মিলেনিয়াল মানুষেরা

মিলেনিয়াল মানুষেরা

কারা এরা? মানে, কে এই মিলেনিয়াল? বৈশ্বিক উন্মুক্ত সংস্কৃতিতে বর্ন ও বেড়ে-ওঠা একটি বিশেষ প্রজন্মের নাম এই মিলেনিয়াল। বিশেষ একটা সময়ের প্রতিভূ এরা। নাইন্টিসের মাঝামাঝি বিশেষ এই প্রজন্মের বার্থ এবং বিকাশ। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এরা আশি খ্রিস্টবছর থেকে পঁচানব্বই খ্রিস্টবছরের মধ্যবর্তী কোনো-একটা টাইমে কিংবা এই টাইমফ্রেমের যে-কোনো বছরে জন্মানো জনগোষ্ঠী। বিগত শতাব্দ তথা অবধারিত সহস্রাব্দের অন্তিম এবং বর্তমান শতাব্দ/সহস্রাব্দের সূচনা, এই দুই সহস্রাব্দসন্ধিক্ষণে এদের জন্মসৌত্রিক অবস্থান। যদি বাংলায় বলতে হয়, কি বলা যায় এই প্রজন্মটাকে? সহস্রাব্দসন্তান? সহস্রাব্দজাতক? সহস্রাব্দসন্ধিসময়ের প্রজন্ম? দুনিয়ায় কে চায় নিজেরে বাংলায় ইন্ট্রোডিউস করাইতে? এই প্রজন্ম তো বোধহয় চায় না। তারা চায় বিশ্বসনে যোগ। ফলে এই টাইমের প্রজন্মটাকে আমরা তাদের বৈশ্বিক পরিচয়েই চিনিয়া রাখতে পারি : দি মিলেনিয়াল।

অবশ্য মিলেনিয়ালদেরে বেশ-কয়েকটা ডাকনামে ডেকে থাকেন সমাজানুধ্যায়ীরা। ডাকনামগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে ‘জেনারেশন মি’, মানে ‘আমি প্রজন্ম’। সি মি। আমারে দেখো। বল্গাহারা আমিময়তায় এরা আবিষ্ট, অবসেসড, অহমপূর্ণ অন্তঃসলিলা। নার্সিসিজম এদেরে প্রধান কুললক্ষণ। বলে থাকেন সমাজানুধ্যায়ীরা। আরেকটা নামেও মশহুর এরা, তাদিগের বিলম্বিত বয়ঃপ্রাপ্তির জন্য, প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতে এরা প্রামাণ্য সময়ের চেয়ে ঢের বেশি সময় নিয়েছিল বলে এদেরে ‘পিটার প্যান জেনারেশন’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এদের পরিচয়তিলক বা বৈশিষ্ট্যাবলি নিয়া নানান মুণির নানান মত থাকলেও একটা বিষয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করেন না, আর তা হচ্ছে এ-ই যে এই জেনারেশনটাকে একক কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা যায় না। বিস্তর বৈভিন্ন এদের মধ্যে। ক্যাটাগ্যরিক্যালি এদেরে একতোড়ায় বেঁধে ফেলা প্রায় না-মুমকিন।

তবু যদি কয়েকটা আখর কররেখায় নিয়া আলাপ সঞ্চালিতে চাই, তাইলে পয়লাই বলতে হয় যে এই বিশ্বভূমণ্ডলে যে-কয়টা ফাস্টেস্ট গতির শিফটিং হয়েছে চেইঞ্জ হয়েছে বেজায় দ্রুতগতির তা সবই এই মিলেনিয়ামানুষের জন্ম ও বিকাশের সময়খণ্ডে সংঘটিত। দুনিয়াব্যাপী ইকোনোমি, পোলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেইপ এবং কালচার সর্বত্র অকল্পনীয় গতিতে চেইঞ্জ এসেছে। শিফটিং। সবই মিলেনিয়ালরা তাদের বেড়ে-ওঠার সময়টায় পেয়েছে। এত এত গতির সেই শিফটিংগুলো যে এসবের সঙ্গে যুঝে থাকাটাও অনেক বড় ব্যাপার। এরা নাইন/ইলেভেন দেখেছে, এর কন্সিক্যুয়েন্সেস নিয়া সাফারিঙের ভিতর দিয়া আদৌ কতটা গিয়েছে সেইটা আলাদা আলাপের ব্যাপার, হারিকেইন ক্যাট্রিনা থেকে শুরু করে ব্যাপক প্রাকৃতিক বিপর্যয় স্যুনামি ডিভ্যাস্ট্যাইটিং আর্থক্যুয়েইক ইত্যাদি এক্সপেরিয়েন্স করেছে, এবং অনেকগুলো অন্তহীন মনুষ্য-কর্তৃক-মনুষ্যধ্বংসের তাণ্ডব দেখেছে যেইগুলারে আমরা যুদ্ধ বলি, সেই যুদ্ধগুলার মধ্যে একটা হচ্ছে ইরাক আর আরেকটা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। এবং প্রকাশ্য দিবালোকে এসেছে এই ন্যাংটো অধিপতিদের সাম্রাজ্যলোলুপ মিথ্যাচার। কথিত প্রথমবিশ্বে একটি ফিন্যানশিয়্যাল ক্রাইসিস আসে দুইহাজারআটের দিকে, এই সময়টাতেই মিলেনিয়ালরা ক্যারিয়ারজিন্দেগি শুরু করতে লেগেছে এবং এই বিশালসংখ্যক নয়া কাজক্ষেত্রে-যোগদানেচ্ছু প্রজন্ম গোড়াতেই শিকার হয়েছে ফলাউটের। এবং, সর্বোপরি, এরা হচ্ছে সেই প্রজন্ম যারা সাক্ষী ইন্টার্নেটপূর্ব যুগের এবং ইন্টার্নেটযুগপরবর্তী বিপন্ন বিস্ময়াভিভূত প্রত্যুষের।

দুনিয়ার সমস্তকিছুই ডিজিট্যালাইজড হচ্ছে এমন একটা টাইমের ভোরবেলায় এই প্রজন্ম বড় হয়েছে। এরা তাদের পৃথিবীটাকে দেখেছে এমন একটা চাহনি দিয়া যা না-বিস্ময় না-বিমূঢ়তা না-মানবিকতা না-দানবিকতা প্রায় আনকোরা আগন্তুক একটা মানুষাভিজ্ঞতা। আগের কোনো সময়ের অভিজ্ঞতা দিয়া টাইমটারে এঁটে ওঠানো যাচ্ছে না এমনই একটা সিচ্যুয়েশন। ব্লগের আর্লি দিনগুলো থেকে একসময় এরা আশ্নাই শুরু করেছে ফেসবুক ইত্যাদির মাধ্যমে ইন্সট্যান্ট মেসেজিঙের সঙ্গে, পেয়েছে এবং নিয়েছে টুইটার, পেয়েছে এবং নিয়েছে ইন্সট্যাগ্র্যাম ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি সোশ্যাল সংযোগের মিডিয়া। আরও আছে, শেষ করা সাধ্যাতীত বলে বলে এমনই বিচিত্র ও অজস্র সংযোগসুবিধা। নানাবিধ বিনোদনের অবারিত অনর্গল ভুবনদরিয়া। ন্যাপ্সটার, আইটিউন্স এবং স্পটিফাই। অ্যাম্যাজন, নেটফ্লিক্স এবং হুলু। সমস্তই দিয়েছে এই পিটারপ্যান প্রজন্মটাকে ডেমোক্র্যাটাইজড এন্টার্টেইনমেন্টের অভাবিত সুবিধা। তারা লাভ করেছে অপূর্ব অপরূপ অকল্পনীয় চয়নের অধিকার। ফ্রিডম অফ চয়েস। অন্তত ফুর্তিফার্তা আর বিনোদন ইত্যাদি চয়নের অধিকার প্রশ্নে এই মিলেনিয়াজেন/জেন-মি ইনকন্সিভ্যাবল প্রিভেলেজ পেয়ে বেড়ে উঠেছে। এদের বড় অংশ কুড়ির উপরে ঠেকেছে যাদের বয়স, অংশত থার্টিসামথিং। এরা জানে যে এই দুনিয়ায় যা-কিছুই ঈপ্সিত একটা মানুষের তা-সমস্তই চাহিবামাত্র প্রাপ্য এবং তারা তা পেতে পারে একটামাত্র বোতাম ক্লিক করে বেতারে একটা আজদহা ব্যবস্থার।

ফলে একটা টাইমে এসে দেখা যাচ্ছে মানবসমাজে এতাবধি আচরিত অভ্যাস, অনুশীলন ও সংস্কৃতি বিচূর্ণ হয়ে ভেস্তে যেতেছে দিকে দিকে এবং জেগে উঠছে নয়া কালচারের দিশা। খানিক অল্প খানিক বেশি ঘটনাটা প্রায় বেবাক দুনিয়াব্যাপী নিত্য ঘটমান। ছোট্ট একটা এক্সাম্পল যদি দিতে চাই, যেমন ধরা যাক বয়সানুসারে শ্রেণিবিভাজনের ব্যাপারটা আর আগের মতো সম্ভব হচ্ছে না। আজকের মিলেনিয়ালদের কাছে ‘জোয়ান’ ও ‘বুড়া’, ‘তারুণ্য’ অথবা ‘বার্ধক্য’ প্রথানুর্তী সীমানা বাড়িয়ে ঢের বিস্তৃত। ধরা যাক প্রাক-ডিজিট্যাল যুগের স্মৃতিধর বা জোরালো মেমোরির অধিকারী যারা, তাদের সখ্য অনেক বেশি দেখা যায় এক্স-জেনারেশনের সঙ্গে; এরা প্রায়শ মোনোকালচারের লাগিয়া লালায়িত লক্ষ করা যায়; এদিকে নাইন্টিসের জাতকেরা ওয়াই-জেনারেশনের সঙ্গে নিজেদেরে বেশি রিলেইট করে উঠতে পারে, যে-জেনারেশন তুলনামূলক দ্রুততর গতির সওয়ার, যাদের কালচার সবসময় যেন বয়ন-পুনর্বয়ন-নবায়নের ভিতর দিয়া ধাবিত, লাইফস্টাইল এবং প্রেফ্রেন্সেসের দিক থেকে এরা হাওয়াবাহিত দক্ষ অথচ সতর্কতাছাড়া সাঁতারু।

মোদ্দা পার্থক্যটা তাহলে কোথায়, মিলেনিয়ালদের সঙ্গে তাদের পূর্বজদের? অনেক বা একাধিক পার্থক্য তো নির্দেশ করা যায়ই, কিন্তু কথা খাটো করার স্বার্থে একটা পার্থক্য বর্তমানে দেখে নিয়ে বিদেয় হই। আর সেইটা হচ্ছে যে, এই তিতপুরানা আমাদের সাধের দুনিয়াটা আমরা চাই কি না চাই মিনিটে মিনিটে এন্তার চেইঞ্জের ভিতর দিয়া যাচ্ছে; এবং মিলেনিয়ালরা এই নিত্য-পরিবর্তমান দুনিয়ার সঙ্গে যেভাবে যে-কায়দায় রেস্পোন্ড করছে সেইখানেই মিলেনিয়াল আর তাদিগের পূর্বজদের মধ্যে প্রধান ও পয়লা ফারাক। অনেক এক্সপেরিয়েন্স অর্জন করা থেকে এই মিলেনিয়ালপূর্ব প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে, এহেন অভিযোগ বা অনুযোগাত্মক অভিযোগ পূর্বজদের ব্যাপারে করে থাকে। করতেই পারে। এই দুইয়ের ভিতরে সাযুজ্য অল্পই প্রুফ করা যাবে, নেই বললেও হয়। ভিন্নতা তাদের মধ্যে ব্যাপক ও অলঙ্ঘনীয় বলেই মনে হয়। রিসেশন-উত্তর যে বিলাস-অভিলাষের ভাটাপড়া যাপন ও জীবন, মিলেনিয়াল ও মিলেনিয়ালপূর্ব উভয় জেনারেশনের মধ্যে এই ক্ষিদেতেষ্টা আলাদা। ডায়মন্ড এবং মর্টগেজ ইত্যাদি নিয়া তাদিগের চিন্তাচেতনাগত অবস্থান এক না। গানবাজনার অ্যালবাম খরিদ করাকরি কিংবা প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে একটা ছায়াছবি দেখা ইত্যাদি সূচকগুলো দিয়া তাদের মধ্যকার ব্যবধানগুলা আরও স্পষ্ট করা যায়।

দুনিয়াদারি নিয়া গাছাড়া একটা ভাব আছে দেখা যায় মিলেনিয়ালদের মধ্যে। এর একটা কিমৎ চুকাইতে হবে আজ হোক বা কাল হোক আমাদের কর্তামানসিকতার পক্ষটাকে, আমাদের রাজনীতি এবং সংস্কৃতি সহ সমুদয় সিস্টেমটাকে। এর অন্য একটা দিক আছে, এই মিলেনিয়ালরা তাদের নয়া রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেখাতেও শুরু করেছে এরই মধ্যে। বেহাত হয়েছে বেশ অনেক ক্ষেত্রে সেইসব প্রজ্ঞাপ্রসূত পদক্ষেপগুলো, তবে সেসবের পেছনে অন্যান্য অনেক ডিন্যামিক্স ক্রিয়াশীল; দুনিয়ার সর্বত্র, প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম সহ তথাকথিত সমস্ত কম্পার্টমেন্টালাইজড চৈতন্যসঞ্জাত পরিসরে, মিলেনিয়ালের অপর/অপার বাস্তবের কিছু স্ফুলিঙ্গ অলরেডি হিউম্যান সিভিলাইজেশন এক্সপেরিয়েন্স করেছে গত দেড়/দুই দশকে। অ্যামেরিকা-অ্যারাব-ননঅ্যারাব-অ্যাফ্রিকা-অ্যাইশিয়া-ল্যাতিনিয়া সর্বত্র। দুনিয়ায় কালা আদমি প্রেসিডেন্ট হয়েছে অ্যামেরিকায়, মিলেনিয়ালের ভোট অত অবদান তখনও রাখে নাই যদিও। তবে এরপরে অ্যামেরিকায় ট্রাম্প বা ইন্ডিয়ায় মোদি ইত্যাদি এলিমেন্টস্ যখন উত্থিত হয়েছে ততদিনে মিলেনিয়ালরা ভোটাধিকার প্রয়োগের মওকা হাতে পেয়ে গেছে। অ্যাপ্লাই করেছে কতটা, বা যা করেছে তাতে তার কোন মনোবাঞ্ছা জানা যাচ্ছে এইসব নিয়া আলাদা ভাববার সময় এসেছে।

অ্যামেরিকায়-ইয়োরোপে এই মিলেনিয়ালদের স্ট্যাটাস এবং তাদের যাপনগতিবিধি সম্পর্কে চাইলেই কিছুটা আয়াস ও সময় ইনভেস্ট করে বেশ আপডেটেড হওয়া যায়; কিন্তু, আমাদের দেশগেরামের মিলেনিয়ালদেরে নিয়া চাইলেই কি ক্লিক-অ্যান্ড-টেইক রেজাল্ট পাওয়া যায়? এই জিজ্ঞাসার অভিঘাতে একটু খুঁজতে বেরোই, কিছু ফলফ্রুট ব্যাগে ঝুলাইয়া তারপরেই ফিরব।

প্রতিবেদন : সুবিনয় ইসলাম

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you