মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার : একটি ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস || স্যারা ডোসান

মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার : একটি ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস || স্যারা ডোসান

আমি তখন এক্সপ্রেসিভ আর্টস্ কোর্সের ক্লাসগুলো করছিলাম। পড়ার টপিক ছিল স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন, সোজা বাংলায় ড্রিমস্ অ্যান্ড নাইটমেয়ার্স। কোর্স-ফ্যাসিলিটেটর হাতে তুলে দিলেন ‘থ্রিলার’ ভিডিয়োটা, ব্যবচ্ছেদ ও ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করতে হবে এই ভিডিয়োটা দেখে নিয়ে। এবং শুরু হয় দেখা, তারপরে লেখা। মাইকেল জ্যাকসনের ‘থ্রিলার’ নিয়া আমি ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিসের কাজটা করি মূলত কোর্সওয়ার্ক হিশেবে। এইখানে অ্যানালিসিসের সবটা না-হলেও অনেকটা আন্দাজ পাওয়া যাবে আশা করি।

‘থ্রিলার’ বানানো হয় নাইন্টিন-এইটিথ্রিতে, এবং মিউজিকভিডিয়োর সিলসিলায় এইটা আজও ওয়ান অফ দি বেস্ট।  এই ভিডিয়োর অন্তর্গত দুর্ধর্ষ একটা ড্যান্স সিক্যুয়েন্স, প্রচুর নাট্যোপাদান এবং একটা টানটান সুন্দর স্টোরি, সর্বোপরি রয়েছে এর মূল গানটা। আর মাইকেল জ্যাকসন তো রয়েছেনই চিরকালের আশ্চর্য সংগীতনৃত্যপ্রতিভা নিয়ে জ্যান্ত ও উজ্জীবিত।

গোটা মিউজিকভিডিয়োটারে এখন যদি ক্রিটিক্যালি ল্যুক-ব্যাক করতে যাই তাইলে বলতে হবে যে এর ড্যান্স ম্যুভস্, কস্টিউমস্, এর মিউজিক, সেটিঙস্, এর লিরিক্স সমস্তকিছুই ইন-স্যম-ওয়ে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন থিমটারেই রিলেইট করে। একদম শাদামাটাভাবে থ্রিলারের একটি সিনোপ্সিস্, স্টোরিলাইনটা অ্যাট-লিস্ট, যদি এইখানে ড্রাফ্ট করতে পারি তাইলে ব্যেটার হয়।

ভিডিয়ো শুরু হয় একটা গা-ছমছমানো হরর ফিল্মের আদলে। সেই ফিল্মে দেখা যায় মাইকেল এবং এক তরুণী, তারা হাত-ধরাধরি হেঁটে যেতেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়া। তাদের দুইজনের ভিতর খুচরা আলাপের একপর্যায়ে আমরা মাইকেলকে বলতে শুনি সঙ্গিনীর কাছে বলছে যে সে, মানে মাইকেল, একটু অন্যরকম, ডিফ্রেন্ট। কেমন সেইটা? আর-দশটা মানুষের মতো না আর-কি। কিন্তু মেয়েটা তাতে তেমন-একটা গা করে না। তারপরে একসময় রাত গাঢ় হয়, মেঘের আড়াল থেকে বেরোয় চাঁদ, জ্যোৎস্না ফাটে জঙ্গলে, ছেলেটা মানে আমাদের মাইকেল আচমকা রূপান্তরিত হতে থাকে নেকড়েতে। নেকড়েরই মুখ, মাথা, দাঁত ও অঙ্গসংস্থান।

শুরু হয় ধাওয়া করার দৃশ্য। তরুণ মেয়েটাকে নেকড়ে ছেলেটা তাড়া করতে থাকে। মেয়েটা তাড়া খেয়ে ছুটতে থাকে রাত্রির ঘনঘোর গাছবিরিখের জঙ্গল চিরে। চেইজিং সিনটা প্রলম্বিত হয় এবং নেকড়ে ছেলেটা ফাইন্যালি পাকড়াও করে ফ্যালে মেয়েটাকে। টেনশন উৎপন্ন হয় এবং এই দৃশ্যে অডিয়েন্স ভীষণ স্কেয়ার্ড ও নার্ভাস বোধ করতে থাকে।

এই পর্যায়ে এসে দর্শকের আসনে বসা আমরা বুঝতে পারি সিনেম্যাটিক ধাঁধাটা। আমাদেরই মতো মাইকেল এবং তার তরুণী বন্ধুটিও ছবিঘরের চেয়ারে হেলান দিয়ে দেখছে সেই হরর ফিল্ম। সিনেমার বাইরে প্রেক্ষাগৃহে বসে যেমন এতক্ষণ সিনেমা দেখছিলাম আমরা, তারাও তেমনি সিনেমার ভিতরে প্রেক্ষাগৃহে বসে দেখছে সেই সিনেমা।

তাইলে, এরপরে, এইখানেই তো কাহিনি শেষ হবার কথা। ক্যাথার্সিস ঘটবার কথা। না, তা হয় না। ছায়াছবি বরং শুরু হয় এইখান থেকেই। দৃশ্যস্থ সংলাপে দেখি যে মাইকেল এবং মেয়েটা ছায়াছবিগৃহ থেকে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং এইখানেই থ্রিলার গানের শুরু হয়। তারা হাত-ধরাধরি সিনেহ্যল্ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে এবং একটা গ্রেইভিয়ার্ডের ভিতর দিয়া হাঁটতে থাকে। এমন সময় একটা ভোয়েসোভার শুনতে পাই আমরা, জনান্তিকে একটা আওয়াজ, আর হররসিনেমা-দেখে-ফেরা দুই ক্যারেক্টারের চাদ্দিকে গ্রেইভ থেকে মুর্দারা জোম্বি হয়ে বেরোতে থাকে মাটি ফুঁড়ে।

এতক্ষণ ভিডিয়ো জুড়ে স্কেয়ারি আর স্যুরিয়্যাল একটা সাংগীতিক আবহ বিরাজ করছিল, জোম্বিদৃশ্য থেকে একটা তীব্র তাল-লয়-ছন্দায়িত এবং শক্তিবিচ্ছুরিত সংগীতের সূত্রপাত ঘটতে দেখি। মিউজিকে একটা ড্রামাটিক পরিবর্তন দেখতে পাই আমরা, পাই আওয়াজের মাধ্যমে একটা মোড় ফেরার ব্যাপার দেখতে, যেখানে হরর সংগীতোপাদান ক্রমশ সরে যেয়ে এনার্জেটিক এবং বিটি মিউজিক জায়গা করে নেয়। মিউজিকে এই চেইঞ্জটা আনা হয় সম্ভবত দর্শকদের মনে এমন একটা রিলিফের বোধ সঞ্চার করতে যে স্কেয়ারি নাইটমেয়ার থেকে তারা হ্যাপি রিয়্যালিটিতে ফিরে এসেছে।

স্পেশ্যাল ইফেক্টস্ এই ভিডিয়ো কন্টেন্টে ব্যাপক পোজিটিভ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষভাবেই নাইটমেয়ারটাকে আরও টেরিফায়িং করে তোলার ক্ষেত্রে স্পেশ্যাল ইফেক্টস্ অনেক বেশি হেল্প করেছে। মাইকেল যখন নেকড়ের সুরতে টার্ন করছে, এই দৃশ্যটা অনেক বেশি রিয়্যাল এবং স্কেয়ারি মনে হয় স্পেশ্যাল ইফেক্টসের বদৌলতে। এই ভিডিয়োয় স্পেশ্যাল ইফেক্টসের আরেকটা নান্দনিক ও বড় চাতুর্য এইখানেই যে অডিয়েন্স থেকে কেউ ঠাহর করতে পারে না তারা যা দেখছে তা বাস্তব, নাকি ড্রিম, না নাইটমেয়ার। এই বিভ্রম তৈয়ার করতে পেরেছে এবং বজায় থেকেছে আগাগোড়া গোটা ভিডিয়োটায় স্পেশ্যাল ইফেক্টসের দৌলতে।

ফেব্যুলাস একটা টেক্নিক বলতে হবে এইটাকে যে ড্রিম আর নাইটমেয়ারের দোলাচলে রেখে সেন্স অফ কনফিউশনের ব্যঞ্জনা চারিয়ে দেয়া অডিয়েন্সের ভিতরে। আপনি যখন দৃশ্যকোলাজগুলা দেখছেন তখন বারবার হোঁচট খাচ্ছেন বুঝে উঠতে এইটা বাস্তব না কল্পনা। মানুষ মাইকেল বাস্তব, না নেকড়ে মাইকেল? অনুরূপে নেকড়ে মাইকেল নাইটমেয়ার, না মানুষ মাইকেল? এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় ফ্লিকিং করবার এই ইউনিক টেক্নিকটাই ক্রিয়েট করেছে সেই ইল্যুশন, অডিয়েন্সের কাছে যে-কারণে ড্রিম আর নাইটমেয়ার বা বাস্তব ও অবাস্তব স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন-কল্পনা-অবকল্পনা গুলিয়ে ওঠে, একাকার হয়ে যায়।

দৃশ্যনির্মিতিগুলাই তো নয় খালি, লিরিকের কথাটাও উল্লেখ করতে হয় আলাদাভাবে। যেই-পঙক্তিমালা ছায়াগতিচিত্রে ব্যবহৃত হতে দেখি আমরা, তা ইক্যুয়্যালি ইম্পোর্ট্যান্ট যেমন ইম্পোর্ট্যান্ট ভৌতিক গা-ছমছমানো গল্পটা। গানের গীতিকথাগুলোও হরর ইম্প্রেশনই ইমপ্রিন্ট করে যায় গানশ্রোতার মনে। ইট’স্ ক্লোজ্ টু মিডনাইট অ্যান্ড স্যমথিং ইভল্ ইজ্ লার্কিং ইন দ্য ডার্ক। এই লাইনটা আমরা থ্রিলারের লিরিক থেকেই নিয়েছি। মেয়েটাকেই উদ্দেশ্য করে মাইকেল গানটা গাইছেন, কিন্তু মোটেও শাদামাটা ফ্ল্যাট সম্বোধনে নয়, একজন কথকের স্টোরিটেলিং টেক্নিক গোটা গানটায় লিস্নারদেরে অ্যাট্র্যাক্ট করে। এর সঙ্গে অ্যাডেড অ্যাট্র্যাকশন হিশেবে মাইকেলের ড্যান্সম্যুভস্ অপরিসীম অবদান রেখেছে দৃশ্যবস্তুটাকে স্কেয়ারি করে তোলার ক্ষেত্রে। ড্যান্সম্যুভগুলো এমন যে দেখে মনে হয় মাইকেল যেন পঙক্তিমালার সঙ্গে করেস্পোন্ড করছেন তার নৃত্যমুদ্রা দিয়া।

আরোপিত মনে হয় না কিছুই, ভিডিয়োর একটা দৃশ্যও মনে হয় না ফেলনা। কাহিনির যেই অংশগুলোতে রিয়্যালিটির ভায়োলেশন ঘটানো হচ্ছে, সেই অংশগুলো কোথাও মনে হয় না আচমকা উড়ে এসে জুড়ে বসল। বরং খুবই ইজি মনে হয়। ড্রিম, নাইটমেয়ার এবং রিয়্যালিটি কিছুই জোরপূর্বক গাইঞ্জা না। ধরা যাক জোম্বি দৃশ্যকলাপগুলোর দৃষ্টান্ত। খুবই ইল্যুসিভ একটা বাস্তবের প্রতিভাস মনে হয় দৃশ্যকল্পগুলো। ম্যুভমেন্টগুলো খুবই ইম্পোর্ট্যান্ট রোল প্লে করেছে জোম্বিদৃশ্য ফোটানোর বেলায়। ক্যারেক্টারগুলোর নড়াচড়া, নাচসদৃশ অঙ্গসঞ্চালনা থেকেই তাদেরে জোম্বি হিশেবে আমরা আবিষ্কার করে উঠি। কিছু কিছু পয়েন্টে ক্যারেক্টারগুলোর ম্যুভস্ রোবোটিক এবং ফলে জোম্বি হিশেবে এরা আরও বিশ্বাসযোগ্য হতে পেরেছে। এদের ম্যুভগুলো জটিল, অক্রবক্র, বঙ্কিম এবং তা সত্ত্বেও নড়াচড়া শার্প অ্যান্ড ট্র্যান্সপ্যারেন্ট।  শরীরের কিছু কিছু অংশ তারা আইসোলেইট করে রেখেছিল বলেই হয়তো জোম্বি হিশেবে ব্যাপক গ্রাহ্য হয়েছে। ড্যান্সের সিক্যুয়েন্সগুলায় স্পিনের ব্যবহার লক্ষণীয়। লাফানোগুলো লক্ষণীয়। তাদের জুতার মুচড়ানো আর মেঝেয় পায়ের আঁচড়ানো সবকিছুই ইউনিক একটা সাউন্ডইফেক্টস্ প্রোডিউস করছিল। গোটা ড্যান্সকম্পোজিশনটাই একটা আলাদা সাউন্ডইফেক্টস্ প্রোডিউস করে যায় আদ্যোপান্ত। খুবই ইফেক্টিভ সাউন্ডইফেক্টস্।

ড্রিমস্ এবং নাইটমেয়ার্স দৃশ্যকল্প রচনায় বিস্তর পরিমাণে হরর পজিশন্স প্রযুক্ত হয়েছে ড্যান্সম্যুভমেন্টগুলোতে। এর ফলে একটা কার্যকর ইফেক্ট অ্যাড হয়েছে ড্রিমস্ অ্যান্ড নাইটমেয়ার্স সিনগুলায়। এই নৃত্যপজিশনগুলার মধ্যে সেরা একটা পজিশনের উল্লেখ করতে গেলে বলব সেই পজিশনটার কথা যেইখানে তারা হাতের থাবা বাগিয়ে হেঁটে আসে। এইটাও হরর ইফেক্ট অ্যাড করে ভিডিয়োটায়। এই সমুদয় ইফেক্টস্ ভিডিয়োটায় ড্রিমস্ এবং নাইটমেয়ার্সের সেটিং ও সারাউন্ডিং ক্রিয়েইটকরণে ব্যাপক অবদান রাখে। এবং আমার মনে হয়েছে যে ড্রিমস্ এবং নাইটমেয়ার্সের সঙ্গে যেই সিনগুলো যুক্ত, সমস্তই রিয়্যালিটির যুক্তিশৃঙ্খলপরম্পরা ভাঙার মাধ্যমে করা। তাইলে কেমন করে আপনি নিশ্চিত হবেন যে এই দৃশ্য বাস্তব এবং ওই দৃশ্য বাস্তব না? কারণ, গোড়ায় বাস্তবটাকেই তো ভাঙা বা ব্যাহত করা হচ্ছে। একদম অবাস্তবভিত্তিক ভুঁইফোঁড় তো না কোনো কল্পনাই। ভিডিয়োটা, আমি বিশ্বাস করি, বাস্তবেরই ড্রিম অথবা নাইটমেয়ারের একটা বিশেষ ও বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপন।

[এই নিবন্ধটা গ্যুগলের ওপেন সোর্স থেকে নেয়া। স্যারা ডোসানের কোর্সক্লাসওয়ার্কের অ্যাসাইনমেন্ট এইটা। আংরেজিতে লেখাটা ‘Critical Analysis of Thriller of Michael Jackson by Sarah Dawson’ লিখে সার্চ দিলে অ্যাভেইল করা যাবে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে মূল ডক্যুমেন্টটা আরও বড়, অনেক বিস্তারিত, অনেক বেশি ক্রিটিক্যালি ভিডিয়োটার বিভিন্ন দৃশ্যানুদৃশ্য সব্যাখ্যা আলোচনা করা আছে। এর বাংলা করবার সময় লাইন-বাই-লাইন অনুবাদে না যেয়ে অ্যাডাপ্টেশনের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কেউ মূল ডক্যুমেন্ট দেখতে চাইলে গ্যুগ্লিং করার মাধ্যমে সেই সুযোগও রইল। তর্জমা  : জাহেদ আহমদ]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you