বাংলায় থ্রিলার || কল্লোল তালুকদার

বাংলায় থ্রিলার || কল্লোল তালুকদার

লকডাউন চলছে, তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাই না। বাসায়ও সচরাচর কেউ আসে না। সপ্তাহখানেক আগে সন্ধ্যায় ডোরবেল বেজে ওঠে। একটু অবাকই হই। এ-সময় আবার কে এল!

বের হয়ে দেখি, দুই যুবা দাঁড়িয়ে আছে। একটু কাছে যেতেই তাদের একজনকে চেনা চেনা লাগল। হ্যাঁ, মাথাভরতি চুল নিয়ে যে স্মার্ট ছেলেটি দাঁড়িয়ে, তাকে চিনলাম। কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না। এটি আমার পুরনো সমস্যা, মাঝেমধ্যে অতি পরিচিতজনের নামও মনে করতে পারি না।

করোনা-পরিস্থিতির কারণে গ্রিলের ভিতরে থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ধীরে ধীরে সব স্পষ্ট হতে লাগল। মনে পড়ল যুবকের নাম। ইফতি। ফাইয়াজ ইফতি।

প্রায় একযুগ আগের কথা। তখন আমি জুবিলী হাইস্কুলের মাস্টার। লক্ষ করলাম মিষ্টি মিষ্টি ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার, অথচ চোখেমুখে ভীষণ দুষ্টুমি-মাখা ছোট্ট দুটি ছেলে সবসময় পাশাপাশি বসে। স্যারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবও চলে। তাদের সঙ্গে আলাপ জমালাম। ধীরে ধীরে তাদের অনেক কথা জানি। তারা দু-জন চাচাতো ভাই। বাসা শহরের কালিবাড়ি এলাকায়। এক আলোকিত পরিবারের সন্তান। এই দু-জনের একজন ইফতি। অন্যজনের আবার ওই বয়সেই ছিল জীবজন্তুর প্রতি গভীর আকর্ষণ। সে নাকি ইতোমধ্যেই বাসায় সফলভাবে ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করে ফেলেছে! অথচ তখনও তার ক্লাস নাইনে উঠতে বেশ কয়েকবছর বাকি। শুনে তাকে বুঝালাম; মৃদু বকাঝকাও করলাম। বললাম, ডাক্তার হতে গেলে এখনই কাটাকাটি করতে হবে না। অযথা একটি প্রাণীকে হত্যা করা ঠিক না। সে বলল, ‘না, স্যার, ব্যাঙটিকে মারিনি। সেলাই করে ছেড়ে দিয়েছি। লাফিয়ে লাফিয়ে সে চলেও গেছে!’

আরও কত কথা মনে পড়ে! ইফতিকে জিজ্ঞেস করি, তার ব্যাঙ-ব্যবচ্ছেদকারী ভাই এখন কী করছে? সে বলে, ‘স্যার, তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে। এখন সে ডাক্তারি পড়ছে।’

অনেক বড়সড় হয়ে যাওয়ায় প্রথমে ইফতিকে চিনতে পারিনি। এখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একপর্যায়ে আমার বাসায় তার আসার কারণ জানতে পারি। সে একটি বই দিয়ে বলল, ‘স্যার, এটি আমার প্রথম বই। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সময় পেলে পড়ে দেখবেন।’

বইটির গেটআপ বেশ সুন্দর। নাম ‘ধ্বংসতত্ত্ব অথবা ইসরাফিলের শিঙা’। একটি কন্সপিরেসি থ্রিলার। ছেপেছে ঢাকার ভূমিপ্রকাশ

মৃত্যুসংবাদ শুনতে শুনতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। তাই কয়েকদিন ধরে পড়াশোনা, টিভিদেখা, অনলাইনে ঘুরাঘুরি কিছুই ভালো লাগছে না। এ যেন এক অদ্ভুত অলস সময় — থমকে আছে!

ইফতির বইটিও যথারীতি পড়ার টেবিলের এক কোণে পড়ে রইল। তাছাড়া থ্রিলারের পাঠক ছিলাম সেই স্কুলজীবনে। এখন কী আর এসব পড়তে পারব? যদিও বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা আছে — ‘শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্কদের জন্য’। তবু ভরসা পাই না। বইটি টেবিলে পড়েই থাকে।

আমরা যখন স্কুলছাত্র, তখন ছিল সেবা প্রকাশনীর যুগ। দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী ধ্রুব এষদাদা তখন ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁর সুবাদে সেবার প্রায় সব বই প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এই প্রান্তিক মফস্বলে থেকেও আমরা পেয়ে যেতাম। বই এসে পৌঁছানোর পর শুরু হতো ভীষণ প্রতিযোগিতা। কে আগে পড়বে। পাড়ায় তখন পাঠকের সংখ্যাও নিতান্ত কম ছিল না। সিনিয়ররা পড়ার পর আমরা সুযোগ পেতাম। একেকটি বই যেন আমরা গোগ্রাসে গিলতাম। ধাপে ধাপে কিশোর থ্রিলার, ওয়েস্টার্ন, গোয়েন্দা অম্নিবাস, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, মাসুদ রানা — তখন আমরা পড়েছি। তারপর একসময় অন্য বিষয় এসে যথারীতি এসব বইয়ের জায়গা দখল করে নেয়। এত বছর পর এখন কী আর থ্রিলার পড়তে ভালো লাগবে?

কিন্তু দু-দিন আগে বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে নিজের অজান্তেই পড়তে শুরু করি। এবং একপর্যায়ে আবিষ্কার করি, বইটি আর হাত থেকে রাখতে পারছি না! কী-এক অজানা সম্মোহনী শক্তি যেন আমাকে জড়িয়ে ধরেছে!

কী ঝরঝরে গদ্য! গোছানো ও বলিষ্ঠ লেখা! পড়তে পড়তে বিস্মিত হয়েছি — এই লেখা কী সত্যি আমাদের সেদিনের সেই ছোট্ট ইফতির! এত পরিণত! প্রমিত বানানবিধিও বইটিতে যথাযথভাবে অনুসৃত হয়েছে।

বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল দিয়ে যে চিত্রকল্প লেখক সৃষ্টি করেছে, তা সত্যি অনন্য। পড়তে পড়তে বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখা যেন বারবার ঘুচে যায়! বিশাল এক ক্যানভাসে চিত্রকল্পের বিস্তৃতি ঘটিয়ে দারুণ এক মুন্সিয়ানায় তাদের আবার একবিন্দুতে সে একীভূত করেছে। এ যেন এক সুদক্ষ শব্দজাদুকরের কাজ!

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইফতি যদি পড়াশোনার আলোকিত রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে এবং লেখালেখি অব্যাহত রাখে, তবে আমরা পাবো এক বরেণ্য কথাসাহিত্যিক।

বাংলাসাহিত্যের জগতে যেন এক শক্তিশালী লেখকের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।


গানপারে কল্লোল তালুকদার রচনারাশি

কল্লোল তালুকদার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you