বছরজুড়ে ইশকুলে ধুন্দুমার উৎসব লেগেই থাকত। হপ্তাব্যাপী বাৎসরিক সাংস্কৃতিক উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চের নানানকিছু। রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী। আমার ক্লাসের বন্ধুদের সেসবে অবধারিত অংশগ্রহণ ছিল। বড়ক্লাসের আপারা এসে আমাদের গাইড করত। ইশকুলবার্ষিকীর জন্য লেখা চাইত। আমিও ততদিনে বেশ-রকম কবি হয়ে উঠতে চাইছিলাম। একদিন আম্মাকে এসে বললাম —
আমাদের ইশকুলম্যাগাজিনের জন্য লেখা লাগবে।
আম্মা মুখে মুখে বলে গেল —
আমার ছোট্ট বালিশটি রে
কী মিষ্টি রে ভাই
তোর উপরে মাথা রেখে
রোজ আমি ঘুমাই
ইত্যাদি কীসব জানি ছিল সেই ছড়ায়। আমিও বার-কয়েক শুনেটুনে লিখে ফেললাম খাতার পাতায়। তারপর নাম, শ্রেণি, রোল লিখে জমা দিলাম বড়ক্লাসের আপাদের কাছে। আপা ভাঁজ-করা কাগজটা নিয়ে চলে গেল। দিন-কয়েক বাদে আপার সাথে টিফিনআওয়ারে দেখা হতেই আমি ছুটে গেলাম। কিন্তু খুব সসংকোচ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন যেন আপাকে কিছুই জিগ্যেশ করতে পারছিলাম না। একে তো ‘বেঙ্গলি’ তায় আবার ‘কবি’! দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমি আর কিই-বা করতে পারি? সেই বড়আপা কী বুঝলেন কে জানে, নিজেই কোমল স্বরে বললেন —
বড় হয়ে আরও ভালো করে লিখবে, তখন বার্ষিকীতে ছাপা হবে।
আমি দমে গেলাম। এত আশা করে আম্মার বলা ছড়াটা লিখে দিলাম, অথচ সেটা কিনা ছাপাই হবে না! কপাল মন্দ হলে যা হয় আর-কি।
হরহামেশাই দেখা যায়, প্রায় প্রতি ক্লাসেই দুই-একজনের করে এক্সপোজার থাকে, যাদের মাতুব্বুরি আর খবরদারিতে অন্যেরা অনেকটা গুটিয়ে থাকে। তাদের কাজ হলো নিজেকে বড় প্রমাণ করার ছলে অন্যদের ছোট করে ফেলা। অন্যদের সুকুমার বৃত্তি এতে অপ্রকাশিত রয়ে যায়। তাদের দাপটে সারা ক্লাস তটস্থ থাকে। আমাদের ক্লাসেও এরকম দুই-চারজন অবশ্যই ছিল, যারা ছিল মহা ঝগড়ুটে। ছিল উচ্চকিত স্বর। যাদের দাপটে আমাদের কোণঠাসা হয়ে থাকার কথা। কিন্তু যেমনটা থাকার কথা, আমরা সেটা থাকতাম না। যাদের সাথে মনের মিল হতো, আমরা আলাদা হয়ে গিয়ে খেলাধুলা-আনন্দ-উল্লাস ঠিকই করতাম। তবে পান্নার সাথে আমার ভাব-বনিবনা বড় মীমাংসিত ছিল। কী যেন একটা কেমিস্ট্রিতে আমরা বাঁধা থাকতাম। হতে পারে দুইজনেই ভেজালহীন ‘বেঙ্গলি ভাষায়’ কথাবার্তা চালাতাম বলে। আমরা বরাবর একই বেঞ্চে বসতাম। আমি ওদের বাসায় যেতাম। ও আসত আমাদের বাসায়। কিন্তু আজ ভাবলে অবাক লাগে, আমি ওর কাছে পড়াশোনার জন্য কোনো হেল্প চাইতাম না। ও-ও চাইত না। ওর রেজাল্ট বরাবর ভালো ছিল। আমি ওর মতো টপ না করলেও একেবারে ডালমার্কা ছাত্রীও ছিলাম না। কিন্তু ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ আমার ছিলই না মোটে। আমি নিজেও খুব পড়ুয়া ছিলাম না। সিলেবাসের বাইরের বইগুলি পড়তেই আমার বেশি ভালো লাগত। ঠিক পরীক্ষার আগের রাতে পড়তে বসতাম। সারাবছর পড়া ফাঁকি দিয়ে চলতাম। আমার বাসায় কোনো হাউসটিউটর কোনোকালেই ছিল না। আমার পড়া দেখিয়ে দিত আব্বা, ছোটকা। চাচাতো ভাইদের কাছে থেকেও আমি পড়া বুঝে নিতাম। কিন্তু আমি আমার সবকিছু নিয়েই মহাসুখী ছিলাম। আনন্দিত ছিলাম।
এর মাঝে একুশে ফেব্রুয়ারি সন্নিকট হয়ে উঠল। বড়ক্লাসের আপারা এগিয়ে এল এক নাটক নিয়ে। ওই নাটকটা তাদের কারো লেখা হয়ে থাকবে। এতদিনে ঠিকঠাক মনে নেই। ভুলে গেছি অনেককিছুই। তবে এটা মনে আছে, সব সংলাপ ছড়ায় ছড়ায় বলে যাওয়া। অর্থাৎ কাব্যনাট্য। আমাদের ক্লাসের এক্সপোজাররা ছাড়াও দুই/একজন নিতান্তই ভালোমানুষ টাইপরাও চান্স পেয়ে গেল। আমিও ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো লাফাতে লাফাতে সামিল হতে চাইলাম। কিন্তু আমার স্টেজভীতি ছিল (আজও তা বিদ্যমান)। তাছাড়া পিঠে ‘বেঙ্গলি’ স্টিকার সেঁটে থাকার কারণে আমি ছিলাম ভীতু খরগোশছানার মতো। গুহায় লুকিয়ে থাকতে পারলেই যেন আমার স্বস্তি হতো। কিন্তু বড়ক্লাসের আপারা সহৃদয় ছিল। ফলে আমাকে চান্স দিলো, কিন্তু মাত্র দুইটা বাক্য বলার জন্য। কার যেন ছোটবোনের চরিত্র ছিল সেটা। মহা শোরগোলে রিহার্সেল চলতে লাগল। আমাদের ক্লাসের প্রায় ৫/৬ জনের বেশি ওই রিহার্সেলে অংশ নিলাম। রিহার্সেল তো ভালোই করলাম, কিন্তু মঞ্চায়নের দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, আমি ততই ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে লাগলাম। এত লোকের সম্মুখে সংলাপ বলব কীভাবে?
এসে গেল একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রভাতফেরির পরে মঞ্চস্থ হবে আমাদের নাটক। আমিও বুক-ঢিপঢিপানি নিয়ে প্রস্তুত। এই নাটক নিয়ে বাসায় ফাড়াগফ জোড়াগফ সবই আমি দিয়েছি। আব্বা-আম্মাকে বলেছি অনেক বড় একটা চরিত্র করছি আমি। ভাই প্রদীপের কাছেও আমার গল্পের কমতি নাই। বাসায় তো খালি পান্না, বন্যা, মনশ্রী, রত্না — এদের গল্পই চলে। ইশকুলের গল্প না করলে আমার পেট ভরবে কী দিয়ে? আর আমার গল্পের তো শ্রোতার অভাব নাই। আমি যা-ই বলি না কেন, সবাই সেসব খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিন নাটক শুরুর আগে আমরা ফোর/বি-র ক্লাসরুমকে গ্রিনরুম বানিয়েছি। মিষ্টি নামের এক মিষ্টি মেয়ে, সেও আমাদের ক্লাসমেট — বসে বসে রিহার্সেল দেখছে। সহসা সে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে —
তুমি কি এই জামা পরেই স্টেজে উঠবে?
আজ ঠিকঠাক মনে নেই তার মুখচ্ছবি। বা, সে কী সিলেটি ছিল না বেঙ্গলি? তবে তার ছিল সিল্কি চুলের রাশি। শ্যামলাবরনি সেই মেয়ের কথায় আমি বেশ অপ্রস্তুত বোধ করি। সে ফের জানতে চায় আমি অন্য কোনো জামা ব্যাগে করে এনেছি কি না?
আমি অন্য কোনো জামা আনিনি। পরে আছি ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে আব্বার কিনে দেয়া টাফেটা কাপড়ের চোস্ত পায়জামা আর কামিজ। গাঢ় নীল রঙ। সেই রঙের উপর আম্মা যত্ন করে শাদা রঙের চওড়া লেস লাগিয়ে দিয়েছে।
আমি মিষ্টির দিকে তাকাই। মিষ্টি আলতো করে বলে —
তুমি আমার জামাটা পরতে পারো। তুমি এটা পরে নাও। নাটক শেষ হলে খুলে দিয়ে দিও।
আমি তার সামনে একেবারে খোরগোশের ছানার মতো ত্রস্ত হয়ে উঠি। আড়চোখে তার জামার দিকে তাকাই। মিষ্টি পরে আছে হাল্কা সোনালি রঙের সাটিন সিল্কের একটা নতুন জামা। তার ঘাড়ের উপর সমান-করে-ছাঁটা সিল্কি চুল ঝলমল করছে! সে খুব ভালোবেসে ও আন্তরিকভাবেই আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছে। হয়তো সে আমাকে ভালোবাসে! কিন্তু আমি ভেবে পাই না কীভাবে আমি তার জামা পরবো। আমি কীভাবে ক্লাসরুমে আদুল-গা হব? বা কীভাবে জামা বদলাবদলি করব?
আমি চুপ করে আছি দেখে মিষ্টি আর তেমন পীড়াপিড়ি করে না। হয়তো সে বুঝে যায় আমি তার জামা পরতে অনিচ্ছুক। আমার জামা হয়তো অতটা উজ্জ্বল নয়, কিছুটা রঙ-মলিন হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তা পরেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। কাঁচা হোক তবুও ভাই নিজের বাসা!
রামগুয়া গাছের তলায় একচিলতে সবুজ আঙিনায় উঁচু বেঞ্চগুলি জোড়া দিয়ে দিয়ে স্টেজ বানানো হয়েছে। মাইকে ভেসে আসছে কবিতার ছন্দে ছন্দে বলা সংলাপ। আমার ডাক এসে যায়। স্টেজের পেছনে থাকা বড়আপারা আমায় হাত ইশারা করে ডাকে। ফিসফিসিয়ে বলে যে, যাও যাও এখন তুমি। তোমার সিন এসে গেছে।
খানিকটা-অনুজ্জ্বল-হয়ে-যাওয়া টাফেটা কাপড়ের জামা আর বাটার স্যান্ডেল পরে আমি সোজা স্টেজে উঠে যাই। মাইক্রোফোনের সামনে দুইলাইন সংলাপ গড়গড়িয়ে বলে অন্যদের পেছনে নিজেকে আড়াল করে ফেলি। একটা গুহা পেলে আর তাতে এক্ষুণি ঢুকে পড়তে পারলে বেশ হতো!
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS