দোয়েলের-ফড়িঙের ন্যায় যে-জীবন, সুখের বিষয় এইটে যে, সে-জীবনের সনে দেখাসাক্ষাৎ হয় না মানুষের। দোয়েলের-ফড়িঙের ন্যায় যে-জীবন, কিংবা মানুষের, সেইটা কেমন তা জানি না। দাশবাবু হয়তো-বা জানতেন। তবে এই প্যারায় একটা গ্র্যাম্যাটিক্যাল্ গ্রাউন্ডের গোলমাল রয়েছে। একটি জীবন তো থাকতে হবে আপনার, যদি আপনি অন্য জীবনের খোঁজপতা চান, হোক সে-জীবন শুঁয়োপোকা বা পার্চমেন্ট পেপার কারেন্সি নোটের। হতে পারে একটি জীবন দ্রোণকলসি তৃণের, দইপাতার, বা দাড়িম্ব ফলের। পিঁপড়ারও হয়, কিংবা গালবাদ্যগ্রস্ত গলগণ্ড পণ্ডিতের, জীবন হতে পারে জ্যাকেল্ কি মিস্টার হাইডের। যে-জীবন সিনেমার, গানের …
ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর (François Truffaut) সিনেমায়, ‘দ্য উওম্যান্ নেক্সট ডোর’ (The Woman Next Door), একটা দারুণ সুন্দর মুহূর্ত পাওয়া যায়, একটা তো নয় আসলে, অ্যা সিরিজ্ অফ দুর্ধর্ষ মুহূর্ত ত্রুফোর যে-কোনো ম্যুভিতেই মিলবে র্যান্ডোম্ চয়েসে গেলেও, তবে এই সিনেমার একটি বিশেষ দৃশ্য, সংলাপিকা আসলে, যেন শুশ্রূষার মতো, অথবা দৃশ্যটা আসলেই কিন্তু রোগশয্যার, কথা বলছে নায়িকা আরোগ্যনিকেতনে মানসিক ভারসাম্যবিঘ্নিত সুদূর ফ্যাকাশে স্বরে, সেইখানে কিছু সংলাপ ভীষণ সুন্দর ও সত্যের মতন আততায়ী। সিনেমার নায়িকা যখন নার্ভাস-ব্রেইকডাউনজনিত কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাখাটে মুমূর্ষু দশা, নায়ক ভিজিটিং আওয়ারে দেখতে এসে তারে — আমাদের নায়িকারে — দর্শনার্থী নায়ক তার প্রেমিকারে দেখতে এসে — দেয়াল-ঘেঁষে-রাখা রেডিয়োয় নিউজচ্যানেল্ অন্ করে দেবে কি না জিগ্যেশ করছে। সেই-সময় নায়িকা তারে উত্তরে বলে এই কথাগুলো : বরং গানের কোনো রেডিয়োস্টেশন্ ছেড়ে দিয়া যাও। গান কখনো মিথ্যা বলে না। সবচেয়ে বাজে-বিচ্ছিরি গানটাও বলে চেনা-চেনা মানুষেরই কথা, মানুষের মায়াভরা আকুতি ও মিলন-বিরহের গূঢ় ইচ্ছার কথা, বলে প্রাগৈতিহাসিক ভালোবাসা-বাসনাকামনার কথা। গানগুলো সবসময় এই সত্য কথাটাই চিরায়ত বলে চলে ঘুরায়েফেরায়ে — এই চিরায়ত ওষধি মিথ্যামালাটা — আমি তোমাকে ভালোবাসি … তোমায় ছাড়া আমি বাঁচব না … আমারে ছেড়ে যেও না প্রিয় … ‘খোদার কসম, জান্, আমি ভালোবেসেছি তোমায়’ … এবং ইত্যাদি।
মির্যাক্যল্ এই মিথ্যে, এই জীবনপথ্য, অলীক ভেষজ ও বনস্পতি, এইসব সত্য। সুন্দর এইসব। শুনতে ক্ষ্যাত্ শোনালেও কথাগুলো তো প্রমিত-অপ্রমিত ঝগড়ার ন্যায় কিছু নয়, কিংবা নয় ঈশ্বরানুসারীদের ন্যায় বন্ধুহন্তা। ‘জানি না জুডাস্ কেন ভালোবেসে যিশুকে খোঁজেনি’ … আহা! ‘জানি না এ-পৃথিবীর ঘাতকরা গান শোনে কি না / জানি না লালন শুনে ভাসে কেন বুকের আঙিনা … জানি না বয়স হলে প্রেমে কেন এত পাক ধরে / জানি না হৃদয় কেন রাত জেগে পায়চারি করে … জানি না কাঁদায় কেন সহজ সুরের শয়তানি …’ — জানি না, সত্যি, জানি না। ‘ক্যাক্টাস্, তুমি কেঁদো না / যিশুর মুকুটে কাঁটা …’ — কার ধ্যানস্থ রক্তে চরাচর এমন নতজানু, তথাগত, জানো তুমি? কিংবা বাংলা গানের প্রেমে নাস্তানাবুদ অ্যান্টোনি ফিরিঙ্গির আনন্দ-বেদনা? জানি না, হে দিগ্গজ পণ্ডিত, ওহে ও মদ্যডুবন্ত পদ্যকার সবজান্তা চাঞ্চল্যকর বন্ধু আমার, আমি জানি না, আমি সত্যি জানি না। আবছাভাবে এইটুকু শুধু বুঝতে পারি যে, একদা মানুষ গানের টানে, স্রেফ গান শোনার গরজে, স্রেফ সুরের শরণ নিতে, যেত বনে-জঙ্গলে, যেত সন্ন্যাসব্রতে, যেত প্রব্রজ্যায়-বানপ্রস্থে, যেত গুরু ধরিবারে, যেত সংসার ও লোকালয়ের বাইরে, যেত অগস্ত্য যাত্রায়। সেকালে গানোন্মাদ সুরগ্রস্ত লোকেদের জন্যে এ-ই নিদান ছিল। ভক্তিমার্গ বলি, কিংবা তারে এক্সপ্লোয়েট করে গড়ে-ওঠা নানাবিধ বুজরুকি, এর চারধার বেষ্টন-করা গান ও সুরের কারবার। একালে রেকর্ডিং ইত্যাদির কল্যাণে — শব্দসংরক্ষণ যন্ত্রাদি বিকাশের এই সময়ে — সুর ও গান সর্বত্র বিরাজে; — এবং অসুরও শয়ে-শয়ে, যেমন ভক্তিমার্গের পাশাপাশি বিস্তর ভণ্ডামি বিরাজিত পৌরাণিক-উত্তরপৌরাণিক-পুরাণান্তিক সর্বকালে-সর্বভূখণ্ডে; — একালে জেবের ভেতরে, সুরোন্মাদের করপুটে, যার যার সুরমুর্শিদ, গানের গুরু ও পিরফকির, গানবাজনার ঋষি ও দরবেশ। তবুও যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র, স্বজনের বিরুদ্ধে শানানো ছুরিকার হিংসা আপন স্বজনেরই, পিট্ সিগ্যারের সেই বিপন্ন প্রশ্ন : হোয়েন্ উইল্ দ্যে এভার লার্ন? — উই রিয়্যালি ডোন্ট নো, সত্যিই, আমরা জানি না।
ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর কাজ দেখে একটা ব্যাপার মনে হয়েছে সবসময়, কেবল সংলাপ দিয়েও ম্যুভির ম্যুভিত্ব বজায় রাখা আদৌ অসম্ভব নয়। এই কথাটাকে ব্যাখ্যা করা আমার সাধ্যিতে এ-মুহূর্তে কুলাচ্ছে না। খালি এইটুকু বলতে পারি যে, এর আগে আমি ভাবতাম ম্যুভিতে ডায়লগ সিক্যুয়েন্স অতটা আবশ্যক কিছু না। আজও বড় দাগে এই কথাটা আমি মিথ্যে মনে করি না অবশ্য। ত্রুফোর সিনেমাগুলো দেখে এভার ফার্স্ট মনে হয়েছিল যে এই ডিরেক্টরের অন্যতম উয়েপন্ হলো সংলাপ। ফলে ত্রুফোর সিনেমাকাজগুলো যৌবনকালে দেখার সময় ডিভিডি প্যজ্ দিয়ে একেকটা সংলাপের ইংরেজি নিয়েছি খাতায় টুকে, — সেইসব খাতাও রয়েছে এখনও কোথাও কোনো তোরঙ্গের কোণায় লুকনো, সভ্যতার হেন সংযোগধন্য সময়ে। সেসব সংলাপের বেশকিছু মুখস্থও হয়ে গেছিল। ‘দ্য উওম্যান্ নেক্সট ডোর’ ম্যুভির সমাপ্তি-অঙ্কে যেমন, একেবারে লাস্ট সংলাপ, ম্যাটিল্ডা ক্যারেক্টারে অভিনয়কারী ফ্যানি অদাঁ আশ্লেষে মিলনের শেষে প্রেমিক বার্নার্ডরূপী জেরার্দ দেপার্দিয়্যুকে বলছে প্রায়-ফিসফিস এই কথাটা : নট উয়িথ য়্যু, নর উয়িদাউট য়্যু : তোমার সঙ্গে তো না, তোমারে ছাড়াও না। তারপরেই ট্রিগারের ঘোড়া টানা। মানে? ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না / তার সনে নয় লেনাদেনা’ …। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ম্যুভিগুলো সংলাপের ভিতর দিয়ে এইভাবে দ্ব্যর্থ/অনেকার্থ পরিস্থিতি তৈরি করে নেয় সবসময়।
প্রেমের প্রায় জান্তব অসহায়তার দিকটা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর সিনেমায় যেভাবে পেয়েছি, এইভাবে আর কোথাও না। মানুষ যে শেষমেশ অসহায় এক জন্তু, অসহায় এবং সকরুণ জন্তু, ত্রুফোম্যুভিগুলো চোখের সামনে এই ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করেছে আমার কাছে। প্রেমচরিতার্থ জন্তু কেউ, প্রত্যাখ্যাত কেউ-বা, পরিত্রাণহীন অগ্নিনিমজ্জিত পতঙ্গ। যে-জীবন প্রণয়ের, বিষাদের, অনর্থ অবসাদের, যে-জীবন প্রেমাসক্তির … “এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো / এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর করো” … ত্রুফোম্যুভিগুলো মধুমৃত্যু ক্রন্দনের একেকটি সিল্যুয়্যেট। দেখতে দেখতে ‘মাথার ভিতরে এক বোধ জন্ম লয়’ … কে তারে পারে এড়াতে? যে-জীবন দোয়েলের, ফড়িঙের, — যে-জীবন সিনেমার, গানের …
Film Title: The Woman Next Door ।। Released Year: 1981 ।। Genre: Drama, Romance ।। Duration: 1h 46 min ।। IMDb Score: 7.4/10 ।। Director: François Truffaut ।। Stars: Fanny Ardant, Gérard Depardieu ।। Music Score: Georges Delerue
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS