তোমারই পথপানে চাহি, আমারই পাখি : পশ্চিমা দর্শনের দুই ধারা || মাইক ফুলার :: অনুবাদ / মহসিন রাহুল

তোমারই পথপানে চাহি, আমারই পাখি : পশ্চিমা দর্শনের দুই ধারা || মাইক ফুলার :: অনুবাদ / মহসিন রাহুল

[কয়েকটি পারিভাষিক শব্দের নিম্নোক্ত প্রচলিত বাংলা অনুসরণ করা হয়েছে। এবং, কিছু ইংরেজি শব্দ/বাক্য অনুবাদ না করেই রাখা হলো।

অভিজ্ঞতাবাদ — empiricism, যুক্তিবাদ — rationalism, প্রয়োগবাদ — pragmatism, বিজ্ঞানবাদ — scientism, বিবর্তনবাদ — evolutionism, অস্তিত্ববাদ — existentialism, প্রতিভাসতত্ত্ব — phenomenology, জগৎ-দৃষ্টি — world-view, কার্যকারণ সম্বন্ধ — causality, করুণা-মৃত্যু — euthanasia, অধিবিদ্যা — metaphysics, সারসত্ত্বা — essence, স্বাধীন ইচ্ছা / নিয়তিবাদ — free will / determinism, জার্মান ভাববাদ — German idealism, নারীবাদ — feminism, উদ্দেশ্য-বিধেয়-ফ্রেমওয়ার্ক — subject-object framework, স্বস্থিত জগৎ — things-in-themselves, অতিন্দ্রীয়বাদ — mysticism, ঈশ্বর-প্রমাণ-প্রকল্প — God project.

# অনুবাদক ]


দর্শনের অ্যানালিটিক ধারা আর কন্টিনেন্টাল ধারা আলাদা পথে-যে হাঁটা আরম্ভ করলো, এ-প্রবন্ধে আমি সে-বিষয়ে কথা বলতে চাই। যে, কেন দুই ধারার দুই দার্শনিক একে অন্যের কাজের দিকে হতভম্ব হয়ে বলেন, ‘এটা কি আদৌ দর্শন? … অবশ্যই না !’

দুই ধারার আলাদা হবার ধরন, কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান ঘেঁটে দেখতে আমি আলোচনাকে চারটি ভাগে উপস্থাপন করব। প্রথমে দেখতে চাই এর পেছনের কাহিনি। দ্বিতীয়ত, চিহ্নিত করার চেষ্টা করব দর্শনের কাজগুলি কী আসলে; এতে আশা করি সমস্যাটা বোঝা সহজ হবে। তৃতীয়ত , দুই ধারার বিচ্ছেদে বড় ভূমিকা-রাখা কয়েকজন দার্শনিক ও কয়েকটি আন্দোলনের তদন্ত করব আমি । সবশেষে চেষ্টা করব, কোনো একটা উপসংহার টানতে।

পেছনের কাহিনি
দুই ধারার এই ভেদ মোটামুটি পুরানা ঘটনা। সেই ১৭ ও ১৮ শতকে, দেখা যাবে , বৃটিশ দার্শনিকদের ঝোঁক অভিজ্ঞতাবাদের দিকে (লক, বার্কলে, হিউম), আর কন্টিনেন্টাল দার্শনিকদের আগ্রহ যুক্তিবাদের দিকে (দেকার্ত, স্পিনোজা, লাইবনিজ)। এবং এভাবেই আলাদা ভঙ্গি ও পদ্ধতির শুরু। তা সত্ত্বেও, অভিজ্ঞতাবাদীরা আর যুক্তিবাদীরা, দুই পক্ষই নিজেদেরকে গ্রিক, খ্রিস্টান ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার মিশ্রণ থেকে উৎসারিত একটা অভিন্ন ধারার সমান দাবিদার সদস্য ভাবতেন । একপক্ষ অন্যপক্ষের রচনার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকানো তো দূরের কথা, তাঁরা বরং একে অন্যের সাথে তর্ক-বিতর্ক করতে পারতেন, এবং তা করেছেনও। তাই দেখা যাবে, লাইবনিজ ও লক তর্ক করছেন জন্মগতভাবে-থাকা-ধারণা বা innate idea সম্পর্কে, এবং খুব বিখ্যাতভাবে দেখা যাবে হিউম কান্টকে তাঁর বিশ্বাসের গভীর নিদ্রা থেকে জাগাচ্ছেন।

২০ শতকের শুরুর দিকে বার্ট্রান্ড রাসেল ও জি.ই. মুর-এর লেখার মাধ্যমে দুই ধারার পার্থক্য তীব্রতর চেহারা পায়। তখন দুনিয়া জুড়ে কন্টিনেন্টাল তত্ত্ব হেগেলবাদের জয়জয়কার। তা শাসন করছিলো শুধু কন্টিনেন্ট না, বরং ইংল্যান্ড ও আমেরিকাও ছিল তার ছাতার নিচে। ইংল্যান্ড-আমেরিকায় যাদের হাতে এর পতাকা ছিল, এখন তাঁরা বিস্মৃতপ্রায় নাম, — কেয়ার্ডস, ম্যাকটাগার্ট, বৌসানকেট, রয়েস। হেগেলবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কলরব উঠেছিল নানা প্রান্ত থেকে। যেমন, উইলিয়াম জেমসের আমেরিকান প্রয়োগবাদ, হার্বার্ট স্পেন্সার ও হেকেলদের ‘বিজ্ঞানবাদ’ ও ‘বিবর্তনবাদ’। তবে মুর আর রাসেলের প্রত্যুত্তরই সম্ভবত সবচেয়ে বড় অভিঘাত, এবং বলা যায় এর থেকেই ‘অ্যানালিটিকাল দর্শন’ নামে আমরা এখন যা চিনি, তার জন্ম।

মুর-রাসেল কার্যক্রম নিয়ে এল স্পষ্টতা, যুক্তি ও ভাষার দিকে সচেতনতা। এবং জার্মান ভাববাদ ও হেগেলবাদের ‘প্রকাণ্ড ধোঁয়াশার’ বিপরীতে দর্শনচর্চায় আনতে চাইলো গদ্যস্বভাবী সুনির্দিষ্টতা। এটা ছিল দর্শন আলোচনার একটা শক্ত, সুনির্দিষ্ট, ‘পুরুষালি’ দৃষ্টিভঙ্গি, — হেগেলবাদকে সে-তুলনায় প্রবহনস্বভাবী, জটিল ও ‘কমনীয়’ বলা যায়। রাসেল ও মুরের তৈরি পথেই গড়ে ওঠে অ্যানালিটিকাল দর্শন (রাসেল-মুর থেকে লজিকাল পজিটিভিজম ও ভিটগেনস্টাইন ও তৎপরবর্তীগণ)। শুধু তা-ই নয়, এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দর্শন বিভাগের কারিকুলামের গঠনেও পড়ে তার ছায়া। দর্শন পড়া হতো ‘গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হিউম’ পর্যন্ত, তারপরই হঠাৎ লাফ দেয়া হতো রাসেল এবং মুর-এ (ফলে, ফিকটে, হেগেল, নীৎসে, মার্ক্স ও হুসার্লের মতো কন্টিনেন্টাল দার্শনিকদের সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হতো)। মনে হতো যেন, হিউম আর রাসেলের মাঝখানে দর্শনে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই ঘটে নাই।

এটাই সম্পূর্ণ চিত্র না, অবশ্যই । দু-একজন কন্টিনেন্টাল দার্শনিকের অ্যানালিটিকালদের এলাকায় গলিপথে ঢোকার অনুমোদন ছিল, যে, উনারা জরুরি ও অ্যানালিটিকাল পদ্ধতির ‘ইউজার-ফ্রেন্ডলি’। যেমন, কান্ট (অনেকটা যেন ‘প্রুশিয়ার হিউম’), ফ্রেগে (‘যুক্তি’-র উপর উনার কাজের জন্যে), এবং সবচেয়ে লক্ষণীয় ও অদ্ভুতভাবে — ভিটগেনস্টাইন। সেই সঙ্গে, আরো উদার অ্যানালিটিকাল ডিপার্টমেন্টগুলো ‘অপশনাল এক্সট্রা’ হিসেবে দু-একটা কন্টিনেন্টাল কোর্স অফার করত। কোর্সটা সাধারণত হবে সার্ত্রে-ঘরানার অস্তিত্ববাদ, বা কদাচিৎ হয়তো হুসার্লীয় প্রতিভাসতত্ত্বর উপর। এটা পরিষ্কার সিদ্ধান্ত ছিল যে, কন্টিনেন্টালদের মধ্যে কান্ট, ফ্রেগে ও ভিটগেনস্টাইনের ঘরানা হচ্ছে মূল কোর্সের অংশ (কেননা তাঁরা মূলত অ্যানালিটিকাল দার্শনিক), কিন্তু সার্ত্রে বা হুসার্ল্ মোটেই কোর্সের মূল খাদ্য না, বরং অনেকটা অভিনব স্বাদের মিষ্টান্ন মাত্র। অনেকটা এমন ভাব যে, “কন্টিনেন্টালেরা কী নিয়ে আছে আজকাল” —ছাত্রদের একটু সেই ধারণা দেয়া।

একসময় মনে হয়েছিল, ভিটগেনস্টাইনের শেষজীবনের চিন্তাভাবনা অ্যানালিটিকাল দার্শনিকদের নিরেট, নির্দিষ্ট, যৌক্তিক পদ্ধতিকে পুরাই ধসিয়ে দিবে। ভিটগেনস্টাইনের উত্থানের ফলে এমনকি ‘Clarity Is Not Enough’ এইরকম নামের বইপত্রও বেরিয়েছে। কিন্তু অ্যানালিটিকাল ঐতিহ্য দ্রুতই ফিরে আসতে সক্ষম হয় নিজস্ব মূর্তিতে, এবং নিয়মনিষ্ঠ যুক্তিবিদ্যার উপর ভর দিয়ে বিশুদ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে দার্শনিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ততদিনে, কন্টিনেন্টে বহুকিছু গেছে পাল্টে। ইংলিশ ইউনিভার্সিটিগুলিতে তখনো সাম্প্রতিক কন্টিনেন্টাল দর্শনের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে অস্তিত্ববাদ ও প্রতিভাসতত্ত্ব পড়ানো হচ্ছে। কন্টিনেন্টালরা নিজেরা ততদিনে এই দুই মতবাদকে সমালোচনা করে ঘোষণা দিয়েছেন, এগুলি ছদ্মবেশী ‘দেকার্তীয় প্রকল্প’ এবং সহজ-সরল ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক দর্শন’। শুনতে আজব সব নাম, দর্শনচর্চার তারো চেয়ে অদ্ভুত সব ভঙ্গি নিয়ে একেবারে নতুন একগুচ্ছ আন্দোলন একটা থেকে আরেকটা সেখানে ফলে উঠলো দ্রুতই : স্ট্রাকচারালিজম, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম, পোস্টমডার্নিজম এবং ডিকন্সট্রাকশন।

পেছনের কাহিনি মোটামুটি এই। অ্যানালিটিকালরা কন্টিনেন্টালদের চিন্তাভাবনার দিকে তাকান যেন এ কী বেহুদা অনর্থ! উত্তরে কন্টিনেন্টালরা বললেন, “আপনাদের এগুলি কি আদৌ দর্শন? … মোটেই না!”

দর্শনের কারবারটা কী আসলে?
দর্শনের মূল প্রকল্প, আমার বিবেচনায়, চারটা :

(১) এক নম্বর প্রকল্প হলো, সত্যের সন্ধান। জিনিসটা আরেকটু পরিষ্কার করে বলা যায় যে, আমাদের ‘জ্ঞান’ আসলেই নিশ্চিতভাবে সত্যিকার জ্ঞান কি না সেটা বোঝার চেষ্টা।

এটা দর্শনের একদম ঐতিহ্যবাহী প্রোগ্রাম, এবং একদম সেই প্লেটোর আমল থেকে চলছে, যিনি ভবিষ্যতের সব চাপানউতোরের কাঠামো সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে ঠিক করে দিয়েছিলেন। এজন্যেই এ. এন. হোয়াইটহেড বলেছিলেন, দর্শন মানে হলো “প্লেটোর ভাবনাচিন্তার পাদটীকা”।

(২) দ্বিতীয় প্রকল্প, ধারণা ও সমস্যার বিশ্লেষণ ও স্পষ্টকরণ (এবং ধারণার ও দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনামূলক গ্রহণ ও বর্জন)।

এটা একদম বিমূর্ত ও তাত্ত্বিক হতে পারে, যেমন ‘কার্যকারণ সম্বন্ধ’-র উপর হিউমের বিশ্লেষণ। তবে, প্রাত্যহিক জীবনের উদ্ভূত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও হতে পারে। যেমন ‘স্বাধীনতা’ সম্পর্কে জন স্টুয়ার্ট মিলের আলোচনা, বা ‘করুণা-মৃত্যু’, ‘গর্ভপাত’, ‘আত্মহত্যা’ এসবের নৈতিক দিক নিয়ে এখনকার যে-আলোচনা। বিমূর্ত কিংবা বাস্তব আলোচনা, যেটাই হোক, — সাধারণত সত্যিকার সমস্যার সমাধানে নীতিনির্ধারক এ-ধরনের আলাপ দেখা যায় (তবে, কখনো কখনো বিমূর্ত সমস্যা বাতিল করতেও এ-ধরনের আলোচনা হয় )।

(৩) মানুষের জীবনের সুখ , এবং ‘উৎকৃষ্ট জীবন’ বা ‘বিশুদ্ধভাবে’ বাঁচা নিয়ে গভীর ভাবনাচিন্তা।

(৪) ‘হ্বেল্টানশাং’ বা ‘জগৎ-দৃষ্টি’ এবং ‘চিন্তার পদ্ধতি’, ‘জীবন-পদ্ধতি’ উপস্থাপন। বিশেষত যেসব বিষয় পৃথিবীতে বর্তমান জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত (যেমন, খ্রিস্টানবাদ, উদারবাদ, ডারইনবাদ, মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদ, ‘নব্যডান’ পোস্টমডার্নিজম, নারীবাদ ইত্যাদি)।

তো, এইসব প্রকল্প একটার সাথে অন্যটা সম্পর্কিত, এবং হয়তো কোনো দার্শনিক এর কিছু অংশে জোর দিলেন বাকিগুলি বাদ দিলেন। আমার বক্তব্য হলো, অ্যানালিটিক দর্শন জোর দেয় (১) এবং (২) নম্বরে, এবং বিশ্বাস করে যে কন্টিনেন্টাল দর্শন অস্পষ্ট বাতেলায় জোর দেয় (৩) ও (৪) নম্বরে। অ্যানালিটিকেরা এও মনে করেন যে, কন্টিনেন্টালরা যখন (১) ও (২) নম্বর সমাধা করতে আগান, তখন নিতান্ত বেড়াছেড়া কাণ্ড ঘটান।

এর উত্তরে কন্টিনেন্টাল দার্শনিকেরা কিঞ্চিৎ অবজ্ঞায় বলেন, গোঁড়া অ্যানালিটিক পদ্ধতি ওই (৩) ও (৪) নম্বরে শুধু যে অপর্যাপ্ত মনোযোগ দেয় তা-ই না, এই ব্যর্থতার কারণে এটা বিমূর্ত ও অনুর্বর তো বটেই, উপরন্তু, ওই পদ্ধতি মারাত্মক ভুল করে যখন খুব তৃপ্তির সঙ্গে নিজেকে ভাবে (১) ও (২) নম্বর সমাধা করতে একচামচ বেশি পারঙ্গম। অ্যানালিটিক পদ্ধতির স্পষ্টতা ও সুনির্দিষ্টতা আসলে উনাদের হ্রস্বদৃষ্টি, অল্পপ্রাণতা, সত্যিকার গভীরতার অভাব, এবং নিজেদের ফ্রেমওয়ার্ক ও প্রোগ্রামের সীমাবদ্ধতা বুঝতে ব্যর্থতারই চিহ্নমাত্র। সংক্ষেপে বললে, কন্টিনেন্টালদের বক্তব্য হলো, অ্যানালিটিকালরা আসলে (১) ও (২) নম্বর সমাধা করেন তাঁদের তুলনায় হ্রস্বদৃষ্টিতে। অ্যানালিটিকদের এমন করার কারণ, তাঁদেরকে যেসব সমালোচনা করা হয়েছে সেগুলো তাঁরা পড়েন নাই, বা ঠিকমতো বুঝেন নাই। সেসব সমালোচনা এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও আন্দোলন থেকে, যার কিছু আবার অ্যানালিটিকিদের নিজেদেরই ঐতিহ্যের। যেমন, নীৎসে, হাইদেগার, ভিটগেনস্টাইনের শেষদিককার লেখা, দেরিদা এবং ডিকন্সট্রাকটিভ আন্দোলন, নারীবাদ, রিচার্ড রর্টি। এবার এসবের দিকে একটু তাকাব আমরা।


সক্রেটিসপ্রাণিত ত্যাঁদড় কিছু সমালোচক : ভিটগেনস্টাইন, নীৎসে, হাইদেগার, দেরিদা, নারীবাদ এবং রর্টি


ভিটগেনস্টাইন —
দুই পথ আলাদা হয়ে যাওয়ার এইকাহিনিতে ভিটগেনস্টাইনের অবস্থানটা সবচেয়ে অদ্ভুত। উনাকে এখনো অ্যানালিটিক ধারার অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়। কিন্তু, এই ধারার ভিতরের ও বাইরের অনেকে মনে করেন, স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উপায়ে সত্য খুঁজে বের করার অ্যানালিটিকদের যে-প্রতিজ্ঞা ও উদ্দেশ্য ছিল, ভিটগেনস্টাইনের শেষদিককার লেখা তা বর্জন করেছিল।

ভাষা সম্পর্কে ভিটগেনস্টাইনের যে-অবস্থান, সেটাই অধিবিদ্যার উপর উনার দিকের মূল আক্রমণ। ভাষার মধ্যে উনি দেখলেন, উনার টিপ্পনী অনু্যায়ী বললে, ‘game ’ ও ‘tools’; উনার স্লোগান ছিল, ‘Don’t ask for the meaning, ask for the use’। সহজ করে বললে, যদি একটা শব্দ একটা বিশেষ পারিপার্শ্বিকতায় একটা ফ্রেইজের মধ্যে ব্যবহৃত হয়ে অর্থ উৎপাদন করে, তাহলে সেই শব্দকে যখনই সেই পারিপার্শ্বিকতা থেকে হেঁচকা টানে বের করে নিয়ে আসা হয়, তখনই শব্দটা ‘language game’-এর ‘tool’ হিসেবে ব্যবহৃত হবার যোগ্যতা হারায়, এবং শব্দটা তখন নিরর্থক হয়ে যায়, আর তখন ‘language has gone on holiday.’।

ভিটগেনস্টান মনে করেন, অধিবিদ্যা ভাষাকে প্রেক্ষাপট-বহির্ভূত উপায়ে ব্যবহারের চেষ্টা চালায়, যখন জগৎ ‘আসলেই কেমন’ সেই সারসত্তামূলক বিশ্লেষণ দিতে যায়। এমন ‘সারসত্তার সমস্যার’ (‘essence fallacy’) ফাঁকির উপর ভর দিয়েই দার্শিনেকেরা বাস্তব প্রেক্ষাপট কিংবা প্রামাণ্য ফ্রেমের বাইরে গিয়ে জগৎ ব্যাখ্যা করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন। এবং এই পদ্ধতিতেই তাঁরা মন/দেহ কিংবা স্বাধীন ইচ্ছা / নিয়তিবাদ এই ধরনের পুরানা ধূসর সব বিতর্কের ‘সত্তাগত সমাধান’ পেয়ে যাবেন বলে আস্থাবান।

ভিটগেনস্টাইনের ব্যাখ্যা এখানে খুব লক্ষণীয়ভাবে দেরিদার ‘ডিকন্সট্রাকশনের’ কিছুটা পূর্বাভাস দিবে। ভিটগেনস্টাইন দেখাতে চান, দার্শনিক ভাষা আরো গভীর, আরো সারার্থমূলক হতে গিয়ে তা হতে তো ব্যর্থ বটেই, বরং তা অজান্তেই হয়ে উঠেছে ‘রেখে-যাওয়া ছাপ’ (‘traces’), বর্জিত টুকরাটাকরা, আর মূল প্রেক্ষাপটের প্রতিধ্বনির মিশ্রণের সম্পূর্ণ নিরর্থক এক খিচুড়ি । যেই প্রেক্ষাপটের মধ্যে ব্যবহৃত হবার কারণে একটা শব্দ বোধগম্য হয়, তার বাইরে ছিঁড়ে আনার ফলে দার্শনিক এসব শব্দের আসলে কোনো অর্থ হয় না।

এরকম সমালোচনার থেরাপি খেয়ে দর্শনের যে-কোনো ছাত্রের বুঝতে পারা উচিত যে অধিবিদ্যা অসম্ভব, এবং ‘যা যেমন আছে, তেমন’ রেখে শান্তির জীবনে ফিরে যাওয়া উচিত। পাত্তা দেবার মতো কোনো দার্শনিক সমস্যাই তো নাই যা সমাধান করা বাকি, কারণ সবই ‘বাতিল’ করে দেয়া যায় ভাষাতাত্ত্বিক ওই থেরাপি দিয়ে।

কিন্তু, বেশিদিন গেল না, অ্যানালিটিক দার্শনিকরা আবার দার্শনিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আরম্ভ করলেন। এর কারণ কী? এর কতটা এই কারণে যে ভিটগেনস্টাইনের সিদ্ধান্তগুলোকে ভুল প্রমাণ করা গেছে, বা কতটা এমন ব্যাপার যে (রর্টি হয়তো এটা বলবেন) অ্যানালিটিকাল দার্শনিকরা ‘ভিটগেনস্টানের প্রকল্পে’ বোরড্ হয়ে গেছেন, এবং উনার বিরুদ্ধে পালটা তর্ক না করে সোজা উনাকে বাদ দিয়ে এগিয়ে গেছেন, যেন ভিটগেনস্টাইন বলে কেউ নাই?

এর উত্তর পরিষ্কার না। ভিটগেনস্টাইনের সিদ্ধান্তগুলোকে একটু এদিক-সেদিক এবং নরম করার অনেকগুলি চেষ্টা দেখা গেছে, কিন্তু সেগুলি কতখানি সফল, তা নিঃসন্দেহে বলা কঠিন। ডব্লিউ.ভি.ও. কোয়াইন নিয়ে এসেছেন ‘semantic ascent’ (‘শব্দার্থ ফেলে শব্দ নিয়ে কাটাছিঁড়া’) কথাটা। এই সমালোচনার বক্তব্য হলো, দর্শনের সমস্যা-সমাধান-প্রকল্প ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বেহুদা বা অসম্ভব তো নয়ই, বরং, যথেষ্ট ব্যবহারিক কারণেই, দরকারি এবং সম্ভব। মাইকেল ডামেট সন্দেহ তুলেছেন ভিটগেনস্টাইনের ‘meaning in use’ তত্ত্বের (এবং তার ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্ত, শব্দের ব্যবহারিতিরিক্ত অর্থ নাই) যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়ে। বহু পূর্বে ফ্রেগে ‘force’ (‘বক্তব্যের ঝোঁক’) এবং ‘sense’ (‘বোধ’) এই দুইয়ের পার্থক্য করেছিলেন, ডামেট সেই রাস্তা ধরে এগিয়েছেন। যদি যথার্থ মনে হয়, ডোনাল্ড ডেভিডসনের তর্ক দেখা যেতে পারে। ‘scheme’ ও ‘content’ বিভাজনের সমালোচনা উনার, যা ভিটগেনস্টাইনের ‘থেরাপি কার্যক্রমের’ গোড়ায় থাকা বোধগত আপেক্ষিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ।

ভিটগেনস্টাইনের শেষদিককার চিন্তা, বলা যেতে পারে, দর্শনের ওই (১) ও (২) নম্বর প্রকল্পের উপর স্পষ্ট আক্রমণ। ‘ফিলোসোফিকাল ইনভেস্টিগেশন্স’-এ তিনি চূড়ান্ত সত্যের এবং স্পষ্টতা-নির্দিষ্টতার আদর্শের সমালোচনা করেছেন। উপরের (৩) ও (৪) নম্বর প্রকল্পের রাজনৈতিক ও নৈতিক মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই মনে করেন, ভিটগেনস্টাইনের ‘philosophy leaves everything as it is’ কথাটা কোনো কাজের না, কোনো সাহায্যও করে না।

নীৎসে —
নীৎসের তিন ধরনের সম্ভব পাঠ আমি প্রস্তাব করতে চাই :

(ক) জার্মান ভাববাদের ক্লান্তিকর শেষপ্রান্তের প্রতিনিধি তিনি। জগতের ভাববাদী ব্যাখ্যায় শোপেনহাওয়ারের ‘বাঁচার বাসনা’ (‘will to live’)-কে তিনি প্রতিস্থাপন করেছেন ‘ক্ষমতার বাসনা’ (‘will to power’) দিয়ে। (নীৎসেকে দীর্ঘদিন এভাবেই দেখা হয়েছে, বিশেষত অ্যানালিটিকদের দ্বারা, কিন্তু আমার মনে হয় না এখন আর কেউ বিশ্বাস করে যে এটাই নীৎসে।)

(খ) তিনি বেশ সরাসরি সন্দেহবাদী ও আপেক্ষিকতাপন্থী, যিনি কান্ট থেকে একবিন্দু আগাননি, এমনকি কান্টের বিরুদ্ধে রাগ উগড়ানোর সময়ও না। ( এটি আমার নিজের পাঠ।)

(গ) তিনি অনেকটা বলা যায় ‘দেরিদার আদি ভার্শন’, যিনি ধারাবাহিক ‘কুলুজি টেনে টেনে’ যুক্তি ও সুনির্দিষ্টতার প্রতি দর্শনের বাতিক ও এর সত্য-সন্ধান-প্রকল্পের ডিকন্সট্রাকট করেন, খুলে দেখিয়ে এগুলির অন্ধকার মনোবৈজ্ঞানিক সব শিকড়। তিনি বরং প্রশংসা করেন অবচেতনা, আবেগ, সহজাত প্রবৃত্তি,শরীরের। (নীৎসের এই পাঠ বহু কন্টিনেন্টাল ও নারীবাদী চিন্তকের প্রিয়। এবং এ থেকেই কিছুটা বোঝা যাবে সাম্প্রতিক কন্টিনেন্টাল চিন্তার আরো ‘বিপ্লবী’ রচনারাশির দিকে অ্যানালিটিক দার্শনিকরা কেন বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকান।)

যদি দ্বিতীয় বা তৃতীয় পাঠ সত্যের কাছাকাছি হয়, তাহলে স্পষ্টত তিনি উপরের দর্শন-প্রকল্প (১) ও (২) নম্বরকে আক্রমণ করছেন; — সত্যসন্ধানে যৌক্তিক নির্দিষ্টতা চাওয়া পণ্ডশ্রম মাত্র। তবে তাঁর মূল্যবোধ নির্মাণ, জগৎ-দৃষ্টি নির্মাণ , ‘মহাসত্যের’ ‘মিথ্যা সান্তনা’-মুক্ত জীবনযাপনের প্রস্তাবনা কিছুটা উপরের প্রকল্প (৩) ও (৪) নম্বরের দাবি পূরণ করে।

নীৎসের দর্শন সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, বা আদৌ তাতে কিছু আসে যায় কি না, তা অধুনার অ্যানালিটিক ও কন্টিনেন্টাল দর্শনের অমীমাংসিত বিতর্কের বিষয়গুলোর একটা।

হাইদেগার —
এই আলোচনায় সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হলো হাইদেগারের শেষদিককার চিন্তা ও তাঁর তথাকথিত ‘অধিবিদ্যার ধ্বংস’। কন্টিনেন্টাল চিন্তকরা সম্ভবত হাইদেগারের শেষদিকের লেখাগুলো মাথায় রেখেই তাঁদের সমকালীন অ্যানালিটিকদের রচনা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন যে এরা এখনো ‘উদ্দেশ্য-বিধেয় ফ্রেমওয়ার্ক’ দিয়ে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করছেন! তাঁরা বোধ করেন, ‘আদিতম অবস্থায়’ ‘অধিবিদ্যার গোড়ায়’ ফেরার হাইদেগারের যে-আহ্বান, তা অ্যানালিটিকরা যে-ফ্রেমওয়ার্কে বিষয়আশয় ব্যাখ্যা করেন তাকে অবশ্যই অপ্রতুল হিসেবে প্রমাণ করেছে। কারণ, তা দেখায় যে, উদ্দেশ্য-বিধেয় বিভাজন একটা গৌণ ও কৃত্রিম নির্মাণ, যা Being-কে স্পষ্টভাবে বর্ণনার বদলে আরো ধোঁয়াটে করে তোলে।

আমি এখানে শেষদিককার হাইদেগারের চিন্তার একটা পাঠ প্রস্তাব করব, যেটা অনেক বিশেষজ্ঞই হয় ভুল নয়তো ভয়ঙ্কর সরলীকরণ মনে করতে পারেন। শেষদিককার হাইদেগার আসলে এক অতিন্দ্রীয়বাদী চিন্তক। উনার বক্তব্যের সারার্থ বুদ্ধ, লাওৎসু বা সেন্ট জন অফ ক্রস, এদের কাউকেই বিস্মিত করবে না।

অতিন্দ্রীয়বাদ আমাদের সবসময় শিখিয়েছে, ব্যক্তি ও জগতের মাঝখানে ‘ego’ বা ‘অহম’ এসে যখন পর্দা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সত্য বা জগতের আসল রূপ আর ধরা দেয় না। এই চিন্তাভঙ্গি বারবার এসেছে দর্শনে ও ধর্মতত্ত্বে, এবং হাইদেগার হচ্ছেন তার নতুনতম ভার্শন।

হাইদেগার স্পষ্টতই আক্রমণ করছেন দর্শনের উপরিউল্লিখিত (১) ও (২) নম্বরকে। উদ্দেশ্য-বিধেয় ফ্রেমওয়ার্কের সীমার মধ্যে থেকে অ্যানালিটিকালরা আলোচনায় শুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতার যে-চর্চা করেছেন, তা নেহাতই শক্তির অপচয় (যদিও হাইদেগার স্বীকার করবেন, বলা ভালো — জোর দিয়ে বলবেন যে, এই ফ্রেমওয়ার্ক ও পণ্ডশ্রম খুবই দৃশ্যমান ও দুর্ভাগ্যজনক প্রভাব ফেলেছে সে-অনুসারে নির্মিত আমাদের পৃথিবীর উপর)। হাইদেগার মানব-অস্তিত্বের “হওয়াকে হতে দিবে” তেমন নীতিজ্ঞান ও রাজনীতির দিকে পক্ষপাত দেখান, এবং আধুনিক পৃথিবীর উপর প্রযুক্তিগত “হস্তক্ষেপের” মূলে আমাদের “Will to will”-এর যে-মানসিকতা, সেটির ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকতে বলেন। এভাবে হাইদেগার উপরোক্ত (৩) ও (৪) নম্বর প্রকল্পের দায় শোধেন।

দেরিদা —
চিন্তার ধারার মধ্যকার এই বিতর্কে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি শংসা ও ক্ষোভের জন্ম দেয় দেরিদার উপস্থিতি। তাঁর নিন্দুকেরা মূলত অ্যানালিটিকাল ধারার কিছু দার্শনিক। দেরিদাকে এঁরা কেউ দেখেন এক অশিক্ষিত ধড়িবাজ হিসাবে, আবার কেউবা উদার হয়ে ভাবেন, লোকটার কিছু ন্যায্য দার্শনিক বক্তব্য আছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এর সবই ভিটগেনস্টাইন (কখনোবা নীৎসে) আগে বলে গেছেন। তাঁর ভক্তরা — প্রায় ক্ষেত্রেই সেই লোকজন যাদের দর্শন বা এর ইতিহাসের ব্যাপারে তত গভীর দখল নাই — ভাবেন যে, দেরিদা (যিনি দাবি করেন, দর্শন ও এর ইতিহাসের বিষয়ে তিনি গভীরভাবে ওয়াকিবহাল) সমস্ত দুর্দান্ত কাণ্ডের নায়ক। তিনি দর্শন ও যুক্তির দিন শেষ করে দিয়েছেন, দর্শন ও যুক্তির নতুন ভঙ্গি উদ্ভাবন করেছেন তিনি, তিনি দর্শনকে অবনমিত করেছেন সাহিত্যে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ভদ্রলোক নিজ জীবদ্দশায়ই সত্যিকার এক কিংবদন্তি।

দেরিদার ব্যাপারে প্রথমেই আমার দুইটা কথা বলার। প্রথমত, আমার মনে হয়, হোয়াইটহেডের মতো যেসব দার্শনিক দর্শন বলতে ভাবেন “প্লেটোর দর্শনের পাদটীকা”, দেরিদাকে ন্যায্যভাবেই সেই গোত্রে রাখা যায় (কারণ, বাস্তব জগতের পেছনে উপস্থিত বিশেষ সত্য খোঁজার চিন্তাপদ্ধতির পরিষ্কার বর্ণনা সর্বপ্রথম দিয়েছিলেন প্লেটোই। “উপস্থিতির অধিবিদ্যা”-র বিরুদ্ধে দেরিদার যে-জিহাদ, তার কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ওইটাই)। দ্বিতীয়ত, দেরিদাকে বাতিল করা বা তাঁকে ফ্রান্সের ভিটগেনস্টাইন বলে চিহ্নিত করা খুব সহজ। আমার মনে হয়, যেসব চিন্তক অন্যদের চিন্তার সৃষ্টিশীল সংশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন চিন্তা উপস্থিত করেন, দেরিদা তেমনই অনেকটা (উনার ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে,পূর্বতন চিন্তকরা : হাইদেগার, স্যসুর, নষ্টের গোড়া নীৎসে, এবং হেগেল)।

আমি দেরিদার একটা পাঠ উপস্থাপন করতে চাই যেটি, আবারো, অনেকেই নিঃসন্দেহে বেঠিক কিংবা সরলীকরণ মনে করবেন। দর্শনে দেরিদার প্রধান অবদান হলো, কান্ট ‘জ্ঞান’-কে যা যা করতে চেয়েছেন, দেরিদা ঠিক তা-ই করতে চেয়েছেন ভাষা ও অর্থের ক্ষেত্রে। কথাটা একেবারে সহজেই বলা যায়। কান্ট শিখিয়েছিলেন, যেসব কারণে আপেক্ষিক (ফেনোমেনাল) জ্ঞান সম্ভব হয় (এক্ষেত্রে, ‘ধারণা’ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে স্থান ও কালের সংবেদন মারফত), হুবহু সেসব কারণেই স্বস্থিত জগৎ-এর চূড়ান্ত ( নউমেনাল) জ্ঞান অসম্ভব। দেরিদা শেখান, ঠিক যেসব কারণে আপেক্ষিক অর্থ সম্ভব হয় (এক্ষেত্রে, ‘trace’-এর মারফত চলে ‘play’ এবং ‘difference’-এর কারবার), সেসব কারণেই চূড়ান্ত অর্থ অসম্ভব (ফলত অসম্ভব ‘উপস্থিতির অধিবিদ্যা’)।

স্বীকার করি, দেরিদার আরো বহুৎ কিছু আছে। কিন্তু, অ্যানালিটিকাল ধারার দার্শনিক হয়তো বলবেন, দেরিদার “অন্য যা-কিছু, সবই সাহিত্য”। আর কিছু না হোক, অর্থ সম্পর্কে এই কেন্দ্রীয় তর্কটিই অ্যানালিটিকাল দার্শনিকদের বিবেচনায় আনতে হবে। এবং, চূড়ান্ত-অর্থ ও বর্ণনার অসম্ভবতা সম্পর্কে ভিটগেনস্টাইনের তর্কগুলোর, এবং তদনুসারী পরবর্তী যত দার্শনিক আলাপের, সাথে অনেক মিল আছে এর।

সুতরাং, প্রকল্প (১) ও (২) নম্বরকে দেরিদা পরিষ্কারভাবে আক্রমণ করেন। কারণ, দেরিদার কথা যদি সত্য হয় , তাহলে চূড়ান্ত অর্থ এবং সত্য অসম্ভব, — ফলত অসম্ভব অর্থ ও সত্যের পরম নির্দিষ্টতা। প্রকল্প (৩) ও (৪)-এর প্রেক্ষিতে তাকালে বলতে হয়, এটা ঠিক পরিষ্কার না যে দেরিদার ডিকন্সট্রাকশনগুলোর নৈতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল কী দাঁড়ায়, যদিও এসব নিয়ে বিপুল পরিমাণ প্যাঁচালের বিস্তার ঘটেছে। এর কতকটা শুনতে পুরানা দিনের সেই উদার মানববাদ (স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা, — সম্ভবত এই দুইয়ের মাঝখানে অ্যানার্কির একটা ড্যাশ ঝুলানো) বলে সন্দেহ হয়, যদিও আমাদের ভরসা দেয়া হয়েছে যে এটা মোটেই তা নয়।

নারীবাদ —
দর্শনের নারীবাদী সমালোচনা — বিশেষত যখন কন্টিনেন্টালদের পথ ধরে আগায়, যেমন জুলিয়া ক্রিস্তেবা বা লুসি ইরিগারের রচনা — অ্যানালিটিকাল দার্শনিকদের সামনে শুধু মারাত্মক কিছু দুর্ভেদ্য রচনা উপস্থিত করে তা-ই নয়, সেই সাথে দর্শনের রূপরেখার নির্মাণকারী পুং-কেন্দ্রিক কার্যক্রমের বিবিধ নিন্দা জানায়।

বলা যেতে পারে ‘নারীবাদ’ বলে একক কোনো বস্তু নাই। যা আছে তা হলো, দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান — যেগুলি একটা আরেকটার সাথে আংশিক একমত বা আংশিক ভিন্নমত। কিন্তু, যেহেতু এর সবগুলোই নারীর ভূমিকাকে কেন্দ্রে রাখে, সুতরাং নানা ভিন্নতা সত্ত্বেও ‘নারীবাদ’ নামে সাধারণভাবে এদের পরিচয় দেয়া যায়।

সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদের নানান রকমফের । কিছু নারীবাদী হয়তো চান পুরুষের সমান অধিকার (“playing men at their own game”), কিছু চান পুরুষ-শাসিত সমাজকে রূপান্তরিত করতে, আবার কিছু আছেন যাদের পুরুষ নিয়ে মাথাব্যথা নাই একদমই (‘বিভেদবাদ’)। একইভাবে, দার্শনিক নারীবাদেও রয়েছেন বিবিধ রকম নারীবাদী। কিছু নারীবাদী বলবেন যুক্তি-উপস্থাপন ও বিশ্লেষণী ক্ষমতায় তাঁরা তাঁদের পুরুষ সহকর্মীদের সমান বা ওদের চেয়ে দক্ষ। আরেকপক্ষ বলেন, পুরুষকেন্দ্রিক দার্শনিকতা (যা পুরুষের হাতে বিকশিত হয়েছে দর্শনের পুরো ইতিহাসজুড়ে) পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ ও আংশিক। এদিকে একাংশ বলবেন, নারীবাদী দর্শন পুরুষের নির্মিত রাস্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নপথগামী একটি প্রকল্প, এবং তা হওয়াই উচিত। বিশেষত, শেষোক্ত দৃষ্টিভঙ্গিটা হয়তো বিশ্লেষণ,বুদ্ধি ও যুক্তিচর্চার বর্জনে আগ্রহী, — তার বদলে আবেগের ভাষা, সহজাত প্রবৃত্তি, এবং শরীরকে অগ্রাধিকার দিতে সচেষ্ট। এবং, কিছুক্ষেত্রে এর পেছনে মদত দেয় নীৎসে,হাইদেগার এবং দেরিদা প্রমুখের কাজ।

স্পষ্টত, অধিকাংশ নারীবাদী সমালোচনা আংশিকভাবে হলেও প্রকল্প (১) ও (২) নম্বরকে আক্রমণ করে। এবং অধিকাংশই (৩) ও (৪) নম্বরকেও আঘাত করে; কারণ, নারীবাদীরা অনুভব করেন, মানুষের সুখ ও ‘উৎকৃষ্ট জীবন’-এর যত ব্যবস্থাপত্র, এবং এর সাথে যত জগৎ-দৃষ্টি, মনোভঙ্গি ও জীবনাচরণ জড়িত, সবই ভীষণরকম পুং-কেন্দ্রিক।

রর্টি —
রিচার্ড রর্টি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন আমেরিকান প্রয়োগবাদী এবং ‘পোস্টমডার্ন বুর্জোয়া উদারবাদী’ — উভয় হিসাবে। তিনি গুটিকয়েক অ্যানালিটিকাল দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষ একজন, যিনি কন্টিনেন্টাল দর্শনকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার চেষ্টা করেছেন। উভয় ধারায়ই তাঁর গভীর বিশেষজ্ঞতা। কিন্তু, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বহুমুখিতার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দুই ধারারই করেন ভুলপাঠ। এবং অস্বীকার করার উপায় নাই, নিজের পছন্দের দার্শনিকদের (অ্যানালিটিক ধারায় ভিটগেনস্টাইন ও ডেভিডসন, কন্টিনেন্টাল ধারায় হাইদেগার ও দেরিদা) খুব সহজেই তাঁর সর্বগ্রাহী আমেরিকান প্রয়োগবাদের উত্তরীয়-তলে ঢুকিয়ে ফেলার ঝোঁক রর্টির।

তারপরও, দুই ধারার বিভেদের ধরন বিবেচনায় রেখে বলা যায়, কম লোকই দ্বিমত করবে, দুই ধারার মধ্যে ভারসাম্য তৈরিতে রর্টির প্রচেষ্টাটি সাহসী ও জরুরি। এবং তাঁর লেখা দুইপক্ষের যোগাযোগশূন্যতার মাঝে স্বস্তি আনে; যতটা না বেঠিক চিত্র দেয়, তার তুলনায় অনেক বেশি করে আলোকসঞ্চার। তাঁর কাজ অন্তত দুই পক্ষেরই গোঁড়া সমর্থককে পরস্পরকে বোঝার পথ দেখায়।

নিজের অবস্থানের ভূমিকা হিসাবে রর্টি তাঁর প্রথম বইয়ে পার্থক্য টানেন ‘প্রকৃতির দর্পনের’ (‘mirror of nature’) দর্শন (বা, ‘কান্টের প্রকল্প’) এবং ‘চেতনা-উন্নয়নপন্থী’ বা ‘edificationist’ দর্শন (প্রয়োগবাদ) — এই দুইয়ে। তাঁর সমালোচনার কেন্দ্রীয় বক্তব্যের জন্য তিনি ঋণী হাইদেগার, ভিটগেনস্টাইন ও দেরিদার কাছে; এবং আমেরিকান প্রয়োগবাদী জন ডিউয়ি ও উইলিয়াম জেমসের কাছেও।

ঠিক পরিষ্কার না, রর্টি কি শেষপর্যন্ত বলতে চান যে বাস্তব জগতের পেছনের চূড়ান্ত সত্য (‘mirror of nature philosophy’) জানা অসম্ভব, নাকি বলতে চান এই জানা অসম্ভব না-ও যদি হয়, এটা বেহুদা, ক্লান্তিকর, এবং উত্তরণহীন (‘unedifying’)। অর্থাৎ, ঠিক বোঝা যায় না, রর্টি প্রথাগত দর্শনকে খণ্ডন করতে চান, নাকি সরাসরি একে বর্জন করতে চান। বাস্তব জগতের পেছনের রহস্যের সমাধান আর ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ একই রকম বিষয়, উদ্ভূত এহেন পরিস্থিতির সমালোচনা ও বিশ্লেষণে তাঁর রচনা ঘুরপাক খায় । রর্টি বলেন, কেউ প্রমাণ করেনি যে ঈশ্বর নাই, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মানুষ ঈশ্বর নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া স্রেফ বাদ দিয়েছেন। তাঁরা ‘ঈশ্বর-প্রমাণ প্রকল্প’ স্রেফ বন্ধ করে দিয়েছেন, কারণ তা আগ্রহোদ্দীপক নয় আর, বা জীবনযাপনের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। তাই, রর্টি মনে করেন, ‘প্রকৃতির দর্পণ’ প্রকল্পের ব্যাপারেও ঠিক এমন হওয়া উচিত। প্রকল্পটা স্রেফ বাদ দিয়ে এর চেয়ে আকর্ষণীয় কিছু চিন্তা করা যাক।

বর্জন কিংবা খণ্ডন, বা উভয়, যা-ই করে থাকুন, রর্টি পরিষ্কারভাবে উপরোক্ত (১) নম্বরকে আক্রমণ করেন। (২) নম্বর প্রকল্পের উপর সর্বাত্মক আঘাত করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন রর্টি, কারণ তিনি যথেষ্টই অ্যানালিটিকাল দর্শনের ঈমানদার; অবশ্য, প্রায়ই গর্বিতভাবে নিজেকে ‘ধোঁয়াশাময়’ বলেন তিনি।

(৩) ও (৪) নম্বরের নৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্যের প্রেক্ষিতে, রর্টি মনে করেন, একজন প্রয়োগবাদীর কাছে এগুলি দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, এবং এটা বিবেচ্য রেখে আমাদের চিন্তা করা উচিত। রর্টির বিশ্বাস, বামপন্থী রাজনীতির একদলীয় প্রবণতাগুলির তুলনায় তাঁর নিজস্ব ‘পোস্টমডার্ন বুর্জোয়া উদারবাদী রক্ষণশীলতা’ সত্যিকার অর্থেই বেশি বিপ্লবী। কারণ, বামেরা এখনো ‘প্রকৃতির দর্পণের’ দর্শনের চর্চা ও এনলাইটেনমেন্টের ‘সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ’-এর খপ্পরেই আছেন।

শেষের কথা —
দুই ধারার যে-বিচ্ছেদের কথা বললাম, এর পেছনে প্রধান কারণ, প্রথাগত দর্শনের কেন্দ্রীয় যেই সত্য-সন্ধান প্রকল্প, তাতে ভরসা হারানো। এরিস্টোটল প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তর্কের নিয়ম ও যুক্তি। সেই থেকেই সত্য-খোঁজার ওই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেল সুনির্দিষ্টতা আর স্পষ্টতা। তো, এই সুনির্দিষ্টতা ও স্পষ্টতার ব্যাপারেও দেখা দিলো সন্দেহ, — যখন নীৎসে, ভিটগেনস্টাইন, হাইদেগার, দেরিদার মতো সমালোচকেরা উক্ত সত্যসন্ধান-প্রকল্পকে তুললেন কাঠগড়ায়।

দর্শনের (১) ও (২) নম্বর প্রকল্পের ব্যাপারে এই সন্দেহ সত্ত্বেও, (৩) ও (৪) নম্বর কার্যক্রম ঠিকই চলমান। কারণ, সুরাহা করা দরকার এমন ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয় মানুষের আছেই। ‘জগৎ-দৃষ্টি’ এবং ‘জীবনপদ্ধতি’-র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মানুষ, এবং ‘জগৎ, এবং তাতে নিজেদের অবস্থান’ বিষয়ে মতামত তার প্রয়োজন।

তবে, মনে হতে পারে যে, কুত্তা লেজ ঠিকই নাড়াচ্ছে, অথচ কুত্তার মগজ মৃত। বাস্তব-জগতের অন্তর্নিহিত সত্যের কোনো একটা মানদণ্ড ছাড়াই কিভাবে সম্ভব যে, কেউ নৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বা জগৎ-দৃষ্টির নির্মাণ আশা করে? এর কমপক্ষে তিনটি উত্তর হতে পারে :

প্রথমত, বহুলোকই সত্যের ঝামেলাজনক চরিত্র যা দর্শন দেখিয়েছে, সে-বিষয়ে বেখবর, এবং তাঁরা খুশি মনেই কেউ খ্রিস্টান বা মুসলমান, কেউ মানবতাবাদী কিংবা নাস্তিক, কেউ বস্তুবাদী কিংবা ডারউইনপন্থী। শুধু তা-ই না, তাঁদের প্রত্যেকে বিশ্বাস করেন যে আসল সত্যটি তিনি জানেন।

দ্বিতীয়ত, অন্য একদল, তাঁদের গায়ে হয়তোবা দর্শনের বদ-হাওয়া কিছুটা লেগেছে। সত্য এবং মূল্যবোধের ব্যাপারে তাঁরা পছন্দ করেন এক ধরনের ঢিলেঢালা আপেক্ষিকতাবাদ। জেমস ও রর্টির অ্যাকাডেমিক প্রয়োগবাদ এই উভয় অবস্থানেরই সমর্থক।

তৃতীয়ত, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও, সত্য ও সমস্ত মূল্যবোধের দিকে নীৎসে এবং পোস্টমডার্নিজম অনুসরণে একটা বিদ্রুপমাখা  অবস্থান নেয়াই যায় (সন্দেহবাদী অবস্থান হিসাবে এটা সম্ভবত প্রাচীন সন্দেহকার সেক্সটাস এম্পিরিকাস ও তাঁর ‘ataraxia’ বা অবিচলতার মতবাদের বয়সী পুরানা)।

তবে এর কোনোটাই প্রকৃতপক্ষে দুই ধারার বিচ্ছেদের অবসান নিয়ে ভাবিত নয়। সবশেষে, আমি তিনটা প্রস্তাব রাখতে চাই :

১. যদি অ্যানালিটিকাল দর্শনের প্রতি কন্টিনেন্টাল দর্শনের সত্যিই মারাত্মক সমালোচনা থেকে থাকে, তাহলে তা করা হোক। তবে তা যেন হয় দু-পক্ষেরই বোধগম্য ভাষায়। একই কথা কন্টিনেন্টাল ধারার বিরুদ্ধে অ্যানালিটিকদের সমালোচনার প্রতিও (যেমন, রাইল কিছুটা চেষ্টা করেছেন হাইদেগারের বিরুদ্ধে, সার্ল্ করেছেন দেরিদার বিরুদ্ধে)।

এর উত্তরে কেউ যদি বলেন যে, তা অসম্ভব, কারণ দু-পক্ষেরই সম্পূর্ণ আলাদা ও নিজস্ব নিয়মকানুন আছে, যেখানে কোনো ‘পালনীয় যৌথ আচরণবিধি’-র সম্ভাবনা নাই, তাহলে আমার উত্তর : না, তা নিশ্চিত নয়। বরং নিশ্চিত যে, দুই পক্ষই সন্দেহবাদ, আপেক্ষিকতাবাদ, ভাষার স্বভাব, অর্থ, অর্থোৎপাদন, সত্য এসবকে কেন্দ্রে রেখে বেশ একইরকম দুশ্চিন্তায় ভোগেন।

বা, এমনও না যে এই দুই আলাদা ‘অপরিমেয় কাঠামো’-র মধ্যে পারস্পরিক আলাপের সম্ভাবনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ হয়নি। অ্যানালিটিক ধারায় পল ফেয়রাব্যান্ড, আলাস্টার মাকিনটায়ার এবং ডোনাল্ড ডেভিডসন — এরা সবাই এই নিয়ে কথা আগাবার চেষ্টা করেছেন। কন্টিনেন্টাল ধারায়, স্ট্রাকচারালিস্টদের ‘ফেরারি দ্যোতক’ (‘floating signifier’) এবং গাদামারের ‘দিগন্তরেখাদের মিশে-যাওয়া’ (‘merging of horizons’) নিয়ে কাজ ওই সমস্যার দিকেই বেশদূর এগিয়েছিল। রিচার্ড রর্টির সমস্ত কাজেও দেখা মেলে এই সন্ধির চেষ্টা।

২. দু-পক্ষেরই নিজেদের ব্যাপারে আরেকটু বিনয়ী, এবং পরস্পরের দিকে আরেকটু উদার হওয়া দরকার। কন্টিনেন্টালরা হয়তো জেনে বিস্মিত হবেন যে, ভাষাদর্শন তাঁদের নিজস্ব আবিষ্কার নয়। এবং অভিজ্ঞতাকে ভাষার চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়ার হুসার্লের প্রয়াসকে অ্যাংলো-সেক্সন ভাষাদার্শনিকেরা, দেরিদা ‘স্পিচ অ্যান্ড ফেনোমেনা’ লেখার বহু আগেই, আনাড়ি কর্ম হিসাবেই ভাবতেন। অ্যানালিটিকাল দার্শনিকরা অনেকে শুনে হয়তো বিস্মিত হবেন যে, নীৎসে আসলেই  একজন দার্শনিক, এবং হাইদেগার প্রকৃত একজন দার্শনিকই না শুধু, সুশৃঙ্খলও বটে। আর, যদি তাঁরা ভিটগেনস্টাইনকে বাতিল করতে প্রস্তুত না থাকেন, তাহলে দেরিদাকে বাতিলের উপায় তাঁদের নাই।

৩. সবশেষে, দুই ধারার সঙ্গমে হয়তো এমন একটা পটভূমি পাওয়া যাবে, যেখান থেকে দর্শনের পরবর্তী যাত্রার কোনো ‘মহা-নির্মাতা’ উঠে আসবেন।

দেরিদা বলেছিলেন, পশ্চিমের অধিবিদ্যার ইতিহাস হলো, প্লেটোর দেখানো পথে, চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ সত্যের ‘পুরোপুরি উপস্থিতি’-কে ধরার চেষ্টার ইতিহাস। কিন্তু, এটা ‘পুরোপুরি উপস্থিতি’-কে সন্দেহ করারও ইতিহাস বটে (প্রোটাগোরাস, সেক্সটাস এম্পিরিকাস, মতেইন, হিউম এবং কান্টের মতো সন্দেহবাদীদের সিলসিলায় দেরিদা হচ্ছেন সাম্প্রতিকতম সংযোজন)। এ অন্তত বলা যায় যে, দর্শনের ইতিহাসে কান্ট ছিলেন সর্বশেষ ‘মহা-নির্মাতা’; এবং তাঁর পরের ‘নবিশেরা’ হয় তাঁর সন্দেহবাদী সিদ্ধান্তগুলো থেকে বের হবার চেষ্টা করেছেন (যেমন, হেগেল, মার্ক্স, সি.এস. পার্স, মুর, হুসার্ল্, হাইদেগার), না-হয় চেষ্টা করেছেন কান্টের সন্দেহবাদের ‘বর্ধন, বিস্তারণ, ও ভাষাতত্ত্বীকরণ’ (যেমন, নীৎসে, উইলিয়াম জেমস, ভিটগেনস্টাইন, দেরিদা)।

‘মহা-নির্মাতা’, ‘নবিশ’ এসব বিশেষণের এই আলাপ আপনাদের পছন্দ না হতে পারে, এবং আপনারা হয়তো কান্টের দিকে আমার পক্ষপাতে একমত হবেন না। তবে এই বক্তব্যে ভিন্নমতের সম্ভাবনা খুবই অল্প, কান্ট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ছিলেন, এবং দুই ধারার মিলনের এক অসামান্য উদাহরণ তিনি।

তবে, বৃটিশ দার্শনিক হিউমই কন্টিনেন্টাল দার্শনিক কান্টের গভীর ঘুমের বারোটা বাজিয়েছিলেন।

[‘Philosophy Now’ ম্যাগাজিনের ৭ম সংখ্যায় প্রকাশিত Mike Fuller রচিত ‘The Continental Rift’ প্রবন্ধের অনুবাদ]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you