আসো ফুটবল, আমরা অপেক্ষায় আছি || নিখিল দেব

আসো ফুটবল, আমরা অপেক্ষায় আছি || নিখিল দেব

প্রায় দেড়দশক পরে একদিন, শৈশবে-জমানো উত্তেজনার বশে, খেলব বলে ছোট্ট এক মাঠে নেমে পড়েছিলাম। দেখি, বল যায় একদিকে, আর আমি অন্যদিকে। এক দৌড়ের পর মনে হচ্ছিল, না-জিরোলে মারাই যাব। আর চেষ্টা করিনি। বুঝলাম, মনের উত্তেজনাটা এখন মনেই ভালো, শরীরে আনতে গেলে সেটা মরীচিকারূপ ধারণ করবে। করে। অনেক বিষয়ে হয়তো মনের উত্তেজনাটাও খুউব আর আগের মতো কাজ করে না; কারণ, মনোযোগ বদলেছে, আমি মোটেও এখন আর স্পোর্টি নই। বরং খেলার চাইতে খেলার খেলাটাকে নিয়েই ভাবতে বেশি ভালো লাগে এখন। জ্ঞান যে সুখ কেড়ে নেয় — সেটা তো মিথ্যে নয়!

জীবন ছিল এক। ছিল। নেই। যদি কখনও নিজের জীবনী লিখি, শৈশব থাকবে বেশিরভাগ জুড়ে। আর, শৈশবের বর্ণনাও জীবন পাবে না যদি-না সেখানে ফুটবল নিয়ে কিছু লিখি। এর বাইরে গেলে মিথ্যে বর্ণনা হবে (যদিও বেশিরভাগ আত্মজীবনীই তো মিথ্যে ভরপুর — তার কারণটা অবশ্য মনোবিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন । প্রতিটা মানুষের নিজেকে হিরো হিসেবে উপস্থাপন করতে চাওয়ার প্রবণতা থেকেই, তাকে গ্লোরিফাই করে এমন জিনিসই নিয়ে আসে জীবনীকারেরা বর্ণনায়)। তাই, আজ প্রায় দেড়/দুই দশক পেরিয়ে যখন শৈশবের সে-মাঠের দিকে ফিরে তাকাই, হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখির মায়ের মতো বুকটা ভারী হয়ে আসে! এখনও বুঝতে পারিনি আমি কেন গ্রাম ছেড়েছিলাম। কেন গ্রাম ছাড়ি আমরা। লাভ-ক্ষতি দুটোই হয়তো আছে। যা-ই হোক, বেদনা তো নয়, সুখ খুঁড়তে বসেছি আজ!

আমি কী ভালো খেলতে পারতাম? না। তবে খেলতে পারতাম। দুপুরের পরে যে খেলা শুরু হতো, সেটা চলত সন্ধে পর্যন্ত। মাঝেমাঝে সন্ধেটাও আটকে যেত খেলার নেশায়; কী রোদ কী বৃষ্টি! সপ্তাহে একদিন, শনিবার —  বাজারবারে, বন্ধ থাকত খেলা। আামাদের যাদের ওপরে পরিবারের বাজারের দায়িত্ব থাকত না , তাদের মনখারাপ লাগত সেদিন। হয়তো তখন গোল্লাছুট খেলে কাটাতাম সময়। ফুটবল খেলাতে যদিও তরুণদের ভিড় ছিল বেশি, তবু আমি মনে করতে পারি — সেখানে ১৩/১৪-৪৫ বছরের মানুষ থাকত। আমি ছেড়ে এসেছি সে-জীবন। ‘আগে কী সুন্দর’ জীবন। সেই জীবনও আর নেই। সেসব মানুষ নেই, তাঁদের উত্তরাধিকার নেই, মাঠ নেই, নদী নেই। মানুষ আছে। হয়তো। শহরের সামাজিক মর্যাদা আর ক্ষমতাকাঠামোর উপাদানগুলো সেখানে ভালো করেই পৌঁছেছে। আমি মনে করতাম সে-সময়, গ্রামের সেই মানুষটিই মর্যাদবান/ক্ষমতাবান যে ফুটবল খেলে ভালো! একটা পরিবার ছিল — তাদের চারভাইয়ের তিনজনই খেলত সেইরকম খেলা। ওদের ছোটভাই, সজল, যাঁর সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল কম, আমার পছন্দের খেলোয়াড় ছিল। একবার, মনে পড়ে, এক প্রতিযোগিতায় সে একাই নিয়ে গিয়েছিল আমাদের গ্রামকে ফাইনালে।  কোথায় আছে তারা এখন? তাদের তিনজনই এখন ভারতে। নিশ্চয়ই খেলে না তারা ওখানে! খেলা তো একটা সুখের বিষয়। জীবনে সুখ না-থাকলে মানুষ খেলে?

সেই সময় — টিভি ছিল দুর্লভ। তবু বিশ্বকাপ আসলে কী হতো — ভাবেন! একমাস বুঁদ হয়ে থাকা। সে-থাকাটা হয়তো এখনও আছে। আর তখন, ম্যারাডোনাআর্জেন্টিনা কীভাবে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ঢুকে গেল মানুষের কলিজার ভিতরে তা বোঝার জন্য মনস্তাত্ত্বিক হওয়ার প্রয়োজন আছে কী? বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সাপোর্টাররা ম্যারাডোনাযুগের উত্তরাধিকার। তা জিদান-রোনালদো-মেসি যা-ই খেলুক, ফুটবলে দর্শকের কাছে ‘ঈশ্বর’ হওয়ার ক্ষমতা ম্যারাডোনার পরে আসবে বলে আমার মনে হয় না। দর্শকের প্রকৃতি একটা মুখ্য বিষয় — খেলোয়াড় বরণের ক্ষেত্রে। বিষয় যা-ই হোক, ফুটবল আজ মধ্যবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে মানুষের ড্রয়িঙরুমে আর ছাদে উঠেছে। তারে ঘিরে উত্তেজনাটা, হয়তো, প্রকট হয়েছে, কারণ তার পূর্বপুরুষের চেতনার ধারা বিলীন হওয়ার সময় এখনও আসেনি। তবে আসবে। বছর-পঞ্চাশেক পরে হয়তো কোনো একটা সংখ্যায় লঘু শ্রেণির মর্যাদার প্রতীক হিসেবে থাকবে ফুটবল। তবে সেটা নতুন ফুটবল। সেটা অন্য ফুটবল। এখনও শহুরে বেশিরভাগ মানুষের শেকড় গ্রামে, তাই সে চাইলেও গ্রাম ছাড়তে পারে না।

যা-ই হোক, বিশ্বকাপ আসলে তাই একটা উৎসব আসে। উত্তেজনা আসে। এবারও আসল। আপাতদৃষ্টিতে কিছু উত্তেজনাকে একটু অতিরিক্তই মনে হয়। তবু, ফুটবল নিয়ে উত্তেজনাকে আমার একদম বাড়াবাড়ি কিছু মনে হয় না। বরং যারা এটাকে নিয়ে, মানুষের উত্তেজনাকে নিয়ে, বাড়াবাড়ি করেন তাদেরকেই আমার শেকড়হীন মনে হয়। ছাদের ওপর পতাকা টানালে যদি দেশপ্রেমের ক্ষতি হয়ে যায় সে-দেশপ্রেমের ক্ষতি হওয়াটাই ভালো! ফুটবল হারিয়ে যাওয়ার অভিশাপ (দুঃখ) আছে। এর সাথে মাঠ হারানোর সম্পর্ক আছে, মানুষ হারানোর সম্পর্ক আছে, প্রকৃতি হারানোর সম্পর্ক আছে, সম্প্রীতি হারানোর সম্পর্ক আছে, অসাম্প্রদায়িকতা হারানোর সম্পর্ক আছে। সমাজের ভেঙে পড়ার সম্পর্ক আছে।

আমাদের গ্রামের পাশে বিশাল এক মাঠ ছিল। বৃক্ষ ছিল তার পাশ ঘিরে।  গ্রামগুলোতে, সম্ভবত তখন দু-তিনটা গ্রামের পরপরই, বিশাল এক মাঠ থাকত। থাকত। হ্যাঁ, এখন আর নেই। বেশ ক-বছর আগে যখন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম — মাঠের দশা দেখে মনে হচ্ছিল, এ-মাঠে এখন আমারই জায়গা হবে না! আর মাঠ-লাগোয়া যে-নদীতে খেলার পরে সাঁতার কাটতাম, খেলার মাঝখানে পিপাসা পেলে পানি পান করতাম — সে-নদীর ওপর দিয়ে এখন সড়ক আছে। সেতু নয়, সড়ক। তাই, দর্শকের এসব উত্তেজনার ভিতর দিয়ে যদি ফুটবলটা, সেই ফুটবলটা, আসলেই ফিরে আসত, তবে নিজেদের হারানো জিনিস ফিরে আসার একটা রেকর্ডও হতো! তা হয়তো আসবে না। তবু সে-উত্তেজনাটাই বা কম কীসে? একসাথে, সম্প্রদায়ব্যতিরেকে, বসে খেলা দেখার উত্তেজনা ভাগ করার নির্মলতাকে উপভোগ করাটাই বা কম কী?

আমার ভালোই লাগে। যদিও বা এবার সেই তাপটা খুব উপভোগ করতে পারব না । তবু প্রস্তুত আছি! আমার আরো ভালো লাগবে মানুষ ফুটবলটাকে যদি আরো ভালোবাসে। তবু, ছোট্ট যে-কথাটা লিখে শেষ করব — সেটা খুব ছোট একটা খবরে প্রকাশিত। সংবাদটা গুরুত্ব পায়নি। পাওয়ার কথা না। দেখলাম, ব্রাজিলে বেশকিছু মানুষ ফুটবল আয়োজনের প্রতিবাদ করছে। করে যাচ্ছে। খবরে যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভের ছবি এসেছে সেটা হয়তো ফুটবলোন্মাদনার জোয়ারে ভেসে যাবে। তা যাক। তবু, আয়োজনের এ-মহোৎসবে যে ঝলমলে আলো প্রকাশিত হয় সেটা কোনো অন্ধকারকে লুকিয়ে ফেলে কি না সেটা বোঝার দায় মানুষ হিসেবে অবশ্যই আমরা এড়াতে পারি না। নিজেদের ফেভরিট দলের জয়-পরাজয়ের আনন্দে-দুঃখে হারিয়ে যাওয়ার সময় একটু যেন ভাবি — ওদিকে সব ঠিক আছে তো?

জুন ২০১০


নিখিল দেব রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you