বাঙালির মানসচেতনায় রবীন্দ্রচর্চার প্রভাব ও পরিণতির দৃশ্যমান বন্ধ্যাত্ব আর ভণ্ডামিকে কামান দাগানোর সময় সুবিমল রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতাকে খারিজ করে বসেন, যেখানে রবিকে নতুন করে পাঠ যাওয়া ও বি-নির্মাণের সম্ভাবনা অথবা সে-রকম স্পেস তার কাছে পাত্তা পায় না। তার প্রতিবাদের ধরন এই অর্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রচলিত অভ্যাসের দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় জায়মান অসংগতিকে খিস্তি করার ক্ষণে সেই ব্যবস্থায় বিদ্যমান (*হয়তো প্রভাবহীন) আরেকটি ধারাকে বিকল্প বলে হাজির করা ও তাকে প্রতিষ্ঠার জন্য জানবাজি রাখার মাঝে বাঙালির বন্ধ্যাত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন তাঁকে উতলা করেছিল। যে-কারণে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎকে ঘিরে সৃষ্ট প্রতিমাকে খিস্তির তোড়ে খারিজ করলেও এর বিকল্প ভাবতে যেয়ে কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, ঋত্বিক কিংবা গদারের প্রতিমা গড়া ও এর মহিমার গুণগানে নিজেকে তিনি নিঃস্ব করেন।
সুবিমলসৃষ্ট এই প্রতিমায়নে গদার কিংবা ঋত্বিককে অগত্যা আর প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ থাকে না। প্রশ্ন হলো, যে-দোষে রবি বা সত্যজিৎ সুবিমলের ‘প্রতিমাচূর্ণ’ মিশনে প্রশ্নবিদ্ধ ও খারিজ হতে থাকেন এবং বিকল্পরূপে (ধরা যাক) জয়েস, কমলকুমার, গদার বা ঋত্বিকের প্রতিমায়ন ঘটে, সেখানে উনাদের প্রশ্নবিদ্ধ করার স্পেস তিনি রাখেন কি? নাকি উনারা তার কাছে সেই বিকল্প যা প্রশ্নের আওতায় কখনও দাঁড়িয়ে নেই? সুবিমল যে এমনটি ভাবেন না সে তার লেখাপত্রে বহুবার ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নিয়মে প্রতিমা ভেঙে নতুন যে-প্রতিমা গড়ে ওঠে তাকে একসময় ভাঙনের কবলে পড়তে হয়, এবং এই বিবেচনা তার রচনায় দুর্লভ নয়। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কী হেন কারণে রবি বা সত্যজিৎকে ঘিরে তৈরি প্রতিমায় হিসি করার ক্ষণে গোটা রবি ও সত্যজিৎকে তিনি প্রস্রাবের ফেনায় ভাসান? কেনই-বা তার একবারও মনে হয় না বাঙালিসৃষ্ট রবি বা সত্যজিতের প্রতিমায় মেদ থাকলেও ওই মেদটুকু ছেঁচে তুলতে পারলে প্রতিমারা স্বকীয়তায় ঝিলিক দিতেও পারে?
রবি কিংবা সত্যজিৎকে নতুনভাবে পাঠ ও বি-নির্মাণের সম্ভাবনা সুবিমলকে কদাপি ভাবিয়েছে বলে মনে হয়নি। কিংবদন্তিপ্রতিম মূর্তিগুলোর মস্তকছেদনকে তিনি জরুরি ভেবেছিলেন, নকশালরা যেমন বিপ্লবের প্রথম প্রহরে বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। এইসব একমুখী নির্ধারণের কারণে সুবিমলের ভিতরে আগুনরাঙা ক্রোধের ফুলকি থাকলেও সেই ক্রোধ তাকে প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে নিষ্ক্রমণ নিতে কোনও সহায়তা করেনি। তিনি একের পরিবর্তে বিদ্যমান অন্য প্রতিমার প্রতিষ্ঠায় নিজের দম বাজি রেখেছিলেন। রবিসাহিত্যে প্রাগ্রসর হওয়ার লক্ষণ তিনি খুঁজে পাননি, ওটাকে নির্ধারণবাদী ও স্থবির বলেই দেগেছেন। ভালো কথা, কমলকুমার-অমিয়ভূষণ কিংবা ঋত্বিক কি নির্ধারণবাদী ছকের বাইরের কোনও ঘটনা ছিলেন কিংবা সেখানে স্থবিরতার লক্ষণ কি বিলকুল নিখোঁজ? সুবিমলের ক্রাইসিসটা ছিল এখানেই, এক মানদণ্ড খারিজ করে তিনি অন্য মানদণ্ডের পিছু নিয়েছেন এবং একটাকে কামান দাগতে গিয়ে আরেকটি দিয়ে নিজের গোলাবারুদের বাকশো ভরে তুলেছিলেন।
মানবসংসারে যত ঘটনা তার কিছুই প্রশ্নের বাইরে নয়। সবকিছুই এখানে প্রতিমাপুজোয় নিঃস্ব হয় বিধায় কোনও প্রতিমাই কারও জন্য স্বস্তিকর বা অন্তিম হতে পারে না। আবার সকল প্রতিমার গায়ে জমা ধুলোবালি সফা করে সেখানে নতুন তুলি টানা ছাড়া কারও পক্ষে সত্যিকার প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া কঠিন।
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS