খুব বেশি তো নয়, বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়্যাল ম্যুভির ইন্ডাস্ট্রিটা আকারে এমনিতেই ছোট, হাতে-গোনা খানকতেক বই রিলিজ হয় অ্যানুয়্যালি হিসাব করলে। এখন তো মনে হয় সিনেমা বানানোর সংখ্যা আরও তলিয়ে এসেছে। প্রেক্ষাগৃহগুলো বুঁজে আসছে একটার পরে একটা, যারা বানাবে সিনেমা তারা অ্যাডভার্ট আর টেলিফিল্ম-টিভিড্রামা বানায়ে জেবের রেস্ত মটকায় ট্র্যান্সফার করছে সংসারের খাইখর্চা-বিলাসব্যসনের জন্যে, যারা ছায়াছবি নির্মাণ করছে তাদের মধ্যে এফডিসি অ্যাভোয়েড করে দেশের মানুষকে বেশি পাত্তা না দিয়ে বিদেশভ্রমণ ও দুনিয়াজয়ের একটা দুর্মর বাসনা বিরাজ করতে দেখা যাচ্ছে। এবং অখ্যাত সমস্ত পুরস্কার বিদেশের পাড়ামহল্লাভিত্তিক ক্লাব থেকে বগলদাবা করে নিয়ে এসে কেউ কেউ বোকা বাংলাদেশজ খবরবিলির পত্রিকা আর টিভিচ্যানেলগুলোর কাছ থেকে বেজায় বাইটও জুটিয়ে নিচ্ছে। বেশ চলছে দেশের সিনেশিল্প।
পরিস্থিতি চিরদিন এমন ছিল না। খানিক ভিন্ন পরিস্থিতি ছিল বছর-পনেরো আগেও। লোকে প্রেক্ষাগৃহে এসে পয়সা খর্চে সিনেমা দেখত এবং সেই বিবেচনায় একটা ম্যুভি হিট হতো অথবা ফ্লপ। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রের সর্বোচ্চ অবস্থানে, এফডিসি থেকে সে-সময় প্রায় রোজই সিনেমা বাজারে এসে নেমেছে। নয়া নায়ক, নয়া নায়িকা, নয়া নয়া ডিরেক্টর ও প্রোডিউস্যর বেরোতে দেখা যায় হপ্তায় হপ্তায়। একটানা আস্ত দশক ছিল ম্যুভিনির্মাণে মুখরিত। যদিও তখন অধিকাংশ সিনেমাই নিন্দিত হতো কপিকাটপেইস্টের অভিযোগে, হিন্দি সিনেমা থেকে ফ্রেইম-টু-ফ্রেইম টুক্লিফাইয়ের অভিযোগ উঠত মুক্তিপ্রাপ্ত ম্যুভিগুলোর উপরে। এরপরের দশকে অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। কাটপিসের মালমাত্তায় সয়লাব হয়ে যায় এফডিসি। এরপরে এখন তো বছরভর শুধু শিল্পীসমিতির নির্বাচন আর বনভোজন ও মধুপুরের রইদে র্যাফেল ড্র করে বেড়ায়, সিনেমা করাকরির পাট চুকিয়ে টেলিভিশনে ঈদেচান্দে একটু খোমা দেখাইবার সুযোগ খোঁজে সবাই। রিসেন্টলি তারা জাতীয় নির্বাচনের ঠিকা নিয়েছিল, সফল হয় তাদের প্রকল্প, ভবিষ্যতে তাদেরে আর নাটক করেও পয়সা আর্ন দরকার হবে না। টাকশাল তারাই চালাবে যেহেতু, পরিশ্রম করে রইদে পুড়ে অ্যাক্টিঙের দরকার তো দেখি না।
শাবনূর নব্বইয়ের দশকে এসেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে। এহতেশাম নামে একজন পরিচালক ছিলেন, ঢাকাই ফিল্মে নতুন মুখের আমদানি এবং ব্যবসাসফল ছবি বানানোয় এহতেশামের ছিল জব্বর নামডাক। অনেক নায়িকার অভিষেক হয়েছে এহতেশামের হাত ধরে। শাবনূর এহতেশাম-উপস্থাপিত অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে একজন। পয়লা শাবনূর-অভিনীত ‘চাঁদনী রাতে’ সিনেমাটা বাজারে মুখ থুবড়ালেও পরের সিনেমা থেকে সেন্সেশন্যাল সালমান শাহের সঙ্গে পেয়ারআপের মাধ্যমে দেশজোড়া ভাইব তৈয়ার করেন। পরে একে একে এই জুটির অনেক সিনেমা বাইরায়, একটা ক্যাল্কুলেশনে দেখা যায় সালমান শাহ আত্মহননের আগ পর্যন্ত সালমান-শাবনূর হার্টথ্রব জুটির অভিনীত ম্যুভিসংখ্যা চোদ্দটা। বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে যে-কয়টা সাক্সেসফ্যুল জুটি ছিল বা আছে এই জুটিটা তাদের শীর্ষগণ্য বোধহয়।
শাবনূরের মতো ছটফটে কিশোরী ইম্প্রেশনের নায়িকা বাংলাদেশে এর আগে বা পরে কমই এসেছে। গেছো কাঠবিড়ালির ছটফটানি তার চোখের পাতায়, পায়ে এবং শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গে। এইসব দেখে দেশের পত্রপত্রিকা তারে সেক্সি ইমেজের নায়িকা ভাবতে শুরু করে। যদিও দুরন্ত ছুটাছুটি আর ছটফটানির কারণে সেক্সি বলতে পারা যায় না শাবনূররে। একটা চিরকিশোরীর ইমেজেই থেকে গেছেন শাবনূর, ম্যাচিউর হইতে দেখা আর গেল না তারে। অযথা নাকেমুখে কথা বলিয়া যাওয়া নাদান কিশোরী। ভুলভাল চোখনৃত্য আর গা-হেলানি কিশোরী। কিন্তু দুর্দান্ত শরীরী ফিটনেস নিয়া শাবনূর সবচেয়ে বেশিদিন বিরাজ করেছেন সিনেমায়। ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে রেখেই। কিছু মুটিয়ে গেছিলেন বিরতিতে যাবার আগে, একটা আলগা নারীলাবণ্য ধরেছিল সেই মেদস্ফীতির কারণে।
হ্যাঁ, নৃত্যপটীয়সী ছিলেন বলা যায়। বাংলাদেশের সিনেমার নায়িকাদেরে ব্যাপক বনজঙ্গলে আর খালেবিলে ঝাঁপাঝাঁপি আর দাপাদাপি করে বেড়াতে হয়। শাবনূরের ন্যায় এমন দাপাদাপি স্মরণকালে কেউ করতে পেরেছে বলিয়া সাক্ষী মিলবে না। আর শাবনূরের নখরামি। এইটাও তো ঢাকাই সিনেমার নায়িকা এমনকি নায়কদেরও অবশ্যপালনীয় আচরণ ও যোগ্যতা। ন্যাকামো করা। কান্নার সিনে সেকেন্ডে তেরোবার হেঁচকি তোলা। শাবনূরের সঙ্গে ন্যাকামো-নখরামি দিয়া পার পাওয়া সাধকেরও অসাধ্য। নখরা-ন্যাকা নায়িকাদের ল্যান্ড বাংলাদেশে শাবনূর ন্যাকাশিরোমণি। ঠিক যে এই ক্যারেক্টারিস্টিকগুলা পাব্লিকে খেয়েছে ভালো, পরিচালকেরা তার আগে, পয়সা উশুল হয়েছে প্রেক্ষাগৃহফেরতা পাব্লিকের ও পরিচালকদিগের।
বাংলাদেশে এখনও জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী সালমান শাহ অকালে প্রস্থানের আগে চুটিয়ে কাজ করছিলেন শাবনূরের সঙ্গে। স্যুইসাইডের অব্যবহিত পরে এর একটা অভিঘাত শাবনূরের উপরে অর্শানোর আশঙ্কা থাকলেও তরী সামলায়ে নেন শাবনূর। অভিনয়টা জানেন এবং তার জায়গায় বিকল্প কেউ না থাকায় মিডিয়ার উল্টাপাল্টা কারবারের পরেও শাবনূরের কামব্যাক ঘটে রয়্যালভাবে এবং পরে একচেটিয়া শাকিল-রিয়াজ-ফেরদৌস প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেন। রিয়াজ-শাবনূর জুটিটা পাব্লিকের মনে ধরেছিল। অচিরে নায়িকা অস্ট্রেলিয়ায় গেলে ধীরে ধীরে তার অবসরযাপনের সঙ্কেত পাওয়া যায় ইতিউতি এবং একসময় তারে বিয়ে-থা করে সংসার পাততে দেখা যায় একটা ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এখন সন্তানজননী শাবনূর কালেভদ্রে দেশে ফেরেন। হিজাব পরেন, পর্দাপুশিদা করেন, রোজানামাজের খবর জানা যায় না। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর, একবার; পরে ‘নিরন্তর’ ম্যুভিতে অ্যাক্ট করার জন্যে ক্রিটিকদেরও প্রশংসা জুটেছিল কপালে।
একটা ব্যাপার নোট করা দরকার বোধহয়, দেশের সব বিগত-স্বাগত নায়িকা-নায়কেরা নাটকের টেলিচ্যানেলে আসেন হামেশা, শাবনূরই শুধু রয়্যাল একটা সিনেমালাইফ কাটাইতে পেরেছেন এবং এখনও ছোটপর্দায় উঁকি দেন নাই দুইপয়সা কামাইয়ের আশায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যতটা আন্দাজ করা যায় এই বছরের একটা টাইমে শাবনূর দেশে আসবেন অবকাশযাপনের নিয়তে এবং তখন দুই-দুইটা ছায়াছবিতে অ্যাক্ট করবেন বলিয়া আখবারে এলান করা আছে। শাবনূরফ্যানদের জন্যে এইটা খুশখব্রি নিশ্চয়।
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS