গোচারণে গোষ্ঠের পথে || সুমনকুমার দাশ

গোচারণে গোষ্ঠের পথে || সুমনকুমার দাশ

সাথী দাশ নামের একটি মেয়ে আমাদের সহপাঠী ছিল। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা একই প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। আমাদের ছোটবেলার সেই বিদ্যালয়, অর্থাৎ ঘুঙ্গিয়ারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হতো সকাল দশটায়। তবে ক্লাস শুরুর ঘণ্টাদুয়েক আগেই আমরা কয়েকজন সহপাঠী বিদ্যালয়ে চলে যেতাম। বিদ্যালয়প্রাঙ্গণ ছিল উন্মুক্ত, ফলে হুটহাট করেই আমরা ঢুকে যেতে পারতাম। এ সময়টাতে স্যার-দিদিমণি কেউ না থাকায় বিদ্যালয়প্রাঙ্গণে হৈ-হুল্লোড় আর এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতাম।

সাথীদের বাড়ি ছিল বিদ্যালয়ের পাশেই। তাই কখনও বিদ্যালয়ে ছুটোছুটি ভালো না লাগলে সাথীদের বাড়িতে চলে যেতাম। সেখানে ঠুলি-মিছি, বর-কনে সাজানো, ফোড়নকাটা সহ কত রকমের খেলা যে খেলতাম! এ-রকমই একদিন সাথীদের বাড়ির সামনের সরু বরান্দার মাটির মেঝেতে মাদুর পেতে চারজন সহপাঠী মিলে রস-কষ-সিঙা-বুলবুল খেলছিলাম। খেলা চলাকালে হঠাৎ পাশের রুম থেকে সাথীর বাবার কীর্তন ঢঙের একটি গানের সুর ভেসে আসে।

গান শুনে আমরা পাটকাঠির বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম — হারমোনিয়াম বাজিয়ে সাথীর বাবা কীর্তন গাইছেন। আমাদের ফিসফাস শুনে প্রথমে তিনি মেয়ের নাম ধরে ডাকলেন। আমাদের সবাইকেও তাঁর রুমে গিয়ে গান শোনার জন্য বললেন। আমরা কিছুটা ভয় আর কিছুটা রোমাঞ্চ মনে নিয়ে সাথীর বাবার রুমে ঢুকি। তিনি সেদিন বেশ গান গেয়েছিলেন, সেগুলোর কোনও পঙক্তিই আজ আর মনে নেই। তবে গান শেষ করে আমাদের উদ্দেশে বলা কথাগুলো বেশ মনে আছে — ‘বাবারা, এইগুলা গোষ্ঠগান’।

আমরা তখন ‘গোষ্ঠ’ উচ্চারণ করতে পারতাম না, বলতাম — ‘গুষ্ঠুগান’। এ ঘটনার পর বিটিভিতে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় প্যাকেজ নাটক ‘মনের মুকুরে’ কিংবা ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি’-র কোনও গান সামান্য মুখস্ত হলেই সেটা গুনগুনিয়ে গাইতাম। গুনগুনিয়ে গাওয়া শেষ হলে বন্ধুবান্ধবদের বলতাম — ‘বাবারা, এইগুলা গুষ্ঠুগান’। এ কথা বলার পর সবাই হেসে কুটিকুটি হতাম। শুধুমাত্র একজন আমাদের সেই ইচড়েপাকামি শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হতো এবং মন খারাপ করত। তার কালো চেহারা আরও কালো হয়ে যেত। সে হলো সাথী। এভাবেই একসময় সাথীকে আমরা ‘গুষ্ঠু সাথী’ বলে খেপাতে শুরু করলাম।

সাথীর সঙ্গে এখন আর দেখা হয় না, কোনও ধরনের যোগাযোগও নেই। তবে বন্ধুদের মুখে শুনেছি সে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত। এও শুনেছি — বছর দশেক আগে সাথীর বাবা মারা গেছেন। এখন এই সময়ে এসে যখন ‘গোষ্ঠগান’ নিয়ে আলাচনা করছি, তখন সাথীর বাবা অনিল দাশের মুখটাই প্রথমে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

এই তো ২০১১ সালে লালনধামে গিয়ে ফকির হৃদয় সাধুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি সেদিন লালনের গোষ্ঠগানগুলো নিয়ে এ পর্যন্ত পৃথক কোনও সংকলন প্রকাশিত না হওয়ার বিষয়ে আফসোস করছিলেন। হৃদয় সাধুর কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে ভাসে সাথীর বাবার মুখ। ওইদিন অনিল দাশ কার গোষ্ঠগান গেয়েছিলেন? লালন, রাধারমণ, হাউড়ে গোঁসাই, শরৎ, লালশশি, প্রতাপরঞ্জন তালুকদার? নাকি অন্য কোনও পদকর্তার? হৃদয় সাধু আফসোস করেছিলেন — ‘লালনের গোষ্ঠগানের কোনও সংকলন বের হয়নি কিংবা গবেষকরা সাঁইজির গোষ্ঠগান নিয়ে এক ধরনের উদাসীন!’ কথাটা সত্যি, কিন্তু এটাও তো সত্যি যে — অন্য কোনও মহাজনের গোষ্ঠগানগুলো নিয়েও তেমন আলোচনা হয়নি।

আশার কথা হচ্ছে, লালনের গোষ্ঠগান অন্তত তাঁর কিছুসংখ্যক ভাবশিষ্যের মধ্যে গুরুপরম্পরায় চর্চিত হয়ে আসছে। ২০১১ সালে কুষ্টিয়ায় লালন স্মরণোৎসবে যাওয়ার পর গবেষক সাইমন জাকারিয়ার আমন্ত্রণে একদিন খুব ভোরে ফরহাদ মজহার প্রতিষ্ঠিত ‘নবপ্রাণ আন্দোলন’-এ গোষ্ঠগান শুনতে হাজির হয়েছিলাম। চারিদিকে ধূপের সুগন্ধ, প্রায় অর্ধশতাধিক সাধু-সন্ত মঞ্চ আলোকিত করে বসে রয়েছেন। সামনে আরও জনা-পঞ্চাশেক উৎসাহী মানুষ।

ভোরবেলা অন্যরকম এক ঘোরলাগা দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময়টাকে সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্ত বলেও ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক, না-ভোর না-সন্ধ্যা ভাব। আধো অন্ধকার, আধো আলো। এমনি এক মুহূর্তে ‘নবপ্রাণ আন্দোলন’-এ ঢুকি। ভোরের পবিত্র পেলবতা সঙ্গী করে রওশন ফকির, বেহুলা ফকিরানী সহ অন্য ফকিরেরা সম্মিলিত কণ্ঠে গাইছেন গোষ্ঠগান। অসাধারণ এই পরিবেশনা। সেদিন লালনের গোষ্ঠগানগুলো আমার কাছে অন্য উচ্চতায় ধরা দিয়েছিল। আহা, কী মধুর কথা আর সুর — ‘গোচারণে গোষ্ঠের পথে / কষ্ট নাই মা গোষ্ঠে যেতে’। যশোদা, কানাই, বলাই, শ্রীদাম, সুধাম সহ গোষ্ঠগানে ব্যবহৃত পৌরাণিক চরিত্রগুলো নতুন করে যেন আমার কাছে প্রতিভাত হচ্ছিল।

গোষ্ঠগানের পর্ব শেষ হলে গন্তব্যে যাত্রা শুরু করি। ততক্ষণে হলুদ কুসুমের মতো ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু রেশ থেকে যায় সেই গানের। গুনগুনিয়ে আপন মনে আওড়াতে থাকি লালনের সেই অতি পরিচিত গোষ্ঠগানের পঙক্তিগুলো :

ও মা যশোদে তোর গোপালকে গোষ্ঠে লয়ে যাই।
সব রাখাল গেছে গোষ্ঠে বাকি কেবল বলাই কানাই।।

ওঠো রে ভাই নন্দের কানু বাথানাতে বাঁধা ধেনু
গগনে উঠিল ভানু আর তো নিশি নাই
কেন মায়ের কোলে ঘুমায়ে র’লি এখনো কি তোর ঘুম ভাঙে নাই।।

গোচারণে গোষ্ঠের পথে কষ্ট নাই মা গোষ্ঠে যেতে
আমরা সবাই স্কন্ধে করে গোপাল লয়ে যাই
তোর গোপালের ক্ষুধা হলে দণ্ডে দণ্ডে ননী খাওয়াই।।

আমরা যত রাখালগণে ঘুরি সবে বনে বনে
সারাদিন জনে জনে যত ফল যে পাই
ফকির লালন বলে রাখালে ফল খেয়ে মিঠে হলে তোর গোপালকে খাওয়াই।।

গোষ্ঠে বলাই ও কানাই দুই ভাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপর সঙ্গীদের আকুতি — ‘সব রাখাল গেছে গোষ্ঠে বাকি কেবল বলাই কানাই’। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ কানাই/গোপাল খেলায় সাথী হিসেবে চমৎকার, তাই যে-কোনও মূল্যে বলাই সহ তাকে গোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য সঙ্গীদের আগ্রহ থেকে নানা রকমের ছলনার আশ্রয় নিত তারা। বলাই-কানাইয়ের মা যশোদাকে তারা বুঝাত এই বলে, ‘সারাদিন জনে জনে যত ফল যে পাই / […] / রাখালে ফল খেয়ে মিঠে হলে তোর গোপালকে খাওয়াই’। মা যশোদা এই আশ্বাস পেয়ে বলাই আর কানাইকে মাঠে/গোষ্ঠে যেতে দিতে রাজি হতেন।

তবে গোষ্ঠে যাওয়ার পর ‘গোপালের ক্ষুধা’ পেলে ‘দণ্ডে দণ্ডে ননী’ খাওয়ানোর কথা ঠিকই সাথীরা ভুলে যায়। কানাই আক্ষেপ করে — ‘গোষ্ঠে আর যাব না মাগো / গোষ্ঠে আর যাব না মাগো দাদা বলাইয়ের সনে’ কিংবা ‘ক্ষুধাতে প্রাণ আকুল হয় মা ধেনু রাখার বল থাকে না’ অথবা ‘বড় বড় রাখাল যারা বনে বসে থাকে তারা / আমায় করে জ্যান্তে মরা ধেনু ফিরানে’। কানাই যখন চরম হতাশাভরা কণ্ঠে মাকে জানায় — ‘বনে যেয়ে রাখাল সবাই বলে, এসো খেলি কানাই / হারিলে স্কন্ধে বলাই চড়ে তখনে’। এ কথা শুনে মা আর গোপাল/কানাইকে কখনও গোষ্ঠে যেতে দেবে না জানিয়ে বলাইয়ের উদ্দেশে বলেন :

বল রে বলাই তোদের ধর্ম কেমন হারে।
তোরা বলিস সব রাখাল ঈশ্বরই গোপাল মানিস কই রে।।

বনে যত বনফল পাও এঁটো করে গোপালকে দাও।
তোদের এ কেমন ধর্ম বল সেই মর্ম আজ আমারে।।

গোষ্ঠে গোপাল যে দুঃখ পায় কেঁদে কেঁদে বলে আমায়।
তোরা ঈশ্বর বলিস যাঁর কাঁধে চড়িস তাঁর কোন বিচারে।।

আমারে বোঝা রে বলাই তোদের তো সেই ভাব দেখি নাই।
লালন বলে তাঁর ভাব বোঝা ভার এ সংসারে।।

এভাবে বলাই, কানাই আর তাদের সাথী কিংবা যশোদার কথোপকথনে লালনের গোষ্ঠগানগুলো অন্য আমেজে শ্রোতাদের কাছে ধরা দেয়। তবে আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে — গত বছর-পঁচিশেক আগেও লালনের ভাবশিষ্যরা যেভাবে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোষ্ঠগান গাইতেন, এখন সচরাচর এই দৃশ্য তেমন-একটা দেখা যায় না। হাতেগোনা গুটিকয়েক লালন-অনুসারী এখনও নিয়মিত ভোরে গোষ্ঠগানের প্রচলন ধরে রেখেছেন। এটি লালনধামে অষ্টপ্রহরের সাধুসঙ্গের সময় আরও বেশি প্রত্যক্ষ করা যায়। সে-সময় আগত হাজারো সাধুসন্তের মধ্যে খুব কমসংখ্যককেই গোষ্ঠগান করতে দেখা যায়। বরং এ সময়টাতে তাঁদের অঘোরে ঘুমাতেই বেশি দেখা যায়।

ফকির হৃদয় সাধু সেদিন অভিযোগের সুরে আমাকে বলেছিলেন, ‘সাঁইজির দৈন্য গান যেহেতু ইদানীং জনপ্রিয় ধারার গান হিসেবে তরুণ-তরুণী সহ শ্রোতাদের কাছে বিবেচ্য হচ্ছে, তাই সেগুলো ঠিকই রঙ মাখিয়ে বাণিজ্যের উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন শিল্পীরা গাইছেন। কিন্তু গোষ্ঠগানের মার্কেট ভেল্যু  না থাকায় এই গানগুলো কেউ গাইছেন না। তাই সাঁইজির গুরুত্বপূর্ণ এ দিকটি অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।’ একই কারণে ‘মার্কেট ভেল্যু’ না থাকা এই গোষ্ঠগান হালে লালনের গান গেয়ে মাত করা শিল্পীরাও গাইছেন না। কারণ এসব গান মুষ্ঠিমেয় শ্রোতারা পছন্দ করবেন, তাই ‘বাণিজ্যলক্ষী’ অধরাই থেকে যাবে।

গোষ্ঠগান প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার এক ফকিরের কাছে একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি এ-রকম : একবার এক বিদেশি মহিলা ফকিরদের বিচিত্র জীবনযাপন প্রত্যক্ষ করতে কুষ্টিয়ার লালন-আখড়ায় এসেছিলেন। তখন ছিল ভোরবেলা। আগত ওই মহিলা দেখলেন আখড়ার ভেতরে একদল ফকির লালনের গান একটার পর একটা গেয়ে চলছেন। এসব গান শুনে আখড়ার আশপাশ দেখার উদ্দেশে ওই মহিলা একটু ঘুরাফেরা করছিলেন। তখন একজন বয়োবৃদ্ধ ফকিরকে পশ্চিমমুখী হয়ে বসে থাকতে দেখেন। তিনি তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে লালনের একটা গান শুনতে চাইলেন। মহিলার কথা শুনে ওই ফকির একটি গোষ্ঠগান শোনালেন। ফকিরের কণ্ঠের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ওই মহিলা আরেকটি গান শোনানোর অনুরোধ জানালে বৃদ্ধ মুচকি হেসে বলেন, ‘গোষ্ঠগানের সময় শেষ। দেখছেন না — ভোরের আলো ভেদ করে সূর্য উঠছে। আরেকটি গান যদি আপনাকে শুনতে হয় তাহলে সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। তখন না হয় একটি দৈন্যগান আপনাকে শোনাতে পারব।’

দৈন্যগান যেমন সন্ধ্যায় গাইতে হয়, তেমনি গোষ্ঠগান গাইতে হয় ভোরবেলা। সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত গোষ্ঠগান গাওয়ার রীতি রয়েছে। এই গোষ্ঠগানের আবার তিনটি পর্ব রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে : পূর্বগোষ্ঠ, মধ্যগোষ্ঠ এবং উত্তরগোষ্ঠ। প্রথম পর্বে গোষ্ঠে গমনের আহ্বানসূচক গান, দ্বিতীয় পর্বে কৃষ্ণের অন্তর্ধানরহস্যের গূঢ়তত্ত্ববিষয়ক গান এবং উত্তর গোষ্ঠে বৃন্দাবনে কৃষ্ণের নিখোঁজ হওয়ার পর আক্ষেপসূচক গানগুলো গীত হয়। ভোরবেলা গরু নিয়ে গোষ্ঠে গমনের সময় শ্রীকৃষ্ণের চালচলনকে কাঠামো করে গোষ্ঠগানের তত্ত্ব আবর্তিত হয়েছে।

আবদেল মাননান গোষ্ঠগান প্রসঙ্গে তাঁর সম্পাদিত ‘অখণ্ড লালনসংগীত’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘ফকির লালন শাহী গোষ্ঠলীলা রসোত্তীর্ণ চিরন্তন বিষয়। […] গোষ্ঠলীলার সারমর্ম হলো স্থূলদেহ ছেড়ে সূক্ষ্মদেহে শ্রীকৃষ্ণের আত্মদর্শনগত মহাভাবলোকে উত্তরণ জগতের জন্যে পারত্রিক শিক্ষাপর্ব। বহির্মুখি স্থূল ইন্দ্রিয়জগত থেকে অন্তর্মুখি অতীন্দ্রিয় জগতে উল্লম্ফনেরই রূপক আভাস। এর মর্মগভীরে নিহিত অখণ্ড দেহমনে আত্মদর্শনের সূক্ষ্মপ্রেমলীলা কেবল শুদ্ধরসিক চিত্তই আস্বাদন করতে পারেন, সর্বসাধারণ নয়।’

এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি ঘটনা মনে পড়ছে। বেশিদিন আগের কোনও ঘটনা নয়, এই তো মাস চারেক আগে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে লালন সাঁইজির জনপ্রিয় ধাঁচের একটি গোষ্ঠগান গাইছিলেন এক শিল্পী। যেহেতু ওই শিল্পী গুরুপরম্পরা কোনও ফকিরি দীক্ষা নেননি, তাই স্বভাবতই সময়-অনুযায়ী ভোরবেলা গোষ্ঠগান গাওয়ার রীতিটি সম্পর্কেও হয়তো অবগত নয়। আর অবগত হলেও সেটা তার জন্য কতটুকু প্রযোজ্য সেটাও বিবেচ্য বিষয়। তাই সন্ধ্যাবেলা ওই গানের আসরে বেশ কয়েকটি লোকধাচের গান গাওয়ার পর লালনের ‘কোথায় গেলি ও ভাই কানাই’ এই গানটিতে টান দেন।

শিল্পীর কণ্ঠ ছিল অসাধারণ। আমরা শ্রোতারা তন্ময় হয়ে তার গান শুনছিলাম। হঠাৎ মঞ্চের ডানদিকে তাকাতেই দেখি — একটি অল্পবয়েসী মেয়ে গানের তালে হাততালি দিচ্ছেন। একসময় গান যখন জমে ওঠে, তখন ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে কী যেন প্রত্যক্ষ করে ওই তরুণীটি উঠে দাঁড়িয়ে আরও জনা-দশেক তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে শুরু করে দেয়।

যদিও ভাবগত ব্যাখ্যার দিক দিয়ে শিল্পীর গাওয়া লালনের গানটির মর্মার্থের সঙ্গে নিমগ্নতাই শ্রেয়, সেখানে নাচ একেবারেই যায় না, তবু কেন জানি এ দৃশ্যটি আমার মনে গেঁথে যায়। যেন সেই গানের পঙক্তির মতোই — ‘মনের ভাব বুঝতে নারি কী ভাবের ভাব হয় তোমারই’। এ দৃশ্যটা আমি কোনওদিন ভুলতে পারবও না বোধহয়। হয়তো চিরকাল মনের গভীরে এক বিশেষ তরুণীর আবেগময় উচ্ছ্বাসের দৃশ্যটি নিরন্তর রিপ্লে হতে থাকবে। কারণ এ দৃশ্যে যে বাঙালির ভেতরের সত্তার অনন্য রূপটাই ধরা পড়েছে!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you