদ’ জলের মতো সহজাত হওয়ার কারণে ‘আমি বা আমরা’ নিয়ে পশ্চিমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তির ন্যায় তার মনে গোল বাঁধে না।
নিজের অনূদিত কোরানের ভূমিকায় আসাদ এই মতে স্থির হয়েছিলেন, কোরান সম্পর্কে ধারণা অর্জনে আরবি ভাষায় দক্ষতা শেষ কথা নয়। পুঁথিগত বিদ্যা এবং আরব অঞ্চলের শিক্ষিত নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে উঠবস দরকারি হলেও কোরানের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক পটপ্রবাহ অনুভবে সেটা যথেষ্ট নয়। কোনও ব্যক্তি চর্চার মাধ্যমে আরবিতে ওস্তাদ হয়ে উঠতে পারেন কিন্তু কোরানের ধ্রুপদি ভাষারূপ যারা নিজের জীবনে সহজ ছন্দে ধারণ করে তাদের উটে সওয়ার হওয়া ছাড়া তার হৃদয়ে সেই সহজাত অনুভবের (instinctive “feel”) তরঙ্গ বহে না যেটি কোরানের অর্থ ও স্ববিরোধিতা বোঝার একমাত্র চাবি! আসাদ তাই মন্তব্য ঠুকেছেন :—
This does not, however, mean that a non-Arab can never understand Arabic in its true spirit: it means no more and no less than that he cannot really master it through academic study alone, but needs, in addition to philological learning, an instinctive “feel” of the language. — Source: The Meaasge of The Quarn, Introduction and Translated by Muhammad Asad; PDF Edition.
আসাদের বক্তব্যের সঙ্গে এই জায়গায় দ্বিমতের অবকাশ নেই। পৃথিবীর কোনও ভাষা স্রেফ পুঁথিগত পদ্ধতির ভিতরে গমনের সাহায্যে রপ্ত করার বিষয় নয়; তার সঙ্গে শব্দার্থ, ধ্বনি-ব্যঞ্জনা ও রূপমূলসহ শাব্দিক রূপকার্থের স্থানিক সম্পৃক্তি মাথায় নিয়ে তবে সেই ভাষার পাঠে নামতে হয়। কোরান-হাদিস ইত্যাদি টেক্সটের পাঠে বিশেষভাবে বাংলা ভাষায় যেসব অনুবাদ ঘেঁটেছি তার সবগুলো তাই কমবেশি আড়ষ্ট মনে হয়েছে। এর কারণ বাংলা ভাষায় যিনি তরজমায় হাত লাগান তাঁর মাতৃভাষাজ্ঞান সেক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়। ইংরেজি বরং পেশাদারিত্বের কারণে সুখকর হলেও পরিভাষাগত জটিলতা সেখানেও কমবেশি বিদ্যমান মনে হয়েছে। এসবের খারাপ দিক হচ্ছে শব্দের ভ্রান্ত তরজমা এবং ততধিক ভয়ানক ভ্রান্ত ব্যাখ্যা।
মিশরের স্ব-ঘোষিত সংস্কারপন্থী ড. তাওফিক হামিদ যেমন মনে করেন কোরানে ব্যবহৃত শব্দার্থের ভ্রান্ত প্রয়োগ সাধারণ মুসলমানকে শুধু জিম্মিই করেনি উলটো নব্য চরমপন্থীদের উত্থানের পেছনে এর দায় অনেকখানি। ইসলামে চরমপন্থা নিয়ে অনুসন্ধানী কিতাব ‘Inside Jihad: Understanding and Confronting Radical Islam’ ছাড়াও হামিদের বিভিন্ন লেখাপত্র ও বক্তৃতায় কোরানের আয়াতে ব্যবহৃত শব্দার্থের ফ্যাক্টস বা ঘটনাপ্রবাহ হৃদয়ঙ্গমে আমজনতা থেকে বিশেষজ্ঞদের ভ্রান্তির বিষয়টি প্রায়শ উদাহরণ হয়ে আসে। এই যেমন ‘আমি কেন ইসরায়েলকে ভালোবাসি’ শিরোনামে নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে একজন মুসলমান কী কারণে ‘ইহুদি’ শব্দটিকে ঘৃণার চোখে দেখে সে-প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হামিদ এই ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন, — ‘ইহুদি’ শব্দের সঙ্গে মুসলমানের সম্পৃক্তির ধরন হচ্ছে মূল সমস্যা যা তার মনে ঘৃণা উসকে দিতে সাহায্য করে। তাঁর মতে প্রথমত তিনি ইসরায়েলকে ভালোবাসেন কারণ কোরানে এই শব্দটি আল্লাহ প্রেরিত সেই নবির কথা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যাঁকে স্রষ্টা স্বয়ং ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ (Promised Land) ও নিজের লোকজন নিয়ে সেখানে স্থায়ী হওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন; যে-ভূমি কার্যত তাঁর নামেই এখন পরিচিত। তো ইসরায়েল শব্দকে ঘৃণা করতে গেলে তাঁকে নবি ইসরায়েলকে ঘৃণা করতে হয়, যা একজন মুসলমান হিসেবে তিনি চিন্তাও করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত আরববিশ্বে সিংহভাগ মুসলমান বাল্যকালে ‘ইসরায়েল’ (Israel) শব্দটিকে জান কবজকারী মালাইক বা ফেরেশতা ‘আজরায়েল’র (Azraeil) সঙ্গে সম্পৃক্ত ভেবে উচ্চারণ করে; ধ্বনিগত মিলন থাকলেও উভয় শব্দের অর্থ শুধু ভিন্ন নয়, তারা সম্পূর্ণ পৃথক ঘটনাও বটে! উচ্চারণবিধির এই দুর্ঘট অনিচ্ছাকৃত হলেও মুসলমানের মনোজগতে শব্দ দুটি লিংক বা সংযুক্তির জন্ম দিয়ে যায় এবং প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ‘ইসরায়েল’ ও জান কবজকারী মালাইক ‘আজরায়েল’ বালকের কাছে অভিন্ন হয়ে ওঠে। অভিন্নতার এই ছাপটি বালেগ হওয়ার পরেও নিজের মনোজগতে সে অজান্তে বহন করে চলে। ‘ইসরায়েল’ রাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলমান বিশ্বের বাদবিবাদের বহমান স্রোতে ‘ইসরায়েল’ শব্দটি যখনই সামনে আসে তার তখন ‘আজরায়েল’-এর কথা মনে পড়ে যায়! এই মনঃস্তত্ত্ব তাকে কোরানে বর্ণিত পটভূমিতে গমন করতে কিংবা নবি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইহুদি গোত্রের ঐতিহাসিক ভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচ্যুতির কার্যকারণ উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সমস্যার অতল খুঁজতে বাধা দেয়।
তৃতীয়ত হামিদ ‘ইহুদি’ শব্দটিকে ‘ল্যভ’ (Love) করেন, কারণ আরবি উচ্চারণবিধি অনুসারে ইহুদি মূলত ‘হাদু’ (Hado) ও ‘হুদনা’ (Hudna) শব্দের মিলন থেকে সৃষ্ট ‘ইয়াহুদ’ (Yahood) শব্দকে ধারণ করেছে এবং এর কোরান নির্দেশিত অর্থ ও ইতিহাস একজন মুসলমানের উপলব্ধি করা উচিত। ‘ইয়াহুদ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মহান স্রষ্টার নিকটে ফেরত আসা বা প্রত্যাবর্তন (Returned Back)। কোরানে আল্লাহ ‘ইয়াহুদ’ নামক গোত্রকে গোমরাহীর পথ পরিহার করে তাঁর নিকটে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। পুরস্কার হিসেবে তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’। এটা সেই ভূমি যার খবর তিনি ইব্রাহিমকে দিয়েছিলেন এবং নবি ইসরায়েলকে সে-সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। অতঃপর মূসাকে প্রেরণ করেন পথপ্রদর্শক নবি রূপে, যেন তারা ফেরাউনদের গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করে আজাদি লাভ করতে পারে। তারা যদি সঠিক পথে ফেরত আসে তবে মূসার নেতৃত্বে ‘নিজ দেশ’-এ আজীবন স্থিত থাকার সুযোগ পাবে। এখন ‘ইয়াহুদ’ গোত্রকেও মোহাম্মদের মাধ্যমে একই বার্তা তিনি প্রেরণ করছেন; এবং ‘হাদু’ গোত্র যেমন একসময় সেই আহবান গ্রহণ করে সত্যপথে ফেরত এসেছিল, তাদেরকেও তিনি স্রষ্টার পথে ফিরে আসার আহবান জানাচ্ছেন। তো এই দুটি শব্দের মিলন থেকে উদ্ভূত ‘ইয়াহুদ’কে হামিদ ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের চলমান Land settlement জটিলতার জের ধরে অস্বীকার যাওয়া কিংবা গোটা ‘ইহুদি’ জনগোষ্ঠীকে শুক্রবারের বয়ানে ‘বানর ও শূকর’ ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করতে নিজ আপত্তির কথা জানিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না।
কোরানে সংকলিত শব্দার্থকে কীভাবে পাঠ, তরজমা ও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে হামিদের কাছে সেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কোরান শিক্ষার প্রচলিত ও বিশ্বস্বীকৃত পদ্ধতি স্বয়ং ভ্রান্তির ওপর দাঁড়ানো বলে তিনি মনে করেন। হান্টিংটনের পশ্চিম ও আরব সভ্যতার সংঘাত বিষয়ক বিখ্যাত টেক্সটের সূত্র ধরে রচিত নিবন্ধে কোরানে সংকলিত শব্দার্থের ভ্রান্ত পাঠ প্রসঙ্গে তিনি তাই আবারও ফেরত যান। কোরান শিক্ষার ক্ষণে Infidel বা ‘কাফির’ শব্দের সঙ্গে একজন মুসলমানকে কীভাবে পরিচিত করানো হয় সে-বিষয়টি তাঁর উপজীব্য হয়ে ওঠে। হামিদ জানান ইসলাম প্রচার-প্রতিষ্ঠার বিক্ষুব্ধ দিনগুলোয় মক্কা ও মদিনার অবিশ্বাসী গোত্র সমূহের সঙ্গে মহানবির বিবাদের সুবাদে ‘কাফির’ শব্দ কোরানে ব্যাপকতা লাভ করে। এখন শব্দটির আগে প্রত্যয় বা সাফিক্স (Suffix) হিসেবে আরবি ‘আল’ (Al) ও ‘আলাজিনাহ’র (Alazhina) ব্যবহার অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তির নজর এড়িয়ে যায় অথবা তাঁরা একে গুরুত্ব দিতে ভুলে যান! এর ফলে দলমতনির্বিশেষ সকল অবিশ্বাসীকে ‘কাফির’ নামক টেক্সটে তাঁরা একত্র করেন এবং শব্দটির সরলীকরণ ও ভ্রান্ত প্রয়োগ ঠেকানোর পথটি তখন রুদ্ধ হয়ে যায়!
সাফিক্স (Suffix) বা মূল শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত করার রীতি অনুসারে ইংরেজিতে ‘The’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং এভাবে মূল শব্দে ধৃত অর্থকে সেখানে নির্দিষ্ট করা হয়। কোরানের আয়াতে ‘কাফির’ শব্দের আগে আরবি ‘আল’ (Al) ও ‘আলাজিনাহ’র (Alazhina) অনুরূপ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। হামিদের কাছে বিষয়টি তাৎপর্যবহ মনে হয়েছে, কারণ কোরানে যখন কাফির বা অবিশ্বাসীকে হত্যার কথা বলা হচ্ছে (দ্রষ্টব্য : সূরা ‘তওবা’র ৫ নাম্বার বা এরকম আরও বহু আয়াত) তখন সেখানে আরবি ‘মান কাফের’ (Man Kafar) আর ‘আল-কাফিরুন’ (Al-Kafereen) শব্দের প্রয়োগ অর্থবিচারে এক বস্তু নয়। দুটি শব্দের সেমিওটিক্স সম্পূর্ণ আলাদা। ‘মান কাফের’ যে-কোনও কাফির বা অবিশ্বাসীর প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়, পক্ষান্তরে ‘আল-কাফিরুন’ নির্দিষ্ট ব্যক্তি-গোত্র বা গোষ্ঠীকে বোঝায় এবং কোরানে সেই নির্দিষ্টতার সাপেক্ষে এর ব্যবহার ঘটেছিল। সাফিক্সের এহেন প্রয়োগকে বিবেচনায় নিলে তবেই মোহাম্মদ কোন পরিপ্রেক্ষিতে কাকে ‘কাফির’ বলছেন এবং কেন বলছেন সেটার তল পাওয়া সম্ভব, অন্যথায় এর সরলীকরণ ও ইতিহাস-বিচ্যুত অপব্যবহার ঠেকানো যাবে না। হামিদ তাই মন্তব্য করছেন :—
Therefore, emphasizing the meaning of “The” in the Quranic verses can serve to better prevent many young Muslims from pursuing the path of generalized violence. Without teaching the text in this manner, we actually allow radicals to use such texts to win the hearts and minds of young Muslims. — Source: Can Fresh Interpretations Of Islamic Text Prevent A Possible ‘Clash Of Civilizations?’ By Dr. Tawfik Hamid; The Collected works Of Tawfik Hamid: Observations on Radicalized Islam; 2009-2011; PDF Edition.
হামিদ তাঁর নিবন্ধে ইহুদি প্রসঙ্গ পুনরায় টেনেছেন এই ভ্রান্তি নিরসনের প্রয়োজনে, Jews বা ইহুদি বলতে আমরা এখন যেমন বুঝি তার সঙ্গে কোরানের বুঝের তফাত রয়েছে। কমপক্ষে পাঁচটি ঐতিহাসিক ইহুদি গোত্র বা সম্প্রদায়ের উল্লেখ কোরানে পাওয়া যায়। প্রথমত ‘ইয়াহুদ’, যাদের সঙ্গে মোহাম্মদের বিবাদ ঘটেছিল। দ্বিতীয়ত ‘আলজিনা হাদু’ যারা স্রষ্টার আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করেছিল। তৃতীয়ত বনি ইসরায়েল বা নবি ইসরায়েলের বংশধর, যাদের উল্লেখ চারটি ঐশী গ্রন্থে কমবেশি ব্যাপক আকারে পাওয়া যায়। এবং বাকি দুটি অর্থাৎ ‘আসহাব আল-সাবত’ ও ‘আসহাব মূসা’ সরাসরি মূসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দুটির মধ্যে প্রথমটি একটি গ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত গোত্র যারা মূসাকে নবি বলে মানতে আপত্তি জানিয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি নবি ইসরায়েলের বংশধারার সঙ্গে যুক্ত কিনা সে-নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকে মনে করেন মিশরবাসের সূত্রে তারা ইসরায়েলের বংশধর বটে। তবে তারা হচ্ছে সেই গোত্র যারা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র সন্ধানে মিশর থেকে মূসার সঙ্গে সাগর পাড়ি দিয়ে চল্লিশ বছরের লম্বা সফরে শরিক হয়েছিল! যাদেরকে এখন নবি ইসরায়লের বংশধর ভেবে বনি ইসরায়েল (বা বনি ইসরাইল) নামে সম্বোধন করা হয়।
তো এ-রকম আরও বিভিন্ন ইহুদি গোত্র সেকালের আরবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত এবং কোরানে তারা সাফিক্স সূত্রে নির্দিষ্টতা সহকারে উল্লেখিত হলেও পরবর্তী পাঠ ও ব্যাখ্যায় সকলকে ‘ইহুদি’ বলে দাগানো হতে থাকে। এই সরলীকরণ হচ্ছে বিপদজনক ফাঁদ যেটি একজন মুসলমানের মনোজগতে ইহুদিকে ঐতিহাসিকভাবে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত সম্প্রদায় ভাবতে বাধ্য করে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান সমস্যাকে এই ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে সে যখন পাঠ যায় তখন তাকে ঘৃণা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও বিকল্প তার মাথায় আসে না। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি তাই লেগেই থাকে। হামিদের ভাষায় :—
All of these Arabic expressions are interpreted and translated simply as “Jews.” However, this incorrectly targets all Jews throughout history, even those in the present day…In fact, Muslim scholars who insult the Children of Israel must realize that most of the messengers described in the Quran belong to these Children. Therefore, insulting all the Children of Israel by labeling Jews as pigs and monkeys is an insult to these messengers. Such an insult is considered a grave sin in Islam. In fact, the Quran actually has positive verses about the Children of Israel (Quran 2:47; 44:32; 45:16). — Source: Can Fresh Interpretations Of Islamic Text Prevent A Possible ‘Clash Of Civilizations?’ By Dr. Tawfik Hamid; The Collected works Of Tawfik Hamid : Observations on Radicalized Islam; 2009-2011; PDF Edition.
হামিদের বক্তব্য নিয়ে মূলধারার ইসলামে মতভেদ থাকলেও তাঁর ভিন্নমাত্রার ব্যাখ্যা অন্যভাবে এই ইঙ্গিত উঠায়, কোরানকে টেক্সট হিসেবে বাহ্যত যতটা সরল ও অগভীর মনে হয় বাস্তবে এই গ্রন্থটি নিবিড় পঠন ও চিরুনিতদন্ত দাবি করে, যা কেবল পশ্চিমা সাহেব বিরচিত কিতাব দিয়ে অনুধাবনের বিষয় নয়। এর জন্য প্রাচীন ও আধুনিক আরবি ভাষা ও কৃষ্টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রয়োজন। মোহাম্মদ আসাদ তাঁর অনূদিত কোরানের ভূমিকায় যেসব প্রসঙ্গ টেনেছিলেন কোরানের অনুবাদ ও ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে সেগুলো হয়তো গভীরভাবে বিবেচনা করার সময় হয়েছে। যে-কোনও ধর্মের ইতিহাস প্রাচীন ও সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এ-সম্পর্কিত অনুসন্ধানে পূর্ব-ধারণা পরিহার করে খোলা মনে অগ্রসর হওয়ার বিকল্প নেই। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ভাবুকতার জায়গা থেকে দর্শন ও বিজ্ঞান সৃষ্ট যুক্তির সাহায্যে ধর্মবিশ্বাসকে বাতিল করা এক জিনিস আর তার ঐতিহাসিক পটভূমি ও বর্তমানে কেন সে প্রাসঙ্গিক তার অনুসন্ধান পৃথক বিষয়। দুটোর মধ্যে যিনি গোল বাঁধান তিনি আসলে কিছু দাঁড় করাতে পারলেন কি না এই প্রশ্নটি তাঁকে করা উচিত।
অনুবাদ ও ব্যাখ্যার জটিলতা উপলব্ধির খাতিরে আরেকটি উদাহরণ টানা যাক; — কানাডাপ্রবাসী উদারপন্থী হাসান মাহমুদ অনেকদিন যাবত ইসলাম বিষয়ে লেখালেখির সঙ্গে সংযুক্ত। তাঁর কোনও এক লেখায় (*যতদূর মনে পড়ে কারযাভীর গানবাজনা বিষয়ক বক্তব্য নিয়ে লেখাটা তিনি লিখেছিলেন) দেশবরেণ্য আলেম মাওলানা মুহিউদ্দিন কর্তৃক কিছু আয়াতের অনুবাদে ভুল অর্থ আরোপণের নমুনা তিনি পেশ করেছিলেন। মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী-র বিখ্যাত তফসিরগ্রন্থ ‘মা আরেফুল কোরান’-এর অনুবাদ এবং আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে মুহিউদ্দিনের নাম জড়িয়ে আছে। ‘মদীনা’ নামে ধর্মীয় সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘ দিন। পাঠপকপ্রিয় সেই সাময়িকীর পাঠ আমাদের কৈশোরে নিয়মিত ঘটনা ছিল। ‘মদীনা’ অর্থোডক্স চিন্তাধারা লালন করলেও বেশ গোছানো কাগজ ছিল মানতে হবে। সেই মুহিউদ্দিন নাকি কোরানের সূরা ‘লোকমান’ ও ‘বনি ইসরাইল’-এর দুটি আয়াত সরাসরি গানবাজনার সঙ্গে সম্পৃক্ত এই ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন এবং আয়াত দুটির তরজমা তিনি সেভাবে সম্পন্ন করেছেন। ‘লোকমান’-র ৬ ও ‘বনি ইসরাইল’-এর ৬৪ নাম্বার আয়াতের তরজমায় মুহিউদ্দিন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন যারা গানবাজনা করে সেইসব লোক ‘অবান্তর কথাবার্তা’র মাধ্যমে লোকজনকে বিপথে টানে ইত্যাদি। যদিও মূল আরবি থেকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় যাঁরা অনুবাদ করেছেন তাঁরা গানবাজনার প্রসঙ্গ জুড়ে উক্ত আয়াত দুটির ভাষান্তর করেননি।
হাসান মাহমুদ ভুলটা মার্কিং করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন ‘লোকমান’-এর ৬ নাম্বার আয়াতে ‘অবান্তর কথাবার্তা’ মানে ‘অবান্তর কথাবার্তা’-ই এবং অন্যকিছু নয়; অর্থাৎ ননসেন্স টক্ বলতে লোকে যেমন বুঝে থাকে সেটাই সেখানে বোঝানো হয়েছিল। অন্যদিকে ‘বনি ইসরাইল’-এর ৬৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তাঁর চিরন্তন শত্রু শয়তানকে প্রতীকার্থে অনুমতি দিয়েছিলেন, মানুষকে সত্য থেকে বিপথগামী করার কাজে সে তার কণ্ঠস্বর ও লোকলস্কর নিয়ে যা মন চায় করতে পারে এবং তিনিও দেখতে চান সে কতদূর কী করতে পারে ইত্যাদি। যদিও মুহিউদ্দিন শয়তানের কণ্ঠস্বরকে রাগ-রাগিণী ও গানবাজনা ইত্যাদির সঙ্গে জুড়ে তরজমার কাজটি সেরেছিলেন! মুহিউদ্দিন সাহেবের এই অনুবাদের সঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশন (*মূল আরবি সহ প্রখ্যাত কোরান অনুবাদক আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী-র ইংরেজি ভাষান্তর তাঁরা অনুবাদে সংযুক্ত করেছেন। বাংলা অনুবাদে ভাষাগত আড়ষ্টতা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক এই তরজমাকে তুলনামূলক যত্নশীল, সতর্ক ও বিবেচক মনে হয়েছে।) ছাড়াও অন্যান্য অনুবাদের মিল আমি নিজেও খুঁজে পাইনি। ফাউন্ডেশনের অনুবাদটি ছিল এ-রকম :—
‘মানুষের মধ্যে কেহ কেহ অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ হইতে বিচ্যুত করিবার জন্য অসার বাক্য ক্রয় করিয়া নেয় এবং আল্লাহর পথ লইয়া ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। উহাদেরই জন্য রহিয়াছে অবমাননাকর শাস্তি।’ — লোকমান ৩১:৬;
‘তোমার আহ্বানে উহাদের মধ্যে যাহাকে পারো পদস্খলিত করো, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা উহাদেরকে আক্রমণ করো এবং উহাদের ধনে ও সন্তান-সন্ততিতে শরিক হইয়া যাও ও উহাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও। শয়তান উহাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় উহা ছলনা মাত্র।’ — বনি ইসরাইল/ইসরা ১৭:৬৪;
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রণীত ‘কোরানশরিফ : সরল বঙ্গানুবাদ’ সাধারণ পাঠকের কাছে বেশ জনপ্রিয় বলেই জানি। তাঁর অনুবাদ ফাউন্ডেশনের অনুবাদ থেকে অধিক দূরবর্তী ছিল না :—
‘মানুষের মধ্যে কেউ-কেউ অজ্ঞ লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অসার বাক্য বেছে নেয় ও আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রুপ করে। ওদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ — লোকমান ৩১:৬;
‘তোমার কণ্ঠস্বর দিয়ে ওদের মধ্যে যাকে পারো সত্য থেকে সরিয়ে নাও, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে ওদেরকে আক্রমণ করো, আর ওদের ধনসম্পদে ও সন্তানসন্ততিতে শরিক হও, আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাও।’ — বনি ইসরাইল/ইসরা ১৭:৬৪;
উৎস : কোরানশরিফ; সরল বঙ্গানুবাদ; ভাষান্তর : মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান; মাওলা ব্রাদার্স; পিডিএফ সংস্করণ।
বাংলা ভাষায় কোরান অনুবাদের পথিকৃৎ বলে নন্দিত ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের আদি অনুবাদও পরবর্তী অনুবাদের সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে সেই সময় প্রণীত হয়েছিল :—
‘এবং মানবমণ্ডলীর মধ্যে কেহ আছে যে, অজ্ঞানতা-প্রযুক্ত ঈশ্বরের পথ হইতে (লোকদিগকে) নিবৃত্ত রাখিতে আমোদজনক আখ্যায়িকা ক্রয় করে, এবং তাহাকে (ইশ্বরের পথকে) উপহাস করিয়া থাকে; ইহারাই, ইহাদের জন্য দুর্গতিজনক শাস্তি আছে।’ — লোকমান ৩১:৬;
‘এবং তুমি আপন ধ্বনিতে তাহাদের যাহাকে সুক্ষম হও, বিচলিত কর ও তাহাদের উপর আপন অশ্বারূঢ় ও পদাতিক সৈন্য আকর্ষণ কর, এবং সন্তান ও সম্পত্তি বিষয়ে তাহাদের অংশী হও, এবং তাহাদের সঙ্গে অঙ্গীকার কর; নিশ্চয় শয়তান প্রবঞ্চনা ব্যতীত তাহাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করে না।’ — বনি ইসরাইল/ইসরা ১৭:৬৪;
উৎস : কোর্–আন্ শরীফ; ভাষান্তর : ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, চতুর্থ সংস্করণ ১৯৩৬; নববিধান পাবলিকেশন কমিটি, কলকাতা; পিডিএফ সংস্করণ।
গিরিশচন্দ্র সেনের তৎসমবহুল অনুবাদে ইসলামি পরিভাষার বঙ্গীয়করণের ধরন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এবং কালের বিচারে এখন আর সেভাবে পঠিত না হলেও তাঁর ভাষাশক্তি ও শব্দপ্রয়োগ হালের অনেক অনুবাদকের চেয়ে উত্তম ছিল সে-ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। সূরা ‘লুকমান’-র অনুবাদে ব্যবহৃত ‘আখ্যায়িকা’র ব্যাখ্যায় গিরিশ দুটি কাহিনিসূত্র তাঁর টীকাভাষ্যে উল্লেখ করেছিলেন। একটি হচ্ছে হারেসের পুত্র নসর ব্যবসা উপলক্ষে পারস্য গমন করে এবং সেখান থেকে বীর রুস্তম ও আসফন্দিয়ার আখ্যায়িকা ক্রয় করে আনে ও কোরাইশদের সমুখে তা পাঠ করে। কোরাইশরা তখন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, মোহাম্মদ যদি পুনরায় আদ-সামুদ অথবা দাউদ-সোলায়মানের কাহিনি বর্ণনা করে তবে তারা রুস্তম ও আসফন্দিয়ার কাহিনি তাঁকে শুনিয়ে দেবে; যেন সে বুঝতে পারে তাঁর বর্ণিত কাহিনির চেয়ে রুস্তমের কাহিনি অনেকবেশি চমকপ্রদ ও মনোহর। এই পটভূমি উক্ত আয়াত নাজিলে ভূমিকা রাখতে পারে বলে গিরিশ অনুমান করেছেন।
দ্বিতীয় কাহিনিসূত্র গানবাজনার সঙ্গে সম্পর্কিত বটে। দাসী কেনাবেচার চল সেকালে আরব গোত্রে ব্যাপক ছিল। সুকণ্ঠী দাসী ক্রয় ও তাকে নিয়ে নাচগানের আসর বসানোর রেওয়াজ মক্কায় অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। কোরাইশ গোত্র যথারীতি এই কাজে অভ্যস্ত ছিল। মোহাম্মদকে বিব্রত করার জন্য অনেকসময় ইচ্ছে করে সুকণ্ঠী দাসী অর্থাৎ সেকালের বাইজি গানের আসর বসানো হতো; গিরিশের ভাষায় ‘তাহাদের সুমধুর সঙ্গীত শ্রবণে মুগ্ধ হইয়া লোকে হযরতের প্রচারিত সুসমাচার শ্রবণে বিরত থাকিত।’ গিরিশ যে-দুটি কাহিনি উল্লেখ করেছেন তার সমর্থন মাওলানা মওদুদীর তফসির ‘তাহফিমুল কোরান’সহ অন্যত্রও পাওয়া যায়। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে মওদুদী সেখানে মোহাম্মদের আদি জীবনী রচয়িতা ইবনে ইসহাক ও কতিপয় হাদিসকে রেফ্রেন্স হিসেবে উল্লেখও করেছেন।
ওদিকে ‘বনি ইসরাইল’ সূরার বিশেষ আয়াতের টীকাভাষ্যে ‘আপন ধ্বনি’র ব্যাখ্যায় গিরিশ লিখেছেন, — ‘ঈশ্বরের অনভিপ্রেত যে শব্দ উচ্চারিত হয়, তাহাই শয়তানের শব্দ।’ মওদুদীর তফসির অবশ্য এ-ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করেনি। সূরা ‘বনি ইসরাইল’-এর আয়াতসূত্রে তিনি যদিও খাজুরি আলাপ বা ননসেন্স টক্-র প্রসঙ্গ টেনেছেন, যার কথা হাসান মাহমুদ তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। তবে কথা হচ্ছে মুহিউদ্দিনকে কামান দাগতে গিয়ে মাহমুদ নিজেও কম ভ্রান্তিতে পতিত হননি। তিনি আদৌ কতটা কী গভীরে ঢুকেছেন সে-সন্দেহ তাই থেকে যায়। আয়াতের অনুবাদ বিচারে তাঁর মার্কিং ভুল নয় কিন্তু মুহিউদ্দিন কী কারণে গানবাজনার সঙ্গে জুড়ে আয়াত দুটি তরজমা করেন এবং বাকিরা কেন সেদিকে গমন করেননি তার আদিঅন্ত যাচাই করা উচিত ছিল। অবশ্য আদিঅন্ত যাচাই না করে রেফ্রেন্স ব্যবহারের প্রবণতা হাসান মাহমুদ ছাড়াও আরও অনেকের মধ্যে বেশ প্রবল। এটা তাঁদের বক্তব্যকে সন্দেহজনক ও অগভীর ভাবতে বাধ্য করে। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যতার পরিপন্থী বটে। সপ্তম প্রবাহে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সূত্রে এ-নিয়ে বৃহৎ আলোচনা রয়েছে বিধায় আপাতত সেদিকে না যাই।
সে যা-ই হোক, শয়তানের গলার আওয়াজ ইউসুফ আলী কৃত ইংরেজি প্রতিবর্ণায়ন অনুসারে (seductive) Voice নামে ফাউন্ডেশনের অনুবাদে উল্লেখিত হয়েছে। আলী-র কোরান অনুবাদের স্বীকৃত অনলাইন সংস্করণে উক্ত আয়াতের যৎসামান্য ভাষিক পরিমার্জনা চোখে পড়লেও (seductive) Voice সেখানেও অবিকৃত পাওয়া যায়। শয়তানের কণ্ঠস্বর থেকে যে-স্পিচ বা কথাবার্তা বের হয় তা মানুষকে বিপথে চালিত ও সম্মোহিত করার ক্ষমতা রাখে সেটা বোঝানোর খাতিরে তিনি শব্দটি প্রয়োগ করেছিলেন। যদিও আলী-র অনুবাদে (seductive) Voice শব্দের প্রয়োগ যে-তীব্রতা নিয়ে আসে ফাউন্ডেশনের বঙ্গানুবাদে সেটা রক্ষিত হয়নি। চতুর ও সম্মোহক কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করার ঘটনা বুঝাতে অনুবাদক সেখানে ‘আহ্বান’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা ইংরেজি শব্দের অভিঘাতকে ধারণ করেছে বলে মনে হয়নি।
এক্ষেত্রে মোহাম্মদ আসাদকৃত অনুবাদের সঙ্গে ফাউন্ডেশনের অনুবাদ অধিক সংগতিপূর্ণ ধরা যায়। আসাদ তাঁর অনুবাদে শয়তানের কণ্ঠস্বর বা আওয়াজ বুঝাতে Voice শব্দটাই শুধু রেখেছেন, — ‘Entice, then, with thy voice such of them as thou canst,..’ [দ্রষ্টব্য : The Message of The Quran : Translated by Muhammad Asad)। আরবি ‘মিন্-হুম বিসাওতিকা’ অর্থাৎ শয়তানের গলার স্বর নিয়ে আসাদ থেকে আলী সকলে বিপাকে পড়েছেন দেখে মুহিউদ্দিন সাহেব মনে হয় সেটা অনুমানের চেষ্টা করেছিলেন। ইবলিশের (seductive) Voice কেমন হতে পারে তা কল্পনা করতে গিয়ে বিকটস্বরে গানবাজনা করে (*ব্যান্ডের গানবাজনাও হতে পারে, যেহেতু তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় ব্যান্ডসংগীত ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।) এমন ব্যক্তির কথা তাঁর মনে হয়তো জাগ্রত হয়েছিল; অধিকন্তু কোরাইশ কর্তৃক গানের আসর আয়োজনের স্মৃতিও মনে উঁকি দিয়েছিল নিশ্চয়; অগত্যা তিনি ইবলিশকে ‘তুইতোকারি’ ভাষায় সম্বোধনপূর্বক গানবাজনার সঙ্গে জুড়ে অনুবাদ করেছেন।
অনুমান বা অনুমানের সমর্থন অন্যত্র খোঁজা দোষনীয় নহে, তবে তরজমার সময় যে-বিষয়টি তিনি মাথায় রাখেননি সেটা হলো অনুবাদকরা উক্ত আয়াত দুটির অনুবাদে গানবাজনার বিষয় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছেন। যেহেতু (seductive) Voice বলতে কোরান সত্যি কী বুঝিয়েছে সে-সম্পর্কে পরিষ্কার সিদ্ধান্তে আসার জন্য দু-একটি রেফ্রেন্স তাঁদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। তফসির প্রণেতারা অগত্যা গানের আসরে সুকণ্ঠী গায়িকা ব্যবহারের ঘটনাটি ফুটনোট হিসেবে উল্লেখ করলেও শয়তানের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে হইচই করা থেকে বিরত থেকেছেন। তাঁদের হয়তো মনে হয়েছে ইবলিশের কণ্ঠস্বর কেমন সেটা বোঝানোর খাতিরে গানবাজনার সঙ্গে একে যুক্ত করা আয়াতের তরজমা শব্দার্থ বিবেচনায় অপ্রাসঙ্গিক ও ভাবার্থের দিকে থেকে অতিরঞ্জন হয়ে যায়। মুহিউদ্দিন অতসব ভাবাভাবির তোয়াক্কা করেননি এই যা তফাত!
অনলাইনে এরকম অজস্র সাইট পাওয়া যায় যেখানে ‘বনি ইসরাইল’ ও ‘লুকমান’-এর এই আয়াত দুটিকে নির্বিচারে গানবাজনার সঙ্গে জুড়ে অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন; মুহিউদ্দিনও তাঁদের পথ বেছে নিয়েছিলেন! এমনধারা অনুবাদ তাঁর কট্টর মনোভাবের পরিচয় তুলে ধরে। তিনি অর্থোডক্স লোক ছিলেন এবং সেই অর্থোডক্সির ছাপ তাঁর অনুবাদ, ব্যাখ্যা-ব্যাখ্যান ও ‘মদীনা’য় ডাকে-আসা লোকজনের চিঠিপত্রের জবাব দেওয়ার সময় প্রকট হতে দেখেছি। তো এইসব ভজকটের কারণে কোরানে কলাশাস্ত্রের চর্চা সম্পর্কে সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে যা বলা হয়েছে তার যোগ্য পঠনপাঠন ও অর্থানুসন্ধান আমরা করি কি না সে এক প্রশ্ন বটে!
প্রশ্ন আরও উঠানো যায়, কবিতা-গানবাজনা-চিত্রাঙ্কন-আলোকচিত্র ও নাটক-চলচ্চিত্রের মতো অনুভূতিসঞ্চারী মাধ্যমের চর্চা সম্পর্কে মোল্লাশাসিত শরিয়া আইন কোরান-হাদিসের দোহাই দিয়ে যেসব কথা বলে তার বৈধতা কতখানি গভীর? কোরানে কবিতার সঙ্গে মোহাম্মদের বিরোধ যেসব পরিস্থিতির কারণে অনিবার্যতা লাভ করে সেরকম ঘটনার পুনারাবৃত্তি কি ইসলামের সম্প্রসারণ ও পরবর্তী যুগে ঘটেছিল? যে-কারণে কলাশাস্ত্রের অনুশীলন বিষয়ে আলেম-ওলামারা নেতিবাচক মতামত দিতে থাকেন এবং তা পরিহারের তাগিদ মুসলমানের মনোজগৎকে তাড়া করে ফেরে? যেসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মোহাম্মদ কবিতা বা চিত্রাঙ্কন সম্পর্কে নিজের আপত্তি উঠান সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি ইতিহাসের অন্যান্য উৎস স্বীকার করে? যদি সেরকম না হয় তাহলে মোহাম্মদযুগ বিগত হওয়ার পর থেকে আজোবধি কারা এই দাবি অবিরত উঠায়? তারা কি সরাসরি কোরান-হাদিস সূত্রে দাবি উঠায় নাকি এ-সম্পর্কে বিচিত্র যত ব্যাখ্যা ও মতামত ইসলামে পাওয়া যায় সেখান থেকে নিজের পছন্দ মতো একটি তারা চয়ন করে এবং কবি-গায়ক-চিত্রকর সম্পর্কে লোকের মনে উগ্র ঘৃণা ছড়ায়?
জানদার জীবের ছবি আঁকা নিষেধ যদি সেটা দর্শকের মনে শিরক ও উপাসনার অনুভূতি জাগ্রত করায়; সেরকম কিছু না ঘটলে জানদার প্রাণীর ছবি অঙ্কন বিষয়ে আপত্তি কি কোরান-হাদিস সত্যি ক্লিয়ার করে? যদি না করে থাকে তাহলে শরিয়ার এইসব আপেক্ষিক ব্যাখ্যা জানদার জীবের ছবি যে-ব্যক্তি আঁকে কোন যুক্তির নিরিখে সে তা মেনে নেবে? কারযাভী তাঁর বইয়ে ছবি অঙ্কন সংক্রান্ত হাদিস, তফসির এবং ফিকাহ বা Muslim Sharia Law থেকে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। তাঁর কিতাবে লিপিবদ্ধ আলোচনার সারার্থ উপলব্ধির পর চিত্রাঙ্কনকে সুনির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট থেকে ফরবিডেন বা নিষিদ্ধ ভাবা যেতে পারে :—
আল্লাহ সৃষ্ট জানদার জীবের ছবি ও প্রতিমূর্তি যখন স্রষ্টা রূপে তাঁর একত্বকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং দর্শকের মনে কুফরিভাব জাগিয়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তখন সেটা ফরবিডেন হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে কোরান ও হাদিস সেই শিল্পীকে কুফরির প্রচারক রূপে চিহ্নিত করে এবং শেষ বিচারের দিন তার শাস্তি অবধারিত। আল্লাহ তাকে বলতেও পারেন, — জানদার জীবের ছবি তুমি এঁকেছো খুব ভালো কথা, এখন সেই জীবের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করো, যা করার ক্ষমতা তোমার নাই। এহেন অঙ্কনরীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার নেপথ্য ফিলসফি সম্ভবত এই :—
সুনির্দিষ্ট কোডিং ব্যবহার করে আল্লাহ জানদার জীব সৃষ্টি করেন এবং বাস্তব ঘটনা রূপে সেই জীব ধরায় বিচরণ করে ও সময় শেষ হলে মরণের কোলে ঢলে পড়ে। চিত্রকরের ক্যানভাস তার প্রতিলিপি অঙ্কনের ফলে মিথ্যা অবয়ব বা ছায়া-প্রতিমূর্তি জন্ম নেয় এবং তাকে কেন্দ্র করে বাস্তবতার আরেকটি স্পেস মানুষ সেখানে যাপন করতে থাকে। এহেন প্রতিলিপি পুনরায় বিগ্রহ উপাসনায় ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে বিধায় ইসলাম এই অঙ্কনরীতিকে পরিষ্কার ডিনাই বা নিষিদ্ধ গণ্য করে। এখন, অঙ্কনরীতিতে সেরকম উসকানিমূলক উপাদান যদি না থাকে তাহলে জানদার জীবের চিত্রাঙ্কন সম্পর্কে হাদিসের ভাষ্য ও শরিয়তের বিধান বিশেষ প্রসন্ন না হলেও দেশকাল ও পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘মাকরুহ’ হিসেবে তাকে স্পেস দেওয়া যেতে পারে।
নবিগণ ও তাঁদের পরিবার এবং সাহাবাদের প্রতিকৃতি অঙ্কন পরিষ্কার নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাঁদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী গ্রোগ্রামিংয়ের সাহায্যে নির্ধারিত করার পাশাপাশি ওহি প্রেরণের মাধ্যমে তা সুনির্দিষ্ট করেছেন। শিল্পীর চিত্রাঙ্কন সেখানে ভাষাবিহীন পদ্ধতির আশ্রয়ে বিকল্প ভাষা সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। নবিগণ ও তাঁদের জীবনের সচিত্র এই উপস্থাপনা ঐশী পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট গুণাবলীকে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে দর্শককে প্ররোচিত করতেও পারে; এর ফলে যেসব মনগড়া কল্পনা, প্রতিমা উপাসনায় ফেরত যাওয়ার ঝোঁক, এবং ফিতনার আবহ সমাজে তৈরি হয় সেটা পরিহারের স্বার্থে এইসব ব্যক্তিবর্গের প্রতিকৃতি অঙ্কন ইসলাম এলাউ করে না। একইভাবে কল্পনার সাহায্যে আল্লাহর স্বরূপ অঙ্কনের চেষ্টা অথবা জিন, ফেরেশতার ন্যায় বায়বীয় সত্তার অনুমানমূলক চিত্রায়ণ সোজা কথায় নিষিদ্ধ।
সালাতের স্থানে জানদার জীবের ছবি স্থাপন বা দেয়ালচিত্র অথবা ভাস্কর্য বিধিসম্মত নহে। সালাত আদায়ের স্থানে সচিত্র জীবের উপস্থিতি আল্লাহর উপাসনায় বিঘ্ন ঘটায় এবং মনোসংযোগ ব্যাহত হয়। মোহাম্মদ যে-কারণে আয়েশার গৃহে প্রবেশের ক্ষণে পর্দায় অঙ্কিত জানদার জীবের ছবি দেখে তাঁকে সেই ছবি অপসারণ করতে বলেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল এই ছবি সালাত আদায়ের সময় তাঁকে দুনিয়াবির সঙ্গে যুক্ত হতে প্ররোচিত করে এবং ধ্যান ও মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটায়। কারযাভী তাঁর কিতাবে বিখ্যাত এই হাদিসের একাধিক সংস্করণ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য হাদিস ও তাদের মাঝে বিদ্যমান স্ববিরোধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর অভিমত রেখেছিলেন, — কাপড় কিংবা সমতল জাতীয় মাধ্যমে অঙ্কিত জানদার জীবের ছবি ঘরে রাখার ব্যাপারে নবি সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি, তবে সালাত আদায়ের স্থান থেকে এইসব চিত্র অপসারণের কথা একাধিক ঘটনা সূত্রে জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং কেউ যদি জানদার জীবের ছবি ঘরে রাখতেই চান সেক্ষেত্রে সালাত আদায়ের স্থান বিবেচনায় নিয়ে গৃহের অন্য কোনও স্থানে রাখতেও পারেন।
সামগ্রিক পটভূমি বিবেচনায় এই কথা বলা যায়, জানদার জীবের ছবি অঙ্কন বা চর্চা সম্পর্কে ইসলাম অপ্রসন্ন হলেও মোল্লারা হাদিসের দোহাই দিয়ে যেভাবে শোরগোল তোলেন বাস্তবে ঘটনা সেই পরিমাণ আতঙ্ক-জাগানিয়া নয়। জানদার নয় এমন বস্তু যে-কোনও মাধ্যমের আশ্রয়ে অঙ্কন ও স্থাপনের ব্যাপারে ইসলামের আপত্তি প্রবল নয়; বরং কোরান প্রণীত জীবনধারার সঙ্গে স্ববিরোধিতা সৃষ্টি না করলে এই অঙ্কনরীতির চর্চায় বাধা নেই। অন্যদিকে জানদার জীবের ছবি বৈধ হতে পারে যদি সেটা আল্লাহর একত্ব ও তাঁর সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংঘাত তৈরি না করে। কারযাভী তাই তাবারি-র তফসিরে বর্ণিত ব্যাখ্যা যেমন উল্লেখ করেছেন, আলোচনার অন্তে ফিকাহশাস্ত্রের রেফ্রেন্স দিতে কার্পণ্য করেননি। হানাফি মাযহাবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিচারক হিসেবে সম্মানিত আল-তাহায়ি-র মন্তব্য নিজের কিতাবে তিনি উদ্ধৃত করেছেন :—
In the beginning the Prophet (s.a.w.s.) prohibited all types of figures, even if they were two dimensional, since the Muslims had only recently converted from the worship of images. Accordingly, everything of this type was prohibited. Later he lifted the prohibition from cloth with prints because of the necessity of wearing clothes. He also permitted figures which were not treated in a respectful manner, (As is evident from these ahadith, this would include figures which are made into pillows or cushions on which to sit or recline, figures in rugs or carpets which are trod upon and the like….since there was no danger that the ignorant would venerate what was debased. The prohibition of figures which are not debased was never lifted. (This has been reported by Sheikh Bakhit in AI-Jawab al-Shafi. — Source: The Lawful and The Prohibited in Islam by Seikh Yusuf Al-Qaradawi, Al-Falah Foundation, 1960; PDF Edition.
মোদ্দা কথা ফরবিডেন সংক্রান্ত বিষয় ঘিরে যেসব দ্বন্দ্ব বিদ্যমান তার নিরসনে শরিয়াশাসিত টেক্সট গৎবাঁধা ছকে আবর্তিত হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যে এই সন্দেহ প্রবল হয় আরব তথা বিশ্ব জুড়ে মুসলমান কোরান, হাদিস ও সিরায় নামমাত্র যাপন করে, তার জীবনধারা আসলে নির্ধারিত হয় মাযহাবসূত্রে উদ্ভূত আইনি কাঠামোয়। সময়ের আবর্তনে মহানবির যুগের অনেক ঘটনা এখন আর প্রাসঙ্গিকতা রাখে না। মুসলমান বিদ্বান পরিমণ্ডলে সেরকম কোনও বার্ট এহেরম্যানের দেখা পাওয়া কঠিন যিনি কথাটা সোচ্চারে প্রমাণসহ বলতে পারেন। মোহাম্মদের সময়ে দেশ-বিদেশ সফরে ভিসা-পাসপোর্ট ও ছবি সংযোজনের বালাই ছিল না। যদি সেটা থাকত মনে হয় না তিনি ছবি সংযোজনে আপত্তি তুলতেন। কারণ ঘটনার গতিপ্রকৃতি বুঝে পরিস্থিতি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসার দূরদর্শিতা তাঁর ছিল, যদিও অনুসারীদের ব্যাপক অংশে সেসবের বালাই নেই এবং বহু যুগ ধরে বহুভাবে সেটা প্রমাণিত।
শরিয়তের ফোকর গলে ইসলামে সুফি ও মরমি ধারার বিকাশ যুগের ফেরে তাই অনিবার্যই ছিল। কোরান-হাদিস ঘিরে ব্যাখ্যার দ্বন্দ্ব ও অসংগতি সুফিভাবে মাথা মোড়ানো লোকজনের কাছে উৎপাত মনে হওয়ায় সেই ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল যে কিনা কোরানের টেক্সটকে একরৈখিক অর্থে পাঠ যাওয়ার পরিবর্তে বহুরৈখিক দ্যোতনায় পাঠের প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল। সুফি সাধনায় আল্লাহর একত্বে বিলীন হওয়ার ধাপে নবি মাধ্যম হিসেবে অশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর ইহজাগতিক কাজকারবারকে সুফিরা জাহিরির কাতারে ফেলেন এবং বাদবাকি বিষয়গুলাকে স্তর বিভাজনের সাহায্যে বাতেনি রূপে উপলব্ধির আহবান জানান। শাহাব আহমেদ তাঁর ‘What Is Islam?: The Importance of Being Islamic’ নামক সুলিখিত গ্রন্থে সুফি সাধক আবু তালিব আল-মাক্কি-র কথা উল্লেখ করেছিলেন। সূরা ‘আল-এমরান’ বর্ণিত ‘মুহকাম’ বা কোরানের সোজাসরল অর্থ ও ‘মুতাশাবিহ্’ বা ফিতনা সৃষ্টির সম্ভাবনা রাখে এমন অর্থের গোলযোগ মিটানোর জন্য মাক্কি কোরানের অর্থস্তরকে সাতটি ভাগে ফেলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। শাহাবের সুখপাঠ্য বিবরণে জীবন্ত হয়ে ওঠা স্তরভাগের সারসংক্ষেপটি এখানে পেশ করা যেতে পারে :—
মাক্কির বর্ণনা অনুসারে প্রথম স্তরটি হচ্ছে জাহির অর্থাৎ বাহ্যিক বা সোজাসরল অর্থ; এই অর্থ মূলত ‘আওয়াম’ বা আমআদমির জন্য প্রযোজ্য গণ্য হয়ে থাকে। দ্বিতীয় স্তর বাতেন বা গুপ্ত; বাতেন তাদের জন্য যারা আল্লাহর সক্রিয়তায় নিজেকে বিলীন করার আরাধনায় মগ্ন থাকেন। বাতেনি অর্থের সন্ধানে জীবন ব্যয়কারী ব্যক্তিকে তাই ‘খাওয়াজ’ বা স্রষ্টার সৃষ্টিলীলা অবধানে ব্যাকুল পাবলিক ধরা যায়। তৃতীয় স্তরটি ইশরাতদের বেলায় প্রযোজ্য হয়। তারা হলেন সেই সমস্ত লোক যারা কোরানের আয়াত সমূহে ইশারা খোঁজেন যা স্রষ্টার একত্ব উপলব্ধি করতে তাদেরকে সহায়তা করে। আয়াতের মর্ম ভেদের মধ্য দিয়ে স্রষ্টায় নিজেকে তারা সমর্পণ করেন। চতুর্থ স্তরে কোরানকে যারা রিড করেন তারা হলেন ‘আমরাত’ বা অলি-আউলিয়ার অংশ, স্বয়ং নবি যাঁদেরকে আল্লাহর দোস্ত নামে সম্মানিত করে গেছেন। পঞ্চম স্তরটি ‘লতিফ’ অর্থাৎ সিদ্দিকুন বা সত্যান্বেষীদের জন্য প্রযোজ্য গণ্য হয়। কোরানের সেইসব আয়াতের সঙ্গে সিদ্দিকুনরা নিজেকে একীভূত করেন যে-আয়াতগুলা সত্যের স্বরূপ উপলব্ধি করতে তাঁদেরকে সহায়তা করে এবং সত্য মানে হচ্ছে স্রষ্টা স্বয়ং। ষষ্ঠ স্তরে যারা কোরানকে রিড করেন তারা ‘দাকিক’ বা সোজা কথায় মজুন; অর্থাৎ মজনু যেমন লাইলীর প্রেমে দিওয়ানা ছিল তাঁরাও স্রষ্টাকে একতরফাভাবে ভালোবাসা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও কৌতূহল দ্বারা নিজেকে উতলা করেন না। সমপ্ত স্তরটি হলো ‘হাকিক’ বা ক্রুড রিয়েলিটি যেখানে নবিগণ কোরানের অর্থের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন।
সুফি তরিকায় যে-লোক হাঁটতে চায় তাকে প্রতিটি স্তরে বিন্যস্ত আয়াতের অর্থ উপলব্ধি করে তবে কোরানের পাঠ নিতে হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, মাক্কি প্রণীত স্তর-বিভাজন ইসলামের ইতিহাসে বিভাজনের স্মারক হয়েই আসে, যেখান থেকে ইসলামের মূলধারায় নিজেকে উদার মধ্যপন্থী ও সংস্কারবাদী বলে দাবি করে সেই বিকল্পধারা জন্ম নিয়েছিল। অন্যদিকে ইসলামি বিশ্বাস ও সংস্কৃতি থেকে হিজরত গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রাক্তন মুসলমানে (ex-Muslim) পরিণত আরেকটি ধারা বিকল্পধারার পৃথক অঙ্গ রূপে সেখানে বিকাশ লাভ করে। পরবর্তী পর্বে সেই সামগ্রিক আলোচনায় যেতে চাই।
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS