‘শুক’-দর্শন : আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মদহনের প্রতিধ্বনি || সিরাজুদ দাহার খান

‘শুক’-দর্শন : আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মদহনের প্রতিধ্বনি || সিরাজুদ দাহার খান

[এ প্রতিবিম্বের দুটি অংশ। প্রথমটুকু নাট্যপর্যালোচনা; আর দ্বিতীয় অংশ শুক ও শিখণ্ডীজীবন। দ্বিতীয় অংশটুকু বাড়তি সংযোজন মাত্র, মূল পর্যালোচনার অংশ নয়, শুধুমাত্র কৌতূহলী পাঠকের জন্য নিবেদিত।]


উপসংহার
‘শুক’ ছিল দারুণ এক টানটান কল্পগল্প! মহাভারতের আলোছায়ায় উন্মেলিত এক প্রতিবাদের নাম ‘শুক’ তথা শিখণ্ডী। আমি এবং আমরা মুগ্ধ!

বিশেষ করে শুক-এর নিজেকে মেলে ধরার কলাকৌশল, বাক্যচয়ন, সংলাপ প্রক্ষেপণ, শারীরিক মুদ্রা আর স্পষ্ট জেদি উচ্চারণ ছিল চমকে দেয়ার মতো। তার পরিচয় শোনার পরও বাস্তবে চরিত্ররূপায়নকারীর জেন্ডার কী, মনে হয় যেন এখনও আমি নিশ্চিত নই; এতটাই শক্তিমত্তা ছিল তার চরিত্র রূপায়ন!

মহাভাবতের পূর্বক্ষণের ছোট একটি আখ্যানের আধুনিক ইন্টারপ্রিটেশন আমাদেরকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিয়েছে। রাষ্ট্র, সম্পত্তি, মালিকানা, উত্তরাধিকার, যুদ্ধ, পরিবার — সবকিছুর দুর্দান্ত সাহসী মেলবন্ধন এটি। লেনিন ও এঙ্গেলসের ব্যাখ্যায়িত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের সুস্পষ্ট বয়ান যেন এ প্রযোজনা।

প্রায় প্রতিটি চরিত্রই ছিল সাবলীল; চরিত্ররূপায়নকারীগণ ছিলেন অনবদ্য।

নাট্যআখ্যান
মহাভারতের আলোছায়ায় উন্মেলিত আমাদের অবলুপ্তমান শিক্ষকচেতনায় অভিঘাতসৃষ্টিকারী এক কল্পগল্প, এক প্রতিবাদের নাম ‘শুক’। একখণ্ড উজ্জ্বল আলোকোচ্ছটার নাম ‘শুক’। গ্রুপ থিয়েটার ‘বটতলা’ আয়োজিত আন্তর্জাতিক নাট্য-উৎসবে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের মূলমঞ্চে একবিংশ শতাব্দীর নভেম্বর মাসের ২৩ তারিখ মঞ্চস্থ এ নাট্য-আখ্যানের চরিত্রসমূহ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২০০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন ‘মহাভারত’ থেকে চয়ন করা হয়েছে। যদিও মঞ্চে দর্শকসমষ্টির সামনে যা উপস্থাপিত হতে থাকে, তাতে মহাভারতে বিবৃত ঘটনাবলির হুবহু সামঞ্জস্য নেই। ভারতের জলপাইগুড়ি কলাকুশলী প্রযোজিত এ নাটকের নাট্যকার ও নির্দেশক অবশ্য সে-কথা সপ্রতিভ ঘোষণা দিয়েই মাঠে নেমেছেন। বলেছেন — এটি একটি কল্পকাব্য। এবং নাটকের স্পিরিট বা মূল সুর হৃদয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়, দর্শক হয়ে সামনে বসে-থাকা স্তব্ধবাক জনসমষ্টিকে।

মূল মহাভারতে শিখণ্ডী উভয়লিঙ্গ ধারণকারী; শুক নয়। শুক এক মহাজ্ঞানী এবং পরবর্তীতে ব্রহ্মত্বলাভকারী এক পরিশুদ্ধ মানুষ। কিন্তু এ নাট্যাখ্যানে শুককে দেখানো হয়েছে প্রচ্ছন্ন লিঙ্গের (থার্ড জেন্ডার) ‘শিখণ্ডী’-র প্রতিভূরূপে। শিখণ্ডীর জন্মগল্প ও তাঁর লিঙ্গরূপান্তরপ্রক্রিয়া একাধারে বেদনাদায়ক ও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, যা মহাভারতে বর্ণিত আছে। কিন্তু নাট্যকার ও নির্দেশক নিপুণ কৌশলে তার অন্তর্বেদনা ও প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন ব্যাসদেবপুত্র শুকের প্রশ্নবাণ ও বাগ্মীতায়। তখন দর্শকদের মনে হতে থাকে যেন শুকই শিখণ্ডী। [এ প্রতিফলনের পরিশিষ্টাংশে শুক ও শিখণ্ডীজীবন সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে উৎসুক পাঠকমণ্ডলীর সমীপে।]

নাটকের শুরুতে ব্যাসদেবকে দেখা যায়, তাঁর চার শিষ্য — পৈল, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও সুমন্তকে নিয়ে তিনি জ্ঞানসাধনায় রত। আর তাদের কথোপকথন ও ধারাভাষ্যে দর্শকের চিন্তায় ভেসে ওঠে দীর্ঘদিন ধ্যানমগ্ন সাধনারত ব্যাসদেবপুত্র শুকের অবয়ব । তখনও তাঁকে মঞ্চে দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু দর্শকের চিত্তে তিনি ধরা দেন নেপথ্যে থেকেই। ব্যাসদেব, যিনি পরবর্তীতে নাটকের পরিসমাপ্তিতে মহাভারত  রচনায় ব্যাপৃত হন, তিনিও আকুল হয়ে ওঠেন তার পুত্র শুকের ধ্যানভঙ্গের প্রতীক্ষায়।

এমতাবস্থায়, যখন শিষ্যগণ সহ তিনি প্রায় বিলাপরত, তখন সেখানে আবির্ভূত হন মহাজ্ঞানী বীরযোদ্ধা ভীষ্ম, যাঁকে জ্যেষ্ঠ হিসেবে সম্বোধন করতে দেখা যায়। ভীষ্ম তখন যুদ্ববাজ রাজা দুর্যোধনের প্রধান সেনাপতি। তিনি ব্যাসদেবের সাথে কুশলাদি বিনিময়েরে পরে অকস্মাৎ শুকের মুখোমুখি হন। শুকের আচমকা উপস্থিতি, তাঁর প্রশ্নবাণ ও মর্মবেদনা আছড়ে পরে ভীষ্ম ও দর্শকদের মধ্যে। শুক তাঁর জীবনের অতৃপ্তি, কষ্ট, বেদনা প্রকাশে উচ্চকিত হন। তিনি নিজের পরিচয় জানতে চান। তাঁর জন্মরহস্য জানতে চান। শিখণ্ডীর মতো তাঁর জীবন অসহায় ও অতৃপ্ত মনে হয়। শিখণ্ডী না-নারী, না-পুরুষ, নাকি উভয় লিঙ্গের? তাঁর জীবনের মর্ম কী? মানবজীবনের সার্থকতা কীসে? রাজনীতি-লিঙ্গরাজনীতির জটিল আবর্তে বিহ্বল ও বিভ্রান্ত, আশাহত ও জীবনবিমুখ প্রতিবাদী মহাজ্ঞানী শুক। ভীষ্ম তাঁর এ-ধরনের মনোবিকাশে ও বিভিন্ন প্রশ্নবাণে জর্জরিত ও শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন শুকের একেকটি বেদনাক্লিষ্ট প্রশ্ন ও ভাষ্যে। তাঁর যে-কোনো উত্তরই শুকের প্রতিউত্তর ও জবানিতে পরাস্ত হয়ে যায়। তিনি বিপর্যস্ত, অসহায় ও সর্বোপরি দিশেহারা হয়ে ওঠেন। এমতাবস্থায় হাহাকার ছড়িয়ে দিয়ে একপর্যায়ে শুক নিষ্ক্রান্ত হন দৃশ্য থেকে।

বেদব্যাস মহাবীর ও মহাজ্ঞানী ভীষ্মকে বিপর্যস্ত ও দিশেহারা দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি ভীষ্মকে অবহিত করেন যে, তাঁর নিশ্চয়ই কোনো ভ্রম হচ্ছে! শুক তো দীর্ঘদিন ধ্যানমগ্নাবস্থায়! শুকের সাথে কারো কথোপকথন অসম্ভব! তাহলে কি এসবই ভীষ্মের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মদহন? যে-আত্মদহন দর্শকমননেও তোলে আলোড়ন!

অতঃপর তাঁরা দু-জন যুদ্ধ ও শিক্ষা এবং এতে শিক্ষকের ভূমিকা বিষয়ে আলাপনে লিপ্ত হন। দুর্যোধনের প্রধান সেনাপতি হিসেবে ভীষ্ম তাঁর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে সচেষ্ট হন। ব্যাসদেব সবিনয় জবাব দেন যে, তিনি শিক্ষক। শিক্ষকের প্রধান এবং একমাত্র দায়িত্ব হলো, জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ; মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা। একজন শিক্ষক কখনো যুদ্ধাস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারেন না; পারেন না যুদ্ধে কোনো প্রেরণা যোগাতে। অতএব, তিনি জ্ঞান-ধ্যান-সাধনাতেই তাঁর জীবন ব্যাপৃত রাখতে চান। এ-কথায় মৃদু সায় দিলেও ভীষ্ম প্রস্থানকালে নিজেকে দুর্যোধনের পক্ষে থাকার অটলতা প্রকাশ করেন।

এমতাবস্থায়, দুর্যোধনের দূত সমরাস্ত্র হাতে মঞ্চে প্রবেশ করেন এবং ব্যাসদেবকে যুদ্ধে রসদ সরবরাহের প্রস্তাব দেন। ব্যাসদেব তাতে সম্মত না হলে, দূত অস্ত্র উন্মোচন করে হুঙ্কার দিয়ে তাঁকে অবহিত করেন যে, ‘আপনি যুদ্ধে সহযোগিতা করতে বাধ্য। কারণ, শুধু আপনি না; আপনি যে-স্থানে বসে জ্ঞানচর্চা করছেন, তার প্রতিটি ধূলিকণা রাজা এবং রাষ্ট্রের অধীনস্ত। এ-রাজ্যের প্রত্যেকেই রাজা ও রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ।’ এহেন জটিল ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দুর্যোধনের প্রধান সেনাপতি হিসেবে ভীষ্ম অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়ান এবং রাজদূতকে এই বলে নিরস্ত করেন যে, শুধু ব্যাসদেবের জ্ঞানালয় নয়; দেশের কোনো বিদ্যাপিঠই রাজার অধীনস্ত নয়; তার আজ্ঞাবহ তো নয়ই!

এতদসত্ত্বেও, পরিস্থিত বেসামাল দেখে ব্যাসদেব তাঁর শিষ্যদেরকে বলেছেন, গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে। যেখানে যেখানে অজস্র শুক ঘুমিয়ে আছে তাদের জাগাতে; এটাই হবে তাদের যুদ্ধ।

এবং এরপর ব্যাসদেব নিজস্ব অভিজ্ঞান থেকে মহাভারত  লেখায় মনোনিবেশ করেন।

অভিনয়, নির্দেশনা, আলো, শব্দপ্রক্ষেপণ, মঞ্চ পোশাক পরিকল্পনা
মঞ্চে ব্যাসদেব, ভীষ্ম, শুক তো বটেই প্রায় প্রতিটি চরিত্র নিজ নিজ ভূমিকায় সমুজ্জ্বল ছিলেন। সংলাপ প্রক্ষেপণ, কণ্ঠস্বরের আলোড়ন-লয়-ছন্দ সবদিক ছিল পরিমিত। চরিত্রসমূহ যেন দর্শকদেরকে ঘটনাযুগে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রায় প্রতিটি চরিত্রই ছিলেন সাবলীল; ছিলেন অনবদ্য। ব্যাসদেব চরিত্রে অপূর্ব ছিলেন সত্যিই অপূর্ব; প্রিয়জিৎ রায় ভীষ্মের প্রতিমূর্তিই ছিলেন; আর শুক চরিত্রে অভিজিৎ দর্শকদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে একনিঃশ্বাসে। সৌগত, সৌরভ, গ্রন্থন, অরিজিৎ, নীলাঞ্জন, পৌলমী, লুনা — যার যার চরিত্রে ছিলেন বিশ্বস্ত। নেপথ্যে থেকে অভিনয়কুশলীদেরকে যথাযথ রসদ যুগিয়ে দর্শকহৃদয় জয় করে নিয়েছেন নাট্যকার ও নির্দেশক তমোজিৎ রায় এবং তাঁর সহযোদ্ধাগণ — আশীষ, সৌভিক, শান্তনু, সন্দীপ, সুতপা, বিবেক, অমিত এবং অভিজিৎ।

আলোক ও শব্দপ্রক্ষেপণ ছিল ঘটনাপ্রবাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও দর্শকহৃদয়ে প্রশান্তিদায়ক। গোছানো পরিচ্ছন্ন এ-প্রযোজনার শক্তিমত্তা প্রকাশ পেয়েছে নির্দেশক ও নাট্যকারের সুচিন্তিত বিন্যাস ও পরিকল্পনায়। জটিল একটি আখ্যান সহজসরলভাবে উপস্থাপনায় নির্দেশক মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি পদক্ষেপে। কয়েকটি দৃশ্য তো চোখে লেগে থাকবে দীর্ঘদিন।

নাট্যসূচনার কিছু সময় পরেই অকস্মাৎ শুকের প্রবেশ এবং তাঁর আবিষ্ট করে রাখার মতো শারীরিক ও বাচনিক ভঙ্গি, ভীষ্ম ও শুকের তর্কমালা, আলোছায়ায় অনাম্নি অঙ্গনার সাথে ব্যাসদেবের নিপুণ ও শিল্পিত মিলনদৃশ্য, ভীষ্মের সাথে ব্যাসদেবের বাক্যবিনিময় ও দর্শনালাপ, দুর্যোধনের দূতের সাথে ব্যাসদেবের বাদপ্রতিবাদ, নিজদলের দূতের প্রস্তাবে ভীষ্মের আকস্মিক জ্বলে ওঠা এবং আরও দুয়েকটি অংশ। শুক তথা শিখণ্ডীর নিজেকে মেলে ধরার কলাকৌশল, বাক্যচয়ন, সংলাপ প্রক্ষেপণ, শারীরিক মুদ্রা আর তাঁর স্পষ্ট জেদি উচ্চারণ ছিল চমকে দেয়ার মতো। তাঁর পরিচয় শোনার পরও বাস্তবে চরিত্ররূপায়নকারীর জেন্ডার কী, মনে হয় যেন এখনও আমি নিশ্চিত নই; এতটাই শক্তিমত্তা ছিল তার চরিত্র রূপায়ন!

রূপসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পনা ছিল চরিত্র ও ঘটনাযুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; বিশেষ করে শুকদেবের পোশাকসজ্জা ছিল দর্শকচিত্তকে দোদুল্যমান করে তোলার মতো অনুপম! বলাই বাহুল্য, সেট ডিজাইন ও পুরো নাটকে কলাকুশলীদের ম্যুভমেন্ট ছিল ছিমছাম এবং বক্তব্য প্রকাশনে যথাযথ।

নাটকের মূল উপজীব্য ও বক্তব্য ছিল অত্যন্ত শাণিত, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত উপযোগী। তবে, সাধারণ দর্শকের কাছে আরও স্পষ্ট করার জন্য শুকদেবের আখ্যানটুকু আরেকটু স্পষ্ট করার চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রথম দর্শনেই নাটকটি আমাদেরকে এমনভাবে টেনে রেখেছে যে, এর উল্লেখযোগ্য কোনো বিচ্যুতি আমার চোখে ধরা পড়েনি। কোনো বিশেষজ্ঞজন যদি এটি দেখেন এবং কলম বা কিবোর্ড নিয়ে বসেন তারা তা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আমাকে এর সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করতে গেলে দ্বিতীয়বার এ নাটকের দর্শক হতে হবে।

বিরতিহীন ৭০ মিনিটের এ চুম্বক উপস্থাপনাটি যেন একনিঃশ্বাসে পরিণতি লাভ করেছে।

মূলসুর
‘শুক’ ছিল দারুণ এক টানটান কল্পগল্প! মহাভারত লেখার পূর্বক্ষণের ছোট একটি আখ্যানের আধুনিক ইন্টারপ্রিটেশন আমাদেরকে চমকে দিয়েছে। রাষ্ট্র, সম্পত্তি, মালিকানা, উত্তরাধিকার, যুদ্ধ, পরিবার — সবকিছুর দুর্দান্ত সাহসী মেলবন্ধন এটি। লেনিন ও এঙ্গেলসের ব্যাখ্যায়িত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের সুস্পষ্ট বয়ান যেন এ-প্রযোজনা। এ প্রেক্ষিতে নাটকটির পরিচিতিপত্র থেকে ধার করে নিম্নোক্ত কিছু প্রশ্নের অবতারণা করাই যায়।

যখন আসে মহাযুদ্ধের কাল, সাম্রাজ্যদখলের উদগ্রবাসনায় রাষ্ট্রপরিচালকদের হাতে ওঠে মারণাস্ত্র, শুভবোধ হয় ভূলুণ্ঠিত, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সভ্যতা — তখন শিক্ষককুলের ভূমিকা কী? আর রাষ্ট্র যখন কর্তৃত্ব করতে চায় শিক্ষালয়, তখনই-বা তাঁদের কী করণীয়?

পুরুষ ক্ষমতা দখল ও প্রদর্শন করতে চায়, পদদলিত করতে চায় পুরুষভিন্ন অন্যদের — নারী বা প্রচ্ছন্ন লিঙ্গের (থার্ড জেন্ডার) মানুষেদেরকে। জ্ঞান-মেধা-সুচেতনা নয় — লিঙ্গপরিচয়ই কি হবে ক্ষমতার নির্ধারক?

এসব নির্দয় প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়েছে মঞ্চকুশলী, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রপরিচালক এবং প্রত্যক্ষভাবে দর্শকমণ্ডলীকে। স্পষ্ট উত্তরের ইঙ্গিতও দিয়েছে এ নাট্য-আলেখ্য শাণিত তরবারির মতো।

আমাদেরও শেখার আছে।

জয়তু জলপাইগুড়ি কলাকুশলী!


২য় অংশ / পরিশিষ্ট : শুক শিখণ্ডীজীবন


পাঠকের রসাস্বাদনের সুবিধার্থে এখানে মহাভারতে বর্ণিত শুক ও শিখণ্ডীর একাধারে অস্বাভাবিক, রোমাঞ্চকর ও রহস্যময় জীবনচাঞ্চল্য অতি সংক্ষেপে বিবৃত করা হলো।

শুকজীবন

মহাভারতের ভাষ্যমতে, মহামতি দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব এক মোক্ষপ্রাপ্ত আত্মজ্ঞানী ধর্মাত্মা, যাঁর জন্ম হয়েছিল এক অস্বাভাবিক পন্থায়। মহামতি ভীষ্মের জবানিতে শোনা যায়, পুরাকালে ব্যাসদেব পুত্রকামনায় সুমেরুর শৃঙ্গে মহাদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। একপর্যায়ে মহাদেব তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দিলেন, ‘দ্বৈপায়ন, তুমি অগ্নি জল বায়ু ও আকাশের ন্যায় পবিত্র পুত্র লাভ করবে।’ বর লাভ করে ব্যাস অগ্নি উৎপাদনের জন্য দুইখণ্ড অরণী কাষ্ঠ নিয়ে মন্থন করতে লাগলেন। সেই সময়ে ঘৃতাচি অপ্সরাকে দেখে তিনি কামাবিষ্ট হলেন। তখন ঘৃতাচী শুকপক্ষিণীর রূপ ধারণ করলেন। ফলত, ব্যাসদেবের মনোসংযোগ ক্ষুণ্ণ হলে তাঁর শুক্র অরণীকাষ্ঠের উপর স্খলিত হলো। এবং সেই অরণীতে জন্মগ্রহণ করলেন শুকদেব। শুক্রের মন্থনে উৎপন্ন তাই তাঁর নাম হলো ‘শুক’। জন্মমাত্র সমস্ত বেদ শুকের আয়ত্ব হলো। এরপর তিনি বৃহস্পতির কাছে সকল শাস্ত্র অধ্যয়ন শেষ করে মোক্ষলাভের জন্য সুমেরুশৃঙ্গ থেকে যাত্রা করে নানাদেশ ভ্রমণ করে ভারতবর্ষের আর্যাবর্তে এসে স্থিত হলেন। তারপর নিজ ইন্দ্রিয়কে পরাজিত করে তিনি জনকরাজের কাছ থেকে মোক্ষবিষয়ক উপদেশ নিয়ে আত্মজ্ঞান লাভ করে পিতার কাছে ফিরে এলেন।

তাঁর পিতা তখন সেখানে সুমন্ত্র, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও পৈল — এই চার শিষ্যর সাথে শুককেও পুনরায় বেদাধ্যায়ন করাতে লাগলেন। অধ্যয়ন শেষে অন্য চার শিষ্য বিদায় নিলে ব্যাস শুককে বেদপাঠের আজ্ঞা দিয়ে গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। তখন শুক নারদ মুনির কাছ থেকে যাবতীয় হিতোপদেশ গ্রহণ করবার পর ভাবলেন — স্ত্রীপুত্রাদি পালনে বহু ক্লেশ, বিদ্যার্জনেও বহু শ্রম। তাই তিনি শাশ্বত জীবন লাভের জন্য যোগবলে দেহ ত্যাগ করে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করবেন বলে স্থির করলেন। তারপর তিনি পিতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে উদাসীন, স্নেহশূন্য ও সংশয়মুক্ত হয়ে পিতাকে ত্যাগ করে কৈলাস পর্বতের উপরে চলে গেলেন। সেখান থেকে তিনি যোগবলে আকাশে উঠে সূর্যের অভিমুখে যাত্রা করলেন। এবং বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বে গিয়ে ব্রহ্মত্ব লাভ করলেন।

শিখণ্ডীজীবন

শিখণ্ডীর জন্মগল্প ও রূপান্তরপ্রক্রিয়া একাধারে বেদনাদায়ক ও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, যা মহাভারতে বর্ণিত আছে। অম্বা নাম্নী কাশীরাজের এক কন্যা ছিলেন। ভীষ্মদেব কাশীরাজের কন্যা অম্বাকে হরণ করে এনে তার সাথে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে দিতে সচেষ্ট হন। কিন্তু বিবাহকালে অম্বা জানান যে, পিতার অজ্ঞাতসারে তিনি ও শাল্বরাজ পরস্পরকে বরণ করেছেন। এ-কথা শ্রবণ করে ভীষ্ম তাঁকে মুক্ত করে দিলে অম্বা শাল্বরাজের কাছে গেলে তিনিও তাকে ফিরিয়ে দিলেন এই বলে যে, তুমি ভীষ্মের সুখস্পর্শ করেছো; তাই আমি তোমাকে ভার্যা করতে পারি না। অম্বা তখন তার পিতা, শাল্বরাজ, ভীষ্ম, বিধাতা — সবার উপরে রুষ্ট হলেন। এবং ভীষ্মই যেহেতু তাঁর বর্তমান বিপদের মুখ্য কারণ, তাই তাঁর উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।

এরপর তিনি নগরের বাইরে তপস্বীদের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। সেখানে অম্বা তার মাতামহের আশ্রমে থেকে পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণের সাক্ষাৎ লাভ করেন। এবং তাঁর কৃপায় পরদিন অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরশুরাম আশ্রমে উপস্থিত হলেন। পরশুরামকে অম্বা বললেন, ভীষ্মকে আপনি বধ করুন। তারপর পরশুরাম ও ভীষ্মের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হলো। একপর্যায়ে নারদ ও অন্যান্য দেবগণের আদেশে তারা যুদ্ধে ক্ষান্ত দিলেন। এভাবে পরশুরাম ব্যর্থ হলে অম্বা নিজেই ভীষ্মকে বধ করার জন্য আত্মপ্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।

তারপর তিনি যমুনাতীরে আশ্রমে কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন। তপস্বীরা তাকে নিরস্ত করতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি ভীষ্মের বধের জন্য তপস্যা করছি, স্বর্গলাভের জন্য নয়। তাঁর জন্য আমি পতিলাভে বঞ্চিত হয়েছি, আমি যেন স্ত্রীও নই, পুরুষও নই। আমার স্ত্রীত্ব ব্যর্থ হয়েছে, তাই পুরুষত্ব লাভের জন্য দৃঢ় সংকল্প করেছি।’ এ-কথা শ্রবণ করে শূলপাণি মহাদেব তাঁকে বর দিলেন, ‘তুমি অন্য দেহে পুরুষত্ব লাভ করে ভীষ্মকে বধ করবে। তুমি দ্রুপদের কন্যা হয়ে জন্মলাভ করবে এবং কিছুকাল পর পুরুষ হবে।’ মহাদেব এই বলে অন্তর্হিত হলেন এবং অম্বা পুরুষ হয়ে নবজন্মকামনায় স্বেচ্ছায় চিতারোহণে দেহত্যাগ করলেন।

সেইসময় দ্রুপদরাজা সন্তানকামনায় মহাদেবের আরাধনা করছিলেন। মহাদেব তাকে বর দিলেন, ‘তোমার একটি স্ত্রী-পুরুষ সন্তান (থার্ড জেন্ডার) হবে।’ যথাকালে দ্রুপদমহিষী একটি পরম রূপবতী কন্যাসন্তান প্রসব করলেন এবং তার স্ত্রীপরিচয় গোপন করে তাকে পুত্রের ন্যায় লালনপালন করে বড় করে তুললেন। তার নাম দিলেন শিখণ্ডী! এই শিখণ্ডীই অম্বা তথা অম্বাই এই শিখণ্ডী! অম্বা তথা শিখণ্ডীর যৌবনকাল উপস্থিত হলে তাঁকে দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে বিবাহ প্রদান করা হলো। কিন্তু বিবাহের পরে অচিরেই তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েন যে তিনি পুরুষ নন, স্ত্রীলোক। এ প্রতারণার কথা শুনে রাজা হিরণ্যবর্মা ক্রোধে ফেটে পড়লেন এবং রাজা দ্রুপদকে অমাত্যপরিজন সহ বিনাশ করার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।

পিতামাতার এই দুরবস্থা দেখে তথা শিখণ্ডীনী গৃহত্যাগ করলেন এবং বনে স্থুণাকর্ণ নামক এক যক্ষের ভবনে আশ্রয় নিলেন। বহুদিন অনাহারে থেকে শরীর শুষ্ক করলেন। তাঁর এই অবস্থা দেখে এবং সমুদয় ঘটনা শুনে, ওই যক্ষ তাঁকে বর দিলেন। এবং শিখণ্ডীনীর সঙ্গে লিঙ্গবিনিময় করলেন। স্থুণাকর্ণ স্ত্রীরূপ ধারণ করলেন এবং শিখণ্ডীনী পুরুষরূপ পেয়ে পিত্রালয়ে ফেরত গেলেন। এ খবর পেয়ে রাজা হিরণ্যবর্মা তাকে আবার জামাতা হিসেবে বরণ করে নিলেন। দ্রুপদরাজা তাঁকে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা নিতে পাঠালেন। শিখণ্ডী এভাবেই স্ত্রী থেকে পুরুষত্ব পেয়ে রথীশ্রেষ্ঠ হলেন। অর্থাৎ, কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বাই পুরুষরূপে শিখণ্ডী!]


(এ অভাজন একজন প্রাক্তনী। অনুশীলন নাট্য দল, সমকাল নাট্যচক্র, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রাক্তন নাট্যকর্মী। এখন সক্রিয় দর্শকমাত্র। লেখাটি একজন দর্শক হিসেবে অনুভূতি প্রকাশ; কোনো প্রথাগত ক্লাসিক্যাল নাট্যসমালোচনা নয়।)
০২.১২.২০১৯

  • বটতলা রঙ্গমেলা ২০১৯ চলাকালীন ‘শুক’ মঞ্চায়নের স্থিরচিত্রগুলো গ্রহণ করেছেন শিল্পী পি. চন্দ

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you