কবি ইন রেট্রোস্পেক্ট

কবি ইন রেট্রোস্পেক্ট

তা বলা যেতে পারে একটা বেশ ঘটনাই ঘটেছে সেদিন। ঘটনাটা ঘটার আগে, ঘটনাটা ঘটতেসিল যখন এবং ঘটনাটা ঘটে যাবার পরেও খুব মজা/আমোদ পাচ্ছিলাম, আমোদ আপন মনে। এইবেলা আস্ত ঘটনাটুকু খুলে ফেলা যাক প্রকাশ্য রৌদ্রালোকে।

এক কবির বাড়িতে গেসলাম সেদিন। সন ২০০৬, পড়তি গ্রীষ্ম, অপরাহ্নে। গেসলাম কবিনিবাসে। সেই কবির নামের আগে পরিচয়-তকমা লাগানো হয় এই বলে যে, ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসছি, তিনি ‘গণমানুষের কবি’। কোনো তকমা তর্পণ না-করেও আমি নিজের ভিতরে নিজে-নিজে এইটুকু জানি যে, তার কবিতা — তার আজীবনের লেখাপত্র — প্রায় সমস্তই পড়েছি আমি, বেজায় ভালো না-হলেও মন্দ নন তিনি কবি হিশেবে আমার বিবেচনায়। এই সেদিন পর্যন্ত, বুড়ো-বয়সেও, সমান স্পিডে লিখে গেসেন তিনি, তার যে-কোনো-কোথাও-ছাপা-হওয়া কবিতা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি, পড়তে আগ্রহ পেয়েছি। এটুকুই এনাফ, যথেষ্ট, একজন কবির জন্য সম্মানের। আজকাল এই সম্মানটুকুও ঘন-ঘন দেখানোর সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না অবশ্য। তূর্কিনাচনে নেত্তমত্ত তরুণদের কবিতা পড়েও মনে হয় প্রায়শ পড়ছি অশীতিপরের অসহায় হা-হুতাশ, মাজাব্যথার কাত্রানিমাখা কফ-শ্লেষ্মা। আজকাল এমনই অবস্থা। আসলে এইটা চিরকালেরই পরিস্থিতি।

কিন্তু গেসলাম যার বাড়িতে সেদিন, তার কবিতানিষ্ঠা অনুসরণীয়, অনুস্মরণীয়। বলা বাহুল্য, অনুসরণীয় কবিতার প্রতি তার নিষ্ঠা, তার কাব্যশৈলী নয়; যার যার লিখনভঙ্গিমা তারে-তারেই খুঁজে নিতে হয়, ওই জিনিশ পড়ে রয়েছে যার যার ব্যক্তিগত বাদামপাহাড়ে, কাজ কেবল কুড়িয়ে নেবার; — হেন অভিজ্ঞান উৎপলকুমার না-বললেও বুঝে নিতে বেশি দিরং হতো না। তার ছন্দচেতনা তর্কাতীত। সমস্ত অবশ্য প্রথানুবর্তী রিদমের বাদ্যিবাজনা। আর সবচেয়ে বাজেবিচ্ছিরি কবিতায় তার খামাখার বক্তব্যচারিতা।

আমি মূল্য দেই তার সনেটগুলো, সনেটগুলোর বাঁধুনি-বুনট, চৌকো ও লম্বরৈখিক প্রকরণভঙ্গি। বিরক্তিকর যদিও গণপরিবর্তনের বেহুদা আশাবাদী চিল্লাচিল্লি। বিষয় প্রথাপথের হলেও, প্রকরণ নিয়মানুগ হলেও, এই জেনে-বুঝে নিয়মানুশাসন চর্চাও মূল্য পাবে আজকের আকালের কবিতাবাজারে। যে-সমস্ত কবিসিংহবৃন্দ বেহিসাব ঢোল-শোহরত আর ঢাকের কাঠির সংবর্ধন পান নিতিদিন, খুব চড়া দামদর যে-দু-চারজনের কবিতাসার্কিটে, যে-এক-দুজন ‘প্রধান’/‘সব্যসাচী’ ইত্যাদি সাইনবোর্ডের তলায় বসে জম্পেশ বিক্রি করতেসেন মজমায় আতর কী মলম, তাদের থেকে কোনো অংশেই কম নন আমাদের এলাকার, আক্ষরিক অর্থে আমার বাড়ির পাশের পাড়ার এই কবি। আমি এ-রকমই মনে করি। অথচ কোনোদিনই মনে হয়নি একবারও, যে যাই, কবির পদধুলা/চরণনিধি/মুখামৃত(!) নিয়া আসি! কোনোদিনই মনে হয়নি এই ত্রিকালোত্তীর্ণ বয়সে একবারও। বরঞ্চ গুণীজ্ঞানীদিগেরে এড়ায়া যাই আমি, গিয়াসি এড়ায়া আজীবন আমৃত্যু সবসময়, সচেতন সিদ্ধান্তে। ব্যাখ্যার মনে করতেসি না আদৌ দরকার হয়। সেদিক থেকে ভাবতে গেলে ঘটনাটি ঐতিহাসিক বটে, ঘটে গেসে যা সেদিনের সেই বিকেলে।

গেসলাম আপিশ থেকেই, আপিশেরই কাজ নিয়া, আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ দিতে; অতিথি-বক্তা হিশেবে আপিশের একটা অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ করার সম্মতি নিতে। যেয়ে দেখলাম, বয়স হয়েছে তার। বিস্তর বয়স্ক হলেও তথাচ স্বচ্ছ স্মৃতিপ্রাখর্য। ২০০০ সালের ২৬ মার্চ তারিখের একটি বিশেষ দিনের ঘটনা মনে পড়তেসিল আমার, ইচ্ছে করতেসিল জিগাইতে সেই ব্যাপারে কবির বছর-ছয় পরেকার অবস্থানগত পরিবর্তন বা অনুশোচনা আছে কি না; কারণ ওই দিনটার ঘটনাবলির সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে কুনোব্যাঙস্বভাবী আমারও যোগ রয়েছে খানিকটা। বিশেষ একটা ডেমোন্সট্রেশন্ প্রোগ্র্যামে পার্টিসিপেইট করতে যাবার মাঝপথে একটি বিশেষ গণধিক্কৃত সংগঠনের ষণ্ডাদের দৌড়ানি খেয়েছিলাম আমরা সাতবন্ধু, সত্যি সত্যি সাতজনই, পথিমধ্যে সেই ষণ্ডাদের পথরোধকারী গাজোয়ারি গামাপালোয়ানি স্ট্রিটমিটিঙে ঠিক সেই সময়টায় স্পিচ দিতেসিলেন গণমানুষের শ্রদ্ধেয় কবিব্যক্তিটি। জীবনে এহেন কয়েকটা চাক্ষুষ ঘটনায় আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্যই হয়েছি। কিন্তু ওসব কথা থাক।

বললেন, আন্তরিকভাবেই বললেন, বাইরে বেরোনো এড়ায়া চলেন আজকাল। শরীরে কুলায় না। আমরাও চাপাচাপি করি নাই আর। কিন্তু ততক্ষণে বকতে-বকতে কবিপ্রবর আমার মাথার অ্যান্টেনা ছিঁড়েফেড়ে একসা করে দিয়েছেন। টানা দু-ঘণ্টা শুনে যেতে হলো তার আত্মসঙ্কীর্তন! বাপ রে বাপ! অবশ্য বছর-দুয়েক পরের এক সুরম্য সময়ে আরেক কবিনিবাসে যেতে হয়েছিল দায়ে পড়ে, এক বন্ধুর চাপাচাপিপীড়িত হয়ে, সেবারকার কবিটি ছিলেন শরীরস্বাস্থ্যে দেখতে-শুনতে মধ্যযৌবনের, কিন্ত বকবক-করা আত্মপ্রচারণায় যে-কোনো প্রৌঢ়কেও হার মানাবার হিম্মতওয়ালা তিনি তথা আমার বন্ধুর কাছে দেবতুল্য ওই বিস্ময়কর হাঁদা ব্যবসাজান্তব বকাসুর কবিযশলোভী মিনিয়েচার ফর্মের মালদার ব্যক্তিটি। ইনি অবশ্য রাজধানীনিবাসী। দ্বিতীয় ঘটনাটি সংঘটনের পর থেকে বালবৃদ্ধ নির্বিশেষে যে-কোনো কবিনিবাসের দুয়ার পরিগ্রহ করি নাই, জিন্দেগি-বন্দেগির প্রয়োজনে ঠেকে না গেলে সেই বিপদগ্রহের ফেরে পুনর্বার পড়তেও চাই না।

তা যাক, বকমবকম ব্যামোর শিকার এবং শিকারি উভয়েরই বয়সের কোনোপ্রকার ধরনবাঁধন নাই প্রমাণিত হয়েছে। একটা বিস্ময় যে, ইন্ রেট্রো অফ দ্যাট পার্টিকুলার ইভনিং অফ ২০০৬, শরীর অশক্ত তবু কথা বলতে পারেন কটকট, স্মৃতিশক্তি টলটলা, বই পড়তে পারেন স্বচ্ছ দেখে!

বলতেসিলাম কবি দিলওয়ারের কথা। আলাপের বিস্তারিত মজাসে তুলে রাখা যায় এইখানে, একদিন যাবেও নিশ্চয়, কিন্তু উপস্থিত ইচ্ছে করতেসে না আর।

লেখা / জাহেদ আহমদ

জাহেদ আহমদ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you