ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৯ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৯ || আহমদ মিনহাজ

ষষ্ঠ প্রবাহ : বিকল্পধারার ইসলাম : চরপন্থা, মধ্যপন্থা মুনাফিক


টেক্সট হিসেবে কোরানের কোয়ালিটিকে নমনীয়তা সহকারে বিবেচনা করা এবং ইসলামের বিধি-বিধান যুগোপযোগী করতে সংস্কারের আওয়াজ যে-ধারায় ঘন-ঘন ওঠে তার সঙ্গে শরিয়াশাসিত মূলধারা বা র‌্যাডিক্যাল ইসলামের সংঘাত নতুন ঘটনা নয়। শতভাগ শরিয়াশাসিত ইসলামকে মূলধারা কোয়ালিটিটিভ ও আবশ্যক মান্য করে, সেখানে বিকল্পধারা উদারপন্থী নমনীয়তায় শরিয়ার উপস্থাপন ও গুণবিচার জরুরি বলে মানে। বিকল্পধারার বিচারে শরিয়া প্রভাবিত মূলধারা ইসলামের আক্ষরিক পরিভাষা হয়ে আসে যে কিনা প্রতি পদে নবি ও সাহাবাদের জীবনাচার অনুসরণ ও সালাফি মতবাদে নিজেকে একীভূত করে খিলাফতে ফেরত যেতে চায়। তার এই গমন-ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত চরমপন্থী কাজকারবার মোকাবিলায় বিকল্পধারা তাই দাওয়াই রূপে নিজেকে সেখানে উপস্থাপনে উতলা হয়। এই ধারায় ইসলামের কোয়ালিটি বিচারে অভ্যস্ত ব্যক্তিগণ র‍্যাডিক্যাল উদারপন্থী মতের অনুসারী রূপেই নিজেকে প্রচার করেন। এর মানে হলো মূলধারার ইসলামে সক্রিয় কট্টরপন্থার বিরোধী হলেও শরিয়া প্রভাবিত ধারা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা বহিরাগত বলে সে ভাবে না। প্রত্যাখ্যানের পরিবর্তে সংস্কারের দিকে ঝোঁক প্রবল থাকায় বিকল্পধারায় অবস্থানকারী ব্যক্তি অগত্যা মূলধারায় নিজেকে নির্ণীত হতে দেখে!

মূলধারার ন্যায় বিকল্পধারাও কোরান-হাদিসকে নিজের ভিত্তি বলে স্বীকার করে। সেইসঙ্গে ইসলামকে যুগোপযোগী করার স্বার্থে ডেকোরেটিভ টেক্সট অর্থাৎ ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের মারপ্যাঁচে ঘেরা আলঙ্কারিক জগৎকে সমান প্রাসঙ্গিকতায় পাঠ যায়। দেশ-কাল ভেদে ইসলামচর্চায় বিচিত্র ভাবধারা ও সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কোরানে বর্ণিত ইসলামি দীনের মৌল শর্তে আজও হানি ঘটেনি, সুতরাং এইসকল বৈচিত্র্যকে ইসলামে একীভূত ও প্রাসঙ্গিক গণ্য করে মুসলমান রূপে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার নিশান খোঁজা বিকল্পধারায় বিশেষ জরুরি হয়ে ওঠে। র‍্যাডিক্যাল ইসলামকে প্রতিপক্ষ করার পরিবর্তে ধারাটি বরং সেখানে শামিল হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে এমতো বক্তব্য সহকারে, — ইসলামে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং সংস্কারটি মূলধারায় নির্ধারিত ইসলামের শর্ত লঙ্ঘন না করে ঘটানো সম্ভব। ড. তাওফিক হামিদ যেমন তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় মিলিট্যান্ট বা জঙ্গি ইসলামের স্বরূপ অন্বেষণ করতে যেয়ে ইসলামে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে মন্তব্য করেছেন :—

সমালোচকরা আমার গায়ে হয়তো ইসলাম বিরোধী ছাপ্পা লাগিয়ে দেবেন। সত্যের চেয়ে কোনও কিছুই দূরবর্তী নয়। প্রকৃতপক্ষে আমি একজন মুসলমান এবং ইসলামে নিহিত সৌন্দর্য ও তাৎপর্যকে বিবেচনা করে থাকি। যে যাকগে, আজকের দিনে সিংহভাগ মুসলমান সম্প্রদায়কে ইসলাম সম্পর্কে যেভাবে শিক্ষা প্রদান করা হয় তা বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে র‌্যাডিক্যাল ইসলামের আবির্ভাব সেই ভূমি তৈরি করতে সক্ষম যেটি এই শয়তানী বীজকে উপড়ে ফেলবে। যে-কারণে আমি প্রভাবিত, — ইসলামে সংস্কার অথবা ব্যাপক আকারে পুনর্ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং এরকম একটি পরিবর্তন সার্বিক কারণেই সম্ভব। — উৎস : Inside Jihad : Understanding and Confronting Radical Islam By Dr. Tawfik Hamid, 2008; তরজমা : লেখককৃত; পিডিএফ সংস্করণ

ভিন্নমাত্রিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোয় হামিদের কিতাব মূল্যবান হলেও উৎপাদিকা শক্তির বৈপ্লবিক রূপান্তর ছাড়া সংস্কার কী করে সম্ভব সে-প্রশ্নের উত্তর স্বচ্ছতার সঙ্গে সেখানে বিশ্লেষিত হয়নি। গ্রন্থের ‘Towards Islamic Reformation’-এর ‘How to Reform Islam’ অনুচ্ছেদে বর্ণিত লেখকের বক্তব্য তাই কতখানি কী কাজে দেবে সে-নিয়ে সংশয় থেকে যায়। তাঁর এই উলটোযাত্রা একটি বিষয় অবশ্য পরিষ্কার করে, — ইসলামের ভিতরে ইসলামের উদ্ভব কিংবা অন্য ধর্মের সঙ্গে তার সহাবস্থানের প্রশ্নে বিকল্পপন্থী বুদ্ধিজীবীরা মিশ্রপন্থায় জারি থাকতে অধিক আগ্রহী। ‘তোমার দীন তোমার, আমার দীন আমার’, কোরানে ব্যক্ত এই স্পিরিটকে তাঁরা প্রাধান্য দিতে ইচ্ছুক এবং সেটা তাঁদের বইপত্তর ও বাতচিত থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির স্রোতে শামিল সমাজব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষ্যে সক্রিয় চরমপন্থী গোষ্ঠীর আগ্রাসী ইসলামকে ঠেকানোর উপায় হিসেবে ইসলামি বিধি-বিধান দ্বারা শাসিত সমাজের নমনীয় সংস্করণ কোরান ও ব্যাখ্যাবিজ্ঞান থেকে নিষ্কাশন করা যায় কি না এ-ব্যাপারে তাঁদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো ঘটনা বটে! অন্যদিকে মূলধারার ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও পশ্চিম প্রভাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থার ছক মেনে প্রণীত জাতীয়তাবাদ-সার্বভৌমত্ব-গণতন্ত্র ও ধর্ম-নিরপেক্ষতার মতো টেক্সটকে যুগের গতিবিধি বিবেচনায় তাঁরা স্পেস দিতে দ্বিধা করেন না। ত্রিমুখী এই মোহনায় দাঁড়িয়ে র‌্যাডিক্যাল ইসলামে সংস্কার ঘটানোর আশায় অটল বিকল্পধারা শেষাবধি কত দূর মৌলিক আর কতটা মৌলিকত্ব থেকে নিষ্ক্রমণ নিতে অধীর সে-প্রশ্নটি অগত্যা এড়ানো যায় না!

ইসলামের সঙ্গে অন্য ধর্মের পার্থ্যক এখানে যে ইসলাম নিজেকে ‘পরিপূর্ণ জীবনবিধান’ (A complete code of life) বলে দাবি করে এবং তার এই দাবিকে অতিশয়োক্তি ভাবার সুযোগ নেই। ঐশী গ্রন্থ রূপে কোরান স্বয়ং এবং সুন্নাহ ইসলামবিশ্বাসী ব্যক্তি-সমাজ ও রাষ্ট্রের ইহজাগতিক জীবন আসলে কেমন হওয়া উচিত সেই বিষয়ে প্রতি পদে পরিষ্কার নির্দেশনা রেখে যায়! যারপরনাই এ-সংক্রান্ত ব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যা-পরবর্তী সংশোধনী অবধারিতভাবে কোরান-হাদিসের অনুবর্তী হওয়াটা সেখানে বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। এছাড়াও ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’র আমলে সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান শাসনবিধি উপেক্ষার সুযোগ ইসলামে নেই, কারণ তাঁরা ইসলামের আদি রূপ-গঠনের সাক্ষী শুধু নন, এর সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্তি পরবর্তী শাসকদের তুলনায় অধিক নিবিড় ও সরাসরি ছিল। ইসলাম নির্ধারিত সমাজব্যবস্থা কায়েমে কোরান, হাদিস ও ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’ মিলে গঠিত ত্রিভুজ হচ্ছে সেই টেক্সট যেখান থেকে নিগমনের বিধান ইসলাম এলাউ করে না। এহেন দশায় বিকল্পধারা যখন বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার ছকে ইসলামকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে অথবা ইসলামি শাসনব্যবস্থার যুগানুবর্তী স্বরূপ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়, তখন তার এই চেষ্টা কোরান, হাদিস ও ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’-এর সঙ্গে আদৌ ভারসাম্য বজায় রাখে কি না সে-প্রশ্নটি তীব্র হয় সেখানে।

এই প্রসঙ্গে খেয়াল করা প্রয়োজন, প্রচলিত ব্যবস্থার অধীনে শাসিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত সুদবিহীন ব্যবসায়িক লেনদেন থেকে প্রাপ্ত লাভ, রাজস্ব আদায়ের জন্য কৃষিজমির ওপর প্রযোজ্য কর খারাজ, বিধর্মী জনগোষ্ঠী কর্তৃক প্রদেয় কর জিজিয়া এবং সম্পদবান ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য যাকাত ইত্যাদির একত্রীকরণে গৃহীত ইসলামি আর্থিক কাঠামো দ্বারা মোটেও পরিচালিত হয় না। সুদভিত্তিক লেনদেনের ছকে প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক পুঁজিবাদের একচ্ছত্র প্রভাবে এমনকি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দাবিদার রাষ্ট্রগুলো অবিমিশ্র ইসলামি অর্থনীতির পরিবর্তে মিশ্র অর্থনীতি দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে ফিতরাতে অটল থাকতে না পারায় যারা অন্য বিশ্বাসের (অথবা অবিশ্বাস) অনুসারী হয়েছেন তাদেরকে ইসলাম র্নিধারিত বিধান মোতাবেক ধিম্মি (Under Legal Protection of Islam) হিসেবে নিরাপত্তা দানের নজির ইসলামি রাষ্ট্রগুলোয় এখন আর পরিলক্ষিত হয় না। দূর অতীতে বিধর্মীদের জন্য প্রযোজ্য এই বিধানের প্রয়োগ অবশ্য যেভাবে ঘটেছিল সেখানে মুসলমান শাসকদের আচরণ সুখকর ছিল না সেটা ইতিহাসে প্রমাণিত।

স্মরণ রাখা উচিত, যথাযথ কারণ যাচাইপূর্বক জিজিয়া ধার্যের বিধান কোরানে উল্লেখিত হলেও বাস্তবে ধিম্মির আওতাভুক্ত বিধর্মী জনগোষ্ঠীর ওপর এই করের জবরদস্তিমূলক প্রয়োগ শুরু থেকে তীব্র ছিল। বিজিত দেশ বা রাজ্যকে ধিম্মির আওতায় নিয়ে আসার জন্য উমরের চুক্তিনামা  (Pact of Umar) সেই সময় কথিত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর হয়ে উঠেছিল। এই অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা হয়তো প্রয়োজন, একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্রের সামাজিক বিধান ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা আসলে কেমন হওয়া উচিত সে-আলোচনায় বিকল্পধারাকে এখন অবধি স্বচ্ছ, সাবলীল ও আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হয়নি।

পুরোদস্তুর ইসলামি প্রজাতন্ত্র নামে স্বীকৃত রাষ্ট্র যদি একুশ শতকে উমরের চুক্তি মেনে বিধর্মী নাগরিককে ধিম্মি গণ্য করতে যায় তাহলে চুক্তির একতরফা কঠোরতা বজায় রাখা এবং তাকে তার দীন পালনের স্বাধীনতা প্রদান মনে হয় না সম্ভব হবে। চুক্তিনামাটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’র দ্বিতীয় স্তম্ভ হযরত উমরের সময় সিরিয়া (*মতান্তরে জেরুজালেম অথবা ইরাক-কুয়েত সংলগ্ন অঞ্চল) নিবাসী এবং ধিম্মি বলে গণ্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে চুক্তিটি সম্পাদিত হয় বলে বহুল প্রচার ও মান্যতা লাভ করেছে। এখন ক্রস চেক করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি উইকিপিডিয়া এ-সম্পর্কে মতভেদের খবর দিচ্ছে! উইকি সংকলকের ভাষ্য অনুসারে চুক্তিনামাটি খলিফা উমরের সময় সম্পাদিত হওয়ার বিষয়টি অস্পষ্ট! জেরুজালেম নিবাসী খ্রিস্টানদের সুরক্ষার জন্য তিনি সেই সময় যে-চুক্তিপত্র তৈরি করেন তার ভাষ্যের সঙ্গে Pact of Umar নামে বিদিত চুক্তিনামার বিশেষ মিল চোখে পড়ে না। চুক্তিনামাটি সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীতে উমাইদ রাজবংশের দ্বিতীয় সম্রাট উমর ইবনে আবদ্ আল-আজিজ (*দ্বিতীয় উমর) কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। অনেকে মনে করেন খলিফা উমরের নামের সঙ্গে সংযুক্ত এই চুক্তিনামা প্রকৃতপক্ষে দশম শতকে মুজতাহিদ বলে গণ্য আইন প্রণেতাদের অবদান। রাজ্যশাসনে ধিম্মি বিষয়ক আইনের অংশ রূপে তাঁরা এটি প্রণয়ন করেন। মতভেদ থাকলেও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই কথাটি স্মরণ রাখা, চুক্তিনামাটি সময়ের সঙ্গে কিংবদন্তিতে পরিণত হয় এবং বিশ্ব জুড়ে ইসলামের সম্প্রসারণ পর্বে মুসলমান শাসকরা কোরান-হাদিসের ধার-না-ধেরে ধিম্মিদের বেলায় এর প্রয়োগ অমোঘ করে তোলেন।

তো এ-রকম একটি চুক্তি সেটা যে-কালপর্বেই সম্পাদিত হয়ে থাকুক-না-কেন, ইসলামের মৌল বাণী ‘তোমার দীন তোমার, আমার দীন আমার’ সংরক্ষণের নীতিতে অটল থাকতে পারেনি! চুক্তিটি বরং ‘তোমার দীন তোমার কিন্তু আমার অধীনস্থ’-র মতো পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল তখন। ধিম্মি বলে গণ্য আহলে কিতাবধারী সম্প্রদায়ের দীন পালনের স্বাধীনতা চুক্তির ফেরে কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। মুসলমান শাসকের সঙ্গে রণে পরাজিত হওয়ার কারণে চুক্তির অধীনস্থ খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল ধিম্মি রূপে মুসলমান শাসকের দয়া-দাক্ষিণ্য ও Legal Protection যদি পেতেই হয় তাহলে চুক্তির শর্ত তাদেরকে অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলতে হবে, প্রতি পদক্ষেপে খেয়াল রাখতে হবে …

ধিম্মি জনগোষ্ঠী কর্তৃক নির্মিত গির্জার উচ্চতা মুসলমান সম্প্রদায়ের মসজিদকে যেন ছাড়িয়ে না যায়। গির্জার মিনার ও অন্যত্র ক্রুশ স্থাপন এবং প্রদর্শন নিষিদ্ধ এটা স্মরণ রাখতে হবে। ইস্টার সানডে পালনে এখন থেকে তারা বিরত থাকবে। র্গিজার ঘণ্টা চড়া স্বরে বাজানো যাবে না। মুসলমান ব্যক্তির যখন-তখন গির্জায় ঢোকার অধিকার থাকবে এবং এক্ষেত্রে তাকে বাধা দেওয়া যাবে না। গির্জার ভিতরে তার উপস্থিতিতে উচ্চস্বরে বাইবেল পাঠ করা আদাবের বরখেলাপ মনে করতে হবে। জনসমক্ষে খ্রিস্টান ধর্মের গুণগান ধিম্মির জন্য নিষিদ্ধ। মুসলমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনুরূপ পোশাক-আশাক যেমন আলখাল্লা-পাগড়ি ও কোমরবন্ধনী পরে সে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে পারবে না। মুসলমান ব্যক্তির আচার-অভ্যাসের অনুকরণ তার জন্য নিষিদ্ধ।

এখানে শেষ নয়! আইনি সুরক্ষা পেতে হলে ধিম্মি জনগোষ্ঠীকে প্রতি পদে স্মরণ রাখতে হবে …

প্রতিবেশী যদি মুসলমান হয় তবে তার বাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ শূকর পুষতে পারবে না। মুসলমান ব্যক্তিকে শরাব গছানো গুরুতর অপরাধ এবং একইসঙ্গে প্রকাশ্যে মদ্যপান এখন থেকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ মানতে হবে। মুসলমান ব্যক্তির পেছনে ধিম্মি কোনও গুপ্তচর লেলিয়ে দিতে পারবে না। মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি গোপনে বা প্রকাশ্যে কেউ শত্রুতার মনোভাব পোষণ করলে তা সহ্য করা হবে না। মুসলমান মুসাফির এলাকায় প্রবেশ করলে ধিম্মি তাকে কমপক্ষে তিন দিন আতিথেয়তা প্রদর্শনে বাধ্য থাকবে। মুসলমানদের ব্যবহৃত সম্মানসূচক নাম ও উপাধি তারা ব্যবহার করবে না। সর্বোপরি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে শুরু করে সকল খ্রিস্টীয় আচারবিধি পালনে মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুভূতি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনও কাজ তারা করবে না। — Source: Pact of Umar; Analysis of the Pact of Umar; Wikipedia and Wikiislam.

চুক্তিনামায় উল্লেখিত শর্তের লম্বা তালিকা থেকে চুম্বক অংশটি পাঠ যাওয়ার পর বুঝতে বাকি থাকে না মুসলমান অধিকৃত রাজ্যে ধিম্মি রূপে নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে আসলে যুগে-যুগে কী ঘটেছিল। এখন কথা হলো পরিবর্তিত পরিস্থিতি মাথায় রেখে বর্তমানের কোনও শাসক যদি উক্ত চুক্তির ভাষা নমনীয় করে বিধর্মী জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপ করতে যান তবে সেটা বৈধ হয় কি না! কেননা কোরান-হাদিস ও ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’ মিলে ত্রিভুজাকৃতির যে-পিরামিড ইসলামি শাসনব্যবস্থার ভিত্তি, শাসকের এহেন নমনীয়তা সেখানে ত্রিভুজের অঙ্গহানি ঘটায়। যদিও নিজ দীনে জারি থাকা এবং অন্যের দীনের প্রতি সহিষ্ণু আচরণ প্রদর্শনের ঘোষণায় কোরান কোনও কৃপণতা করেনি :—

‘তোমাদের দীন তোমাদের, আমার দীন আমার।’ — কাফিরুন ১০৯:৬;

‘দীন গ্রহণে জোর-জবরদস্তি নাই; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ হইতে সুস্পষ্ট হইয়াছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করিবে ও আল্লাহর উপর ইমান আনিবে সে এমন এক মজবুত হাতল ধরিবে যাহা কখনও ভাঙ্গিবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।’ — বাকারাহ ২:২৫৬;

‘অতএব তুমি উপদেশ দাও; তুমি তো একজন উপদেশদাতা,…’ ‘তুমি উহাদের কর্ম নিয়ন্ত্রক নও।’ — গাশিয়াহ ৮৮:২১-২২;

‘যে কেহ সাধনা করে, সে তো নিজের জন্যই সাধনা করে; আল্লাহ তো বিশ্বজগৎ হইতে অমুখাপেক্ষী।’ — আনকাবুত ২৯:৬;

উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ

‘তিন ব্যক্তি নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-র স্ত্রীদের বাসায় এলেন। তাঁরা নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-র ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। অতঃপর যখন তাঁদেরকে এর সংবাদ দেওয়া হল তখন তাঁরা তা অল্প মনে করলেন এবং বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-র তুলনা কোথায়? তাঁর তো আগের ও পরের সমস্ত গোনাহ মোচন করে দেওয়া হয়েছে। (সেহেতু আমাদের তাঁর চেয়ে বেশি ইবাদত করা প্রয়োজন)। সুতরাং তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, ‘আমি সারা জীবন রাতভর নামাজ পড়ব।’ দ্বিতীয়জন বললেন, ‘আমি সারা জীবন সিয়াম রাখব, কখনও সিয়াম ছাড়ব না।’ তৃতীয়জন বললেন, ‘আমি নারী থেকে দূরে থাকব, জীবনভর বিয়েই করব না।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদের নিকট এলেন এবং বললেন, ‘তোমরা এই এই কথা বলেছ? শোনো! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি, তার ভয় অন্তরে তোমাদের চেয়ে বেশি রাখি। কিন্তু আমি (নফল) সিয়াম রাখি এবং সিয়াম ছেড়েও দিই, নামাজ পড়ি এবং নিদ্রাও যাই। আর নারীদের বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ — উৎস : সহিহ বুখারী; ৫০৬৩; সহিহ মুসলিম; ৩৪৬৯; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিস সম্ভার : ইসলামিকআলোডটকম

সংকলিত উদ্ধৃতি পাঠে বোঝা যায় কোরান ও হাদিসে দীন পালনে বাড়াবাড়ির পরিবর্তে বরং মধ্যপন্থা অনুসরণকে উত্তম গণ্য করা হয়েছে। যদিও ধিম্মিদের বেলায় এহেন নমনীয়তা প্রয়োগের নজির বাস্তবে সেভাবে পাওয়া যায় না। তৎকালীন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দীন পালনের স্বাধীনতা খর্ব করার পেছনে রাজনৈতিক কার্যকারণ থাকলেও ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে এহেন চুক্তিনামার প্রয়োগ জটিলতামুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যে-কারণে হয়তো মডারেট ইসলামের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ঝোঁক কালের গতিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ধর্মবেত্তারা বিংশ শতকের গোঁড়ায় এসে ধিম্মি বিষয়ক বিধান রদ করার সপক্ষে মত দিতে দ্বিধা করেননি। অন্যদিকে চরমপন্থী ইসলামে উমরের এই চুক্তিনামা ফিতরাতে অটল থাকতে অক্ষম মানবগোষ্ঠীর ওপর অব্যাহত চাপ প্রদানের কৌশল হয়ে আসে, যেন সেই চাপে তারা শেষতক ইসলাম কবুলে বাধ্য হয়। যারপরনাই র‌্যাডিক্যাল ইসলামের শুদ্ধ ও পরিণত প্রয়োগ ঘটেছে এমন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যেমন দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়, অন্যদিকে মডারেট ইসলামের অনুসারী হওয়ার মধ্য দিয়ে র‌্যাডিক্যাল ইসলামের মূল শর্ত পূরণ করতে পেরেছে এমন রাষ্ট্রও খুঁজে পাওয়া ভার! মধ্যযুগের লম্বা সময় জুড়ে বিশ্বে বিরাজিত মুসলিম শাসনব্যবস্থা জিহাদ, খারাজ, জিজিয়া ও ধিম্মিকে মসনদ পাকাপোক্ত করার হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছে; কোরান ও হাদিসে বর্ণিত কনটেক্সটের সঙ্গে যা সাংঘর্ষিক ছিল। জিহাদ থেকে ধিম্মি ম্যানেজমেন্টের ইসলামি ছকে মোহাম্মদকে অনেক বেশি সতর্ক ও ডিপ্লোম্যাটিক হতে দেখা যায়, যা এমনকি চার খলিফার শাসনামলে বজায় রাখা কঠিন হয়ে উঠেছিল। ইসলামে চরমপন্থা মোকাবিলায় এই বৈপরীত্য নিরসনে বিকল্পধারার সুবেদী অন্বেষণ কতটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে সে-নিয়ে তাই সংশয় থেকে যায়।

র‌্যাডিক্যাল ইসলামে চরমপন্থার প্রসার ঘটার আরেকটি কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের স্ববিরোধী আচরণ! সংবিধানে সংশোধনী আনার মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসকরা একদিকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দানের পাশাপাশি ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম-নিরপেক্ষতা’ সেখানে জুড়ে দিয়ে আজব খিঁচুড়ি পাকানোর কাজটি সমাধা করেছেন! রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির প্রত্যেকটি এখানে তাই একে অন্যকে কনডেম করে। দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর অনুভূতিকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করার এমন নজির পৃথিবীর খুব কম দেশে মিলে! গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম-নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ রাষ্ট্রে ধর্মের সংযুক্তি শাসকদের ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার নির্লজ্জ কূটচাল ছাড়া কিছু নয়, বিষয়টি উপলব্ধির পরেও দেশের জনগণ রাষ্ট্রধর্ম জারি রাখার পক্ষে-বিপক্ষে বাদ-বিবাদে লিপ্ত থাকে, যেটি প্রকারান্তরে ফিতনার শামিল এবং ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ বলেই গণ্য।

ইসলামকে ঘিরে বাংলাদেশের শাসকদের আচরণ একইসঙ্গে নির্মম ও হাস্যকর। ইসলাম এখানে রাষ্ট্রধর্ম অথচ উক্ত ধর্মের মৌল নীতি ও বিধান দ্বারা দেশটি কদাপি পরিচালিত হয়নি! বাংলাদেশের মতো একাধিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র বিশ্বে এই মুহূর্তে বিদ্যমান যারা অতিমাত্রায় সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির চর্চায় অভ্যস্ত এবং তাদের জনসংস্কৃতি মহাজনি সুদখোর প্রথার ছকে বহমান! বাংলাদেশের বিপুল আমজনতা মসজিদ-মাদ্রাসার মতো স্থাপনা প্রতিষ্ঠা ও দান-খয়রাত থেকে শুরু করে আবশ্যক ইসলামি আচার সুদ ভিত্তিক অর্থনীতিতে নিজেকে নানা মাত্রায় সম্পৃক্ত রেখে সম্পন্ন করে থাকেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে বিত্তবান অর্থাৎ সমাজের প্রতিটি স্তরে সঞ্চয় ও বিনিয়োগে রিবা ওরফে সুদ ওরফে ইন্টারেস্ট ভক্ষণের এই কালচার মুসলমান রূপে নিজের আত্মপরিচয় জাহিরের মৌল শর্তকে লঙ্ঘন করে বিধায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ আদৌ ইসলামে জারি থাকার দাবি করতে পারেন কি না সেটা সর্বাগ্রে বিবেচিত হওয়া উচিত ছিল। পূর্ব আলোচনার ধারাবাহিকতায় আরেকবার বোধহয় স্মরণ করা প্রয়োজন, কোরান-হাদিসের মানদণ্ডে সুদ ঘৃণ্য অপরাধ এবং সকল বিবেচনায় ইসলাম ও মুসলামানিত্বের বরখেলাপ :—

‘ভাল ভাল যাহা ইয়াহুদিদের জন্য বৈধ ছিল আমি তাহা উহাদের জন্য অবৈধ করিয়াছি তাহাদের আল্লাহর পথে অনেককে বাধা দেওয়ার জন্য,…এবং তাহাদের সুদ গ্রহণের জন্য, যদিও উহা তাহাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হইয়াছিল; এবং অন্যায়ভাবে লোকের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য। তাহাদের মধ্যে যাহারা কাফির তাহাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি প্রস্তুত রাখিয়াছি।’ — আন নিসা ৩:১৬০-১৬১;

‘যাহারা সুদ খায় তাহারা সেই ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াইবে যাহাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। ইহা এইজন্য যে, তাহারা বলে, ‘ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। ‘অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করিয়াছেন।’ — বাকারাহ ২:২৭৫;

উৎস : আল কোরান, তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ 

‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ (রহঃ)…আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘সুদের সত্তরটি স্তর রয়েছে। সবচেয়ে নিম্নেরটি হলো নিজ মায়ের সাথে ব্যভিচার করা।’ — সুনান ইবনে মাজাহ; অধ্যায় ১২, ব্যবসা-বাণিজ্য ২২৭৪;

‘হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী জিনিস থেকে বিরত থাকো। জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রসুল (সাঃ) সেগুলো কী কী?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শরিক করা, যাদুটোনা করা, আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন এমন প্রাণীকে অকারণে হত্যা করা, এতিমের মাল আত্মসাৎ করা, সুদ খাওয়া, জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং সতি সাধ্বী নিষ্কলুষ মুমিন মহিলার ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা।’ — মুসলিম শরীফ : কিতাবুল ইমান; ১৭০; সমধর্মী হাদিস, সহিহ বুখারী; অধ্যায় ৪৭, অসিয়ত ১৭২৮;

‘আদম ইবনু আবু ইয়াস (রহঃ)…অবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষের উপর এমন এক যুগ অবশ্যই আসবে যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে কীভাবে সে মাল অর্জন করল, হালাল থেকে নাকি হারাম থেকে।’ — সহিহ বুখারী; অধ্যায় ২৬, ক্রয়-বিক্রয় ১২৯৯;

‘হযরত মূসা ইবনে ইসমাঈল (রহঃ), সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘আজ রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি দুই ব্যক্তি আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে-চলতে এক রক্তের নদীর নিকটে পৌঁছালাম। নদীর মাঝখানে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে। তার সামনে পাথর পড়ে আছে। নদীর মাঝখানের লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায় তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথরখণ্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে সে যতবার বেরিয়ে আসতে চায় ততবার তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে আর সে স্বস্থানে ফিরে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘লোকটি কে?’ সে বলল, যাকে আপনি রক্তের নদীতে দেখছেন, সে হলো সুদখোর।’ — সহিহ বুখারী; অধ্যায় ২৬, ক্রয়-বিক্রয়; ১৯৫৫; সমধর্মী হাদিস : আল-লুলু ওয়াল মারজান; অধ্যায় ৪২, স্বপ্ন ১৪৬৭;

উৎস : সহিহ বুখারী; মুসলিম, ইবনে মাজাহ; ভাষান্তর : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম

সুদখোরের পরিণতি সম্পর্কে কোরান ও হাদিসের কঠোর মনোভাবের একাধিক নজির থেকে কয়েকটি মাত্র এখানে চয়ন করা হয়েছে বিষয়টি ক্লিয়ার করার জন্য, সুদভিত্তিক সংস্কৃতিকে ঘিরে আবর্তিত সমাজ ইসলামে খাড়া থাকার দাবি করতে পারে না। তো এই কালচারের ওপর দাঁড়ানো বাংলাদেশ বা এরকম রাষ্ট্রের মুসলমান সম্প্রদায় ও শাসকবর্গ নামে মুসলমান হলেও কামে মুসলমান কি না সে-প্রশ্ন এইবেলা ওঠে। ইসলামের কনটেক্সট বিবেচনায় ‘মডারেট মুসলিম’ শব্দটি অগত্যা সন্দেহের কারণ হয় এবং চরমপন্থার উত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রেখে যায়। নিজেকে মডারেট মুসলিম বা মডারেট ইসলামের অনুসারী বলে যিনি জাহির করেন তিনি মৌল নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে কীভাবে ইসলামে বহাল থাকেন সেই সন্দেহ প্রবল হয় সেখানে।

বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকে এই কাজটি করে আসছে। পুঁজিশাসিত বিশ্বে কল্কে পাওয়ার শর্টকার্ট খোঁজার যে-ইতিহাস সেখানে মডারেট ইসলাম মোক্ষম হাতিয়ার বটে! বাংলাদেশ গোঁড়া থেকে নিজেকে সেখানে শামিল রেখেছে। ইসলামি জীবনবিধানের প্রচার-প্রসার বা প্রতিষ্ঠা এর লক্ষ্য ছিল না, বরং জগাখিঁচুড়িমার্কা বিশ্বাসে বিরাজিত জনগোষ্ঠীকে ততধিক জগাখিঁচুড়ি ছকে ব্যবহার এবং রিবা বা চক্রবৃদ্ধি হারে বর্ধিত সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির চর্চায় জারি থেকে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র নিজেকে মডারেট রূপে বিশ্বে জাহির করে। দেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থানে অনেকে শঙ্কিত বোধ করেন। এই উত্থানের পেছনে বৈশ্বিক কার্যকারণের অবদান থাকলেও স্থানিকতার ভূমিকা নিছক গৌণ নয়। আপাদমস্তক পশ্চিমা ধাঁচের শাসনব্যবস্থার বাজে অনুকরণ, সেইসঙ্গে প্রাচ্যে বিদ্যমান ঐতিহাসিক স্বৈরতন্ত্রের সুনিপুণ ব্যবহার আর তার সঙ্গে মডারেট ইসলাম রেটোরিক জুড়ে দিয়ে পাকানো খিঁচুড়িটি হচ্ছে সেই কারণ যা এখানে চরমপন্থাকে ত্বরিত করেছে।

সুতরাং, দেশে সক্রিয় কোনও চরমপন্থী গোষ্ঠী যখন আদালত থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ধ্বংসের ছক কষে তখন তাকে চট করে অযৌক্তিক গণ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ তথা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় ইসলামের মৌল নীতির উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ তার র‌্যাডিক্যাল ভিত্তির মানহানি ঘটানোয় চরমপন্থা সমাজে আপনা-আপনি একধরনের বৈধতা ও ন্যায্যতা তৈরি করে নিয়েছে। কেননা রাষ্ট্র প্রভাবিত জনসংস্কৃতি এখানে বহু বছর ধরে ইসলামচর্চার নামে মুনাফিকির চর্চায় লিপ্ত। মুনাফিক আর যাই হোক র‌্যাডিক্যাল ইসলামের বিচারে বৈধ গণ্য হতে পারে না। কোরানে আস্ত একটি সূরাসহ (*মুনাফিকুন : সূরা ৬৩) একাধিক সূরায় লিপিবদ্ধ আয়াত সমূহে মুনাফিকের লক্ষণ সম্পর্কে নবিকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। হাদিসও তাই। রসুলের জীবনে সংঘটিত ঘটনাবলীর পটপ্রবাহে মুনাফিক সেখানে উপমা ও উদাহরণ সহকারে সংকলিত হয়েছে :—

‘আবু বাকর ইবনু আবু শায়বা, যুহায়র ইবনু হারব ও আহমাদ ইবনু আবদা (রহঃ)…জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনু উবাই-র কবরের নিকট আসলেন এবং তাকে তার কবর থেকে উঠিয়ে তার হাঁটুর ওপর রাখলেন এবং তিনি তার ওপর থুথু দিলেন এবং তাকে স্বীয় জামা পরালেন। আল্লাহই এ সম্পর্কে ভাল জানেন।’ — সহিহ মুসলিম শরীফ; মুনাফিক; ৬৭৬৮ সমধর্মী হাদিস ৬৭৬৯; ভাষান্তর : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম

আবদুল্লাহ ইবনু উবাই-র ঘটনায় মোহাম্মদের অদ্ভুত আচরণের খানিক ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনতি পরবর্তী (৬৭৭০) হাদিসে। হয়রত উমরের বর্ণনা অনুসারে মুনাফিক বিদিত উবাইর মুত্যুর পর তার ছেলে নবিকে তার পিতার জানাজা পড়ানোর অনুরোধ করেন ও তাঁর জামাটি পিতার কাফন হিসেবে চেয়ে নেন। মোহাম্মদ উবাইর জানাজা পড়ানোর ক্ষণে উমর তাঁকে এ-ব্যাপারে আল্লাহর বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলে নবি উত্তর করেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহ আমাকে বলেছেন তাদের (মুনাফিক) জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ও না করা সমানকথা। এমনকি সত্তরবারও যদি ক্ষমা প্রার্থনা করি তিনি তা কবুল করবেন না। আমি সত্তরবারের চেয়ে বেশি করব।’ উমরের বাধা অস্বীকার করে নবি উবাইর জানাজা পড়ান ও আল্লাহর কাছে তার জন্য ক্ষমা চান। জানাজা পড়ানো শেষ হলে আয়াত নাজিল হয়, — ‘তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনও তার জন্য জানাজার সালাত আদায় করবেন না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবেন না।’ *দ্রষ্টব্য : সহিহ বুখারী; অধ্যায় ২০, জানাজা ১১৯৫, ১২৮২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

মুসলিম শরীফে মুনাফিক সংক্রান্ত একাধিক হাদিসের মধ্যে সমধর্মী দুটি হাদিসে (৬৭৭৮ ও ৬৭৭৯) নবি তাঁর সাহাবাদের মধ্য থেকে বারো জন সাহাবিকে মুনাফিক চিহ্নিত করেছিলেন, ‘…আমার সাহাবাদের মধ্যে বারোজন মুনাফিক লোক আছে। এদের আটজন জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না; যতক্ষন না সূচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করে। ‘দুবায়লা’ (আগুনের পলিতা) আট ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হবে। আসওয়াদ (রহঃ) বলেন, অবশিষ্ট চার ব্যক্তি সমন্ধে শু’বা কি বলেছেন, আমার তা মনে নেই।’ কোরান ও হাদিসে মুনাফিক সম্পর্কে কঠোর মনোভাব আরব গোত্রে ইসলামের বাণীর অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে তীব্র হয়েছিল সে-ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সুতরাং ইসলামবিশ্বাসী কোনও মুসলমানের জন্য ‘বুখারী শরীফ’-এ লিপিবদ্ধ হাদিসের (অধ্যায় ২, ইমান; ৩২ ও ৩৩) আলোকে নিজের চরিত্র-সংশোধন অনিবার্য হয়। সহি মুসলমান হতে হলে তাকে প্রথমত মিথ্যা কথা পরিহার করতে হবে, কাউকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা সে ভঙ্গ করবে না এবং তার কাছে গচ্ছিত আমানতের ‘খেয়াতন’ করতে পারবে না। কোরান ও হাদিসের এইসব রেফ্রেন্সের মধ্যে সূরা ‘নিসা’য় লোক দেখানো সালাত আদায় সূত্রে বর্ণিত ১৪২ নাম্বার আয়াতের প্রলম্বন হচ্ছে ১৪৩ নাম্বার আয়াত, উক্ত আয়াত সম্ভবত মোক্ষমভাবে মুনাফিকের স্বভাব ক্লিয়ার করেছে। আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী আয়াতটি অনুবাদে কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন :—

‘(They are) distracted in mind even in the midst of it being (sincerely) for neither one group nor for another. Whom God leaves straying never wilt thou find for him the way.’ — Source: Nisa; 4:143; Al Quran; Translation: Abdullah Yusuf Ali; quranyusufali.com.

‘দোটানায় দোদুল্যমান — না ইহাদের দিকে, না উহাদের দিকে! এবং আল্লাহ যাহাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তাহার জন্য কখনও কোন পথ পাইবে না।’ — উৎস : নিসা :১৪৩; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ

ফাউন্ডেশনের বঙ্গানুবাদ আরবি ও ইংরেজির মূলানুগ হলেও ভাষাগত আড়ষ্টতার কারণে আয়াতে ব্যক্ত মুনাফিক সম্পর্কিত ইশারা কেন যেন তীব্রতা পায়নি। আয়াতে দুমুখো লোকজনের স্বভাব সম্পর্কে আল্লাহ যেহেতু ইঙ্গিত দিয়েছেন সেক্ষেত্রে তরজমাটি এরকম হতেও পারত, — ‘তারা কোন পক্ষে যাবে সে-কথা ভেবে দুটানায় দুলছে। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোনও পথ তুমি খুঁজে পাবে না।’ সে যাই হোক, আয়াতটি ক্লিয়ার করে বাংলাদেশের মতো বহু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের মধ্যপন্থা ধারণ পূর্বক ইসলামে জারি থাকা নব্বইয়ে জনপ্রিয় হায়দার হোসেনের গানের কলি স্মরণ করায়! ঢাকাইয়া বুলির কুশলী প্রয়োগে সুগায়ক হায়দার গেয়েছিলেন বৈকি, ‘আমি ইধার কা মাল উধার করি, সারাদিন পেজগি মারি / দিনের বেলা আড়তদারি, রাইতে চোরাকারবারি / দিনদুনিয়ার সবই গেল, জীবন ভেস্তে যায়। / আমি ফাইসা গেছি, আমি ফাইসা গেছি / আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়।’

বেদনা ও হাহাকারের সঙ্গে চোখা বিদ্রুপ মেশানো হায়দারের গানের কলি বাংলাদেশের আমজনতা গুনগুন করার সময় হয়তো টেরও পায় না তারা নিজে এবং তাদের শাসকরা মোক্ষম ‘মাইনকার চিপায়’ বহু বছর যাবত দুলছেন এবং মুনাফিকের সকল আমল রপ্ত করে ইসলামে বহাল আছেন বটে! ‘ইধার কা মাল উধার’ করার চক্করে দোদুল্যমান রাষ্ট্রের কারণে সমাজে মুনাফিকের লক্ষণ অমোঘ হয়, যেখানে মসনদ পাকাপোক্ত রাখার স্বার্থে ইসলামের ব্যবহারে শাসকরা কুণ্ঠিত হয় না! এই দুটানা ইসলামে নিফাক বলেও বিদিত; অর্থাৎ ব্যক্তি অন্তরে কুফরি মনোভাব পোষণ করলেও বাইরে ইমানদার সাজার ভান করে। বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’র সংযোজন ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের খিঁচুড়ি জনগণকে নিফাকের চর্চায় নিবেদিত রাখায় র‌্যাডিক্যাল ইসলামে অটল ব্যক্তির এখানে চরমপন্থী হওয়ার ঝোঁক ঠেকানো মুশকিল। দীন প্রতিষ্ঠায় বাড়াবাড়ি বা চরমপন্থা কোরান অনুমোদন করে না; বিপরীতে এই সত্যটি মনে রাখা প্রয়োজন, নিফাক ও মুনাফিকির ওপর দাঁড়ানো ইসলামচর্চার বনেদকেও সে বৈধতা দান করেনি।

বাংলাদেশ সহ বহু মুসলিম রাষ্ট্র ‘মডারেট’ নামক শর্টকার্টের ভিতর দিয়ে গমন করায় তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামবিশ্বাসী ও মুসলমান কি না সেটা তাই সর্বাগ্রে খতিয়ে দেখা উচিত। অন্যথায় চরমপন্থা কোন জায়গা থেকে নিজেকে র‍্যাডিক্যাল ইসলামের অনুসারী দাবি করে এবং তার এই দাবিকে কনডেম করার পন্থা আসলে কেমন হওয়া উচিত সে-সম্পর্কে সঠিক ধারণায় পৌঁছানো কঠিন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ইসলামি মৌল নীতির ভিত্তিতে তার নিজেকে পরিচালিত করবে নতুবা ধর্মীয় নীতিকে রাষ্ট্র পরিচালনার বাইরে রেখে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবে, এবং সেক্ষেত্রে দুয়ের মাঝামাঝি কোনও শর্টকাট রাস্তা খোঁজার সুযোগ ইসলামে নেই। ওয়াজ নসিহত থেকে শুরু করে মসজিদে শুক্কুরবারের ইসলাম-বয়ানে হুজুররা এ-কথাটি সোচ্চারকণ্ঠে বলেন না যেহেতু তাঁরা নিজেও এই সমাজব্যবস্থার শরিক, যার মৌল বনেদ সুদ ও নিফাকের ওপর দাঁড়িয়ে ইসলামি সংস্কৃতির চর্চায় আজও নিয়োজিত!

সুতরাং এটা একপ্রকার অনিবার্য ধরে নিতে হয়, ওয়াজ ‍ও জুম্মার বয়ানে কাফির বা বেপর্দা নারীদের খিস্তিখেউরে ভরা অভিসম্পাতে জাহান্নাম নিশ্চিত করলেও ‘মাপে বা ওজনে কম দেওয়া’, ‘পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম চাহিদা ও সংকট সৃষ্টি করা’, ‘ঘুষ ও প্রতারণা’, ‘দাতা ও উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে রাষ্ট্রের দীর্ঘ মেয়াদি সুদে ঋণ গ্রহণ ও সেই অর্থে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে অনুদানের নয়ছয়’, ‘গরিবের হক মেরে খাওয়া’, ‘ভোটের সময় মিথ্যা আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি’ এবং জেনার চেয়ে ভয়াবহ অপরাধ ‘চক্রবৃদ্ধি হারে রিবা ওরফে সুদ ওরফে ইন্টারেস্ট খাওয়া’ সম্পর্কে ইসলামের বিধান তাঁরা এড়িয়ে যাবেন অথবা মুখে কুলোপ এঁটে থাকা সমীচীন ঠাউরাবেন! সমাজে তাঁদের ভরণপোষণ ইসলামবিরোধী কাজকারবারের মধ্য দিয়ে ঘটার কারণে তাঁরা নিজে সেই ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ যা পোশাকি এবং ইবলিশের ‘আকল’ দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশেসহ বিশ্ব জুড়ে মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা এহেন সংস্কৃতিতে প্রোথিত থাকায় ‘ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি জাতীয়তাবাদ, মুসলিম মিল্লাত, মুসলমান কওমিয়াত, উম্মতে রসুল’ ইত্যকায় শব্দগুলোর ওজন শুধু হ্রাস পায়নি, এগুলোকে মুনাফিকের ফাঁপা বুলি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রেটোরিকে ভাবা মুশকিল হয়ে পড়ে। অগত্যা আল্লামা ইকবালের আফসোসবচন একালের মুসলমান চিনতে কাজে লাগে :—

খুব কহিছ : দুনিয়া হইতে বিদায় নিতেছে মুসলমান!
প্রশ্ন আমার : মুসলিম কোথা? সে কি আজও আছে বিদ্যমান?
চলন তোমার খৃস্টানি, আর হিন্দুয়ানি সে তমদ্দুন,
ইহুদিও আজি শরম পাইবে দেখিলে তোমার এ-সব গুণ!
হতে পার তুমি সৈয়দ, মির্জা, হতে পার তুমি সে আফগান,
সব কিছু হও, কিন্তু শুধাই : বলত তুমি কি মুসলমান?

  • উৎস : কবিতা১৭, জবাবশিকওয়া; শিকওয়া জবাবশিকওয়া : আল্লামা ইকবাল; ভাষান্তর : গোলাম মুস্তফা; চিরায়ত গ্রন্থমালা : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ

‘শিকওয়া’-য় ইকবাল স্রষ্টার কাছে নালিশ ঠুকেছিলেন এই অভিমানে, কেন তিনি মুসলমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, যে-মুসলমানের কারণে জগতে তাঁর একত্ব বা তাওহিদের মর্মবাণী নতুন করে ধরায় জীবন লাভ করেছিল একদিন! কেনই-বা স্রষ্টা সেই মুসলমানকে এখন শান-শওকতে রৌশন করতে এত বিমুখ, কার্যত যার অকুতোভয় আনুগত্যের কারণে বিশ্বে একদিন সত্য রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল! অভিমানক্ষুব্ধ ইকবাল নালিশ ঠুকেছিলেন বৈকি :—

…সইছি মোরা জিল্লাতি আর দুশমনদের টিটকারি
তোমার তরে জান দিয়েছি — বদলা দিলে এই তারি?

দুনিয়া এখন মোদের ছেড়ে দুশমনদের দেয় পিয়ার
আমরা এখন বেকুফদিগের স্বর্গে আছি — চমৎকার!
আমরা তো আজ হচ্ছি বিদায়! নিচ্ছে তারাই কর্মভার,
দেখো, যেন শেষটা না কও ‘তৌহিদ নাই বিশ্বে আর!’
আমরা তো চাই — এই দুনিয়ায় কায়েম থাকুক তোমার নাম,
কিন্তু সেটা সম্ভব কি? সাকি ছাড়া থাকবে জাম?

ছেড়েছি কি আমরা তোমায়? কিংবা তোমার নূরনবি?
বুৎ-পূজা কি করছি মোরা? বুৎ বেচে কি খাই সবি?

মানি, মোদের প্রেম নহেকো আগের মতন গভীর আর,
নইক মোরা — যেমন ছিলাম সাচ্চা খাটি ইমানদার।
লক্ষ্যহারা চঞ্চল মন, কিবলা মোদের নাইকো ঠিক,
তোমার প্রেমের পথ ছেড়ে আজ চলেছি মোরা দিকবিদিক,
তুমিই-বা সে কম কিসে আর? — কইতে যে পাই শরম-লাজ,
সবার সাথেই করছ তো প্রেম! ধরেছ ‘হরযায়ী’-র সাজ!

  • উৎস : কবিতা১৭, ২১, ১৮, ২২ : শিকওয়া; শিকওয়া জবাবশিকওয়া : আল্লামা ইকবাল; ভাষান্তর : গোলাম মুস্তফা; চিরায়ত গ্রন্থমালা : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ

ইকবালের শিকওয়ার ভাষিক ব্যঞ্জনা অনুবাদে রক্ষা করা কঠিন। গোলাম মুস্তফা উর্দু জানতেন বিধায় মূল ব্যঞ্জনার নিকটে ঘুরে আসতে পেরেছেন, কিন্তু আমরা যারা উর্দু জানি না তবে ঠারে-ঠোরে যৎকিঞ্চিৎ বুঝি, শিকওয়ার রস তাদের মরমে খানিক দোলা দিয়ে যায় নুসরাত ফাতেহ আলী খান-র সাংগীতিক পরিবেশনা শ্রবণের পর। বিখ্যাত কাওয়াল ফরিদ আয়াজ ও আবু মোহাম্মদের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে নাতাশা বেগ-এর সাম্প্রতিক পরিবেশনাটিও (*Coke Studio: Season 11) এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়, যা ফিউশনের আদলে গীত হলেও শিকওয়ার স্পিরিটকে ধারণ করে বলেই মনে হয়েছে। সে যা-ই হোক, ইকবালের নালিশ জানানোর ধরন সেকালের আলেম-ওলামারা সহজভাবে নিতে পারেননি। তাঁদের চিত্তে ক্ষোভের বাষ্প জমা হয়েছিল এবং তাঁরা তা উগড়ে দিয়েছিলেন মুসলিম মিল্লাতের জাগরণের স্বপ্নে বিভোর কবিকে কুফরি ও নাস্তিক্যবাদের পরিপোষক আখ্যা দিয়ে। আলেমদের ভ্রমের অপনোদন ঘটাতে হয়তো জবাব-ই-শিকওয়ার জন্ম হয়েছিল অনতিপরবর্তী ক্ষণে।

দ্বি-জাতি তত্ত্বের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা হওয়ার জেরে বাংলাদেশের প্রগতিপন্থীদের কাছে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ তকমা লাভ করলেও মনে রাখা প্রয়োজন ইকবাল মুসলমানের মন চিনতে বিশেষ ভুল করেননি। তাওহিদের রক্ষক এই বিশ্বাসী সম্প্রদায়টি যখন নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয় তখন সে কার্যত কোন মুসলমানিত্বে অবস্থান করে সে-জিজ্ঞাসা তীব্র হয় বৈকি! যেহেতু মুসলমান রূপে বিশ্বে তার বিচরণের ধারা ও প্রবণতার সঙ্গে ইসলামের মৌল বাণী অনেক ক্ষেত্রেই এখন তীব্র সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশসহ বিশ্ব জুড়ে মুসলমান সম্প্রদায় ও তাদের শাসকরা অগত্যা যাবুর-এ লিপিবদ্ধ নবি দাউদের আক্ষেপের প্রতিধ্বনিও বটে, ‘They have all turned aside. / They have together become corrupt. / There is none who does good, no, not one.’ — Source: Zabur 14:3; The Holy Zabur; al-kitab.org.

চরমপন্থার রক্তবীজ মূলত এসব কারণে সমাজ পরিবর্তনের বাহানায় ফিরে-ফিরে জন্ম নেয় ও দুর্বার হয়ে ওঠে। পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে একে সাময়িক দমন করা যায় কিন্তু এর স্থায়ী সমাধানের জন্য যে-ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন তার স্বরূপ নির্ধারণে অসহায় বিকল্পধারায় চর্চিত মধ্যপন্থী উদারতা মনে তাই প্রশ্ন ও সংশয় রেখে যায়। র‌্যাডিকাল ও মডারেট টেক্সটের এইসব সাংঘর্ষিক ধারণায় গমনের ফলে ইসলামকে যাঁরা প্রত্যাখ্যান করা উচিত ভাবেন তাঁদেরকে বিকল্পধারায় আবির্ভূত বিদ্রোহী গণ্য করা যায়। স্ববিরোধী ও ক্ষমতালোভী রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত ইসলামকে বাতিল করার মাঝে এই বিদ্রোহীরা স্বস্তি খুঁজে ফেরেন এবং ex-Muslim বলে নিজেকে সাড়ম্বরে জাহিরও করে থাকেন! তাঁদের সম্পর্কে কথাবার্তা পরের পর্বে বলাটাই সমীচীন।


ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৮
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you