দ্য আর্ট অব মিলান কুন্দেরা || আহমদ মিনহাজ

দ্য আর্ট অব মিলান কুন্দেরা || আহমদ মিনহাজ

মিলান কুন্দেরা দেহ রাখসেন শুনে চমকে গেছি বলা যায়। আমার ধারণা ছিল উনি জীবিত নাই। ফ্রান্সে বহু বৎসর ধরে বসবাস করতেসেন জানা ছিল, তবে উনি জীবিত ও সক্রিয় সেইটা কেন জানি মন থেকে মুছে গিয়েছিল। এখন সেইটা ভেবে অবাক লাগতেসে! সাহিত্যপাঠে অনিয়মিত হওয়ার কারণে কি তাঁকে রিকল করার তাগিদ মনে জাগে নাই? ফি বচ্ছর নোবেলের তালিকায় তাঁর নাম উঠতে শুনছি একসময়। অভ্যাসটায় ইদানীং ভাটা পড়ার কারণে কি উনাকে মৃত ভাবসি আমি? হইতে পারে। আমার যৎসামান্য সাহিত্যপাঠে বহুপ্রজ কিন্তু স্বল্পপঠিত লেখকের তালিকায় কুন্দেরা কীভাবে জায়গা করে নিসিলেন, নীরবে ঘুম যাইতেসিলেন এত বচ্ছর ধরে, ওই কথাটাই সববিস্ময়ে ভাবতেসি এখন!

কুন্দেরার ভুবনবিদিত আখ্যান ঠাট্টা পড়সিলাম একসময়। বাংলা ভাষান্তরে। শেখ আবদুর রহমান সম্ভবত অনুবাদটা করসিলেন। ভাষান্তরের ভালোমন্দ এখন আর স্মরণ নাই। তবে কুন্দেরার জাত টের পাইতে সমস্যা হয় নাই। তারপর দ্য আর্ট অব নভেল। বইপত্র থেকে বেশ চড়া দামে গোটা দুইচার ইংরেজি বই কেনার যে-ইতিহাস তার মধ্যে ওইটা ছিল অন্যতম। ইংরেজিতে কাঁচা হইলেও ঠাট্টা পাঠের ইতিনেতি অভিঘাত বোধহয় ওইটা খরিদে মনকে উতলা করসিল। অতঃপর বইখানা উল্টেপাল্টে দেখা হইসে বহুবার। পাঠের চাইতে পাঠের ভান অবশ্য ব্যাপক ছিল সেখানে। নভেল লেখার কারিকুরি নিয়া নতুন যেসব কথাবার্তা কুন্দেরা সেখানে আওড়াইসেন, এবং পরে সেইটা নানা আকারে আমরা বিশ্বসাহিত্যে প্রাসঙ্গিক হইতে দেখসি, তো এর মাহাত্ম্য বোঝার ধীশক্তি তখন ছিল না। দ্য আর্ট অব নভেল এইভাবে আমার পাঠতালিকায় পঠিত হওয়ার নাম করে অপঠিত একখান কিতাব রূপে আজো বিরাজ করতেসেন বলা যায়।

ভানসর্বস্ব পাঠের মধ্যেও কুন্দেরার এই ননফিকশন মনকে বিচলিত করসিল তখন। এমন একখান বই যার মধ্যে আখ্যানের প্রথাগত ছকগুলাকে তিনি ইগনোর করতেসেন! বদলি হিসেবে নতুন মান নির্ধারণ করতেসেন আখ্যানের এবং এর প্রমাণ দিতেসেন The Book of Laughter and ForgettingThe Unbearable Lightness of Being কিংবা Immortality-র মতো রচনায়। কুন্দেরাভক্ত পাঠকগণের মাধ্যমে এইসব খবরাখবর কানে আসলেও তাঁর ভাষাজগতে মুসাফিরি নিতে মন উতলা বোধ করে নাই। কেন করে নাই সেই কথা ভেবে মন হতচকিত বটে! কারণ হয়তো এই, কুন্দেরা সাহিত্যের ছকে সেইসব আলাপ সদা উঠাইতে ব্যস্ত থাকসেন যেইটা নিৎশে পড়তে গিয়া পাঠকের ঘটে। সত্তা নামক ব্যাপারখানাকে একইসঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক চরমাবস্থায় নিরিখ করার পরে যা থাকে সেইটা হইল তাকে ওইসবকিছুর বাইরে নিয়া যাওয়া। সকল গতির মধ্য হইতে সত্তার অপসারণ। ক্রমশ এমতো স্থিতির মধ্যে তারে ফেরত আনা যেখানে জীবন আসলে কিছু হইতে আকুল না। সে বড়োজোর নিভৃতচারী কোনো অজানায় গুম হইতে চায়। হইতে পারে পারি শহরের রাস্তায় মানব প্রজাতির ব্যাপক গতিময়তায় মিশে যাওয়ার ক্ষণে নিজেকে হাপিশ করে অন্যত্র সটকে পড়টা সে মুক্তি বইলা ভাবে। সটকে পড়ার আগে সত্তার পরিণাম নিয়া কয়েকছত্র দার্শনিকতা আওড়ায়। নিৎশে যেমন ওইটা সদা আওড়াইতেন রস-পরিহাসমাখা দারুণ বাক্যবাণে।

কুন্দেরাকে আমার গোড়া হইতে সেরকম একজন লেখক মনে হইত। আপাদমস্তক রাজনীতিসচেতন সত্তা হওয়ার পরেও নিজের অস্তিত্বকে সকল সচেতনা থেকে নিভৃতচারী নির্জনতায় সরিয়ে নিতে উন্মুখ মনে হইত তাঁকে। নিজের লেখায় তাঁর যাত্রা দন কিহোতের মতো কিন্তু যাত্রাটা যেখানে শেষ হইতে চায় সেইটা বেদনার! বিষাদাতুর নিভৃতে এই দন কিহোতে তার নিজেকে নিঃস্ব বইলা দাগায়। এভাবে যে-লোকটা লেখে তারে পাঠ যাওয়া কঠিন বা সহজ কোনোটাই না। কুন্দেরা কাঠিন্যে বন্দি টেক্সট কিন্তু না আবার চটজলদি সহজপাঠ্য বইলা জাহির করাটা মুশকিল। তাঁকে পাঠের ভান করা যায় কিন্তু পাঠ করসি দাবি করাটা (আমার কাছে) সহজ ঠেকে নাই।

মিলান কুন্দেরার সর্বশেষ যে-কাজের খবর কানে আসছিল সেইটা স্লোনেস। মিখাইল গর্বাচেভের পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত-র কল্যাণে কোকোকোলায় রঙিন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অকাল পতনের যুগবিশ্বে পারি শহরে বিচরণ করতে-করতে নিজের সঙ্গে মনে হয় সংলাপে নিরত ছিলেন কুন্দেরা। স্লোনেসকে সেরকম একখান টেক্সট ঠাউরে বসছিলাম আমি। আমার কুন্দেরাপাঠের খতিয়ানে স্লোনেস বোধ করি একমাত্র, ঠাট্টার পরে যার আগাগোড়া পাঠ করসিলাম। কুন্দেরা, বলাবাহুল্য, তাঁর ধরতাই অনুসারে সেখানেও স্বতন্ত্র। পড়তে গিয়া টের পাইতেসিলাম সত্তার লঘুতা নিয়া গুরুতর দার্শনিকতায় নিপতিত লেখক আরেকবার, এবং এইবার আরো প্রবল জোয়ারে রহসময়তায় গমন-উদ্যত, যেইটা আদতে সত্তার আদি পরিচয়। সত্তাকে ভবে আসতে হয় এই অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য,—বিচিত্র চাপের মধ্যে তার সত্তাযাপনটা আখেরে দানবীয় পরিহাসের ঘূর্ণিতে ক্রমশ হারাইয়া যাইতে থাকে। এর থেকে নিষ্কৃতির পথ নাই। নিষ্কৃতির বাহানায় যেইটা অতীতে ছিল এবং এখনো আছে বইলা ভ্রম হয় তারে বিপজ্জনক নিভৃতচারীতা হয়তো বলা যাইতে পারে। সত্তা সেখানে নিজের সঙ্গে সংলাপে নিরত থাকে। ফার্নান্দো পেসোয়া যেমন নিরত থাকসেন সবসময়! কুন্দেরাও তাই বটে!

কুন্দেরার দেশকাল সচেতনা, ষাট হইতে সত্তর অবধি তৎপর রাজনীতি ও এর প্রতিক্রিয়ায় দেশান্তর…, এইসব মিলেঝুলে যে-সত্তাকে মূর্ত হইতে দেখসি সেইটা খোলসমাত্র। খোলসের আড়ালে পইড়া থাকা লোকটা নিৎশে নির্মিত জরত্রুস্ত্রের গলিভাই। তার মতোন সঙ্গবিহীন একলা জওয়ান। নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ ও নিভৃতচারী। জীবিত এই সত্তা কার্যত জীবন্মৃত সত্তার বেশ ধরে প্যারিসের অলিগলিতে বিচরণ করতেসিলেন। তাঁর দৈহিক প্রয়াণের মধ্য দিয়া সেই যুগটা বোধহয় অস্ত গেল যেই যুগ ইতিহাসের বৃহৎ স্বপ্নভঙ্গের শরিক ছিল। গতির বিপরীতে যে-ধীরতাকে বিলীন হইতে দেখে কুন্দেরা নিজেকে নিভৃতচারী নির্জনতায় জব্দ রাখলেন, অদ্য এর পতন ঘটল বলা যায়।

তাঁর রচিত অভিনব ভাষাপৃথিবীর জগতে অনেক আগেই তিনি দেহ রাখসিলেন। দৈহিকপতনে ভাষাপৃথিবীটা এখন প্রশ্ন উঠাইতে পারে,—অদ্য এই বর্তমান অথবা আসন্ন আগামীতে কুন্দেরার সত্তা জুড়ে সচল ধীরতায় গমনের আবশ্যকতা কি মানুষকে তাড়া দিয়া যাবে? নাকি মানবপৃথিবীর পতন ঘটবে কর্তৃত্ববাদী সক্রিয়তায়, যার বাখান মিগুয়েল সার্ভান্তেস হইতে জর্জ অরওয়েল…সকলেই কমবেশি রাখার চেষ্টা করসেন? যার চাপে মিলান কুন্দেরা আখ্যান ফাঁদতে বসে চরিত্র নির্মাণে কভু আগ্রহ বোধ করেন নাই। চরিত্র নয় বরং তাঁর আগ্রহ ছিল চরিত্রকে সেইসব প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে বলায়, যেন সে বুঝতে পারে তার এই সত্তাযাপন নিছক ভান ও আড়ম্বরে নিঃস্ব হইতেসে অবিরত। সত্তাযাপনের ফেরে নিজ দেশ হইতে বিতাড়িত কুন্দেরা পারি শহরের অলিগলিতে বিচরণের ক্ষণে যেসব প্রশ্ন উঠাইসেন তার সৎ উত্তর কঠিন বিধায় মিলান কুন্দেরাকে পাঠ করা যায় না, তাঁকে পাঠ সম্ভব নয়; তবে হ্যাঁ, পাঠের ভান দিব্যি করা যায়। আমি যেমন করসি একসময়।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you